#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ৬
এত বছরের পরিপূর্ণ বাড়িটা আজ একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। বাবা-মা, ভাইদের ছেড়ে অজানা জায়গায় পাড়ি জমিয়েছে সুমি। চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে নতুন বাড়িতে নব বধুর যাত্রা। মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পরলেন রাহেলা বেগম। মা -মেয়ে মিলে কত মনের কথাই না বলতো। আজ মায়ের সেই সঙ্গীটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু কিছুই যে করার নেই সবই বিধাতার নিয়ম।
বসায় এসেই ক্লান্ত হয়ে পরেছে বিন্দু। আজ শাড়ি পরে যেন একটা মহাযুদ্ধ পার করেছে। শিহাবের কথা রাখতেই শাড়ি পরা। প্রথম একটা আবদার করেছে তাও না রেখে উপায় নেই। বাড়িতে এসেই সাজেদা বেগম রান্না বসিয়ে দিয়েছেন। একে তো প্রচণ্ড গরম তার ওপর এত তেলের খাবার। সব মিলিয়ে তেমন কিছুই কেউ খেতে পারেননি। বিধু-বিন্দুও এত তেলের খাবার খেতে পারে না। আধপেটা খেয়েই দু’বোন উঠে গেছে। রাতে কী না খেয়ে থাকবে নাকি। তাই এসেই রান্না বসানো। নিজে না খেলেও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু মেয়ে দু’টোকে না খাইয়ে রাখবেন না তিনি।
কয়েকমাস বেশ আনন্দেই কাটছে বিন্দুর দিনগুলো। নতুন প্রেম বলে কথা। এরই মধ্যে কয়েকবার বাহিরে দেখাও হয়েছে দু’জনের। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই আছে বিন্দু আর শিহাব। অন্যদিকে শিশির আর বিধুর সখ্যতাও বেড়েছে। বিধু যখনই সময় পায় তখনই শিশিরকে কল করে। কিন্তু শিশির স্কুল নিয়ে বিজি থাকায় তেমন একটা সময় দিতে পারে না তবুে বিধুকে সেটা বুঝতে না দিয়ে দু’চারটা কথার মধ্যেই কথাতে ইতি টানে। সব মিলিয়ে সবাই বেশ ভালো আছে। সুমিও জমিয়ে নতুন সংসার করছে। কয়েকদিনের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির সবার মন জয় করে নিয়েছে মেয়েটা। ছোটোবেলা থেকেই সবার সাথে মিশুকে স্বভাবের সুমি। তাই শ্বশুরবাড়িতে এ নিয়ে খুব একটা কষ্ট হয়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির প্রাণ হয়ে উঠলো সুমি। সে নিয়ে রাহেলা বেগমের গর্বের সীমা নেই। মেয়ের এমন তারিফ শুনলে যেকোন মায়েরই খুশিতে প্রাণ ভরে ওঠে। যখনই সময় পায় সুমির হাজবেন্ড ওকে ওদের বাড়িতে নিয়ে এসে রাহেলা বেগমের সাথে দেখা করে নিয়ে যায়। রাহেলা বেগম আর ওনার স্বামীও খুব খুশি এমন জামাই পেয়ে। আর দৈনিক একবার হলেও যাকে কল করতে সুমির ভুল হয় না, সে হলো বিন্দু। সব মিলিয়ে খুব আনন্দেই কাটছে সবার সাজানো-গোছানো সুন্দর সংসার।
সকাল থেকেই পুরো আকাশ জুড়ে গুমধরা মেঘ দেখা যাচ্ছে। কিছু সময় পরপর একটুখানি বাতাসের দেখা মিলছে। আবার একটু একটু সূর্যও খানিক বাদে বাদে আকাশে উঁকি দিচ্ছি পরক্ষণেই আবার মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পরছে। এমন অবস্থাতেও গরম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আজ বাড়িতে একা একা বোর হচ্ছে শিশির। স্কুলও বন্ধ তারওপর প্রচণ্ড গরম সব মিলিয়ে খুব অস্বস্তি লাগছে। ওদিকে আবার শিরিনা বেগম পাতিলে খিচুড়ি বসিয়ে দিয়েছেন। আজ নাকি বৃষ্টি হবে। কিন্তু কোথাও বৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শিশিরের প্রিয় খাবারের তালিকায় খিচুড়ি রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু আজ কেন যেন মন টানছে না। হয়তো সবটাই গরমের প্রভাবে। রুমে আর ভালো লাগছে না। তাই মায়ের সাথে গল্প করার জন্য পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। শিরিনা বেগম খুব মনযোগ সহকারে কাঠের খুন্তি দিয়ে খিচুড়ি নাড়ছেন যাতে পাতিলের তলায় না লেগে যায়।
–মা আজ খিচুড়ি না রান্না করলেও পারতে। প্রচুর গরম লাগছে। খেয়ে মনে হয় মজা পাব না। আর যদি পেট খারাপ করে তখন?”
শিরিনা বেগম হেসে বললেন,
–অলক্ষুণে কথা বলিস না তো। পেট খারাপ হবে মানে কী। দেখবি কিচ্ছু হবে না। আজ শুকনো মরিচের ভর্তাও বনাবো। খিচুড়ির সাথে মাখিয়ে খাবি দেখবি অনেক মজা। আমের আচারও আছে৷ মা ছোট বেলায় বানাতো। আহা! কী যে মজা লাগতো। এখনো জিহ্বায় স্বাদ লেগে আছে।”
কথা বলেই থামলেন শিরিনা বেগম। হুট করেই শিশির বললো,
–মা ফ্রিজে কী ইলিশ মাছ আছে?”
–আছে মনে হয় দুইটা।”
–একটা কাজ করো সেখান থেকে একটা ভাজো। ইলিশ মাছ দিয়ে খিচুড়ি উফ মা যা টেস্ট হয়, না খেলে বুঝতে পারবে না। শিহাবের বাসায় খেয়েছিলাম এই আইটেম। অনেক মজা লেগেছিল।”
ছেলের এমন হাসিমুখের কথা শুনে শিরিনা বেগমও হেসে ফেললেন।
–একটু কষ্ট করে তুই মাছটা নিয়ে আয় আমি এখানে বালতিতে ভিজিয়ে রাখি।”
শিশির মাছটা ওর মাকে দিয়ে চলে যেতে নিলেই পিছু ডাকলেন শিরিনা বেগম।
–শিশির শোন।”
–হ্যাঁ, মা বলো?”
–পাশের বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে না!”
–হু।”
–সেই ঘরের ভাবির ভাইর একটা মেয়ে আছে নাম সালমা। আমি একদিন দেখছিলাম রিদিও দেখছে। তোর সাথে মেয়েটা বেশ মানাবে।”
মায়ের কথা শুনেই বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো শিশিরের। উদাসভাবে মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
–মা আমার এখনো বিয়ে করার সময় হয়নি।”
–আর কত সময় হলে তোর বিয়ের সময় হবে। তোর বয়সের ছেলে-মেয়েদের দুই-তিনটা করে বাচ্চা আছে আর তোর এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। আমি কী নাতি-নাতনীর মুখ দেখবো না।”
শিশির মায়ের কাঁধ জড়িয়ে সুক্ষ্ম কণ্ঠে বললো,
–মা দেখো রিদিটা বড় হচ্ছে এইবার ইন্টারে পড়ে। কত ভালো ভালো সম্বন্ধ আসে শুধুমাত্র আমাদের ঘরটা সুন্দর না দেখে কেউ এগোয় না। সামনের বছরেই আমার প্রমোশন হবে। স্কুল থেকে বিশ হাজারের মতো টাকা পাব। কিছু টটিউশনিও করবো। তারপর একটা লোন নিয়ে ঘরটা একটু সাজাবো-গোছাবো। তারপর রিদির বিয়ে দিয়ে আমি বিয়ে করবো।”
–কেন রিদি থাকলে তোর কী সমস্যা? ”
–আরেহ মা….আচ্ছা রিদিকে বিয়ে না দিয়েই আমি বিয়ে করবো। এবার খুশি তুমি? ”
হেসে ফেললেন শিরিনা বেগম। এরই মধ্যে শিশিরের ফোন নিয়ে রান্নাঘরে এলো রিদি,
–ভাইয়া কতক্ষণ পর্যন্ত তোর ফোনে কল বাজতেছে।”
রিদির থেকে ফোন নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখলো বিধু ফোন এসেছে। রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসলো শিশির।
–হ্যালো পিচ্চি। ”
–জ্বি বড় মানুষ।”
–কেমন আছো?”
–আলহামদুলিল্লাহ আপনি কেমন আছেন?”
–আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি। বাসার সবাই কেমন আছে?”
–সবাই ভালো আছে। আপনাদের?”
–ভালো। বিন্দু কেমন আছে?”
বিধু হালকা হেসে বললো,
–আপুও ভালো আছে। সারাক্ষণই ও ভালো থাকে।”
বিধুর কথা শুনে হেসে ফেললো শিশির,
–তুমি সারাদিন ভালো থাকো না?”
–থাকি তো।”
–তাহলে?
–আচ্ছা বাদ দিন না।”
–ওকে বাদ। এখন বলো পড়াশুনা কেমন চলছে? এক্সাম তো কাছে এগিয়ে আসছে। ”
–হুম সেই জন্যেই তো ভয় লাগছে। আমি ইংরেজিতে তেমন কিছুই বুঝি না। বিশেষ করে গ্রামারগুলো। আপনি কত ভালো ইংরেজি পারেন। আমায় একটু শিখিয়ে দেবেন?”
–কিভাবে সম্ভব।”
–প্লিজ আপনি না করবেন না। একদিন আমাদের বাড়িতে আসুন প্লিজ। আর এসে আমাকে শিখিয়ে দিয়ে যাবেন।”
–বিধু এটা সম্ভব না।”
–কেন সম্ভব না?”
–কারণ আমি তোমার প্রাইভেট টিচার নই যে হুট করেই তোমাদের বাসায় চলে যাব।”
–আমি এত কথা বুঝি না সামনের শুক্রবার আসবেন বলেছি তো আসবেন। আর কোনো কথা শুনতে চাই না।”
শিশিরকে আর কিছু না বলতে দিয়েই ফোন কেটে দিলো বিধু। শিশির পরে গেল মহা বিপাকে। কীভাবে যাবে ওই বাড়িতে। আর এভাবে হুট করে যাওয়াটা কী আধেও শোভনীয় হবে?
আবারও কল আসলো বিধুর। শিশির তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করে বললো,
–বিধু শোনো?”
–শোনাশুনির কিছু নেই। এখন বলেন আপনার হাতের,মাথার চোট কী সেরেছে?”
–হ্যাঁ সেরেছে।”
আবারও ফোন কেটে দিলো বিধু। প্রতিদিন একবার হলেও শেষের কথাটা জিজ্ঞেস করবেই বিধু। যদিও অনেক আগেই ক্ষতগুলো শুঁকিয়ে গেছে তবুও বিধু প্রতিদিন এ কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে না।
শিহাবেরও খিচুড়ি অনেক পছন্দ আজ ওকে ডেকে আনলে মন্দ হয় না। দুই বন্ধু মিলে বেশ আয়েস করে খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা খাওয়া যাবে। ভেবেই ফোন করে বসলো শিহাবকে। বারবার ফোন ওয়েটিং দেখাচ্ছে। কয়েকবার ফোন করেও যখন আর শিহাবকে পেল না তাই চুপচাপ বাহিরে হাঁটতে বেরিয়ে পরলো।
–বিন্দু! ”
–হু।”
একটা কথা ছিল। ”
–বলো?”
–চলো না আমরা কাল মিট করি।”
–কাল, করাই যায়। কোথায় মিট করবো?”
–এটা তোমার জন্য সারপ্রাইজ থাক। এখন বলবো না কাল আসলেই দেখতে পাবে।”
–ওকে যথা আজ্ঞ। এখন শোন না আমি ফোন রাখছি। মা ডাকছে।”
–আচ্ছা ভালো থেকো।”
–তুমিও ভালো থেকো।”
ফোন কেটেই বিন্দু ছুটলো রান্নাঘরে সাজেদা বেগম কখন থেকে ডেকেই চলেছেন। একবার কথা শুরু করলে দুনিয়ার ধ্যান-খেয়াল সব হারিয়ে যায় বিন্দুর। বিন্দু দৌড়ে গিয়ে বললো,
–মা ডাকছিলে?”
–কখন থেকেই তো ডাকছি আর এখন জিজ্ঞেস করছিস ডাকছি কিনা। তারাতারি চিংড়ি মাছগুলো একটু কুটে দে তো। এক হাতে আর সামলাতে পারছি না। তোর বাবার সাথে দুপুরে নাকি তার বন্ধুও আসবে। সবে ফ্রিজ থেকে গোস্ত নামিয়েছি কখন যে কী করবো বুঝতে পারছি না। এই মানুষটা খবর দেওয়ার আর টাইম পেল না।”
–চিন্তা করো না। সবে বারটা বাজে। প্রেসার কুকারে গোস্ত বসিয়ে দেবে তাহলেই হয়ে যাবে আর ভাতটা রাইস কুকারে বসিয়ে দাও।”
–মাংসের বরফ ছুটতে ছুটতেই তো সময় সব যাবে।”
–তুমি চিন্তা করো না আমি মাছ কুটেই মাংসগুলো ছুটিয়ে দিচ্ছি।”
–হুম তাড়াতাড়ি কর। বিধুকেও ডেকে নিয়ে আয় মেয়েটা দুনিয়ার কামচোর হয়েছে৷ এদিকের কুটাটাও ওদিকে নিতে চায় না।”
শিশিরের অনেকগুলো কল দেখে শিহাব ডায়াল করলো শিহাবের নাম্বারে।
–কিরে এতক্ষণে তোর ফোন করার সময় হলো?”
শিহাব হাসতে হাসতে বললো,
–বোঝসই তো আমি এখন কত বিজি।”
–হ্যাঁ সবই বুঝি। এখন শোন তুই আমাদের বাড়িতে চলে আয়। ”
–কেন স্পেশাল খাওন আছেনি?”
–স্পেশাল কিছু না। গুরুর গোস্ত দিয়ে খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা।”
–আমি এক্ষুণি আসতাছি এর চেয়ে স্পেশাল আমার আর কিছুর দরকার নেই। অনেকদিন খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা খাই না। আচ্ছা এখন ফোন রাখ। আমি রেডি হয়ে আসতাছি।
–আচ্ছা আয়।”
–হুম।”
–পাগল ছেলে একটা।(মনে মনে বললো শিশির)
চলবে,,,,,,,