তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব-১৯

0
619

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-১৯
Writer Taniya Sheikh

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

“গরলিটজ শহরে।”

“সেটা কোথায়?”

“বললে কি চিনবে?”

নোভা একপলক তাকাল ইসাবেলার মুখের দিকে। তারপর আবার আগের মতো টমটমের বাইরে মুখ করে বসে রইল। ইসাবেলা কোলের ওপর রাখা হাত দুটোর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। খরগোশটার জন্য এখনও মন খারাপ ওর। কিন্তু রাগের বশে নোভাকে ওভাবে বলাটা উচিত হয়নি ভেবে অপরাধবোধে ভুগছে। সেই ঘটনার তিনদিন হতে চলল। নোভা যথাসম্ভব এড়িয়ে যাচ্ছে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না। ইসাবেলার কথাতে ব্যথা পেয়েছে সে। কিন্তু তারচেয়েও বেশি খারাপ লাগছে স্বভাবের বশে খরগোশটা খেয়ে ফেলায়। ইসাবেলার চোখে খরগোশটি ছিল সৌন্দর্যের, ভালোবাসার। আর নোভার চোখে তা ছিল কেবল আহার। মৃত্যুর আগে মা ঠিকই বলেছিল ওদের। এই জীবন অভিশপ্ত। স্রষ্টার অমোঘ নিয়ম লঙ্ঘন করে অভিশপ্ত ওরা। যেই মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছিল, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে রোজ সেই মৃত্যুকে দেখে। যে প্রাণীগুলোকে হত্যা করে, মৃত্যু ওদের মধ্যে দিয়ে বিদ্রুপ করে। জানান দেয় কতটা ঘৃণ্য, বর্বর জীবনযাপন বেছে নিয়েছে। স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে থাকতে যে নোভা একটা প্রাণীকেও মারেনি। আজ পিশাচী ক্ষুৎপিপাসার তাড়নায় বাছ-বিচার ছাড়াই প্রাণী হত্যা করতে হয়। পিশাচীয় জীবনের প্রথমে মানুষের রক্ত ছিল ওর একমাত্র আহার। তখন প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে দেখতে হতো। মানুষকে সমগোত্রীয় বলে নয়, শিকার বলে জ্ঞান করত। সে জীবন্মৃত, কোনো প্রাণীর প্রতি মায়া-মমতার স্থান থাকার কথা নয়। অন্তত মানুষের প্রতি তো নয়ই। কিন্তু আশ্চর্য! কালান্তরে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করেছে সেই অনুভূতি। শিশুর মরণ কান্না, সন্তান হারা মায়ের আহাজারি আর রক্তশূন্য মানুষের চোখের সেই জল নোভার মৃত বিবেকটাকে সহসা নাড়া দেয়। এমনটা হওয়ার কথা নয়। সে ভ্রম ভেবে হেসেছে মনে মনে। কিন্তু অনুভূতিটা ভ্রম ছিল না। যত দিন গেল নোভার অস্বস্তি বাড়তে লাগল। এক সময় বাধ্য হয়ে বদলাতে হলো নিজেকে। ভ্যাম্পায়ার কমিউনিটির সকলের কাছে আজ তাই দূর্বল সে। রিচার্ড সবসময় বলেন, এই জীবন্মৃত হয়ে থাকার কারণে ওরা শক্তিধরে পরিণত হয়েছে। ঈশ্বরকেও টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে ওদের। সমস্ত পৃথিবী শাসন করবে একদিন। কিন্তু নোভার একসময় মনে হয়েছে ক্ষমতা টমতা কিছু নয়, এই জীবন্মৃত হয়ে থাকা একপ্রকার অসহায়ত্ব। মানুষের রক্তের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। ঈশ্বর কারো ওপর নির্ভরশীল নয়। তাহলে তাঁর সাথে টক্কর কী করে হয়?

“আমাকে মাফ করে দাও নোভা।”

নোভা বিস্মিত মুখে বলল,

“তা কেন?”

“সেদিন তোমাকে যা বলেছি তা বলা উচিত হয়নি আমার। আমি সত্যি অনুতপ্ত ওই আচরণে।”

“তুমি তো ভুল কিছু বলোনি। যা আমি তাই বলেছ। তবে অনুতাপ কীসের?”

“নোভা! সত্যি বলছি রাগের মাথায় ভুলভাল বলেছি। মন থেকে বলিনি।”

“ইসাবেলা, যেভাবেই বলো সত্যিটা বলেছ।”

“না, সত্যি না ওসব কথা।”

“কোনটা সত্যি না? আমি ডাইনি না? আমি পিশাচী না? বলো?”

রেগে গেল নোভা। না সূচক মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। ক্ষিপ্ত হয়ে ইসাবেলার চোয়াল চেপে ধরেছে নোভা।রক্তিম ঠোঁটের দু’পাশে চকচক করছে শ্বদন্ত। ধারালো দীর্ঘ নখগুলো ইসাবেলার চোয়ালের ত্বকে গেঁথে যায়। ব্যথায় নীল হয়ে ওঠে ইসাবেলার মুখ।

“নোভা, ব্যথা লাগছে ছাড়ো।”

“আমি পিশাচী, ডাইনি। তোমাকে এক ফোঁটা করুনা করেছি বলে ভেবে নিয়েছ আমি তুমি এক? আমি আর তুমি এক নই। আমার, আমাদের চোখে তোমরা মানুষ কেবল খাদ্য এবং একসময় হবে আমাদের অনুগত দাস। তোমাদের প্রতি মায়া মমতার রেশ মাত্র নেই। মায়ের কথা স্মরণ করে তোমাকে বাঁচিয়েছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ওই আমার চরম ভুল ছিল। আমার বাবা ঠিকই বলেন, মা বোকা ছিলেন তাই পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে নিজের মতো ভেবেছিলেন। অবশ্য, মৃত্যুর আগে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন বাস্তবতা। বুঝতে পেরেছিলেন সকলে তাঁর মতো নয়। তুমি আর তিনি একই রকম। বোকা। বোকাদের সংসর্গ যত দ্রুত ত্যাগ করা যায় ততই ভালো।”

ইসাবেলার গাল বেয়ে তপ্ত অশ্রুপাত হয়। নোভা ওর গাল ছেড়ে কোচওয়ানের আসনে বসা ভৃত্যটিকে বলে,

“পল, গাড়ি এক্ষুনি থামাও।”

গাড়ির চাকা থামতে হাওয়ায় মিশে কোচওয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“আজ রাতেই এই মেয়ের রাশিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। ওর ছায়াও যেন আর না দেখি আমি।”

“জি, রাজকুমারী।”

“কতবার বলব রাজকুমারী বলে ডাকবে না।”

“বেয়াদবি মাফ করবেন। মালিকের আদেশ আমি অমান্য করতে পারব না।”

দাঁত খিটমিট করে হাওয়ার সাথে মিশে গেল নোভা। সে আর কারো প্রতি মায়া দেখাবে না। তুচ্ছ মানুষের জন্য সমগোত্রীয়দের কথা শুনবে না। একদিন ইসাবেলাকে মুক্তি দিতো৷ আজই বা ক্ষতি কী? বরং যত তাড়াতাড়ি ইসাবেলার সান্নিধ্য ত্যাগ করবে ততই মঙ্গল। আন্দ্রেই ঠিকই বলেছিল, মানুষ নয় ওরা। মানুষের মতো অনুভূতিগুলোকেও স্থান দেওয়াটা উচিত নয়।

নখের আচরে ইসাবেলার গালের ত্বক ভীষণ জ্বলছে। নীরবে কাঁদছে। ব্যথিত হয়েছে নোভার এই আচরণে। আবার বাকরুদ্ধ ওর সিদ্ধান্ত শুনে। সামনে টমটমের ঘোড়া ছুটিয়ে হাঁক ছাড়ে কোচওয়ান। রাতের অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে এগিয়ে যায় অশ্বরব।

ট্রেনে তুলে দিয়ে বিদায় নিয়েছে পল। ইসাবেলা কেবিনের জানালার বাইরে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। বাড়ি ফিরবে আজ। সত্যি কি ফেরা হবে শেষমেশ? সন্দিগ্ধ মনে তাই খুব বেশি আনন্দ হয় না। ট্রেন ছাড়তে এখনও বেশ কিছুক্ষণের বিলম্ব হবে। প্লাটফর্ম লোকারণ্য। ইসাবেলার এই লোকারণ্য ভালো লাগে। আবার ভয়ও হয় হঠাৎ হঠাৎ। প্লাটফর্মে দাঁড়ানো কিংবা হেঁটে যাওয়া কোনো মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে বুক দুরুদুরু করে। ভাবে এই বুঝি ওদের কেউ এসে আক্রমণ করবে। দৃষ্টি সরিয়ে ভেতরে তাকাল। এই বগিতে আস্তে আস্তে যাত্রী উঠছে। নিজেদের আসনে বসে আছে কেউ কেউ, কেউ-বা সহযাত্রীদের সাথে আলাপে মেতেছে। ইসাবেলা একাই একটি কেবিনে। একা সফরের কারণে ভীষণ উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে। এই উত্তেজনা কাটাতে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বর নাম জপতে লাগল। মা বলত পজেটিভ ভাবলে পজেটিভ হয়। কিন্তু যার জীবনে এত কিছু ঘটে গেছে তার মধ্যে পজেটিভিটি যে সহজে আসে না।

“হ্যালো, মেয়ে।”

সচকিত হয়ে চোখ মেলল ইসাবেলা। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মধ্যবয়সী একজন সুশ্রী রমনী। পরনে সাদা ভিক্টোরিয়া গাউন, মাথায় স্কার্ফ। সুহাসিনী রমনী সামনের সিটে মুখোমুখি বসলেন। ইসাবেলার কেন যেন তাঁর মুখটা বেশ পরিচিত মনে হলো। রমণী মমতা সুলভ হাসি হেসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে পুনরায় বললেন,

“হ্যালো, আমি আগাথা ওয়াল্টার।”

“ইসাবেলা আলেক্সিভ।”

আগাথার করপুটে চুম্বন করে ইসাবেলা। হঠাৎই আগাথার মুখটা ম্লান হলো। ঝুঁকে ইসাবেলার থুতনি তুলে বললেন,

“কীভাবে আচর লাগল এমন সুন্দর মুখে?”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইসাবেলা। মনের ব্যথাটা যেন ফের ফিরে এলো। নোভার ওমন নিষ্ঠুর আচরণে যথার্থ ব্যথিত হয়েছে। কিন্তু কেন যেন ওর প্রতি একবিন্দুও রাগ হলো না। শুধু একটু মন খারাপ। জোরপূর্বক হেসে আগাথাকে বলল,

“ও কিছু না।” আগাথা কিন্তু ওর থুতনি ছাড়ল না। বিমর্ষ মুখে একটুখানি হাসল। আঙুল ছুঁয়ে দিলো আচরের স্থানে। কিছু অনুভব করল ইসাবেলা। এতক্ষণ ওখানটাতে যে যন্ত্রণা হচ্ছিল, এই মুহূর্তে তা আর নেই। বিস্মিত মুখে তাকাল আগাথার দিকে। তখনই মনে পড়ল ওঁর মুখটা পরিচিত লাগার কারণ। তারপর নামটাও খেয়ালে এলো। ‘আগাথা ওয়াল্টার’ নোভার পুরো নাম ‘নোভালি আগাথা ওয়াল্টার’ ওর বাবার নাম রিচার্ড ওয়াল্টার। হতবুদ্ধি হয়ে ভীত গলায় বলল,

“আ-আপনি নোভার মা?”

আগাথা হাসলেন। বেশ দীর্ঘায়িত হাসি তাঁর ঠোঁটে। সিটে পিঠ লাগিয়ে মাথা নাড়ালেন হ্যাঁ সূচক। হা হয়ে যাওয়া মুখের ওপর হাতটা চেপে বেরিয়ে চিৎকার দমন করে কিছুক্ষণ পর বলল,

“কীভাবে সম্ভব?”

“কীসের কথা বলছ তুমি ইসাবেল? আমার উপস্থিতির? না আমার বেঁচে থাকার?”

“দুটোই।”

“আমি তোমার সামনে বসে আছি ঠিকই তবে আজ আর আমি জীবিত নই।”

“কিন্তু এই তো বসে আছেন। কথা বলছেন, হাসছেন! মৃত মানুষের দ্বারা এসব কি সম্ভব?”

“না, আবার হ্যাঁ।”

“আপনিও কী!”

“না, ইসাবেল, আমি ওদের মতো নই।”

“তবে কী আপনি?”

“হুঁশশ, আস্তে ইসাবেলা। আমি সব বলছি।”

আশেপাশের কিছু বিরক্ত মুখ দেখে নিজেকে শান্ত করে বসে ইসাবেলা। আগাথা বলতে শুরু করলেন,

“আমার জন্ম জার্মানির একটি ছোট্ট গ্রামে। জন্মের পর থেকে কৈশোর পর্যন্ত জেনেছিলাম আমার বাবা নেই। কুমারী মায়ের সন্তান ছিলাম আমি। এ নিয়ে অনেক কথায় শুনতে হয়েছিল। মা’কে সহ্য করতে হয় গঞ্জনা। আমার মায়ের সাথে সকল বন্ধন ছিন্ন করে তাঁর পরিবার। আমাকে নিয়ে একাই কোনোমতে জীবন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? মা নতুন করে জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। আমি রয়ে গেলাম একা। একপ্রকার না পেরে আমার দায়িত্ব নেন আমার নানী। খুবই ধর্মপরায়ণা ছিলেন তিনি। মানুষ হিসেবেও খারাপ ছিলেন না। আমার জারজ হয়ে জন্মানোটাতেই ক্ষোভ ছিল তাঁর। ওই এক কারণে একটু শক্ত আচরণ করতেন আমার সাথে। তাই বলে স্নেহের ঘাটতি ছিল না আমার প্রতি। তার সান্নিধ্যে এসে রোজ শনি, রবিবার চার্চে যাওয়া আসা হতো। ধর্মের প্রতি আমার অনুরাগ দেখে তিনি আরো ভালোবাসতে লাগলেন। সতেরো বছর বয়সে নানিমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হলো। পরিচয় হয় এক সুদর্শন পুরুষের সাথে। রিচার্ড! যাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে একসময় ভালোবেসেছিলাম।” এইটুকু বলে ম্লান হাসলেন আগাথা। ইসাবেলার ধারণা এই ম্লান হাসির কারণ সোফিয়া। আন্দ্রেই নোভার বড়ো। সুতরাং সোফিয়া আর রিচার্ডের সম্পর্ক যে কীরূপ ছিল তা খানিকটা আন্দাজ করে নিলো। আগাথা পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন,

“রিচার্ডকে প্রথম দেখেই ভালো লেগেছিল। তাই বিয়েতে না করিনি। যথা সময়ে ধর্মাচার পালন করে বিয়েটা সম্পন্ন হয়। রিচার্ড আমাকে নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠল। সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু আমার আঠারোতম জন্মদিনে প্রথম বিপত্তি ঘটল। শরীরে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। তখনও জানতাম না ইতোমধ্যে নিকো আমার গর্ভে এসেছে। আঠারো তম জন্মদিনে আমি উপলব্ধি করলাম আমার ঘ্রাণ শক্তিতে পরিবর্তন এসেছে। আর পাঁচটা মানুষের মতো নয় সেই পরিবর্তন। বিশেষ করে রাতে একটা মিষ্টি গন্ধ টের পেলাম। ঠিক শিওরের পাশের জানালার ওপার থেকে যেন গন্ধটা আসত। আস্তে আস্তে আরো কিছু পরিবর্তন টের পেতে লাগলাম। সেদিন ছিল চন্দ্রিমা রাত। কেন যেন ঘরে মন টিকল না। ছুটে বেরিয়ে এলাম। বাইরে হাড় কাঁপানো শীত তবুও গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে শরীর। একটা সুতো গায়ে রাখা গেল না। আর তখনই কানে আসত ভয়ংকর সেই গোঙানির আওয়াজ। কিন্তু ভয় হলো না মোটেও। চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। দেহ কুঁজো হয়ে যায়। অসহ্য পীড়া হতে লাগল। আর তারপরেই সেই ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হই। একটা শ্বেতকায় নেকড়েতে রূপান্তরিত হয়ে যাই আমি।”

“নেকড়ে!”

উচ্চৈঃস্বরে বলে ওঠে ইসাবেলা। আশেপাশের যাত্রীরা বিস্ফোরিত চোখে তাকাতে মৃদু হেসে বলে,

“গল্পের নেকড়ে, হে হে।” ওর বোকা হাসিতে যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কয়েকজন তো ফিসফিস করে কিছু বলে হাসল। ইসাবেলা ঝুঁকে বসে। আগাথার প্রসন্ন মুখে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,

“তারপর?”

“প্রায় রাতেই লুকিয়ে বেরিয়ে যেতাম। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রিচার্ড গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত তখন। নৈশ ভ্রমন কেবল আর ভ্রমণ রইল না। বনের পশু-পাখি শিকার করতে শুরু করলাম। শুধু শিকার করেই ক্ষান্ত দিতো না আমার নেকড়ে রূপ। ওগুলোর রক্ত মাংস খেয়ে তবে শান্ত হতো। নিজের ওমন অবস্থাতে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিলাম। একটা ভয় আমাকে সর্বদা ঘিরে রাখত। মনে হতো এই বুঝি সত্যিটা কেউ জেনে যায়। মানুষ রূপে ফিরে এলে ঘৃণা হতো নিজের ওপর। কিন্তু কী ই বা করার ছিল? এদিকে গর্ভবতী হওয়ার সকল লক্ষণ প্রকাশিত হতে লাগল। আমি গর্ভবতী জেনে রিচার্ড খুব খুশি হলো। আমি কিন্তু মোটেও খুশি হতে পারলাম না৷ স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে থেকে এ কী অস্বাভাবিক রূপ আমার? কতই না কেঁদেছি তখন। নিজের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ একসময় আরো দৃঢ় হলো। এক রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম সেই গন্ধটাকে অনুসরণ করব। তাই করলাম। নেকড়ের রূপে গন্ধটা পর্যন্ত পৌঁছাতে সমস্যা হলো না। নিবিড় অরণ্যের মধ্যে এক পাল নেকড়ের আস্থানা। গোল হয়ে বৈঠকে বসেছিল যেন। আমাকে দেখতে ওগুলো যেন অবাক হয়ে রইল। তারপর নেকড়ের ভীর ঠেলে এগিয়ে এলো আমারই রঙের এক শুভ্র গাত্রবর্ণের নেকড়ে। গন্ধটা ঠিক ওঁটার গা থেকেই আসছিল। ওঁর চোখে আমি স্পষ্ট জল দেখতে পেয়েছিলাম। আমাকে দেখে খুশি হয়েছিল যেন। কাছে এসে কপালে কপাল রাখল। বিশ্বাস করো, ওইদিন মনে হয়েছিল সবচেয়ে আপনজনকে কাছে পেয়েছি। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ইশারা করল অনুসরণ করতে। আমি করলাম। কিছুদূর বনের মধ্যে গিয়ে ওঁটাকে আর দেখলাম না। পাশ থেকে খচখচ আওয়াজে সতর্ক হতে মানুষ রূপে প্রথম দেখেছিলাম তাঁকে। আমার পিতাকে।”

“আপনি তবে অর্ধ মানবী অর্ধ নেকড়ে?”

আগাথা সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালেন।

চলবে,,,

একটা রহস্যের সামান্য ভেদ হলো আজ। বলেন তো কোনটা?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here