শ্রেয়সী #লেখাঃKhyrun Nesa Ripa #পর্বঃ২৭

0
377

#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ২৭

দিনকাল খুব একটা সহজ যাচ্ছে না শিশিরের। দিন দিনই জীবনটা জটিলতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে মনে হয় কোনো গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছে। নিজেকে চাইলেও সেই ধাঁধা থেকে বের করতে পারছে না। যতই তা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে ততই যেন বেশি বেশি জরিয়ে পরছে। জীবনের কোনো এক মুহূর্তে এসে এভাবে এত প্রবলেম ফেস করতে হবে বড্ড অজানা ছিলো শিশিরের। একা একজন মানুষ কতদিক সামলাবে। নিজেকে মাঝে মাঝে বড্ড অসহায় মনে হয় শিশিরের। এমন কেউই নেই যার সাথে মনের কথাগুলো খুলে বলতে পারবে।
দাওয়াতের দিন বিন্দুদের বাসায় গিয়ে বিন্দু বায়না ধরেছে আর শিশিরদের বাড়ি আসবে না। কিন্তু সাজেদা বেগম আর সাহেদ আলীর রাগের কাছে হার মেনে আসতেই হলো। সেই থেকে বিন্দুর বাজে বিহেইভিয়ার যেন বেড়েই চলেছে। কথায় কথায় বিন্দু শুনিয়ে দেয় কেন তার মতো এমন একটা বাজে মেয়েকে সে বিয়ে করেছে? নিশ্চয়ই ভালোবেসে নয় তার বাপের টাকা-পয়সা দেখে। বিন্দুর এই কথাগুলো মারাত্মক কষ্ট দেয় শিশিরকে। তবুও নিশ্চুপ সবটা সহ্য করে শিশির। দিন শেষে রাত হলে সেই বিন্দু নামক ভালোবাসাকে বুকে আঁকড়ে ধরেই রাত পার করে। নিজের চাওয়া-পাওয়াগুলোও বিন্দুর কাছে প্রকাশ করে না। তারও তো একটা শারিরীক চাহিদী আছে, মনের কামনা-বাসনা আছে সব মিলিয়ে নিজেকে এসব থেকে দূরে রেখেও বিন্দুর একটুও মন পাচ্ছে না। উল্টো নানান কথা শুনতে হচ্ছে। আবার আরও একটা নতুন দুশ্চিন্তা মাথায় এসে ভিড় জমিয়েছে। বিন্দুর যেদিন পিরিয়ড হবে সেদিন কী করে শিশির সবটা ম্যানেজ করবে? নাকি বলবে মিসক্যারেজ হয়েছে? সব মাথার মধ্যে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যে বলতে বলতে এখন হাঁপিয়ে উঠেছে শিশির। কী করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সত্যিটা বলে যে মাথার চাপটা কমাবে তাও সাহসে কুলাচ্ছে না। প্রথমত, বিন্দু কখনোই শিশিরের এই কথা বিশ্বাস করবে না।
দ্বিতীয়ত, এখন যেটুকুও শিশিরের সাথে আছে এই কথা শোনার পর এই বাড়িতে এক দন্ডও থাকতে চাইবে না। তখন বলবে আমি বাড়ি চলে যাব। তখন চাইলেও জোর করে আটকে রাখা পসিবল হবে না। হয়তো এটাও বলে বসতে পারে, যেহেতু আমার বেবীই হবে না তার চেয়ে ডিভোর্সটা হয়ে যাক সেটাই বেটার।

কারণ প্রতিনিয়ত বিন্দু যেভাবে শিশিরকে দুর ছাই করছে সেখানে সত্যিটা জানার পর ডিভোর্স চাওয়াটা বিন্দুর কাছে এমন কোনো কঠিন ব্যাপার না। আর এই বিষয়গুলোর জন্যই মূলত শিশির সত্যিটা আড়াল করে রেখেছে। কারণ বিন্দু নামক এই মেয়েটাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। তাই মিথ্যের মায়াজালে হলেও আটকে রাখতে চায় প্রিয় মানুষটাকে। সব মিলিয়ে প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে শিশির।

আর এদিকে দেখতে দেখতেও অপারেশনের সময় চলে এসেছে। আগামী কালকেই অপারেশন হবে। গতকাল ডাক্তারকে দেখিয়ে এসেছিলো শিশির। বিরতিতে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবছিল শিশির। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। একে তো প্রচুর গরম পড়ছে তারওপর নানা চিন্তাভাবনা। হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছনে তাকালো শিশির। প্রিন্সিপাল স্যারকে দেখেই একটু সৌজন্যমূলক হাসলো।
–শিশির কী এত চিন্তা করছো? বলতে পারো যদি কোনো সাজেশন দিতে পারি অবশ্যই দেব।”
–স্যার যদি এমন হয় একটা মেয়ে জানে তার বাচ্চা হবে কিন্তু পরে যদি জানা যায় মেয়েটার বাচ্চা হবে না। তখন কী করা যায়? আসলে স্যার মেয়েটা অনেক বাচ্চা প্রিয়।”
–সত্যিটা তাকে বলে দেওয়াই বেটার।”
–স্যার সত্যিটা বললে হয়তো সম্পর্কটাই টিকবে না। তখন?”
প্রিন্সিপাল স্যার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
–বেশ জটিল কেইস!”
শিশির আরও চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
–হুম স্যার।”
–একটা কাজ রকলেই তো হয় তারা আবার ফিজিক্যাল রিলেশনে জড়িয়ে গেলেই তো সমস্যা সলভ। তাহলেই তো হয়ে যায়।”
— কিন্তু স্যার মেয়েটা তো তার হাজবেন্ডকেই মানতে পারছে না সেখানে এই রিলেশন কীভাবে সম্ভব।”
প্রিন্সিপাল স্যার একটু ভেবে বললেন,
–সম্ভব! খালি একটু বুদ্ধি খাটতে হবে। এতে করে একদিকে মেয়েটাও জানবে না তার আগে বাচ্চা ছিলো না। বরং জানবে নতুন বাচ্চাটাই তার আগের বাচ্চা। যদিও আগে সে কোনো বাচ্চাই কনসিভ করেনি।
শিশির উদ্বিগ্ন হয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের দিকে তাকালো।
–………………
স্যারের কথা শুনে শিশির একটু লজ্জাও পেলো। এরপর হেসে জবাব দিলো।
–স্যার এতে কোনো ক্ষতি হবে না তো?”
–আরেহ না। ”
–অনেক ধন্যবাদ স্যার।”
–আগে সুখবর পাই পরে ধন্যবাদ দিও।”
–স্যার ওর অগোচরে মানে ওকে না জানিয়ে কাজটা করা কী ঠিক হবে?”
কথাটা বলেই থতমত খেলো শিশির। প্রিন্সিপাল স্যার শিশির মুখ দেখে বললেন,
–শিশির আমি জানি এটা তোমার বউ আর তোমার সমস্যা। কিন্তু আধেও তোমাদের কী প্রবলেম সেটা আমি জানতে চাইবো না৷ এত ভয় পাওয়ার কিছু না। এগিয়ে যাও আর তাড়াতাড়ি সুখবরটা যেন পাই। আর হ্যাঁ, তুমি তোমার ওয়াইফ এর হাজবেন্ড । আর তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে ওর ওপর। সো নো টেনশন।”
শিশির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবারও স্যারকে ধন্যবাদ দিতে ভুললো না।

প্রিন্সিপাল স্যার ছোট ভাইয়ের মতো শিশিরকে ভালোবাসেন। তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। শিশির এমন আরও অনেক সমস্যার সমাধান পেয়েছিল তার এই বড় ভাইয়ের মতো স্যারের কাছ থেকে তাই আজ নিঃসংকোচে নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস কিছুটা পেশ করলো মাত্র।

পরেরদিন বিন্দুর অপারেশন সাকসেসফুল ভাবেই হয়। শিশির মারাত্মক টেনশনে ছিলো। সাজেদা বেগম, সাহেদ আলী, শিরিনা বেগম সবাই শিশিরকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলেছে অধৈর্য্য না হয়ে। সবশেষে অপারেশনটা ঠিকভাবে হয়েছে ভেবে সবাই খুশি। অপারেশনের পর বিন্দুকে বেডে শিফট করা হয়। বেশ কিছুক্ষণ বাদেই বিন্দুর জ্ঞান ফিরে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো আজকের দিনেই বিন্দুর পিরিয়ড শুরু হয়। বিন্দু যখন বিষয়টা বুতে পারলো তখন থেকেই সব রাগটা গিয়ে পড়লো শিশিরের ওপর। মনে মনে কয়েক দফা শাপ-শাপান্তর করলো শিশিরকে৷ কষ্টে হৃদয়টা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে বিন্দুর। কী করে সবাই ওর সাথে এই নোংরা খেলাটা খেলতে পারলো? অপারেশনের নাম করে একটা বাচ্চাকে এভাবে পরিকল্পনা করে সরিয়ে দিলো। নিজেকেই দোষারোপ করতে লাগলো বিন্দু কেন সবার পাতা ফাঁদে পা দিলো। বিশেষ করে বেশি রাগ হচ্ছে সাজেদা বেগম আর শিশিরের ওপর। নাহ্ বিন্দু আর না থাকবে নিজের বাপের বাড়ি না থাকবে শিশিরদের বাড়ি। যেখানে তার চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই সেখানে কেন পরে থাকবে? এখন তো বাচ্চাটাও নেই তাহলে আর কিসের পিছুটান! প্রয়োজনে কাজ করে নিজের ভরোন-পোষন চালাবে। তবুও এই খুনিদের কাছে কিছুতেই থাকবে না। খুব কষ্ট লাগছে বিন্দুর। আজ অনেক বেশি মনে পড়ছে শিহাবকে। মনে মনে বলতে লাগলো,” শিহাব আমায় ক্ষমা করে দিও, পারিনি আমি তোমার আর আমার ভালোবাসার ছোট্ট ফুলটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। সবাই কৌশল করে আমাদের ফুলটাকে গোড়া থেকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।”
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হু হু করে কান্না করে দিলো বিন্দু। সাজেদা বেগম পাশেই বসে ছিলেন বিন্দুকে এভাবে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
–কী হয়েছে?”
বিন্দু কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
–মা কী করে পারলে আমার বাচ্চাটাকে এভাবে মেরে ফেলতে? বিয়ে দিয়ে দিয়েছো তবুও ক্ষান্ত হওনি তুমি, ওই অসভ্য লোকটার সাথে মিশে শেষমেশ ওকে মেরেই ফেললে!”
সাজেদা বেগম কিছু একটা বলতে যাবে তখন শিশির কেবিনে প্রবেশ করে। পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করতে পেরে শিশির সাজেদা বেগমকে কেবিনের বাহিরে চলে যেতে বললো। শিশিরকে দেখেই বিন্দু ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিলো। শিশির বিন্দুর পাশে বসে বিন্দুর হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে নিতেই এক ঝটকায় বিন্দু হাত সরিয়ে নিলো। কর্কশ গলায় বললো,
–খবরদার আপনি আমাকে ছোঁবেন না।”
–কেন?”
–লজ্জা করে না? আবার কেন জিজ্ঞেস করছেন? কেন বিয়ে করেছিলেন আমাকে? আমার বাচ্চাটাকে এভাবে সরিয়ে দেওয়ার জন্য? যখন সিঁড়ি থেকে ফেলে দিয়েও কাজ হলো না তখন অপারেশন নামক প্ল্যান তৈরী করলেন। সত্যিই ইউ আর গ্রেট মি. শিশির। আপনার এই নিখুঁত অভিনয়ের তারিফ না করে পারছি না।”
কথাগুলো শেষ করতে না করতেই আবারও বিন্দু কেঁদে ফেললো। শিশির শান্ত গলায় বললো,
–এত বেশি বুঝো কেন তুমি?”
–কী বেশি বুঝলাম?”
–এই যে বলছো বাচ্চাটা নেই।”
–যেটা সত্যি সেটাই তো বলছি।”
–উঁহু, এটা সত্যি না। বাচ্চাটা একদম ঠিক আছে।”
–দয়া করে আর মিথ্যে নাটক করবেন না। আমি আর নিতে পারছি না আপনার এত এত অভিনয়।”
–অভিনয় না সত্যি। ”
বিন্দু দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–তাহলে আমার পিরিয়ড কেন হলো? বলুন কেন হলো তাও আবার আজকেই হতে হলো কেন? যদি বাচ্চাটা নাই নষ্ট করা হয় তাহলো তো পিরিয়ড হওয়ার কথা না তবুও কেন হলো? জবাব দেন?”
–আরেহ পাগলী তোমার অপারেশন হয়েছে তো। আর ভেতরে কাটা-ছেঁড়া হয়েছে তাই ব্লিডিং হচ্ছে। ভেতরের অতিরিক্ত ব্লাড পিরিয়ডের ন্যায় নির্গত হচ্ছে এটাতে ভয়ের কী আছে? ডাক্তার এটা আগেই বলে দিয়েছে। যাতে আমরা ঘাবড়ে না যাই।”
–আমি ডাক্তারি সম্পর্কে জানি না ঠিকাছে। তাই বলে আপনার এমন অদ্ভুত যুক্তি আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। দয়া করে এই মিথ্যে কথাগুলো বলা বন্ধ করুন।”
–ওকে আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে আমি একজন নার্সকে ডেকে দেই তুমি তাকে জিজ্ঞেস করে নাও। সে আরও সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবে।”

কথাটা শেষ করেই শিশির কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো। একজন নার্সের হাতে পাঁচশত টাকার একটা চকেচকে নোট ধরিয়ে দিলো। নার্সও তার মতো করে বিন্দুকে সবটা বুঝিয়ে বললো। এখন আর অবিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই বিন্দুর। যাক এখন একটু শান্তি লাগছে তার বাচ্চাটা তার খুব কাছেই আছে কেউ তাকে আলাদা করেনি।

শিশিরও এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। তবুও কিছু চিন্তা রয়েই আছে। এখনও যে শিশিরের অনেক কাজ বাকি। আর কাজগুলো খুব সাবধানতার সাথে করতে হবে। আর বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। তবুও যদি শিশির হেরে যায় তখন আর সত্যিটা না জানিয়ে উপায় থাকবে না। তখন না চাইতেও বিন্দুকে সবটা জানাতে হবে। তখন সম্পর্ক ভেঙে গেলেও শিশিরের কিছুই করার থাকবে না। ততক্ষণে শেষ চেষ্টাটুকু করতে ক্ষতি কী? আর বিন্দুর পিরিয়ড হওয়া শিশিরের কাছে আরও একটা প্লাস পয়েন্ট। সেটা কী তা না হয় পরেই জানা যাবে!

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here