#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___৩৫ (বোনাস পার্ট)
_____________
স্বপ্নের বালুকায়, কেউ কি পা লুকায়…
যদি না আসে ভেজা দিন…
ইচ্ছের হিমালয়, হয় না কভু ক্ষয়…
হৃদয়ে থাকে অমলিন…
কিছু স্বপ্ন, কিছু ইচ্ছে
এই আমায় টেনে নিচ্ছে
তোমার কাছে বারবার….
কেউ না জানুক
আমি তো জানি আমি তোমার…
কেউ না জানুক
তুমি তো জানো তুমি আমার…
কেউ না জানুক
আমি তো জানি আমি তোমার….
কেউ না জানুক
তুমি তো জানো তুমি আমার…
মাঝরাতে নির্ঝরের কিন্নর কন্ঠের গান শুনে তরী থমকে গেল। কিছুটা সময় নিশ্চুপ হয়ে রইলো। যখন বুঝতে পারলো এত আবেগ মিশিয়ে গাওয়া গানটা শুধু মাত্র তার জন্য তখন লজ্জা পেয়ে গেল ভীষণ। এতদিনে সে বেশ বুঝতে পেরেছে যে নির্ঝরের সাথে থাকতে গেলে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তাকে লজ্জাকে আলিঙ্গন করতে হবে। এই ছেলে প্রতি পদে পদে তাকে লজ্জায় রাঙানোর জন্য ওঁৎ পেতে থাকে।
তবে এই মুহূর্তে সে অন্য কিছু চিন্তা করে নিল। তা হলো নির্ঝর সাহেবকে লজ্জায় ফেলা। হুট করে চোখ খুলে নির্ঝরকে চমকে দিবে! নির্ঝর গলা ছেড়ে গান গাইছে এটা ভেবে যে সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। নির্ঝরের আবেগমাখা গান সে শুনতে পারছে না। কিন্তু সে তো শুনে নিয়েছে সব এবং খুব করে চাচ্ছে নির্ঝরের কন্ঠে আরেকটা গান শুনতে। বন্ধ চোখে আরো কিছুক্ষণ তরী অপেক্ষা করলো নির্ঝরের পরের সুর শোনার জন্য।
কিন্তু নির্ঝর আর গান ধরলো না। সে আবছা অন্ধকারে তরীকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বেলকনি থেকে আসা সবুজ শেডের আলোর সবটা তরীর মুখে পড়েছে। তাকে এই মুহূর্তে চিরসবুজ, অম্লান, অনবদ্য লাগছে। তার ডান হাত থেকে থেকে তরীর চুল ছুঁয়ে দিচ্ছে। কখনো বা কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। কখনো বা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! আর তার ঠোঁটের কোণে বাঁধ ভাঙা হাসি।
তরীকে সে নতুন করে ফিরে পেয়েছে এগার দিন হলো। আজ দিয়ে তৃতীয় দিন হলো তাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা হয়েছে। পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় তরী এখন অনেকটাই সুস্থ। শুধু পায়ের আঘাত এখনো আছে। প্রথম কিছুদিন তরীর আচরণে ঠান্ডা আর গুরুগম্ভীরতা চলে এসেছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় চুপচাপ কাটাতো। রাতের বেলা ছটফট করতো। তার সেই অস্বাভাবিক আচরণ আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। নির্ঝর কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। গভীর দৃষ্টি মেলে তরীর দিকে চেয়ে রইলো।
একটুপর সে তরীর নাক টিপে দিয়ে বলল,
‘পাজি মেয়ে!’
সঙ্গে সঙ্গে তরী চোখ খুলল। আবছা অন্ধকার বলে চট করে নির্ঝরের চোখে পড়লো না। বুঝতে সক্ষম হলো না যে তরী চৈতন্যে আছে। তাকে আগের মতো নির্বিকার দেখে তরী নাক সিঁটকে বলল,
‘আমি পাজি মেয়ে? তাহলে আপনি কি? পাজি ছেলে!’
তরীর কন্ঠ শুনে নির্ঝর এতটা চমকে উঠলো যে এক লাফে শোয়া থেকে বসে পড়লো। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে তার। সে এক হাতে বুক চেপে ধরে বলল,
‘এভাবে কেউ কাউকে ভয় পাইয়ে দেয়?’
নির্ঝরের সাথে সাথে তরীও ধীরে সুস্থে উঠে বসলো। খাটে হেলান দিয়ে কপাল কুঁচকে নির্ঝরের দিকে তাকালো। অভিমানী কন্ঠে বলল,
‘আমি ঘুমিয়ে পড়লে আপনি আমাকে এভাবে বকা দেন? আমি পাজি, আমি গাধা, আমি গোবর, আমি বোকা, আমি পাগল, আমি আরো কত কিছু। এসব বলে বকা দেন তাই তো?’
‘হাউ ফানি! আমি এতসব কখন বললাম তরী?’
‘আপনি বলেছেন এবং আমি শুনেছি।’
‘সে কি! আমি শুধু পাজি বলেছি একটু।’
তরী দু হাত বুকের উপর ভাঁজ করে গলা উঁচিয়ে বলল,
‘পাজি? পাজি কেন বলবেন আপনি? কি করেছি আমি?’
‘আচ্ছা, স্যরি! আর বলবো না।’
নির্ঝরের গোমড়া মুখ দেখে তরী ফিক করে হেসে ফেলল। মুখে হাত হাসি আড়াল করার চেষ্টা করলো। ততটা সুবিধা করতে পারলো না। নির্ঝর এই আলো আঁধোরিতে তরীর ঝর্ণার মতো হাসির শব্দ কান পেতে শুনতে লাগলো। কি অবিচল তার ধারা। মন জুড়িয়ে যায়। এই হাসি তার বেঁচে থাকার জীবনীশক্তি। দিনশেষে এই হাসির শব্দ কানে এলে তার দেহে প্রাণ ফিরে আসে। তরী সুখে আছে, ভালো আছে এটা বুঝতে পেরে স্বস্তি পায়। বুকের গহীনে সুখ পাখিরা ডানা ঝাপটায়।
ছোট্ট করে শ্বাস টেনে সে চুপ হয়ে গেল।একটুপর অনেকটা ধমকের সুরে বলল,
‘এত রাতে এভাবে হাসছো কেন? সবার ঘুম ভাঙাবে নাকি? ‘
‘আপনাকে ভয় পাওয়াতে এত মজা লাগে!’
‘তাই বুঝি?’
‘হুঁ! এখন থেকে ঘন ঘন আপনাকে ভয় দেখাব।’
তরী কথা শেষ করে আবার হাসিতে যোগ দিল। নির্ঝর কিছুক্ষণ চুপচাপ তরীর দিকে চেয়ে রইলো। তরীকে এই মুহুর্তে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে কে প্রাধান্য দিয়ে সে তরীর দু কাঁধ আলতো করে চেপে ধরলো। তরীর চোখে চোখ রেখে বলল,
‘ডিঙিরানী! এত হাসবে না।’
তরী আরো কয়েক দফা হেসে শান্ত হয়ে গেল। বড় করে দম নিল সে। কাঁধের কাছের নির্ঝরের হাত দুটো ছুঁয়ে সরানোর চেষ্টা করলো। নির্ঝর কৌতূহল নিয়ে তাকাকে সে বলল,
‘গলা শুকিয়ে গেছে। পানি খাব। উঠতে হবে আমাকে।’
‘আমি উঠতে বলেছি? পানি আমি এনে দিচ্ছি।’
নির্ঝর তরীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সেন্টার টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে এলো। তরীর দিকে বাড়িয়ে দিল। তরী গ্লাস হাতে নিয়ে পর পর কয়েক চুমুকে অর্ধেকের একটু বেশি পানি খেল। নির্ঝরের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিতে নির্ঝর বাকি পানি টুকু শেষ করলো। তরী জানতো নির্ঝর এটা করবে। বিগত দিনগুলো সে এসব দেখে আসছে। সে এক নিঃশেষে বলল,
‘এটা করে কি শান্তি পান বলুন তো। শুনতে চাই!’
নির্ঝর গ্লাস পুনরায় টেবিলে রেখে আসলো। এবার আর বসে পড়লো না। এক লাফে বিছানায় নিজের জায়গা শুয়ে পড়লো। আড়চোখে তরীর দিকে চেয়ে বলল,
‘কোনটার কথা বলছো?’
‘এই যে সবসময় আমার খাওয়া জিনিস খেতে পছন্দ করেন।’
‘তরী তোমার মধ্যে অদ্ভুদ ক্ষমতা আছে। ঠিক যেই মুহুর্তে আমি ভেবে রাখি এটা খাব, ঠিক তখনি তুমি ওই জিনিটা খেতে চাও। এই যেমন কয়েক মিনিট আগে ভাবলাম, গলা শুকিয়ে গেছে। পানি খেতে হবে। ঠিক সেই মুহুর্তে তুমি পানি চাইলে। কি অদ্ভুত তাই না? আসলে আমার কষ্ট যাতে কম হয় সেজন্য তোমার খাওয়া পানিটুকু শেষ করলাম। আপাতত এটুকু বলো যে তোমার ঘুম ভেঙেছে কখন?’
‘আপনার গাওয়া গান শুনে ফেলেছি।’
বলেই লজ্জা মিশ্রিত চোখে তরী মাথা নিচু করলো। তারপর খুব দ্রুত নির্ঝরের পাশে শুয়ে পড়লো।
নির্ঝর চোখের দৃষ্টি সোজা উপরে দিয়ে বলল,
‘পা আগের থেকে বেটার নাকি? দেখো তো একটু নাড়াতে পারো কি না?’
তরী কিছু না বলে পা হালকা নাড়াল। তেমন ব্যথা অনুভব করলো না। তার শরীর মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছে। এখন অনেকটাই সুস্থ। এতদ্রুত তার সুস্থতা লাভের একমাত্র কারণ মানসিক প্রশান্তি। অসুস্থতার দিনগুলোতে তার বাবা-মা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ফুপিসহ সবাই এতটা সাপোর্ট আর ভালোবাসা দিয়েছে যে সে চরম বিস্মিত। কেউ তাকে হেনস্তা করেনি, কেউ একটিবারের জন্য জিজ্ঞেস করেনি সে কোথায় ছিল এতদিন? কিভাবে ছিল সে? কে তাকে অপহরণ করেছিল ইত্যাদি। কোনো প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তারা যায় নি। সবাই এত সহজে তাকে গ্রহণ করেছে আর ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে যে সে চির কৃতজ্ঞ সবার কাছে।
সে কৃতজ্ঞ নির্ঝর নামক মানুষটার কাছে। মানুষটা তাকে এমন ভাবে সবসময় আগলে রাখে যেন সে সদ্য প্রস্ফুটিত একটা ফুল। যে কি না হালকা বাতাসেই আঘাতপ্রাপ্ত হবে। ঝরে যাবে! মাঝে মাঝে তার মনে একটা প্রশ্নই জাগে। নে কি এতো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? নির্ঝর তাকে তুলনা হীন ভালোবাসে কেন?
তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের কান্না সামলানোর চেষ্টা করলো। হুট করে চোখের পর্দায় সেই পুরনো দিনগুলো ভেসে উঠলো। ভেসে উঠলো বদ্ধ কুঠুরির সেই বিভৎস্য দিনগুলো। শরীর শিউরে উঠলো তার। ভয়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। সে দ্রুত চোখ বন্ধ করে নির্ঝরের কাছ ঘেঁষে এলো।
নির্ঝর কোনো প্রশ্ন করলো না। তরীর বাহুর সাথে নিজের বাহু স্পর্শ করতে সে তরীকে এক হাতে জড়িয়ে নিল। হালকা করে টেনে তরীকে কাছে নিয়ে এসে বাম হাতে মাথার চুলে হাত ছোঁয়াতে লাগলো। আবেগ মাখা কন্ঠে বলল,
‘ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করো তরীরানী! আমি আছি!’
‘আমি আছি!’ কথাটা কানে যেতে তরী কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। সে জানে নির্ঝরের এই কথাগুলো ফাঁকা বুলি নয়। মানুষটা নিজেকে বিলীন করে দিয়ে তাকে ভালোবাসে।
তরী এক হাতে নির্ঝরের হাত চেপে ধরলো। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল,
‘আমায় আশিক কিডন্যাপ করেছিল।’
নির্ঝর তৎক্ষনাৎ বাঁধা দিয়ে বলল,
‘আমি জানি! ওসব বলতে হবে না। তুমি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ো তো! আগামীকাল একবার হসপিটালে যেতে হবে। তোমার পায়ের সেলাই কাটতে হবে। ‘
বলে নির্ঝর চুপ হয়ে গেল। তরীকে চুপ দেখে কিছুটা স্বস্তি মিলল। কিন্তু বেশিক্ষণ সে শক্তি রইলো না। তরী নিজেকে সামলে বলল,
‘আমায় বাঁধা দিবেন না প্লিজ। বলতে দিন।’
‘তরী আমি দ্বিতীয় বারের মতো বলছি তোমাকে ফিরে পেয়েই কৃতজ্ঞ আমি । তোমার সাথে কি হয়েছে ওসবে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। তবুও তোমার মনের ভার কমানোর জন্য যদি বলতে চাও তাহলে বলবে। কিন্তু খবরদার! নো কান্নাকাটি।’
কিছু বলার আগেই তরী কান্না শুরু করে দিল। খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘সেদিন পরীক্ষা শেষ হতেই আশিকের ফাঁদে পা দিই। এক মেয়ে ভন্ডামি করে আমাকে আমার কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি আশিক!’
(চলবে)…..
একদম ছোট হয়ে গেছে। কাল দুপুুরের পর্ব ইনশাআল্লাহ বড় হবে। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। 🤎