#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫০
আফনান লারা
.
গামছাটা নিয়ে অর্ণব বিছানায় উঠে বসেছে।কুসুম আগের জায়গায় চুপ করে ওকে মুখ মুছতে দেখছিল।
অর্ণব সেটা বুঝতে পেরে বইগুলোর দিকে একবার চেয়ে নিলো।সব এলোমেলো করে রাখা।তার মানে খুলে দেখেছে।
বাংলা বইটা খুঁজে একটা পৃষ্ঠা বের করে সে বললো,’কাল ভোরে তোমায় এই পৃষ্ঠার অক্ষরগুলো শেখাবো।তোমার এই মূহুর্তের কাজ হলো অক্ষরগুলো বড় বড় চোখ দিয়ে দেখে নেওয়া।যেন আমি তোমায় লিখে দেখালে তুমি চট করে লিখতে পারো না দেখেই।বুঝেছো?’
কুসুম মাথা নাড়িয়ে বইটা নিলো।অর্ণব বইটা আবারও কেড়ে নিয়ে বললো,”ডান হাতের আঙ্গুল তো কেটে বসে আছো।লিখবে কি করে?আশ্চর্য! আচ্ছা কাল পড়া শেখাবো।পরে লেখা।তাও দেখো অক্ষর।ধরো’
অর্ণব বইটা ওকে দিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে।কুসুম বই নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে নিচে বসে মনযোগ সহকারে অক্ষরগুলো রপ্ত করা শুরু করলো।অর্ণব ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকে সব পোস্ট দেখছিল তখন।
—
আকাশে সরু চাঁদ।খোলা বারান্দার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকা জবা গাছটার ঢাল নড়ছিল মৃদু বাতাসে।পাতার নড়চড়ে চাঁদের ঝলক কেটে কেটে আসছিল চোখের সামনে।বই থেকে চোখ উঠিয়ে কুসুম তাই সেদিকেই তাকালো।খুব ইচ্ছে হলো ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখার।সে জন্য বই রেখে ছুটে অর্ণবের কাছে এসে বললো,’ছাদে যাবেন?’
‘কেন?’কি কারণ?’
‘চিকন চাঁদ দেখবো।খুব ইচ্ছে হয়।আগে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখতাম।এখন ছাদে গেলে হয়ত সেরকম দেখা যাবে।একা যেতে ভয় লাগে।আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?’
অর্ণব উঠে বসলো।হাঁটুর উপর হাত রেখে তাতে থুঁতনি ভর দিয়ে বললো,’জানো আমি পথ দিয়ে আসার আগে মেসতাক গাছ দেখেছিলাম।ওগুলোর ডাঁটা দিয়ে পিটালে খুব ব্যাথা পাওয়া যায়।
বই আজ আনলাম আর আজকেই তুমি অমনযোগী হয়ে যাচ্ছো।ঐ বেত দিয়ে মেরে মেরে দুদিনে তোমাকে আমি আমার লেভেলের শিক্ষিত বানিয়ে নিতে পারবো।আমাকে চেনা আছে তোমার?’
কুসুম ভয় পেয়ে দরজার ফটক ছেড়ে ছুটে চলে গেলো বইয়ের কাছে।
অর্ণব ওর রিপোর্টটা বের করে হাসপাতালের নাম্বারে কল করেছে।সেখানের নার্স নাম আর ফোন নাম্বার মিলিয়ে জানালো, যে রিপোর্টের রেসাল্ট দেওয়া হয়নি সেটা আসলে ঢাকা পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষা করাতে।পেশেন্ট যদি এখন ঢাকা থেকে থাকে তবে তার প্রেজেন্ট এড্রেস দিলে শেষ রিপোর্টটার ফাইল এখন তার কাছে যাবে।অর্ণব এই বাসার এড্রেসটা দিয়ে দিলো।’যাক এবার একটু শান্তি লাগে।’
কুসুম বই রেখে বারান্দাতে এসে উঁকিবুকি দিচ্ছিলো।চাঁদটা দেখার অনেক অনেক শখ জেগেছে।বাড়িতে থাকতে একা একাই নদীর ধারে ছুটে চলে যেতো সে শুধুমাত্র চাঁদ দেখতে।অর্ণব তো সব কিছুতেই মানা করে।
‘তাই বলে কি স্বাদ মেটাবোনা?নাহয় তাকে না জানিয়ে স্বাদ মেটাবো।।’
যেমন ভাবা তেমন কাজ।পা টিপে টিপে দরজাটা আস্তে করে খুলে কুসুম এক দৌড়ে ছাদে এসে হাজির।অর্ণব তার ব্যাগ থেকে চাকরির প্রস্তুতিমূলক তিনটে বই বের করে তার মধ্য থেকে একটা নিয়ে পড়ছিল।ফেসবুকে এখন আর ভাল লাগেনা।কেমন যেন পানসে পানসে।বইতেই ভাল লাগে।
ছাদের সিঁড়ি যেই জায়গায় সেই জায়গা থেকে কুসুমের বিশাল আওয়াজে চিৎকার ভেসে আসলে অর্ণবের কানে।চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে বই রেখে নেমে দিলো এক দৌড়।ড্রয়িং রুমে এসে ওকে না দেখে দরজার দিকে চেয়ে দেখলো দরজা আগে থেকে খোলা।এবার দরজা খুলে সে ছাদের দিকে গেলো।নিচ তলা থেকে সুলতান শাহ আর মিজুয়ানা বেগম ছুটে আসছেন চিৎকার শুনে।সবাই অর্ধেক সিঁড়ি পর্যন্ত এসে থেমে গেলো।কারণ অর্ণব নিজেও থেমে গেছে।কুসুম সিঁড়িতে পা ধরে বসে ছিল।চোখে অজস্র পানি।অর্ণব কোমড়ে হাত রেখে বললো,’কি হলো তোমার?আমার কথার অবাধ্য হওয়াই কি তোমার স্বভাব?কয়বার মানা করেছি?কোন সাহসে বের হলে?এখন আবার চেঁচালে কেন?পায়ে কি হয়েছে তোমার?’
মিজুয়ানা বেগম আর জাহান এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ওর কাছে।মিজুয়ানা বেগম বললেন,’আহা বকছো কেন!মেয়েটা দেখোই না ভয় পেয়েছে কত!তার উপর হয়ত ব্যাথাও পেয়েছে।মা তুমি ঠিক আছো?’
কুসুম হাত দিয়ে মুখ মুছতেছে আর বারবার পিছনে ফিরে চিলেকোঠার দিকে তাকাচ্ছে।অর্ণব আরেক ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি সমস্যা।
‘শশশশশিয়াল’
‘শিয়াল?মানে?’
সুলতান শাহ কেশে গলাটাকে হালকা করে নিলেন সেসময়ে।তারপর হাতের লাঠিটাকে ফ্লোরে শক্তপোক্ত করে ধরে বললেন,’চলো সবাই।রাত করে বাহিরে থাকতে নেই এতো’
অর্ণবের মনে সন্দেহ হলো তাই সে কুুসুমের পাশ কাটিয়ে ছাদে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলো তা দেখে মাথাটাই হ্যাং হয়ে গেছে।দুটো বড় সাইজের শেয়াল বাঁধা রডের সাথে।দুটো শেয়ালই দাঁত বের করে তাকিয়ে আছে।অর্ণব চোখ কপালে তুলে পিছিয়ে গেলো।কুসুমের কাছে এসে থামলো সে।সুলতান শাহ মাথার টুপিটা হাতে নিয়ে বললেন,’আসলে শেয়ালের মাংস খেলে বাত ব্যাথা সেরে যায়।এটা আমি বলিনা।সবাই বলে।শেয়ালের মাংস পাওয়া তো অনেক কঠিন সেটা অবশ্য তুমি জানো।
আমার আবার জাতের বাতব্যাথা।
সারার নামই নেয়না।যার কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেয়াল পালবো।তারপর এদের নাদুসনুদুস বানিয়ে একদিন রোস্ট বানিয়ে খাবো।ঘন করে।মোগলীয় ভাব আসবে বুঝলে?’
অর্ণব কপালের ঘাম মুছে বললো,’এরা কি সারাদিন এমনই থাকে?’
-“আরেহ না।দিন হলে ছেড়ে দিই।বনবাদাড়ে ঘুড়ে ফিরে আনন্দ করে।এরপর রাতে আবার ভাল ছেলের মতন ফিরে আসে।আমার শিকারি শেয়াল গুলা।আমাকে চেনে ভালমতন।দেখবে?’
সুলতান শাহ এগিয়ে এসে হাত নাড়িয়ে কি সব দেখালো।শেয়ালগুলো একসাথে চেঁচিয়ে উঠেছে তার অঙ্গভঙ্গিমা দেখে।অর্ণব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।ঢোক গিলে বললো,’কর্পোরেশনের লোকেরা দেখলে তো নিয়ে যাবে’
-“দেখাবে কে?কার এত বড় সাহস?’
সুলতান শাহের অগ্নি রুপ দেখে অর্ণব কুসুমের হাত টেনে ধরে বললো চলো যাই।
কুসুম পায়ে হাত দিয়ে বললো,’আপনি যান।আমি ধীরে সুস্থে আসছি’
‘কেন?আমার সাথে চলো।এখানে এক মূহুর্তও থাকা ঠিক হবেনা।কোথায় এসে পড়লাম।এর কারণে বুঝি মৃদুল বলছিল আর কদিন থাকবো আমি।শয়তানটা সব জেনেও আমায় জানায়নি।একটুর জন্য সিবারেল হার্ট এ্যাটাক হয়ে বসতো।’
সুলতান শাহ তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেছেন।যাবার সময় ছাদের দরজায় তালা মেরে গেছেন।অর্ণব কুুসমকে উঠতে বললো কিন্তু সে পায়ে মচ খেয়ে বসে আছে।উঠতেও পারছিলনা।
এদিকে অর্ণবের কেমন অস্বস্তি লাগছিল।সে বুঝতে পারছিলানা এমন সিচুয়েশন থেকে রেহায় কি করে পাবে।
কুসুম ওর হাত ধরে অনেক চেষ্টারর ফলে উঠতে পারলেও হাঁটার দম আর পেলোনা।অর্ণবের পাঞ্জাবির বোতাম সমেত খাঁমছে ধরে রাখলো শক্ত করে।হাঁটতেই পারছেনা।চাইলে পারবে কিন্তু তার মাঝে সাহস আসছেনা।কদম রাখলেই কেমন ঝি ঝি করে আসে। যেন পায়ে কোনো বল নেই।পা একটি আলাদা অংশ হয়ে গেছে শরীর থেকে।হয়তবা মচ সত্যিই লেগেছে।তবে এই মচ যাবেই বা কি করে?
নিজের পাঞ্জাবিতে টান খাবার পর হুশ ফিরে আসলো অর্ণবের।সে কুসুমের দিকে চেয়ে বললো,’তোমার পায়ে কি হয়েছে আবার?’
‘ঐ আসলে শিয়াল দেখে ভয়ে ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম তার পর থেকে হাঁটার জো পাচ্ছিনা’
‘কোলে ওঠার বাহানা নয়তো?যদি তাই হয় তবে শূন্যে ছেড়ে দেবো’
কুসুম অর্ণবের পাঞ্জাবি ছেড়ে দিয়ে বললো,’আপনি যান।আমি ধীরে ধীরে চলে আসবো ‘
অর্ণব নিচু হয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়েছে।সামনের দিকে তাকিয়ে চলেছে এবার।কুসুম হাতদুটোকে একসাথ করে রেখে অবাক চোখে দেখছে ওকে।
এ কেমন অনুভূতি বলে বোঝাতে পারছেনা সে নিজের কাছেই।এ প্রথম অর্ণবের এমন আচরণে অবাক হবার সীমানা ছেদ করে গেলো মনের ভেতর।অর্ণব যেতে যেতে বললো,’দেখলে?আমার কথা না শুনলে কত কি বিপদ হয় তোমার?তার পরেও তো আমার কথা অমান্য করো।আমি ভাবতাম আমি তোমায় পছন্দ করিনা।এখন দেখছি তুমিও আমায় পছন্দ করোনা।আমার কথা মাথায় আনো না’
‘সেটা না।আমি তো এমনেই একটু দেখতে গিয়েছিলাম।সব ছাদ তো এমন দূর্ঘটনাপ্রবণ হয়না।যেমন আপনাদের ছাদ কত মনোমুগ্ধকর ছিল।গেলেই মন ভাল হয়ে যেতো।কিন্তু এই ছাদ যে এমন দুঃস্বপ্নের মতন হবে তা কি আমি জানতাম?’
‘জানলে মানুষ কোনো ভুলই করতোনা জীবনে।যাই হোক, আর কখনও যেন আমি তোমায় আমার কথার অবাধ্য হতে না দেখি।’
কথাটা বলে অর্ণব ধপ করে ফেলে দিলো ওকে বিছানায়। তারপর হাতের কব্জি কচলাতে কচলাতে বললো,’দেখে মনে হয় ত্রিশ কেজিও হবেনা।সব দেখি হাড্ডির ওজন।হাত ব্যাথা হয়ে গেলো আমার।ইচ্ছে করছে এক চড় মেরে দেই। কিন্তু তোমায় মারলে দশ পাড়ায় আগুন লেগে যাবে।আমার বাপে কুমিল্লা থেকে এসে আমাকে একটার বদলে একশোটা চড় মেরে দেবে।উনাদের কলিজার টুকরা তো তুমি’
কুসুম গালে হাত দিয়ে বললো,’আমি কাউকে বলবোনা সত্যি’
অর্ণব মাথা এগিয়ে এনে কুসুমের গাল টিপে ধরে বললো,’যে স্বাদের গাল আপনার।টিপে ধরলে একদিন লাল থাকবে আর চড় মারলে এক বছর লাল থাকবে।এখন মারলে কাল সকালে দেখবো বাবা মা এসে হাজির বেড়াতে।বাহানা হলো তাদের ছেলে তাদের বাবু পুত্রবধূর যত্ন নেয়না ঠিকমত।কি গো সত্যি বলছিনা??’
কুসুম চুপ করে চেয়ে ছিল।অর্ণব ওর গাল ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে বসে কপাল আবারও মুছলো তারপর বললো,’আমায় খুব জলদি মেসের আশেপাশে বাসা খুঁজতে হবে। এদের সাথে একি ছাদের নিচে থাকা অসম্ভব। শেষে কিনা শেয়ালের সাথে!এই জন্যই কি আগের ভাঁড়াটিয়ারা পালাতো?এ্যাই তুমি ভুলেও ছাদে যাবেনা।জামাকাপড় সব বারান্দায় শুকাবে।শিয়ালের কামড় জঘন্য।’
কুসুম ফিসফিস করে বললো,’আপনি জানলেন কি করে?’
‘গোটা মুরগী গিলে খাওয়া কি খরগশের কাজ??ওটা শিয়ালের কাজ।তার মানে সে হিংস্র।প্রয়োজনে মানুষের ক্ষতি ও করতে পারে।আমি আরও একবার করে মানা করছি তোমায়,কখনও ছাদে যাবেনা।মনে থাকবে?’
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/