#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫২
আফনান লারা
.
প্রতিটা রুমে ড্রিম লাইট জ্বলা।ফরহাদের রুমে সবুজ বাতি,জুথির বাবার রুমে লাল বাতি,ওর দাদা দাদির রুমে হলুদ বাতি।
সবগুলো রুমের বাতি চেক করে মৃদুল দেয়ালের সাথে লেগে লেগে রান্নাঘরে ঢুকেছে।জুথি ও ওর পিছু পিছু এসে রান্নাঘরের আলো জ্বালিয়ে বললো,’এরকম নাটকের কি আছে বুঝতে পারছিনা।আপনি কেন এমন ব্যবহার করেন?কি চাইছেন টা কি আপনি?’
মৃদুল একটা পাতিল হাতে নিয়ে বললো,’নুডুলস চাইছি।কোন শেল্ফে রাখলে?’
জুথি বিরক্ত হয়ে প্যাকেট খুঁজে দিয়েছে।মৃদুল দাঁত দিয়ে কামড় প্যাকেট খুলে ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দিয়ে তাকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’আজকে তোমায় এমন নুডুলস খাওয়াবো সারাজীবন আমার তারিফ করে যাবে উন্মাদের মতো’
‘আমি উন্মাদ হতে চাইনা’
‘হতে হবে।মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক লাইফ থেকে রক্ষা পেতে উন্মাদ হতে হয়।পেঁয়াজ,মরিচ আর ডিম এনে দাও এখন।ফটাফট দি গ্রেট মৃদুল শেফ নুডুলস রাঁধবে।ইউ আর এডভান্স ওয়েলকাম ‘
‘আপনি একটা পাগল!’
কথাটা বলে জুথি পেঁয়াজ,মরিচ আর ডিম এনে রেখে চলে গেলো।মৃদুল তার মতন করে রান্না শুরু করেছে।
জুথি বাবার রুমের উপর নজর রাখছিল।বাবা যদি একবার জেগে যায় তাহলে সর্বনাশ।ওদিকে মৃদুল হঠাৎ মা বলে চিৎকার করে বসেছে।
জুথি মুখে হাত দিয়ে আগে বাবার আর ফরহাদের রুম চেক করলো।মৃদুলের চিৎকারে তারা কেউই জেগে যায়নি।সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়েছে।
এবার সে রান্নাঘরে আসলো মৃদুলকে বকবে বলে, এসে দেখলো মৃদুল হাত নাড়ছে আর ফু দিচ্ছে।চোখে পানি ঝলঝল করছিল তার।জুথি তা দেখে ছুটে এসে বললো,’হাতে ছ্যাঁকা লেগেছে?’
‘হ্যাঁ।নুডুলস সেদ্ধর গরম পানিকে ঠাণ্ডা পানি মনে করে হাত চুবিয়েছিলাম’
জুথি গাল ফুলিয়ে ওর হাত ধরে ভেসিনের কাছে নিয়ে পানির নিচে হাত ধরে রাখলো।মৃদুল নাক টেনে বললো,’তোমার পথ চেয়ে থাকতে গিয়ে আজ আমার এই হাল হলো।আর কত কষ্ট দেবে?’
‘যার কাছে কষ্টের অভাব নেই।সে আবার আগ বাড়িয়ে কিসের কষ্ট দেবে?’
মৃদুল গায়ের নীল টি শার্টটাতে হাত মুছে আবারও ফু দিতে দিতে বললো,’উহঃ কি জ্বালা।মরে যাব’
জুথি তার রুম থেকে ওয়েন্টমেন্ট খুঁজে এনে ওকে ধরে সোফায় বসিয়ে অন্ধকারে মলমটা লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,’আপনি সব কিছু অতিরিক্ত করেন।যেটা আমার পছন্দ না’
‘আমার কোন দিকটা তোমার ভাল লাগে?সবটাই তো অপছন্দের তালিকায় লিখে যাচ্ছো, ওয়ান বাই ওয়ান।’
জুথি মলম লাগিয়ে উঠে রান্নাঘরে এসে নুডুলসের বাকি কাজটা করায় মন দিয়েছে।মৃদুল অন্ধকারে দেয়াল ধরে ওর পিছু পিছু চলে আসলো রান্নাঘরে।জুথি তার চুলে খোঁপা করে একটা বড় ক্লিপ দিয়ে চুলগুলোকে দমিয়ে রেখেছে।মৃদুল এক দৃষ্টিতে সেই খোঁপাটাই দেখছিল।ইচ্ছে করে গিয়ে ক্লিপটা খুলে দিতে।সেটা করলে জুথি খুব মারবে।সে ভয়ে এগোলো না।
নুডুলস বাটিতে নিয়ে জুথি ওকে রুমে আসতে বলে চলে গেছে
।মৃদুল বললো,’কফি?’
জুথি জবাব দেয়নি।বাটি এনে নিজের বিছানায় রেখে ওকে বসতে বলে আবারও রান্নাঘরে চলে গেছে।নুডুলসে দুবার ফু দিয়ে মৃদুল জুথির পুরো রুমটা দেখছিল চোখ বড় বড় করে।
স্বাভাবিকভাবে বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ের রুম যেমন হবার কথা তেমনই।সাজসজ্জায় পরিপাটি। নামি দামি আসবাব।
গোলাপি রঙের রুম,গোলাপি রঙের বিছানার চাদর,একশোটা টেডি বিয়ারের ছড়াছড়ি,কিছু কিছু পিচ্চি,কিছু কিছু দানব টাইপের।বিছানায় ছোট বালিশের অভাব নেই।পুরোটা দেখে নুডুলস এক চামচ মুখে দিয়ে মৃদুল ভাবলো জুথিকে ডাকতে যাবে।সেসময়ে ও নিজের বাটি নিয়ে এসে মৃদুলের সামনে চেয়ার টেনে বসে বললো,’কফির গরম পানি বসিয়ে এসেছি।খাচ্ছেন না কেন?যেটার জন্য এত কিছু এখন সেটাকে ঠাণ্ডা হতে ফেলে রেখেছেন?’
‘অনেক গরম।ভাগ্যিস বাম হাতে পুড়েছে নাহলে এখন তোমায় আমাকে খাওয়ানোর দায়িত্বটা নিতে হতো’
‘আপনি আমায় পছন্দ করেন?’
মৃদুল হেসে নুডুলস মুখে দিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসেছে।জুথি প্রশ্নটা আরও একবার করলো।মৃদুল এবার ওর দিকে ফিরে বললো,’বললে সিঙ্গাপুর যাবেনা?’
‘আমি না গেলে আপনার অনেক লাভ হবে?আমার থেকে এত ইগনোরেন্স পাবার পরেও আপনার এত ভালো লাগা কই থেকে আসে?আমার মাঝে আপনি কি পেলেন যেটা অর্ণব পায়নি??’
‘সে কি করে পাবে?সে খোঁজার সময়ে তো রেডি করা একজনকে পেয়ে গেছে যার নাম তার নামের সাথে জুড়ে ছিল আগে থেকেই।খুঁজতে বেরিয়েছি তো আমি নিজেই’
‘আমি এসব কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।সিঙ্গাপুর যাওয়া ক্যানসেল করতে পারবোনা কোনো মতেই।আমাকে যেতেই হবে।আপনি প্লিজ আমায় মায়ায় জড়াবেননা।এমনিতেও জীবনে আমার ভাঙ্গা টুকরো ছাড়া আর কিছু বাকি নেই।আমি আর ভেঙ্গে যেতে চাইনা।’
‘আমার ব্যবহারে তুমি ভেঙ্গে যাবে?’
জুথি কিছু বললোনা আর।আবারও চুপ হয়ে আছে।নুডুলসটা কয়েক চামচ খেয়ে মৃদুল চলে যাওয়া ধরতেই জুথি ছুটে এসে বললো,’কফি হতে আর কয়েক মিনিট লাগবে।’
ওর কথা শুনে মৃদুল বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো,গেলোনা।কিন্তু রুমের ভেতর যাবেনা বলে ঠিক করেছে।
—–
বাসায় ফেরার পর কুসুম একবারের জন্য একটু বিছানায় শুয়ে ছিল।ভেবেছে অর্ণব মুখ ধুয়ে বেরুলেই ওর সাথে বসে রাতের খাবারটা খেয়ে নেবে।কিন্তু পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে তার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসলো।অর্ণব ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ওকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে আর জাগালোনা।রুমের আলো নিভিয়ে বাহিরে গিয়ে খাবারের ঢাকনা সরিয়ে তাকিয়ে রইলো।কুসুম খায়নি বলে ওর নিজেরও খেতে ইচ্ছে আসলোনা।পুনরায় খাবারটা ঢেকে রুমে এসে দেখলো কুসুম বিছানার মাঝখানে এসে ঘুমায়।আস্তে করে বালিশটা নিয়ে অর্ণব অন্য রুমে চলে গেছে।এখন থেকে আলাদা শোবে।বাবার বাড়িতে বাধ্য হয়ে কুসুমের সাথে ঘুমাতো।এখন আর টানাপোড়ন নেই।শান্তিতে চোখ বুজে শুয়ে পড়লো সে।
—
কুসুম গভীর রাতে দুইটা বিশ মিনিটের সময় হঠাৎ জেগে গিয়েছিল ঐ শিয়াল গুলোর কেমন একটা গা হিম করা আওয়াজে।ভয়ে সারা শরীর কাঁপছিল তার।
পাশে হাতিয়ে অর্ণবকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ভয়টা আরও বেশি করে লাগলো।ব্যস্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে ছুটে গেলো রুমের বাহিরে।দরজা ভেতর থেকে লাগানো দেখে স্বস্তি পেলো কিছুটা।তারপর পাশের রুমটাতে গিয়ে দেখলো অর্ণব ওখানে ঘুমাচ্ছে।
কুসুম বুঝলো সে একসাথে ঘুমাতে চায়না।আজ হঠাৎ অর্ণবকে আলাদা ঘরে এসে শুতে দেখে চোখ জুড়ে অশ্রুতে টলমল হয়ে গেছে কুসুমের।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে পিছিয়ে গেলো সে।
অর্ণব কেন তাকে এত অপছন্দ করে ভেবে অনেক কান্না আসলো।অন্ধকারে পিছোতে গিয়ে ওখানে থাকা একটা ছোট টেবিলরে সঙ্গে ধাক্কা লেগে আওয়াজ হলো সামান্য ।সেই আওয়াজে অর্ণব জেগে গেছে।কুসুম ওকে জেগে যেতে দেখে চলে গেলো তার রুমে।অর্ণব উঠে বসে বললো,’কুসুম?’
কুসুমের কোনো সাড়া নেই দেখে রুমের আলো জ্বালিয়ে অর্ণব বের হয়ে দেখলো কুসুম তার রুমের বিছানায় অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছে।ও যে এখানে এসেছিল তা অর্ণব ড্রিম লাইটের আলোয় দেখেছিল।তবে ছুটে চলে যাবার কারণ কি।
সন্দেহ হওয়ায় অর্ণব ওর কাছে এসে বললো,’আমার রুমে এসেছিলে কেন?’
কুসুম জবাব দিচ্ছেনা।নিরবে আঁচল দিয়ে চোখ মুছতেছে ধীরে ধীরে।অর্ণব ওর নড়াচড়া দেখছিল।
তাই এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে এক টান দিয়ে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো সে।দেখতে পেলো তার সারা মুখে পানি।চোখ লাল হয়ে আছে।বারবার করে মুখ মুছে যাচ্ছিল সে।
‘আজব তো।এত রাতে কাঁদতেছো কেন?’
‘কই!আমি কাঁদতে যাব কেন?’
কথাটা বলেই কুসুম কেঁদে ফেলেছে।অর্ণব ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,”আমাকে ঐ রুমে দেখে এসে কাঁদছো।ওহ আচ্ছা! এবার বুঝতে পারলাম।আমি আলাদা রুমে শোয়ায় তোমার খারাপ লেগেছে?তুমি কি জানো তুমি বিছানার মাঝখানে এসে শুয়ে ছিলে?আমার জন্য কোনো জায়গা ছিলনা।আর এখন এত রুম থাকতে আমি কেন তোমার সাথে শুতে যাব?’
কুসুম কেঁদে কেঁদে বললো,’চলে যান।আমি কি বলেছি শুতে?আমার কষ্ট আমি গিলে খাব।কারোর স্বাদ নিতে হবেনা’
‘আবার বড় বড় কথা!যাও কোণায়।আমি বালিশ নিয়ে আসতেছি।রোগীরে কাঁদালে পাপ হবে আমার।এমনিতেও বহুত মানুষরে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।পাপ পাকা করতে চাইনা’
কথাটা বলে অর্ণব গিয়ে বালিশ নিয়ে আসলো ঐ রুমটা থেকে।কুসুম কিণারায় গিয়ে বসে দেখছিল সব।আলো নিভিয়ে অর্ণব ওর পাশেই শুয়ে পড়েছে।এবার কুসুমের কান্না অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো।মুখে হাসি ফুটলো তার।
অর্ণবের গায়ের এক অদ্ভুত গন্ধ তার চোখের পানি শুকিয়ে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে দিলো হঠাৎ করে।
ইচ্ছে করলো ঐ গন্ধটা পেতে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু এত সাহস নেই।
একটু কাছে এগিয়ে এসে কুসুম অর্ণবের একদম কাছে শুয়ে পড়েছে।কত কি ইচ্ছা করছিল।কিছুতেই কোনো কিছু করার সাহস জোগাতে পারছিলনা সে।
শেষে অর্ণবের পাঞ্জাবিটা একটুখানি খাঁমছে ধরে চোখ বন্ধ করলো সে।অর্ণব টের পেয়েছে কুসুম যে তার পাঞ্জাবি ধরেছে কিন্তু তাও সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালোনা।কয়েকটা দিন ধরে ওকে কষ্ট দিতে পারা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘খুব মায়া হয়।এই মায়ার বলে আগেকার অর্ণব সম্পূর্ন বদলে গেছে।যেন সে কুসুমের সব কথা মানতে প্রস্তুত। অথচ এটা আমি কখনও চাইনি।আমি তো ওকে অপছন্দ করি,তাহলে কেন এত টান কাজ করে।কেন এত মায়া লাগে?’
—-
কফির মগ হাতে মৃদুল অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়েছিল।জুথি ওর পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কফি খাচ্ছে।কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছেনা।শেষে কফির শূন্য মগটা নিচে রেখে মৃদুল চলে যাবার জন্য উদ্ধত হতেই জুথি এগিয়ে এসে বললো,’যদি কষ্ট দিয়ে থাকি তবে মাফ করে দেবেন?’
মৃদুল সেসময়ে বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলছিল।জুথির কথা শুনে এক হাত এগিয়ে ওর কানের কাছে নিয়ে গলা স্পর্শ করে চুলের ক্লিপটা খুলে দিয়ে হাতটা আবারও নিয়ে আনলো।জুথি চোখ বন্ধ করে ছিল।মৃদুল রোডে নেমে মুচকি হেসে বললো,’বলছিলাম না!দারুণ অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো?’
চলে গেলো সে।জুথি তার কানের কাছে হাত রেখে ওর চলে যাওয়া দেখছে।কানের ঐ জায়গা কেমন শীর শীর করছে।যেন হাতটা এখনও লেগে আছে।বাতাসে ওর চুল উড়ছিল আপন স্থিতিতে।সেই স্পর্শ যেন নড়ছেনা।জুথি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
‘মৃদুল কেন এমন একটা শাস্তি দিয়ে গেছে রাতের এই অসময়ে?কিসের শত্রুতা ছিল?আমাকে দূর্বল করাই কি তার লক্ষ্য?’
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/