শ্রেয়সী #লেখাঃKhyrun Nesa Ripa #পর্বঃ২৪

0
384

#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ২৪

কাল ঈদ অথচ কোনো আনন্দই হচ্ছে না বিন্দুর৷ একটা ঘূর্ণিঝড় হুট করে এসেই বিন্দুর জীবনের সব রঙগুলো উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে। প্রতিবছর ঈদের আগের দিন রাতে দু’হাত ভর্তি করে মেহেদী পরতো বিন্দু। দিনগুলো কতই না সুন্দর ছিল। কে জানতে এইবার ঈদ আসার আগেই জীবনের সব রঙ ধুয়ে-মুছে যাবে। হারিয়ে যাবে সেই সুখের দিনগুলি। কত ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন বুনেছিলো হৃদয় নামক ছোট্ট ঘরটায়। আজ সেখানে কোনো স্বপ্ন নেই। আছে একবুক শূন্যতা। স্বপ্ন দেখা মানুষটাই তো তার জীবনে নেই তাহলে কাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনবে?
অনেকক্ষণ এলোমেলো চুলে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। আর একাগ্রচিত্তে পরিমাপ করে চলেছে জীবনের পাওয়া-না পওয়ার দাঁড়িপাল্লা। কে বুঝতো এত সহজেই জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাওয়াগুলো না পওয়াতে পরিণত হবে। চোখ জোড়া কখন যে জলের স্রোতে ভিজে উঠেছে একদম টের পেলো না বিন্দু। হঠাৎ রিদির ডাকে ভাবনা ছেড়ে বাস্তবে পদার্পণ করলো। বাঁ’হাতের উল্টো পিঠে বেখেয়ালি ভাবে মুছে নিলে চোখ থেকে ঝড়ে পরা অশ্রু কণাগুলো। তারপর চোখে – মুখে একটু ম্লান হাসি ঝুলিয়ে রিদির দিকে ফিরে বললো,
–কিছু বলবে?”
–এখানে এসো। তোমাকে মেহেদী পরিয়ে দেই।”
–না তুমি দেও। আমার ভালো লাগছে না।”
–তা বললে তো হবে না। নতুন বউয়ের হাতে মেহেদীর রঙ লাগবে না এটা কী করে হয়?”
রিদির জোড়াজুড়িতে অগত্যা বাধ্য মেয়ের মতো এসে খাটের ওপর বসলো। রিদি অনেক সুন্দর করে দু’হাত ভর্তি করে মেহেদী লাগিয়ে দিলো বিন্দুকে। হঠাৎ হাতের দিকে নজর পরতেই নিশব্দে ভেতরটা হু হু করে উঠলো। হাতের তালুর মাঝ বরাবর ‘ S ‘ লেখা দেখেই মনের ভেতরের সুপ্ত ঝড়টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। নিজের চোখের জল আড়াল করার জন্য বিন্দু কোনোরকম বললো,
–রিদি আমি একটু আসছি।”
কথাটা কোনরকম শেষ করেই দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। সেই সাথে বস্ত হয়ে পরলো চোখের পানি মুছতে৷ নিশব্দের কান্নাটা ফুঁপিয়ে উঠতে চাইছে। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না বিন্দু। ঠিক সেই সময় আগমন ঘটলো শিশিরের। রিদিকে মেহেদী নিয়ে খাটের ওপর বসে থাকতে দেখে শিশির বলে উঠলো,
–বিন্দু কোথায়?”
–ব্যালকনির দিকে গেল।”
–মেহেদী পরানো শেষ হয়েছে?”
–আর অল্প বাকি।”
–আর পরানো লাগবে না। এবার তুই গিয়ে পরে নে।”
–ভাইয়া ভাবির হাতে তোর নামের ইংরেজি প্রথম অক্ষর এঁকে দিয়েছি।”
–ওহ্।”
রিদি আর কিছু না বলে চলে গেল। শিশিরের আর বুঝতে বাকি রইলো না। দ্রুত পায়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। বিন্দু অস্থির হয়ে চোখের পানি মোছার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু দু’হাতে মেহেদী থাকার কারণে মুছতে পারছে না। শিশির এগিয়ে গিয়ে বিন্দুকে নিজের দিকে ফেরালো। নিজের হাতে মুছে দিলো বিন্দুর চোখের পানি। কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বিন্দু শিশিরের দিকে। শিশির আলতো করে বিন্দুর নাকটা টেনে দিয়ে বললো,
–এতটা অবাক হওয়ার মতো কিছু হয়নি। এত চোখের জল আসে কোত্থেকে হু? আমি তো চাইলেও কাঁদতে পারি না।”
–আপনি কেন কাঁদবেন? আপনার তো কোনো প্রিয় মানুষ হারিয়ে যায়নি।”
–কিন্তু আমার প্রিয় মানুষটা যে কষ্ট পাচ্ছে সেটাও তো আমি সহ্য করতে পারছি না।”
–আপনার প্রিয় মানুষ আবার কে?”
শিশির একটু হালকা হেসে বললো,
–কেউ না। একটু মায়ের রুমে এসো তো। মায়ের জন্য একটা শাড়ি এনেছি আর একটা তোমার জন্য। দেখো তো কেমন হয়েছে।”
–বিয়েতে তো এত গুলো শাড়ি দিলেন। আবার কী দরকার ছিল।”
–সেগুলো তো ঈদ উপলক্ষ্যে দেইনি। এখন এসো।”

শিশির বিন্দুর জন্য গাঢ় ফিরোজা কালারের মধ্যে কালো সুতার কাজ করা একটা শাড়ি এনেছে। সবারই শাড়িটা ভিষণ পছন্দ হয়েছে। শিরিনা বেগম বিন্দুকে বললো,
–বিন্দু দেখ তো শাড়িটা কেমন হয়েছে?”
–অনেক সুন্দর হয়েছে মা।”
–কালকে এইটা পরবি। খুব মিষ্টি লাগবে তোকে দেখতে। আর এমনিতেও কালকে অনেকজন আসবে দেখতে। কাল একদম অগোছালো থাকবি না৷ একটু সাজুগুজু করবি। বাড়ির মেয়ে-বউরা এলোমেলো থাকলে দেখতেও ভালো লাগে না।”
বিন্দু মাথা নেড়ে সায় দিলো। শিরিনা খুব সহজেই বিন্দুকে আপন করে নিয়েছেন। রিদির মতো বিন্দুকেও তুই করে বলেন। বিন্দুর এই বিষয়গুলো অনেক ভালো লাগে। কত সহজেই সবাই কী সুন্দর তাকে আপন করে নিয়েছে। তবে মাঝে মাঝে বুক ফেটে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সত্যিই তো বিন্দু এসব একদম ডিজার্ভ করে না।
–বিন্দু, বিধু কল করেছে কথা বলো।”(শিশির)
–হ্যালো বিধু।”
–কিরে কেমন আছিস। সবাইকে পেয়ে তো আমাকে ভুলেই গেছিস।”
–আরেহ পাগলী ভুলিনি। মা-বাবা কেমন আছে?”
–কল করলাম আমি আর জিজ্ঞেস করছিস মা -বাবার কথা। বাহ্!বেশ ভালোই। ভালোই আছে তোর মা-বাবা।”
বিধুর পাকাপাকা কথা শুনে বিন্দু হেসে ফেললো।
–তা আমার ঝগড়ুটে বোনটা কেমন আছে?”বলেই মুখ টিপে হাসছে। পাশ থেকে শিশির বলে উঠলো। আমার বোন কিন্তু মোটেও ঝগড়ুটে নয়। এরপর শিশির ফোন নিয়ে বিধুর সাথে ঠাট্টা-মশকরা শুরু করে দিলো।

আজও রাতে শিশির চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিলো। মনে মনে বিন্দুর অনেক প্রশ্ন জমা থাকলেও তার একটাও জিজ্ঞেস করলো না। চুপচাপ নিজের মতো শুয়ে পরলো। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পরলো বিন্দু। শিশির তখনও চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বিন্দু ভেবে পায় না শিশির কেন এভাবে কষ্ট করে ঘুমায়। নাকি শিশিরের ঘেন্না লাগে বিন্দুর পাশে ঘুমাতে? তাহলে প্রথম দুইদিন এভাবে ঘুমিয়েছিল কেন? তখনও তো শিশির সব কিছুই জানতো। এসব ভাবতে ভাবতেই অনেকক্ষণ শিশিরের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কেমন যেন একটা মায়া কাজ করছে বিন্দুর ভেতরে। এভাবে কষ্ট করে ঘুমায় সারাট রাত সত্যিই বিন্দুর খুব খারাপ লাগছে। অন্যদিকে এ নিয়ে যে শিশিরকে প্রশ্ন করবে তাও মন টানছে না। সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তিতে আছে বিন্দু। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেল সকাল সকালই গোসল সেরে নতুন শাড়ি পরে বেরিয়ে আসলো। ততক্ষণে শিশরেরও ঘুম ভেঙে গেছে। বিন্দুকে দেখেই বিষম খাওয়ার মতো পরিস্থিতি শিশিরের। ফিরোজা রঙের শাড়িতে বিন্দুকে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে একটা পবিত্র ফুল। কিছুতেই চোখের দৃষ্টি সংবরণ করতে পারছে না শিশির। এক অজনা শক্তি শিশিরকে চুম্বকের মতো টানছে বিন্দুর দিকে। বিন্দু খানিকটা লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে সরে ব্যালকনিতে চলে গেল। টাওয়ালে চুল মুছতে মুছতে নিজেকেই বকা দিতে লাগলো। কী দরকার ছিল সকাল সকালই শাড়িটা পরার! যার কারণে এখন লজ্জায় পরতে হয়েছে৷ শিশিরও বুঝতে পেরে ওয়াশরুমে চলে গেল। সারা দিনের মধ্যে শিশির -বিন্দু কেউই কারো মুখোমুখি হয়নি। একরকম দু’জনেই পালিয়ে পালিয়ে ছিলো দু’জনের থেকে। বিকেল বেলা বিন্দু ছাঁদে উঠেছিল ফুল গাছগুলোতে পানি দিতে। শিশির জানতো না বিন্দুও ছাঁদে আছে। কারো সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল। বিন্দু বেখেয়ালি ভাবে সিঁড়ি দিয়ে নামছে হঠাৎই শিশিরের সাথে ধাক্কা খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে পরে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় শিশির পুরো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু চিৎকার দিয়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। শিশির দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলো। অনেকখানি মাথা ফেটে গেছে। রক্তে শিশিরের টিশার্ট অনেকখানি ভিজে গেছে। শিশির চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। যদি বেবিটার কিছু হয়ে যায় শিশির কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। অস্থির হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে রুমালটা বের করে বিন্দুর মাথাটা বেঁধে দিলো। শিরিনা বেগম এসেই চিৎকার করে বললেন,
–কিভাবে হলো এসব? এই বিন্দু মা চোখ খোল।”
–মা অস্থির হয়ো না। ভাইয়া তুই তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে চল ভাবিকে। মাথায় তো ভালোই আঘাত পেয়েছে।”
–কিন্তু এমন অঘটন ঘটলো কী করে?”
–মা আমি বুঝতে পারিনি৷ ফোনে কথা বলছিলাম তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেছি আর ওমনি বিন্দুর সাথে ধাক্কা লাগে। আর ও টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে গেছে।”
–এতটা বেখেয়ালি হয়ে কেউ হাঁটে? ইশ এই ঈদের দিনই মেয়েটার কী অবস্থা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি এখন ওরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা। কতখানি রক্ত বের হয়ে গেছে।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here