তবু_সুর_ফিরে_আসে ১ম পর্ব

0
828

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

১ম পর্ব

ঝড়ের বেগে কালো ল্যান্ড ক্রুজার টা ঢাকার দিকে ফিরছে । রাত নয়টা বাজে । গাড়িটা এখন সিরাজগঞ্জ দিয়ে ঢাকার দিকে যাচ্ছে। ড্রাইভিং সিটে অনেক বছর পর যে বসে আছে তার ভেতরের ঝড় সহজেই অনুমেয় তার গাড়ি চালানোর স্পীড দেখে। আর কেউ না বুঝলেও অনেক বছর ধরে তার গাড়ি চালায় ড্রাইভার বাহার পাশের সিটে বসে ঠিক‌ই বুঝতে পারছে! বাহার সিট বেল্ট টা বেঁধে শক্ত হয়ে বসে আছে! মনে মনে যত দোয়া দরুদ জানে সব আওড়াচ্ছে ! গাড়ি কখন যে বেসামাল হয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে স্যার, বাহার সেই আতংকে অস্থির হচ্ছে!
তার স্যার কেন আজ এরকম আচরণ করছে এই মুহূর্তে সে ছাড়া আর কেউ জানে না ! আজ যে ঘটনা স্যারের সঙ্গে ঘটে গেল এরকম কোন কিছুর জন্য তার স্যার কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না ! আসলেই সব কপালের লিখা , তা না হলে কি স্যার হঠাৎ ই এরকম একটা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাবেন ! পুরাই সিনেমার মত ঘটনা ঘটে গেল স্যারের সাথে!
বাহার একবার পিছনে তাকালো । পিছনে ফিরতে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে! কারণ পিছনের সিটে যে বসে আছে স্যারের পাশে বসে তার দিকে তাকাতে বাহারের খুব দ্বিধা কাজ করছে !
কিন্তু তার মনে হচ্ছে পিছনে যে বসে আছে তার কোন একটা সমস্যা হচ্ছে ! অনেক বছর সে গাড়ি চালায় , সামনের সিটে বসে থেকেও পিছনের সিটে কেউ মনে মনে গাড়ি থামানোর কথা চিন্তা করলেই তার কেন জানি মনে হয় সে বুঝতে পারে ! আজ এই মুহূর্তে পিছনের সিটে যে বসে আছে তাকে সে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে দেখেছে !
বাহার এখন শিওর যে পেছনে সমস্যা হচ্ছে এবং বমি করতে চাইছে মনে হয় !
বাহার স্যারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে মুখে কিছু বলতে পারছে না ! স্যার কে সে জমের মত ভয় পায় , যদিও স্যার খুব হাসিখুশি মানুষ কোন দিন কাজের লোকজনের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখেনি বাহার! স্যারের বাসায় আছে সে আজ অনেক বছর। যখন সে আসে তখন তার বয়স ছিল পনের , ষোলো বছর । বাসার ফরমাইশের কাজ করতো ! দোকান থেকে যখন যা লাগে আনা , স্যারের আব্বার শরীর টিপে দেয়া, বাগান পরিষ্কার করা, গাড়ি ধোয়া একদিন গাড়ি ধোয়ার সময় গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালানোর ভঙ্গি করছিল তখন স্যার দেখে ফেলেছিল ! খুব ভয়ে ভয়ে সে গাড়ি থেকে নেমে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ! স্যার হেসে বললেন সেদিন, গাড়ি চালাতে চাস নাকি ?
বাহার চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল! তখন ই স্যার ড্রাইভার নিয়ামত চাচাকে ডেকে বলল, তোমার ভাইয়ের ছেলে না এটা নিয়ামত ?
স্যার আমার ভাইয়ের ছেলে !
ওর মনে হয় গাড়ি চালানোর খুব শখ , এক কাজ করো ওকে হাবিজাবি কাজ না দিয়ে ড্রাইভিং শিখাও । যে কাজটা ভালোবাসা নিয়ে করবে সেই কাজ টা করতে দেয়াই ভালো ! ভবিষ্যতে ড্রাইভার আরো দরকার হবে আমার ঠিক আছে !
সেই থেকে সে নিয়ামত চাচার কাছে গাড়ি চালানোর শিখেছে ! আজ অনেক বছর সে বড় স্যারের গাড়ি চালায় ! অবশ্য বাসায় এখন স্যারের গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি বের হয় না । হঠাৎ হঠাৎ স্যারের আব্বা ডাক্তারের কাছে গেলে অন্য গাড়ি যায় সেটা চালায় নিয়ামত চাচার ছেলে তার‌ই চাচাত ভাই সবুজ।
সে এই বাসায় আসার পর স্যারের বাসা একরকম ছিল এখন আরেক রকম !
হঠাৎ বাহার বুঝতে পারছে এখন‌ গাড়ি থামাতেই বলতে হবে, তা না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে !
বাহার কিছু বলার আগেই ন‌ওশাদ আজমী গাড়ি সাইড করে আচমকা ব্রেক করলো! বাহার বিদ্যুৎ এর বেগে সামনের সিট থেকে নেমে পিছনের দরজা খুলে দিল! পিছনের সিটে যে বসে ছিল গাড়ি থেকে নামতে নামতেই হরহর করে বমি করে দিল!
এই অবস্থা হবে বাহার আগেই বুঝেছিল ! মানুষ টা বমি করেই যাচ্ছে! গাড়িতে উঠে অভ্যাস নাই ! এসি গাড়ি অনেকেই সহ্য করতে পারে না !
ন‌ওশাদ আজমী দরজা খুলে নামলেন ! সামনে রাস্তার পাশে একটা টং দোকান দেখা যাচ্ছে ।
বাহার কাছে এসে বলল,
স্যার এই জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না ! এসব এলাকায় ডাকাতি হয়!
বাহারের দিকে চোখ তুলে তাকালো ন‌ওশাদ ,
গাড়িতে পানির বোতল আছে ?
আছে স্যার, আনতেছি ! বাহার দৌড় দিল পানির বোতল আনতে !
শোন বোতল আমাকে না বমি করছে যে তাকে দাও !
ন‌ওশাদ রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে ঢুকলো ! সিগারেট কিনে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই জ্বালালো। আজ অনেক বছর পর সে সিগারেট খাচ্ছে !
গীতি তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর সে কখনো সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি ! দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পেছনে তাকাতেই অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে ড্রাইভার বাহার বোতল থেকে পানি ঢালছে আর যে বমি করেছে সে মুখ ধুচ্ছে !
হঠাৎ একটা গাড়ির হেড লাইট এর আলো পড়তেই সে এই প্রথম মানুষ টার মুখ টা দেখলো !
ন‌ওশাদ একটা ধাক্কার মত খেলো !
এত সুন্দর একটা মুখ !
এত মায়া করা চোখ ঠিক যেন গীতি আরার চোখ গুলোর মত ! প্রথম যখন দেখেছিল এক ঝলক বোরকার আড়ালে চেহারা সে দেখতে পায়নি ! নেকাবে মুখ ঢাকা শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছিল । তখন‌ই তার মনে হচ্ছিল এই চোখ সে কোথাও দেখেছে ! খুব চেনা চোখ!
এখন সে বুঝতে পারছে এই চোখ তো তার গীতির চোখের মত ! পুরাই যেন গীতির চোখ দুটো দেখতে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ন‌ওশাদ ! মেয়েটি বোরকা খুলে ফেলে দিল ! বোরকায় মনে হচ্ছে বমি লেগেছে ! অতি সাধারণ একটা সেলোয়ার কামিজ পড়া ।
কিন্তু একি!
মেয়ের তো বয়স নিতান্তই কম ! পঁচিশ ও হবে না হয়তো ! অসম্ভব রূপবতী একটি কম বয়সী মেয়ে কেই তো সে দেখছে সামনে !
ন‌ওশাদ নিজের চোখ কেও বিশ্বাস করতে পারছে না !
ড্রাইভার বাহার ও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে !
ন‌ওশাদ এর খুব অস্বস্তি হচ্ছে ! সে এতক্ষন একটা ঘোরের মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছিল। সন্ধ্যার ঘটনার পর তার মাথা কোন ভাবেই কাজ করছে না ! কিন্তু বোরকার আড়ালে যে নিতান্তই বাচ্চা বয়সী একটি মেয়ে ছিল, সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি!
ন‌ওশাদ বাহারকে ডাক দিল !
বাহার একটু হকচকিয়ে গেল ! দৌড়ে সে ন‌ওশাদের কাছে এসে দাঁড়ালো !
বাহার, উনাকে জিজ্ঞাসা করে এসো কিছু খাবে কিনা ?
জ্বি স্যার আমি জিজ্ঞেস করছিলাম ! খাইলে বমি হবে বলছে!
মেয়েটি ওড়নার কোনা দিয়ে মুখ মুছে ওড়না দিয়ে গা ঢেকে দাঁড়ালো গাড়ির পাশে !
ন‌ওশাদ অন্য দিকে ফিরে সিগারেট শেষ করলো ! কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে গিয়ে উঠলো !
বাহার কে ইশারা করলো এখন ড্রাইভ করতে ! নিজে সামনের সিটেই বসলো ! মেয়েটি কে গাড়িতে বসিয়ে এসে বাহার গাড়ি স্টার্ট দিল !
জানালা খুলে রাখো উনার মনে হয় খারাপ লাগছে !
বাহার অবাক হলো স্যার কখনো গাড়ির জানালা খুলে রাখে না ! ধুলো বালি সহ্য হয় না স্যারের ! বাহার সব গুলো গ্লাস নামিয়ে দিল ! তীব্র গতিতে গাড়ি ছুটে আসছে ঢাকার দিকে !
ন‌ওশাদ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছে আজকের দিনটা র কথা ! তার জীবনে এরকম একটা সিনেম্যাটিক ঘটনা ঘটে যাবে সে কখনো কল্পনাও করেনি! জীবন তাকে আজ পর্যন্ত দুই হাত ভরে দিয়েছে ! বন্ধু পরিচিত মহলে সে পরিচিত সেল্ফ মেইড পার্সন হিসেবে ! এক সময় শূন্য হাতে জীবন শুরু করেছিল সে ।
আজ সে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ন‌ওশাদ আজমী ! ব্যবসায়ী মহলে যার উচ্চ স্থান ! একজন সিআইপি ! একটা সময় নিজের কিছুই ছিল না তাঁর!
সঙ্গে ছিল শুধু গীতি ! তাঁর গীতি আরা !

ক্যাডেট কলেজের ক্লাস সেভেনের দ্বিতীয় পেরেন্টস ডে তে প্রথম দেখা গীতির সঙ্গে তার । গীতি এসেছিল তার বাবা মায়ের সঙ্গে বড় ভাই ফাহমিদ যে কিনা ন‌ওশাদ এর দুই ক্লাস সিনিয়র ছিল তাকে দেখতে !
প্রতিটা পেরেন্টস ডে তে গীতি আসতো তার পরিবারের সঙ্গে। ন‌ওশাদ গীতিকে দেখতো, ক্লাস এইটে যখন পড়ে গীতির সঙ্গে প্রথম কথা হয় , পরিচয় হয় । ওরা ক্লাসমেট ছিল। ন‌ওশাদ এর ক্লাসমেট ক্লোজ ফ্রেন্ড মুহিব ছিল গীতির ফুফাতো ভাই । তার কাছে ই প্রথম ন‌ওশাদ গীতিকে পছন্দ করে সেই কথা জানিয়েছিল! এর পর পরপর দুটো পেরেন্টস ডে তে গীতি আসেনি ! মুহিবের কাছ থেকেই জেনেছিল সে গীতির টাইফোয়েড হয়েছে ! পরের ছুটিতেই মুহিব দের ঢাকার বাসায় বেড়াতে এসেছিল ন‌ওশাদ । ন‌ওশাদের বাবার পোস্টিং তখন খুলনায় ! অনেক আবদার করে সে একা ঘুরতে এসেছিল ঢাকায় বন্ধুর বাসায়। শুধুই গীতির জন্য আসা । গীতি কে নিজের মনের কথা বলেছিল নিজেই ! মুহিবের কাছ থেকে আগেই জেনেছিল গীতি ,কেউ একজন তাকে দেখার জন্য প্রতি মাসে অপেক্ষা করে ক্যাডেট কলেজে বসে ! গীতি ও পছন্দ করে ন‌ওশাদ কে ! কৈশোরের প্রেম, কেউ কাউকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি । সেই থেকে ন‌ওশাদ আর গীতি একসঙ্গে জীবনের প্রতিটি দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ ভাগ করে নিয়েছে !
সিনিয়র ভাইয়ের বোন কে পছন্দ করার জন্য কত নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করেছে ক্যাডেট কলেজে ন‌ওশাদ, সেটা গীতিকে বলতে পারেনি কষ্ট পাবে বলে ! কিন্তু তবু সে গীতির প্রতি আগ্রহ এক বিন্দু হারায়নি ! খুব ইচ্ছা ছিল পাইলট হবে, এয়ার ফোর্স এ যাবে। কিন্তু গীতির কাছ থেকেই শুনেছিল তার মায়ের শখ ইন্জিনিয়ার পাত্রের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবেন তিনি ! নিজের স্বপ্ন কে বাদ দিয়ে সে গীতিকে পাওয়ার জন্য বুয়েটে আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু তবুও গীতির বাবা মায়ের মন মত হয়ে উঠতে পারেনি । থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়ই তারা গ্রীন কার্ড ধারী খালাতো ভাইয়ের সাথে গীতির বিয়ে ঠিক করে ফেলে ! অনেক চেষ্টা করেছিল গীতি বিয়েটা আটকানোর ! কিন্তু পারেনি ! ততদিনে গীতির বড় ভাই ও ন‌ওশাদ আর গীতির ব্যাপার টা মেনে নিয়েছিল , কিন্তু তার কথাও গীতির বাবা মা কানে তুলেনি । অগত্যা বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে যাওয়ার পর গীতি বাসা থেকে পালিয়ে চলে আসে ন‌ওশাদ এর কাছে। ন‌ওশাদ তাকে ফিরিয়ে দেয়নি, সেই মুহূর্তে গীতিকে বিয়ে করে সে !
গীতির বাবা মা অনেক ঝামেলা করে কিন্তু ন‌ওশাদ এর বাবা মা গীতিকে ব‌উ হিসেবে মেনে নেয় ! ন‌ওশাদ এর বড় বোন আর বোন জামাই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে গীতির বিষয়ে। প্রথম ছয় মাস গীতি ছিল ন‌ওশাদের বড় বোনের বাসায় ! তার পর ন‌ওশাদের মিরপুরে র বাসায় গীতি থাকতো ! ন‌ওশাদের মা সারা জীবন বার মাসের রোগী ছিলেন। গীতি শ্বাশুড়ির সেবা করতো খুব। নিজের পড়াশোনা র ফাঁকে সংসার সামলাতে হত গীতিকে।
ন‌ওশাদ এর পড়াশোনা যখন শেষ হলো চার বন্ধু মিলে আর্কিটেকচার ফার্ম খুলে তারা !
ন‌ওশাদ এর বাবা ছিল সাব রেজিস্ট্রার ! অনেক অবৈধ টাকা তিনি যে গড়ে ছিলেন, ভার্সিটিতে পড়া অবস্থাই ন‌ওশাদ বুঝতে পারে ! তখন ই রিটায়ার্ড করে বাবা ঢাকার মিরপুরে নিজেদের চার তলা বাড়িতে এসে উঠে। ন‌ওশাদ জানতোই না ঢাকা শহরে তাদের নিজেদের বাড়ি আছে! বাবা মায়ের বড় ছেলে হলেও বাবার সঙ্গে ন‌ওশাদ এর হৃদ্যতা, শখ্যতা তৈরি হয়নি। সে সব সময় বাসার বাহিরে বাহিরে ছিল। ন‌ওশাদ এর ছোট আরো দুই ভাই । তারা তখন কলেজ , ভার্সিটিতে পড়ে।
একদিন এক ক্যাডেট কলেজের বন্ধুর পরামর্শে সে গার্মেন্টস ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। ওখন দেশে গার্মেন্টস ব্যবসা উল্কার বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। ন‌ওশাদ এর কাছে টাকা ছিল না । গীতি তার গয়না বিক্রি করে টাকা দেয়। শ্বাশুড়ি র কাছ থেকে অনেক গয়না পেয়েছিল গীতি। শ্বাশুড়ি র অনুমতি নিয়েই বিক্রি করেছিল সব। ততদিনে ন‌ওশাদ এর অসুস্থ মা গীতি বলতে অজ্ঞান । তিনি গীতির কাছ থেকে শুনে নিজের নামের অনেক জমি ছিল সে গুলো বিক্রি করে টাকা ন‌ওশাদ এর হাতে তুলে দেন ব্যবসার জন্য !
ন‌ওশাদ এর ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন এক গার্মেন্টস ব্যবসা করে তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পাঁচ বছরে সে অনেক উপরে উঠে যায়। এর পিছনে ছিল তার দিন রাতের পরিশ্রম । ততদিনে গীতির আর তার কোলে জন্ম নেয় তাদের এক মাত্র সন্তান তাদের ছেলে নিশাল !
ন‌ওশাদ গার্মেন্টস ব্যবসার পাশাপাশি রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করে সেখানেও সে সফল। ঢাকার নামকরা হাউজিং কোম্পানি তার।
আজ সে একজন সফল গার্মেন্টস , রিয়েল এস্টেট, সিরামিকস ব্যবসায়ী । স্বপ্নের মত উত্থান তার সফলতার ! বাবার মিরপুরে র বাড়ি ছেড়ে বহু বছর আগেই বাবা মা কে নিয়ে বনানীর প্রাসাদের মত বাড়িতে এসে উঠে সে । অসুস্থ মা তার সাফল্যের কিছু অংশ দেখেই মারা যায়। ভাই রা একজন তার ব্যবসায় জড়িত । ছোট ভাই টা ডাক্তার। বৃদ্ধ বাবা আছে তার সঙ্গে ! জীবন তাকে উজাড় করে দিলেও কেড়ে নিয়েছে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ , সবচেয়ে বড় প্রেরণা তার ভালোবাসা , তার গীতিকে ! ছয় বছর আগে গীতি তাকে একা করে না ফেরার দেশে চলে যায়।
সেই থেকে ন‌ওশাদ এক নিঃসঙ্গ মানুষ !
বৃদ্ধ বাবা , একমাত্র ছেলে নিশাল কে নিয়ে এখন তার জীবন ! টাকার পিছনে, সাফল্যের পিছনে ছুটে নিজের ভেতরে র কষ্ট, একাকীত্ব টা কে লুকিয়ে রাখে সযত্নে !
গীতি তার সব আনন্দ, সুখ নিয়ে চলে গেছে কিন্তু গীতি যেমন চাইতো ন‌ওশাদ ভালো থাকুক ন‌ওশাদ এখন নিজেকে সেভাবেই রাখে।
এই যে আজ সিগারেট খেলো গীতি যাওয়ার পর এই প্রথম সিগারেট এ হাত দিল। গীতি থাকতে কত বাঁধা দিত, বকাঝকা, রাগা রাগী করতো কিন্তু ন‌ওশাদ শুনেনি। কিন্তু গীতি চলে যাওয়ার পর সে গীতির ইচ্ছা মত জীবনটা কাটায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া , হিসেব করে খাওয়া, রাত দশটার মধ্যে বাসায় ফিরে আসে , যত ব্যস্ত‌ই থাকুক আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ নেয়া, সপ্তাহে একটা দিন বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে বসে সময় কাটানো এখন সব‌ করে ন‌ওশাদ ! গীতির হাতে গড়া সাজানো সংসার টাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। ওর আশেপাশে র সবাই ভেবেছিল গীতি যাওয়ার পর ও ভেঙ্গে পড়বে কিন্তু ন‌ওশাদ গীতির স্বপ্ন গুলোর কাছ থেকেই শক্তি নিয়ে নিজেকে পাথরের মত শক্ত করে রেখেছে।
শুধু ছেলেটার মনের কাছে ঘেঁষতে পারেনি !
মায়ের কাছ ঘেঁষা নিশাল মায়ের মৃত্যুর পর বাবার কাছে আসেনি !
কোথায় ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে জীবন কাটাবেন না সেই ছেলে পাঁচ বছর আগে ক্যাডেট কলেজে চলে যায়। ন‌ওশাদ এর কোন ইচ্ছা ছিল না ছেলে কে নিজের কাছ থেকে দূর করার কিন্তু ছেলে জিদ করে বসেছিল এটা নাকি তার মায়ের ইচ্ছা ছিল । অগত্যা ন‌ওশাদ কে রাজি হতেই হলো !
ছেলে ক্যাডেট কলেজে তিন মাসে কিছুদিনের জন্য আসে ছুটিতে বাসায়।
তখন কখনো কখনো জোর করেই ছেলেকে নিয়ে দেশের বাহিরে ঘুরতে যায় সে । কোন কোন ছুটিতে পড়াশোনা র বাহানা দেখিয়ে ছেলে যেতে চায় না ! ন‌ওশাদ হাজার চেষ্টা করেও ছেলের মনের কাছে ঠাঁই পায় না !
এটা তার বড় আক্ষেপ!
হঠাৎ গাড়ি জোরে ব্রেক ধরাতে ন‌ওশাদ এর ভাবনায় ছেদ পড়ল!
কি হলো বাহার ?
স্যার উনার মনে হয় আবার বমি হবে !
ও আচ্ছা ! আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে সামনে বসেই ন‌ওশাদ প্রশ্ন করলো ?
পিছনে কোন সাড়াশব্দ নেই !
ন‌ওশাদ উত্তরের অপেক্ষা করলো না ! বাহারের দিকে তাকিয়ে বলল , আর কতক্ষন লাগবে ঢাকা পৌঁছাতে ?
স্যার আমরা উত্তরায় ঢুকব এখন আব্দুল্লাহপুর সামনে !
মেয়েটি চোখে মুখে পানি দিল জানালা দিয়ে মাথা বের করে ।
এখন ঠিক আছেন ?
জ্বি ! এই প্রথম মেয়েটির গলার শব্দ শুনলো ন‌ওশাদ!
স্টার্ট করো !
বাহার গাড়ি স্টার্ট করলো । কিন্তু তার মনে একটা বিরাট প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্যার কি এই মেয়ে কে নিয়ে বাসায় যাবে , নাকি আর কোথাও ব্যবস্থা করে দিবে ? কিন্তু এই প্রশ্ন করার সাহস ওর মনে জীবনে ও আসবে না !
গাড়ি উত্তরা দিয়ে বনানীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ! ন‌ওশাদ এখনো কিছু বলছে না !
বনানী ফ্লাইওভারের উপর এসে বাহার অনেক সাহস সঞ্চয় করে ন‌ওশাদ কে প্রশ্ন করেই ফেলল ,
স্যার কোথায় যাব ?
কোথায় যাব মানে , এত রাতে আর কোথাও যাওয়ার কথা নাকি বাসায়ই যাব !
না মানে স্যার উনাকে নিয়েই বাসায় যাব ?
বাহার সবাই বাসায় যাবে !
স্যার !
গাড়ি কিছুক্ষণ পরেই বনানী কবরস্থান রোড পাড় হয়ে ন‌ওশাদের চার তলা বাড়ি ‘ গীতিময় ‘ এ এসে ঢুকলো!
গাড়ি থামতেই কেয়ারটেকার রিয়াজুল দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল!
ন‌ওশাদ গাড়ি থেকে নেমে রিয়াজুল কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
রিয়াজ পিছনে বসা উনাকে দোতলার গেস্ট রুমে নিয়ে যাও ! আনারের মা কে ডেকে বলো উনার দেখাশোনা করতে !
জ্বি স্যার !
ততক্ষণে মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে !
রিয়াজুল মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
আপনি আমার সঙ্গে আসুন !
মেয়েটি মাথা নিচু করে রিয়াজুলের পিছনে এগিয়ে যাচ্ছে!
ন‌ওশাদ পিছন থেকে ডাকলো ,
শুনুন ! আপনার নাম টা ভুলে গেছি!
মেয়েটি দুই পা ন‌ওশাদ এর দিকে এগিয়ে এসে মাথা নিচু করেই বলল,
জ্বি, হেরা !
কি নাম ?
হেরা ! পবিত্র মক্কা নগরীর হেরা গুহার নামে নাম !
ন‌ওশাদ অবাক হয়ে দেখছে মেয়েটির চোখ দুটো , বড় বড় পাপড়ি ! অবিকল গীতির চোখ! মনে হচ্ছে গীতি তাকিয়ে আছে ওর দিকে ! এটা কি ওর মনের ভুল ! বুঝতে পারছে না ! কি অপরূপ সুন্দর একটা গোল মুখ , ধারালো নাক ! গ্রাম্য একটা মেয়ে কিন্তু চোখের চাহনি কত গভীর!
ঠিক আছে রিয়াজের সঙ্গে যান আপনি !
জ্বি বলে হেরা এগিয়ে যাচ্ছে !
আবার পিছনে ডাকলো ন‌ওশাদ ! আর একটা কথা আপনার বয়স টা কত বলবেন কি ?
ন‌ওশাদ এর দিকে না তাকিয়েই হেরা বলল, এ বছর বাইশ হবে !
ন‌ওশাদ একটা ধাক্কার মত খেলো ! তার মনে হচ্ছে সে ভুল শুনছে !
মুখে শুধু বলল, ঠিক আছে যান !
হেরা রিয়াজের সঙ্গে দোতলায় উঠে গেল !
ন‌ওশাদ আগের মত দাঁড়িয়ে আছে ! একটু দূরে বাহার দাঁড়িয়ে আছে ! ওর দিকে চোখ পড়তেই বাহার কাছে এসে দাঁড়ালো !
যাও বাহার রেস্ট নাও অনেক বড় জার্নি করে এসেছো !
এক রকম অস্বস্তি নিয়ে ন‌ওশাদ দোতলায় নিজের রুমে এসে ঢুকলো!
ফ্রেশ হয়ে ওয়াস রুম থেকে বের হতেই দেখে বেড রুমে গীতির ছোটবোন বিথী দাঁড়িয়ে আছে !
অবাক হয়ে গেল এত রাতে বিথীকে এই বাসায় দেখে ন‌ওশাদ !
তুমি এখানে , এত রাতে !
দুলাভাই আপনি এতো রাতে কোথা থেকে আসলেন ?
আমি খুলনা গিয়েছিলাম একটা কাজে কিন্তু তুমি এত রাতে এই বাসায় কি করছো রাত প্রায় একটা বাজে ?
আপনি ভুলে গেছেন আজ নিশালের পেরেন্টস ডে ছিল ! আমি ছাড়া কেউ তো আর ছেলেটার খবর রাখে না ! আমি গিয়েছিলাম ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল ! তাই আর বাসায় গেলাম না মেয়েদের নিয়ে এখানেই থেকে গেলাম !
ও আচ্ছা , তোমাকে কতদিন বলেছি ওর পেরেন্টস ডে তুমি শোয়েব এর কাছে নোট করিয়ে রাখবে ।
শোয়েব জানত দুলাভাই এবং দুই দিন আগে সে আপনাকে বলেছেও !
ঠিক আছে ভুলে গেছি খুব ব্যস্ত ছিলাম । আর খুলনা যাওয়াটা জরুরি ছিল !
নিশালের চেয়েও বেশি জরুরি দুলাভাই ?
এই সব কিছু যা করছি আমার নিশালের জন্য‌ই বিথী !
বিথী চুপ করে আছে !
কেমন আছে নিশাল ?
ভালো আছে ! মুখে কিছু না বললেও সে আপনাকে চায় পেরেন্টস ডে তে দুলাভাই !
ছুটি কবে তার ?
আগামী মাসে লম্বা ছুটি তে আসবে !
ঠিক আছে ! যাও তুমিও জার্নি করে আসছো, যাও রেস্ট নাও ! আর থেঙ্কস বিথী !
থেঙ্কস এর কিছু নেই আপনার জন্য করি না কিছু সব আপা আর নিশালের জন্য ই করি !
তারপরও থেঙ্কস তোমাকে !
গীতি চলে যাওয়ার পর এই বাসা কখনো ন‌ওশাদ এর দুই শালী বিথী আর যুথীর কথায় চলে কখনো ন‌ওশাদের ছোট দুই ভাইয়ের ব‌উ এসে মাতব্বরি করে ! ঘরের আসল গৃহিণী না থাকলে যা হয় আরকি ! নিশাল তার ছোট খালা বিথীর খুব ক্লোজ তাই বিথীর প্রতি এই বাসার সবাই আজ্ঞাবহ হয় খুব! ন‌ওশাদ ঐ সব নিয়ে মাথা ঘামায় না !

বিথী একটু পর উত্তেজিত হয়ে আবার রুমের দরজা খুলল !
ঘরে না ঢুকে বাহির থেকেই ন‌ওশাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল ,
এই মেয়ে কে দুলাভাই ? আপনি এই মেয়ে কে কোথায় থেকে আনলেন ?
কি সমস্যা বিথী ?
আশ্চর্য এই বয়সী একটা মেয়ে এই বাসায় কেন ? বাসা ভর্তি কাজের মানুষ আর কাজের লোকের তো দরকার নেই ?
ন‌ওশাদ রুমের বাহিরে এসে দাঁড়ালো ! বাসার সকল কাজের মানুষ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ! যেখানে সবার দোতলায় উঠার ও অনুমতি নেই একেবারে এই মুহূর্তে সব এসে গেছে বিথীর উত্তেজিত রূপ দেখে ! হেরাও গেস্ট রুমের দরজায় আনারের মায়ের সঙ্গে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে!
মেয়েটা লজ্জা এবং ভয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে!
গেস্ট রুমে যখন থাকতে দিয়েছি তার মানে সে কাজের লোক শ্রেণীর কেউ না বিথী !
বুঝলাম, কিন্তু আমি জানতে চাইছি দুলাভাই মেয়েটি কে ?
তোমার জানা কি জরুরী ?
কি আশ্চর্য অবশ্যই জরুরি ! এই বাসায় একজন অপরিচিত মানুষ আসছে আমার জানা তো অবশ্যই জরুরি দুলাভাই ! আপা মারা যাওয়ার পর এই বাসার ভালো মন্দ আমি খেয়াল রাখছি যেহেতু, আমাকে জানতে হবে মেয়েটা কে ?
কোথা থেকে আপনি এত রাতে ওকে নিয়ে আসলেন ? এবং কেন আনলেন ? অযাচিত , অহেতুক যে কাউকে এই বাসায় রাখার তো দরকার নেই! আপনি থাকেন না সারাদিন বাসায় , কয়দিন পর পর বিদেশ চলে যান তখন অপরিচিত মানুষ এই বাসায় কি করবে না করবে তার খেয়াল কে রাখবে ?
বিথী রাগে গজগজ করছে !
ন‌ওশাদ বিথীর দিকে তাকিয়ে খুব ঠান্ডা গলায় বলল,
ওর নাম হেরা ও আমার স্ত্রী !
আমার মনে হয় সবার মনে যা যা প্রশ্ন ছিল সবাই উত্তর পেয়ে গেছো !
আনারের মা উনাকে খাবার খেতে দাও উনার যত্নের যেন কোন কমতি না হয় !
বিথী বাজ পড়া মানুষের মত ন‌ওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে !
আশেপাশের লোকজনের ও সেই অবস্থা !
ন‌‌ওশাদ নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল ! কারো কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ইচ্ছে করছে না তার !
আজ সে অনেক ক্লান্ত শারীরিক এবং মানসিক ভাবে।

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here