লীলাবালি🌺 #পর্ব_১৮

0
734

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_১৮
আফনান লারা
.
কুসুমকে বিদায় দিয়ে অর্ণবের বাবা মা চলে গেছেন।মাথা মুছে অনেক দোয়া করে দিয়েছেন তারা।হয়ত আর কখনও দেখা হবেনা ওর সাথে,ভারত চলে যাবার পর ফের কবে আসা হবে তা তো কারোর জানা নেই।
কুসুম পায়ের ব্যাথা নিয়ে জানালার পাশে বসে ছিল।।সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে তখন।
কলি পাশের রুমে পড়ছে।মা বাবা বাহিরে কি নিয়ে যেন কথা বলছেন।কিঞ্চিত অন্ধকার হলেও আকাশে চাঁদ।ভরা চাঁদ।
চাঁদের আলোয় সব কিছুর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পেয়েছে আপন গতিতে।
পুকুরে মাছদের আনাগোনার শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়।গাছের পেছনে দূর আকাশে চাঁদ।গাছের ঢাল নড়লে মনে হয় চাঁদ বুঝি লুকোচুরি খেলছে।এসময়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বসতে মন চাইছিল খুব করে।কিন্তু যাওয়া তো সম্ভব না।পায়ে যে অনেক ব্যাথা।
বাবা মা কলিকে ডেকে বললেন কুসুমের পাশে থাকতে।তারা একটু মেইন রোডের দিকে যাবে একটা কাজে।
কাজটা হলো ওখানে এককন তাদের অপেক্ষা করছেন।একজন সাংবাদিক।সাংবাদিক উনাদের থেকে ঐ দস্যুদের ব্যাপারে খবর নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখবেন।কুসুমদের বাড়িতে যেতে মাটির রাস্তা বের হতে হয়।নির্জন এলাকা হলেও উনার আসতে অসুবিধা হতোনা কিন্তু উনি আসলে পাড়া প্রতিবেশীর কানে খবরটা চলে যেতো।ফলে বাতাসের গতিতে আমির তিয়াজির কানেও যেতো সাংবাদিকের কথা।এর কারণে তারা নিজেরা মিলে ঠিক করেছে তারাই যাবেন মেইন রোডের দিকে।
কলি বই নিয়ে কুসুমের পাশে বসে পড়ছে।মা বাবা যাবার ঠিক পনেরো ষোল মিনিট পর দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়ে কুসুম বই রেখে এক ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।সে ভেবেছিল মা বাবাই এসেছে।তাই জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলোনা।
দরজা খুলে দেখলো চার /পাঁচ জন দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।তিনজন মহিলা,দুজন পুরুষ।হাতে আগুনের মশাল।
কলি ভয় পেয়ে কুসুমের দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো।কুসুম জানালার দিকে চেয়ে বসে ছিল অন্যমনস্ক হয়ে।মহিলা তিনজন কলিকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,’কুসু মা কেমন আছে?তার নাকি পায়ে ব্যাথা’

কুসুম চমকে তাদের দিকে তাকালো।আমির তিয়াজির মেয়ে,পুত্রবধূ আর তার মা এসেছেন কুসুমকে দেখতে।কুসুম তাদের কাউকেই চিনতে পারলোনা।সালাম দিয়ে চুপ করে থাকলো।বাহিরে ছিল আমির তিয়াজি আর তার ছেলে মিঠু তিয়াজি।
কুসুমের পাশে মহিলা তিনজন বসলেন।কুসুম তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’আপনারা কারা?চিনলাম না তো’

-“চিনবে কি করে।কখনও তো দেখোনি।দেখি তোমার ভালো হাতটা দাও তো’

কুসুম হাত দিলোনা।জিজ্ঞেস করলো কি কারণে হাত দেবে।আমির তিয়াজির মেয়ে মুন্নি জোর করে কুসুমের হাত টেনে ধরে একটা স্বর্নের বালা পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,’এইটা তোমার উপহার’

কুসুম হাতের বালাটা দেখলো অনেক মোটা আর ভারী।আগামাথা কিছুই বুঝলোনা সে।বালাটা খুলতে খুলতে বললো,’আপনারা কে?’

মুন্নি তিয়াজি এক ধমক দিলেন ওকে।শেষে বললেন,’আমি তোমার মুরব্বি! যত্ন করে বালা পরিয়ে দিয়েছি খুলে ফেলার জন্য?ওটা হাতে পরে থাকো।বেয়াদবি করবেনা।’

কলি মুখে হাত দিয়ে সব দেখছে আর বারবার বাহিরে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে বাবা মায়ের।
কুসুম ধমক শুনে চুপ হয়ে গেছে।মুন্নি তিয়াজি একটা সোনালি রঙের ওড়না কুসুমের মাথায় পরিয়ে দিয়ে বললেন,’দেখছো তোমরা! কেমন মেয়ে পছন্দ করেছি আমি?’

বাকি দুজন হাসলেন।একজন বললেন,’এটা ঠিক করলেনা।আমার ও তো জেয়ান দুটো ছেলে আছে।সুন্দরটা তুমি নিয়ে গেলে কি করে হয়?’

-“সে যাই বলো,আমি এরে ছাড়ছিনা।তোমরা দরকার হলে এর বোনরে নিয়ে যাও ক্ষণ’

কুসুম হাতের বালাটা খুলে ফেলতে চাচ্ছে তাই হাত দিয়ে খোঁচাখুঁচি করছিল।মুন্নি তিয়াজি বিছানা থেকে উঠে বললেন,’যাই বউ।ঐ বালা ভুলেও খুলবেনা।খুব শীঘ্রই দেখা হবে আমাদের।আসি।নিজের খেয়াল রেখো’

সবাই চলে গেলো।আমির তিয়াজি আর তার ছেলে ভেতরে আসেননি।বাহিরেই ছিলেন।তারা সবাই চলে যাবার পর কলি ছটফট করছিল কখন বাবা মা আসবেন।এত বড় ঘটনা ঘটে গেলো।তাদের জানাতে হবে।
কুসুম বালাটাকে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললো,’হ্যাঁ রে কলি!উনাদের চিনিস তুই?’

-“নাহ।ওটা কি আসল সোনার??নাকি নকল টকল দিয়ে ফুটানি দেখাইলো? ‘

-‘আমি কি জানি!তবে আসলই মনে হয়।
মা কখন আসবে?কই গেছে তারা?’

মা বাবা তখন ভেতরে ঢুকে বললেন,’কিরে আমাদের আসার এত অপেক্ষা করছিলি?
কথাটা বলে মা বাবা কুসুমের দিকে চেয়ে মূর্তি হয়ে গেলেন।
পরক্ষনেই মা ছুটে এসে কুসুমকে ভাল করে দেখে বললেন,’এগুলো আসলো কই থেকে কুসুম?’

কলি এগুয়ে গিয়ে বললো,’তোমরা যাবার পরেই এক দল ব্যাটা,ব্যাটি আসলো।তারা দিয়েছে’

মা বাবার দিকে একবার তাকিয়ে কুসুমের হাত ধরে বালাটা খুলে নিলেন।
ওড়নাটাও মাথা থেকে সরিয়ে বললেন,’কলি!দরজা খুলতে গেলি কেন?তোকে কতদিন বললাম না জিজ্ঞেস করে দরজা খুলবিনা?’

-‘কিন্তু মা,তারা তো কোনো ক্ষতি করলোনা।বরং এতসব দিয়ে গেলো’

কুসুমের মা ওড়না আর বালা নিয়ে ওর বাবার হাতে দিয়ে বললেন কিছু একটা করতে।কুসুম মাকে জিজ্ঞেস করলো এসব কি হচ্ছে।
মা বাবা কোনো উত্তর দিলেন না।বাবা এসব একত্র করে একটা পুটুলি করে নিয়ে যাচ্ছিলেন গ্রামের মাতব্বরের কাছে।
মাটির পথটা শেষ হবেনা।তার ডান পাশ দিয়ে যে গলি যাবে সেখানে মাতব্বরের বাড়ি।চাঁদের আলোয় তিনি সেদিকেই যাচ্ছেন।এই জিনিসগুলো কাছে রাখতেও ঘৃনা হয়।ভয় হয়।
হঠাৎ তার পথ আটকে দাঁড়ালো আমির তিয়াজির লোকেরা।শুধু তাই নয় সেখানে ছিল আমির তিয়াজি নিজেও এবং রাখাল।তাদের হাতের আগুনের আলোতে স্পষ্ট সবার মুখ দেখা যাচ্ছে।পাশেই বাঁশের বাগাম।হুট করে ওখান থেকে তারা পথে নেমে আসায় কুসুমের বাবা আঁতকে উঠেছেন।
রাখালকে দেখে তার নিজেরই ভয় হচ্ছে।ওরকম চেহারার একটা ছেলেকে দেখে তার এত ভয় হয়, তার মেয়ের ঠিক কি অবস্থা হতো তাই ভাবছেন আপাতত। রাখাল তাচ্ছিল্য করে হাসছে।হাসিতে তার তাচ্ছিল্য কেন আসছে তা বুঝতে পারলেননা তিনি।রাখাল এগিয়ে এসে কুসুমের বাবাকে জোর করে জড়িয়ে ধরলো।পিঠে হাত রেখে বললো,’শ্বশুর আব্বা কেমন আছেন?আপনার বড় মেয়ের শরীর ভালো?’

কুসুমের বাবা চুপ করে শুধু দেখে যাচ্ছেন আর কানে শুনে যাচ্ছেন।সবার হাতে ঝোলানো অস্ত্রের শব্দ আসছে রাতের জঙলের পোকামাকড়ের শব্দ ছেদ করে।ভয় যেন শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে।টু শব্দ করবার জো নেই তার কাছে।রাখাল তাকে ছেড়ে সালাম দিলো বড় করে।পেছন থেকে দুটো লোক হাতে বড় বড় রাজহাঁস দুটো এনে কুসুমের বাবার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে জোর করে।আমির তিয়াজি হেসে বললেন,’রাজহাঁসের মাংস অনেক সুস্বাদু ।আমাদের কুসুরে খাওয়াইয়েন।সে নাকি পায়ের ব্যাথায় শুকিয়ে গেছে?’

রাখাল ঠাস করে উনার ঘাঁড়ে হাত রেখে খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,’শ্বশুর মশাই আমাদের ভয় পাচ্ছে নানা শুনছেন!’

-“আহা ভয় পাও কেন??আমরা কি তোমায় কেটে জঙ্গলে ফেলে দেবো নাকি?অবশ্য সেটা আহামরি না।ফেলতেই পারি।কিন্তু ফেলবোনা।আমাদের রত্ন তোমার কাছে তোলা।তাকে যত্ন করবা।তারপর একদিন তাকে আমরা নিয়ে আসবো।তোমাকে তো বাঁচিয়ে রাখতেই হয়।কি বলিস রাখাল?’

রাখাল কুসুমের বাবাকে ছেড়ে বললো,’শুধু রাজহাঁস না শ্বশুর আব্বা!আরও অনেক আছে।হাতের ঐ ওড়না আর বালা কুসুরে ফেরত দিয়েন।
আমার কুসুরে!আর আমরা ফলপাকড় এনেছি ওগুলো ও নিয়ে যান।কুসুরে ভালো করে খাওয়াবেন।না খেতে চাইলে মেরে খাওয়াবেন।বিয়ের আগে দূর্বল হলে চলে?’

কুসুমের বাবা রোবটের মতন হেঁটে বাড়ি ফিরে এলেন।আমির তিয়াজির লোকেরা বাড়ি পর্যন্ত সব দিয়ে আসলো যেগুলো তারা উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিল।
কলি একটা কমলা নিয়ে কুসুমের পাশে বসে খোসা ছিলতে ছিলতে বললো,’আমাদের এত ভালো কে করছে বাবা?’

বাবা মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে আছেন।কুসুম ঘুমাচ্ছে।কুসুমের মা উনার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন সব নিয়ে ফেরত এসেছে কেন।উনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন উত্তর দিতে গিয়ে।এত বড় অভিশাপ লাগলো তাদের মেয়ের উপর।কোনো কিছু করেও এই অভিশাপটাকে দূরে সরাতে পারছেননা তারা।যে দৃশ্য তিনি মাত্র দেখলেন।যে প্রতিশোধের আগুন আমির তিয়াজির চোখে জ্বলছিল তা বলে দিচ্ছে কুসুমকে তারা কিছুতেই ছাড়বেনা।ঐ হিঃস্র রাখালের সাথে বিয়ে দিয়ে তারপর তারা দমবে।ওমন একটা ছেলের ঘরে তার কুসুম কি করে থাকবে ভেবেই কষ্ট হচ্ছে।বুক ফেটে আসছে।বিয়েটা আটকানো যাবেনা কিছুতেই। কেউ এসে বাঁচাতে পারবেনা কুসুমকে।অর্ণবের সঙ্গে বিয়ে বুঝি এ কারণেই ভেঙ্গে গেলো?এই রাখালের ভাগ্যেই বুঝি আমার কুসুম আছে?আমার কুসুমের কপাল বুঝি এতই পোড়া!!’
চলবে ♥

জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/260300312617922/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here