#হৃদয়ের_ওপারে_তুমি
#গল্প_ভাবনায়_ফারজানা_ইয়াসমিন_রিমি (আপু)
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৪
-আরে ভাই কি করলি এটা!
-শোন একেতে রাস্তায় জ্যামে পড়েছিলাম তার উপর মাঝ রাস্তায় হঠাৎ করে গাড়ি খারাপ হয়ে গেলো। গাড়ি ছেড়ে রিকশা নিয়ে এসেছি এতোটা পথ।সারাটা রাস্তায় গাড়ির হর্নের আওয়াজে মাথা ধরে গেছে তার উপর এরকম গরম তো আছেই আর এখন তুই কাজের কথা ছেড়ে ফাও কথা চালাচ্ছিস। তোকে থামানোর জন্য এর থেকে ভালো টোটকা আমার কাছে ছিলো না।
-কাজটা ঠিক করলা না ভাই।
অভ্র নজর ফিরিয়ে বোতলের বাকি পানি টুকু খেয়ে খালি বোতল আবিরের হাতে দিয়ে শার্টের উপর থেকে দুটো বোতাম খোলে মীরার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপা একটু আমার দিকেও বাতাস করেন না। দেখতেছেন না বরফের মতো গলে পড়তেছি।
মীরার হাতে একটা জাপানিজ হাত পাখা ছিলো অভ্রর কথা শুনে ওর দিকে বাতাস করা ধরলো।অভ্র চোখ বন্ধ করে বাতাসে গায়ের ঘাম শুকাচ্ছে।
আর কাব্য টিস্যু, রুমাল দিয়ে মাথার পানি মুছে, কাঁধেও কিছুটা পানি পড়েছিলো সেটুকুও মুছলো।বাকিরা এই দৃশ্য দেখে মজা নিচ্ছিলো কিছুক্ষণের জন্য।এমন সময় বৃষ্টি বলে উঠলো,
-গায়েজ কি প্ল্যানিং করবি কর।দেরি করাস না। এভাবে গরমে থাকা যাচ্ছে না। রেস্টুরেন্টে বসলেও পারতাম আমরা।
অয়ন উত্তরে বললো,
-আরে আজ যেখানেই যাও না কেনো গরম লাগবেই।গরুর মাংস খেলে ব্ল্যাড প্রেশার সবার হাই হয়ে যায়, তাই এতো অস্থির গরম লাগে।আর প্রকৃতির নিচে বসে আড্ডা টাই জমে ওসব রেস্টুরেন্য ফেসটুরেন আমাদের আড্ডায় জমে না। রেস্টুরেন্টে একটু জোরে হেসে দিলেই পাশের টেবিল থেকে মানুষজন তাকিয়ে থাকে হা করে।আবার কিছু রেস্টুরেন্টে সুন্দর করে লিখা থাকে,” keep silent plzz” আরো কত রকম সমস্যা!
অয়নের সাথে অভ্রও সহমত হলো।
-এটা কিন্তু ঠিক বলেছিস ভাই।শুনো আপুমনি আমাদের মতো ফ্রেন্ড সার্কেলের রেস্টুরেন্টে জায়গা নেই। রেস্টুরেন্ট হলো প্রেমিক -প্রেমিকা,ম্যারিড কাপল, ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুকুল পরিবেশ।আর আমাদের জন্য হলো এই রকম খোলা মেলা জায়গা।এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখো কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে নেই।চাইলে তুমি এখানে পড়াশুনা করতে পারো,খেতে পারো,ঘাসের উপর ঘুমাতে পারো, নাচতে পারো, গান গায়তে পারো সব করতে পারো,অই লেকে গিয়ে ডুব পারতেও পারো মনে আনন্দে,কেউ কিচ্ছু বলবে না।
সমুদ্র অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললো,
-আচ্ছা যাই হোক আমরা এখন কাজের কথায় আসি, কাল কখন বের হচ্ছি আমরা?
অভ্র মাথা উঁচু করে কাব্যর দিকে তাকালো,কাব্য দাঁড়িয়ে ছিলো।
-কাব্য ভাইয়া আপনার মূল্যবান বক্তব্য পেশ করা শুরু করুন। জাতি অধির আগ্রহ নিয়ে বসে আছে,আমরা আপনার মতামত শুনে মূল্যবান মন্তব্য প্রদান করছি।
-বেরুলে কাল সকাল সকাল বের হবো।এই ধর ১০ টা। যেতে তো টাইম লাগবে,রাস্তা ফ্রি থাকলে তিন ঘন্টায় চলে যাবো।আর যদি জ্যামে পড়ি,তাহলে সময় অনিশ্চিত। সকাল সকাল যেতে পারলে ভালো হতো তাহলে পুরো বিকেলটা রেস্ট করা যেতো।
বৃষ্টি আর অয়নী বলে উঠলো,
-এতো সকালে বের হবো?
-বেলা ১০ টা এতো সকাল!?ঠিক আছে তোদের প্রবলেম হলে ১১ টাই রওনা হই।আশিক ভাইয়া তো আমাদের আজ রাতেই রওনা হতে বলছে।এখন কাল যদি একটু সকাল সকাল না পৌঁছাই ভাইয়া মন খারাপ করবে।কালকের পরের দিন ই তো গায়ে হলুদ। সবার একটা প্রস্তুতির ব্যাপার আছে না।
-ঠিক আছে ১০ টাই বের হচ্ছি তাহলে।
-ওকে এজ ইউর উইশ।বাট কোনো প্রবলেম থাকলে আমাদের রাতেই জানাস।
-ঠিক আছে।
আবির কাব্যকে প্রশ্ন করলো,
-আচ্ছা সবাই কি এক গাড়িতেউ যাচ্ছি?
কাব্য উত্তর দিলো,
-এক গাড়িতেই গেলেই ভালো হয় তো।
সমুদ্র প্রশ্ন করলো,
-আচ্ছা এখন এটা বল, গাড়ি কাদের কাদের টা যাচ্ছে?
উত্তরে অভ্র বললো,
-এটা তো সিম্পল। লটারি কর, সবার নাম লিখ কাগজে। যার নাম আসবে তাঁর গাড়ি নেয়া হবে।
-গ্রেট আইডিয়া বস!
একে একে সব প্ল্যান করতে লাগলো ওরা।কখন কিভাবে যাবে।কি কি করবে না করবে সব ধরনের প্ল্যানিং।
প্ল্যানিং শেষে চায়ের কাপের সাথে আড্ডা জমিয়ে দিলো সবাই।
এদিকে বিকেলের দিকে ফুলরা সবাই ঘুরতে বের হতে চাইলেও নিজামের স্ত্রী খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে, সুমাইয়াকে রেখে কেউ বেড়াতে যেতে রাজি হয় না , যার জন্য ওদের বাইরে ঘুরতে যাওয়া ক্যান্সেল হয়ে যায়। সবাই ভাবে ফুল মন খারাপ করবে, কিন্তু ফুল একটুও মন খারাপ করে না।বাড়িতেই সবার সাথে মজা করছে।
সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হতে হতে অনুকে ডাকতে লাগলো অভ্র ,
-অনু হলো তোর !
পাশের রুম থেকে অনু উত্তর দিলো,
-ভাইয়া আর পাঁচ মিনিট ওয়েট করো আসছি।
অভ্র রেডি হয়ে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে ব্যাগে ভরছে আর খাটের মাঝখানে নিয়ানা মন খারাপ করে বসে বসে দেখছে।মুখ ভার করে নিয়ানা প্রশ্ন করলো,
-ছোতো বাবা কবে ফিইবে আবাই?
-আসবো বাবা খুব তাড়াতাড়ি।
-তাও কতো দিইন?
-সেটা তো জানি না মা, তবে হ্যাঁ তোমার সাথে আমি রোজ কথা বলবো, আর আসার সময় তোমার জন্য অনেক কিছু আনবো।
-আমায় জন্য কিত্তু আনতে হবে না বাবা।তুমি ছুধু থেকে দাও।আমাল একা একা ভায়ো লাগে না ।
অভ্র ব্যাগ গোছানো শেষ দিয়ে নিয়ানাকে কোলে তোলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বললো,
-ওলে আমাল মা তা! একা একা কোথায় মা!তুমি কি জানো আজকে বিকেলে পাপা, মাম্মাম, তুমি নানু বাসায় যাবে?
নিয়ানা মাথা দিয়ে না সূচক উত্তর দিলো,
-মাম্মাম তো এখন হসপিটালে যাবে ফিরেই তোমরা নানু বাসায় যাবে। সেখানে তোমার কত্ত কাজিনস!আমরা না আসা অব্ধি তুমি ওখানেই থাকবে আর আমরা যখন ফিরবো তখন তুমিও ফিরবে ওকে?
-ওকে বাত দাদাভাই, দিদুন তো একা থাকবে বাবা।
-নাহ দিদুন তো সারাদিন হসপিটালে থাকবে আর দাদাভাই অফিসে।তাহলে একা কোথায়?
-ওকে বাবা থিক আতে।তুমি তায়াতায়ি এতে পরো।আই মিত ইউ ছোতো বাবা।
বলেই নিয়ানা অভ্রর গালে চুমু খেলো।
-মিস ইউ টু মা।
-ছোতো বাবা আমায় জন্য এত্তা ছোতো মা আনবে?
-তোমার ছোতো মা লাগবে?
-হুম।
-আর কয়েকটা বছর ওয়েট করো মা।তোমার মতো একটা কিউট ছোতো মা নিয়ে আসবো।
-ওকে,লাভ ইউ বাবা!
আবারো অভ্রর গালে চুমু খেলো।
এর মধ্যে অনুও অভ্রর রুমে এসে গেছে।
-ভাইয়া আমি রেডি।
-ঠিক আছে চল তাহলে বের হই।
-ওকে।
-অনু মা কি হসপিটালে চলে গেছে?
-নাহ বের হবে এখন। অনয় ভাইয়া অয়নী আপু ওয়েট করছে।
-হুম চল তাহলে।
নিয়ানাকে কোলে নিয়ে অনুকে নিয়ে অভ্র নিচে নামলো,সার্ভেন্ট গিয়ে ওদের ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে তুলে দিলো।
লটারিতে অভ্রর নাম উঠেছিলো তাই এখন অভ্রদের গাড়িটাই যাবে।রাস্তায় সব বন্ধুদের পিক করতে করতে যাবে। অয়ন অয়নী অভ্রদের বাড়িতে এসেছে কারণ ওদের পিক করতে গেলে উল্টো যেতে হতো অনেকটা পথ।
নিচে নেমেই অভ্র অনু বাবা মায়ের থেকে বিদায় নিলো, নিয়ানাকে নিশাতের কোলে দিয়ে বেরিয়ে গেলো ওরা। সারা রাস্তায় সবাইকে পিক করতে করতে সবার লাস্টে পিক করলো কাব্যকে। সবাই একটা করে ব্যাগ নিলেও কাব্য নিচ্ছে অনেক গুলো।
অভ্র গাড়ি থেকে বেরিয়ে কাব্যর দিকে তাকিয়ে বললো,
-কিরে তুই কি পার্মানেন্ট যাচ্ছিস নাকি?ফিরবিনা আমাদের সাথে?
-হ্যাঁ ফিরবোই তো।
-তাহলে এতো এতো ব্যাগ পত্র।কি নিয়েছিস এতো?বিয়ে কি তোর নাকি আশিক ভাইয়ার?
-আরে আমার জামা কাপড় জিনিস পত্র একটাতেই।বাকি গুলোতে ফুলের জন্য।
-কি ওগুলোতে?
-অনেক গুলো ডল, টেডি, চকলেটস….(পুরোটা বলার আগেই অভ্র থামিয়ে দিলো)
-স্টপ স্টপ স্টপ আর শুনতে চাচ্ছি না এই কম্পোজিশন । কাব্য তোর কি মনে হয় না এই ফুল মেয়েটাকে নিয়ে অতিরিক্ত নাচানাচি করিস তুই? ও সরি শুধু তুই না তোরা সবাই। বাকিদেরও দেখি খুব নাচানাচি করে তোর সাথে তাল মিলিয়ে। কি এমন বিশেষ্যত্ব আছে অই মেয়ের বল তো?
-কি আছে ওর মধ্যে ওকে দেখলেতো বুঝবি,আমাদের গ্রুপের সবাই দেখেছে শুধু তুই দেখিস নি, তাই বুঝিস না।
-ভাই চুপ করো। অই মেয়ের বর্ণনা , উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ শুনেই আমার শখ মিটে গেছে।আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই ওকে দেখার।ন্যাকামোর একটা লিমিট থাকে । টাংগাইল গিয়েও ওটার মুখ দর্শন করতে চাই না তুই নিজ দায়ীত্বে বলে দিস যেনো আমার সামনে না আসে।
-আচ্ছা এতো চেতস ক্যান ফুলের কথা শুনলে?
-তা নয়তো কি করবো?তিন বছর চলে গেছে চার নাম্বার বছর চলছে এই একটা মেয়ের নামে একটা টপিকেই কথা বের হয় তোর মুখ থেকে। ভাই ফেড আপ হয়ে গেছি।
আমি যতোটা বিরক্ত ততোটা তো প্রকাশ ই করতে পারছি না।
কাব্য অভ্রর মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বললো,
-আরো বাকি আছে ভাই?!
অভ্র উত্তর না দিয়ে ঘুরে গাড়িতে উঠে গেলো। কাব্যও সব ব্যাগ উঠিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো।যাওয়ার পথে সারা পথ কাব্য ঘুরে ফিরে সেই ফুলের হিস্টোরিই বলা শুরু করেছে।সবাই মনোযোগ দিয়ে খুব গভীর ভাবে শুনছে , কিন্তু অভ্র প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে গানের ভলিউম হাই করে দিয়ে গান শুনছে কারণ যেনো কোনো ভাবেই কাব্যর বকবকানি অভ্রর কান স্পর্শ করতে না পারে।
আকাশটা মেঘলা মেঘলা ছিলো খুব বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব।বৃষ্টিতে ভেজার উদ্দ্যেশে ফুল ওর গ্যাং নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভিজবে বলে। রাস্তায় বেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর সামনে পড়লো,সালমা বানুর সামনে। রক্ত চক্ষু নিয়ে সালমা বানু ফুলের দিকে তাকিয়ে কর্কশস্বরে বলতে লাগলো,
-এই মেয়ে তুই ই পরশুদিন আমার বাড়ির দেয়াল নষ্ট করেছিস তাই না? তোর বাপ ভাইয়েরা গা বাঁচিয়ে দেয় তোর সারা পথ।যেদিন ধরবো না ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো। আমার ভুল হয়েছে সেদিন তোকে হাতে নাতে ধরার পর তোর নামে বিচার না নিয়ে ঠ্যাং টা ভেঙে পেয়ারা গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া।বজ্জাৎ মেয়ে কোথাকার!
সালমা বানুর এরকম কটকটি মার্কা কথা শুনে মাথার মগজ গরম হয়ে গেলেও ফুল চুপ হয়ে যায় কিছু বলে না।এমন সময় প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি নামলো আর সালমা বানু দৌড়ে সরে গেলো।
ফুল ফিক করে হেসে দিয়ে বর্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আল্লাহ যখন বান্দার উপর খুশি হয় তখন তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। বৃষ্টি আল্লাহর রহমত। আর সালমা বানু আল্লাহর রহমত থেকে গা বাঁচিয়ে দৌড়ে পালালো।একে তো অন্য ভাবে সাইজ করতে হবে।
-কি করবি এখন?দেখেছিস কি সব কথা শুনালো!আচ্ছা রকম শিক্ষা দিতে হবে একে।
-দাঁড়া ভাবতে দে।এমন কিছু করবো যেনো সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙে শুধু জব্বর একটা প্ল্যান কষতে হবে।
বকুল ফুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো
-ভাবো ভাবো। ভালো করে ভাবো।এবার আমরা কোমর বেঁধে নেমে সাইজ করবো এই মহিলাকে।
-তা তো অবশ্যই!
কথাটা বলেই ফুল বাঁকা হাসি দিলো।
বৃষ্টির বেগ ক্রমে ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে আর ফুল ওর গ্যাংয়ের সাথে ভিজতে লেগেছে।বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে টইটই করে অনেক দূর হাঁটতে হাঁটতে এলাকার বাইরে একদম প্রেম রোডের দিকে চলে গেলো যেখানে অনেকটা জনশুন্য।কংক্রিটের এই রাস্তাটার দুপাশে শুধু গাছ আর গাছ।
গাছের ফাঁকেফাঁকে আবার কাশবনও। বৃষ্টিতে ভেজায় সব কটা এতো বেশি মেতে উঠেছে যে কারো হুঁশ ই নেই এতো দূর চলে এসেছে ওরা।
প্রায় দু’টো বাজে ঢাকা থেকে পথ পাড়ি দিতে দিতে মির্জাপুর অব্ধি আসার পর সব কটা গল্প করতে করতে থেমে গিয়ে ঘুমে বিভোর হয়ে আছে।কাব্যটা তো হা করে ঘুমাচ্ছে মুখের ভেতর মশা মাছি গিয়ে হয়তো সংসার করা শুরু করে দিয়েছে।কিন্তু অভ্র জালানার কাছে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে আর প্রকৃতি দেখছে।এরকম প্রকৃতির সামনে ঘুমানো বারণ!
-পরীমা? পরী কোথায় তুই ?
আয়েশা বেগম অনেক্ষণ ধরে পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে ফুলকে ডাকাডাকি করছে। কিন্তু ফুল তো এলাকাতেই নেই।
-পরীমা কোথায় তুই?সাড়া দিচ্ছিস না কেনো!
এদিক ওদিক খোঁজার পর বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো ফুলকে দেখেছে কিনা।এমন সময় কবিতা উত্তর দিলো,
-মা দেড় ঘন্টা আগে ফুলকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেখেছি।আমি ছাদে ছিলাম জিজ্ঞেস করলাম ওকে কোথায় যাচ্ছে, কি যেনো উত্তর দিলো ঠিক মতো শুনতেও পেলাম না।
-বলছো কি?এই বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা কোথায় গেলো।আল্লাহ তুমি এই মেয়েকে কবে জ্ঞান দিবে?এখনো কি বাচ্চা আছে নাকি ও।কোথায় পাবো ওকে। কোন দিক খুঁজবো!
ফুল এই বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির বাইরে বলে দুশ্চিন্তায় পরে গেলেন আয়েশা বেগম। ও যে বড় চাচা, মামা, ফুপা কারো ফ্ল্যাটে নেই এটা স্পষ্ট কারণ সব সদস্যই এখন ফুলদের বাড়িতে। আশিকের বিয়ে উপলক্ষে নানান তোড়জোড় চলছে।বাড়িতে নানান জায়গা থেকে আত্মীয় স্বজন এসে ভরছে।এতো মানুষের ভীড়ে ফুল নিখোঁজ! পলাশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ির পাশে মাঠে খুঁজতে গেলো সেখানেও নেই। পারভেজ ও বেরিয়ে পড়েছে ফুলকে খুঁজতে। বৃষ্টি না হলে কেউ এতো দুশ্চিন্তা করতো না।বর্ষার বৃষ্টি একবার শুরু হলে সেকি আর থামে!
টাংগাইল বাই পাস অব্ধি আসার পর দেখলো টাংগাইলে ঢুকার রাস্তাটা অফ। ড্রাইভার বেরিয়ে মানুষজনের থেকে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলো সামনে দুটো ট্রাক এক্সিডেন্ট করে রোড আটকে আছে বৃষ্টি থামলে রাস্তা ক্লিয়ার করা হবে।
ফুলদের বাড়ি যেতে হলে পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের উপর দিয়ে যেতে হবে ।অভ্রর দিকে ড্রাইভার তাকিয়ে বললো,
-মামা কি করবো এখন?
-আচ্ছা ওয়েট,
অভ্র পেছন ঘুরে কাব্যকে ডাকা শুরু করলো,
-কাব্য! এই কাব্য।
কাব্য ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে তাকালো,
-কি হয়েছে?
-সামনে রাস্তা অফ। এখন কিভাবে যাবো?
-আচ্ছা সমস্যা নেই নতুন বাস স্ট্যান্ডের উপর দিয়ে যাও।
-ঠিক আছে মামা।
-আচ্ছা ওয়েট সামনে দেখো যাওয়ার পথে জ্যাম ধরছে একটু একটু করে ।এক কাজ করো গাড়ি ঘুরাও মামা।একটু পিছিয়ে লতিফপুর রোডে গাড়ি ঢুকাও একদম গোডাউন ব্রিজের আগের রোডটাতে উঠবো তারপর একটান দিলে দুমিনিটে পৌঁছে গেছি দেখবে।
-ঠিক আছে মামা তাই ই করছি।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে লতিফপুর রোডে ঢুকালো।কাব্য রাস্তা দেখিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো।কিছু পথ যেতে যেতে গাড়িটা প্রেমরোডে উঠলো রোডটা একদম স্ট্রেট তাই সামনের অনেকটা দূর দেখা যায়,রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ আবার এক গাছ থেকে আরেক গাছের মাঝে কাশফুলের বন। অভ্র মুগ্ধ হয়ে দেখছে এ দৃশ্য! কিছুটা সামনে কয়েকটা ছেলে মেয়েকে দেখছে বৃষ্টিতে খুব মন মাতিয়ে ভিজছে আর লাফাচ্ছে রাস্তায় পাশে।
সাথে সাথে DSLR টা বের করে দূর থেকেই কয়েকটা ছবি তুললো,জানালারর গ্লাস সরালেই পানি ছিটকে আসছে কয়েকটা ছবি তোলার পর গ্লাস আটকে দিলো,আর মনস্থির করলো একদম কাছে যাওয়ার পর ছবি তুলবে।
অভ্র গভীর মনোযোগ দিয়ে এ দৃশ্য দেখছিলো,তাকে তাকে ছিলো কাছে যাওয়ার পর পর ই ছবিটা তুলে ফেলবে।একদম কাছে যেতেই অভ্র জানালার গ্লাস সরাতে যাবে এমন সময় সমুদ্রর ঘুম ভেঙে গেলো আর অভ্রকে ডাকতে লাগলো,
-ভাই কতো দূর আর?
অভ্র ঘাড় পেছনে ঘুরিয়ে উত্তর দিলো,
-এইতো এসে গেছি আর একটু ওয়েট কর।
-ভাই হেব্বি দূর তো রাস্তা।
-আরে নাহ তেমন দূর না। কালিয়াকৈরের জ্যামে পড়ে যা একটু সময় গেছে।তা ছাড়া রাস্তা পুরো ফ্রিই ছিলো।আর ওখানে জ্যামে না পড়লে আরো এক ঘন্টা আগে পৌঁছাতাম আমরা।
অভ্র সমুদ্রর সাথে কথা বলতে বলতে কাব্যরও ঘুম ভেঙে গেলো।
কাব্য হামি তুলতে তুলতে সবাইকে ডাকতে লাগলো এসে গেছে প্রায়।এতোক্ষণে অভ্রর হুঁশে এলো ছবি তোলার কথা ছিলো সামনে তাকাতেই দেখে অনেকটুকু ক্রস করে এসেছে। ছেলে মেয়েগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। মনে মনে আফসোস হলো এমন সুন্দর একটা ছবি ক্যামেরা বন্দী করতে পারলো না,
টাংগাইল শহরে গাড়ি ঢুকতেই বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেলো। পুরাতন বাস স্ট্যান্ড ক্রস করে গ্রীন রোডে গাড়ি ঢুকালো আর ফুলদের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালো।
এদিকে বৃষ্টি থামার পর ফুল ওর গ্যাং নিয়ে বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে চলে যেতে নিলো।
রোজ প্যাটলের ভেতর গাড়ি প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো এই বৃষ্টিতেও থেমে নেই বিয়ে বাড়ির কাজ কর্ম।কিছু কর্মী বাড়ির বাইরে দিয়ে রাস্তা সাজানোতে ব্যাস্ত কেউ আবার ভেতরে বাড়ির চারপাশে লাইটিং করছে।মোট কথা বিয়ে বাড়ির প্যান্ডেল সাজানোতে ব্যস্ত মানুষজন।
বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই কয়েকজন গৃহকর্মী ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এলো ওদের এগিয়ে নিতে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে আবার।আকাশ এসে সবার সাথে কোলাকুলি করলো।দুজন কর্মীকে গাড়ির ডিকি থেকে ব্যাগ পত্র নিয়ে আকাশদের বাড়িতে নিয়ে রাখতে বললো। ফুলদের বাড়িতে অনেক মানুষ দেখা যাচ্ছে দূর দুরান্তের সব আত্মীয়রা আসছে বাড়িতে।বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই আকাশের মা ফুলের মা সামনে আসতেই সবাই সালাম দিলো। উত্তর নিয়ে সবাইকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো উনারা।ড্রয়িংরুমে সবাই বসতে না বসতে ফুপি এসে সবাইকে শরবত দিলো।কাজের বুয়া সন্দেশ, মিষ্টি,নিমকি আরো কিছু হাল্কা খাবার এনে রাখলো সামনে।
কাব্য এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে ফুলকে খুঁজতে লাগলো,
-পুতুল বোনকে দেখছি না যে আন্টি?
আয়েশা বেগম চিন্তিতো ভাবে উত্তর দিলো,
-আর বলো না বাবা।সেই বৃষ্টির আগে মেয়েটা বেরিয়েছে বাড়ি থেকে এখনো ওর হদিস নেই।কোথায় যে গেছে নিয়ম, পলাশ,পারভেজ খুঁজতে বেরিয়েছে।পুরো এরিয়াতে নেই। গ্রীন রোডের প্রতিটা আনাচেকানাচে দিয়ে খুঁজেছে কোথাও নেই।মেয়েটা এলাকার বাইরে চলে গেছে হয়তো।কোথায় খুঁজবো এখন ওকে!এতো বড় শহরে কোথাও কোনো বিপদে পড়লে!
-আরে আন্টি চিন্তা করবেন না।আশেপাশেই আছে হয়তো।বৃষ্টির জন্য আটকা পড়েছে আসতে পারছে না তাই।
-জানি না মেয়েটা বড্ড বাঁধ ছাড়া হয়ে যাচ্ছে।কোথায় গেলি বলে যাবি না!কবে একটু বোধ বুদ্ধি হবে।এরকম বাচ্চামো আর কতো দিন!
-আন্টি খামোকা টেনশন করছেন।পুতুলের কিচ্ছু হবে না।বাইরে এখনো বৃষ্টি পড়ছে।থামলেই এসে পড়বে।
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই আবার চোখ গেলো বাড়ির পাশের অই মাঠে।সাথে সাথে চলে গেলো সেখানে। দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো সব কটা, কাঁদা দিয়ে ছুড়াছুঁড়ি করে পুরো শরীর একদম কাদাময় হয়ে গেছে।
নিয়ম ফুলকে খুঁজতে গিয়েছিলো এমন সব জায়গায় যেদিকে ফুল যেতে পারে। কোথাও না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিলো এমন সময় দেখতে পেলো ফুল মাঠে কাদা ছুড়াছুঁড়ি করছে ওর সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে।সাথে সাথে গাড়ি থেকে বেরিয়ে ওদিকে গেলো।
-পুতুল বোন তুই এইখানে? কোথায় খুঁজিনি তোকে?কোথায় ছিলি তুই?এখানে তো কয়েক বার এসেছিলাম কই দেখলাম না তো!
-আরে ছোটো ভাইয়া আমরা তো অনেক দূরে গিয়েছিলাম এখানে তো একটু আগে এসেছি।
-কোথায় গিয়েছিলিস?
-প্রেম রোড গিয়েছিলাম।ওদিক টাই কখনো যাই নি তো তাই। আমাদের এলাকা থেকে বেরুলেই প্রেমরোড।
-এতো দূরে গিয়েছিলিস তুই!
-হ্যাঁ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হেঁটে হেঁটে গিয়েছিলাম।
-কি বলছিস বোন?ওই রাস্তা তো অনেক শুনশান। তোরা ওভাবে গিয়েছিলি যদি বিপদ হতো?যেতে ইচ্ছে করছে ভাইদের বলতি নিয়ে যেতাম।
-আচ্ছা বাদ দাও ভাইয়া।যেটা হয়ে গেছে হয়ে গেছেই।তুমি বাড়ি যাও না হলে আমার সাথে খেলা করো।
-না বোন,আর খেলা যাবে না।বাড়ি চল ছোটো মা অনেক চিন্তা করছে তোর জন্য!তাড়াতাড়ি চল বাড়িতে।
কথা শেষ দিয়েই নিয়ম ফুলের হাত ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।পকেট থেকে ফোন বের করে পলাশকে জানালো ফুলকে পেয়েছে আর বাড়িতেও জানালো।
ফুলের আসার কথা শুনে আয়েশা বেগমে আত্মায় পানি ফিরে এলো আয়েশা বেগম কি কাজে যেনো রান্নাঘরের দিকে গেলো,
কাব্যরা সবাই গল্প করছে বাড়ির লোকদের সাথে। আকাশ বাড়ির প্রত্যেক মেম্বারদের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। ভাইদের মধ্যে বাড়িতে একমাত্র আকাশ ছিলো। নিয়ম, পলাশ,পারভেজ ফুলকে খুঁজতে বেরিয়েছিলো আর বাকিরা কাজে বেরিয়েছে।
অভ্রও সবার সাথে গল্প করায় তাল মিলয়ে যাচ্ছে।কথায় কথায় ফুলের প্রসঙ্গ উঠতেই অভ্র ইন্ডাইরেক্টলি টপিক ইগনোর করে ফোন চালানোতে মনোযোগ দেয়।
সাদা রঙের ড্রেস পড়া ছিলো ফুল।কাদা লাগিয়ে সাদা রঙের জামা আদার রঙ বানিয়ে ফেলেছে।
মা যে যে রেগে আছে এটা ফুলের জানা আছে।
-ছোটভাইয়া তুমি আগে যাও,আমি পেছনে যাবো। মা দেখার আগেই আমি উপরে চলে যাবো।
-ঠিক আছে,সাবধানে যাস।দৌড় দিস না কিন্তু গায়ে কাদা লেগে আছে তোর।পিচ্ছিল দিয়ে পড়লেই কোমর শেষ।
-ঠিক আছে যাও তুমি।আমি তোমার পেছনে লুকাচ্ছি।
নিয়ম সামনের দিকে যেতে লাগলো আর ফুল নিয়মের পেছন পেছন পা টিপে টিপে যাচ্ছে। ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়েছে যেনো আত্মীয় স্বজনরা কেউ দেখে চিনে না ফেলে।
অভ্র ফোন টিপছিলো আর সবার কথায় টুকিটাকি সাড়া দিচ্ছিলো এমন সময় ধপাস করে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে সবাই তাকালো, ফোন স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে অভ্রও সেই আওয়াজটার দিকে তাকাতেই…..!
চলবে…………