#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩০
Writer তানিয়া শেখ
পোল্যান্ড এবং লিথুনিয়া সীমান্তের কাছাকাছি একটি ছোট্ট গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে নিকোলাস। ইসাবেলার পা থেকে গুলি বের করা হলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ওর শরীর একেবারে দুর্বল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই ভীতিকর পরিবেশে ডাক্তার জোগাড় করা সহজ ব্যাপার ছিল না মোটেও। কিন্তু যখন প্রসঙ্গ আসে ইসাবেলার, তখন নিকোলাসের কাছে কিছুই কঠিন নয়। ওরা এখন আছে ডাক্তারের পরিচিত এক আত্মীয় বাড়িতে। দ্বিতল কাঠের বাড়িটির ওপরের তলার ছোট্ট একটি ঘরে ওদের আশ্রয় হয়েছে। এ ঘরে একটিমাত্র বিছানা। ইসাবেলার পায়ে মোটা ব্যান্ডেজ। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় ওকে। নিকোলাসের হয়েছে ঝামেলা তাতে। এই ঘরের মেঝেতেও তেমন জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে বিছানার এককোণে শুতে হয় ওকে। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ইসাবেলার পাশে শুয়ে থাকা সত্যি কষ্টসাধ্য ওর জন্য। ও কেবল দিন গুনছে। রিগা পৌঁছানো মাত্র হাঁপ ছাড়বে। ইসাবেলার পায়ে গুলি না লাগলে কবেই রিগা পৌঁছে যেত। লিথুনিয়া থেকে রিগা খুব বেশি দূরে নয়। মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ। এই কয়েক ঘন্টা এখন কয়েকদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের মনকে সে পর্যন্ত বশ মানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু একটা ভয় ওর সেই চেষ্টাকে বার বার শেষ করে দিচ্ছে। ইসাবেলা আজকাল আর ঘৃণার চোখে তাকায় না। কয়েকবার আড়চোখে তাকাতে ধরে ফেলাতে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে ইসাবেলা। এই দৃষ্টি আর ওর পূর্বের দৃষ্টি এক নয়। ভয়টা এখানেই নিকোলাসের। ইসাবেলা ওর প্রতি ভালো লাগা দেখালেই মন বশ করার আপ্রাণ চেষ্টা বৃথা যাবে। বদলে যাবে ও। দুর্বল হবে। দুর্বল হতে চায় না ও। এই বিশ্ব শাসন করতে চায়। শাসকের দুর্বল হলে চলবে না, দুর্বলতা থাকলে চলবে না। তাছাড়া ও আর ইসাবেলা তেল আর জলের মতো। ওকে নিয়ে কিছু ভাবা বোকামি। মানুষের সাথে পিশাচদের সম্পর্ক খাদ্য আর খাদকের, শিকার আর শিকারির। এর বাইরে কোনো সম্পর্ক হয় না।
“তবে এত মায়া, চিন্তা কীসের জন্য? কেন ওই সৈন্যদের ওমন করে মেরেছ তুমি? কেন আর সবার মতো ওকে শেষ করে ফেলোনি। কেন ওকে বাঁচাচ্ছ বার বার?”
“সেই প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই আমি।”
ভেতরের শয়তানটা হাসে। বলে,
“নিজের সাথে ছলনা করছ? তা বেশ, করো যত ইচ্ছে ছলনা নিজের সাথে। পস্তাবে শেষে তুমিই। খুব ভুগবে এই বলে দিলাম।”
নিকোলাস চুপ রইল। অদূরে মোরগ ডেকে উঠতে হেঁটে এলো বিছানার দিকে। গভীর নিদ্রায়মাণ ইসাবেলা। ঘুমালে ওকে নিষ্পাপ ফুলের ন্যায় লাগে। ফুল দেখলে যেমনই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়, নিকোলাসেরও তেমন সাধ জাগে ওকে ছুঁয়ে দেখার। সজোরে মাথা ঝাকায়। সে ছোঁবে না ওকে। চুপচাপ গিয়ে সটান হয়ে বিছানার এককোণে শুয়ে পড়ল। প্রভাত গড়িয়ে সকালের সূর্য ওঠে। ইসাবেলা চোখ মেলে তাকায়। অসতর্কে ডান পা নড়তে ব্যথায় ককিয়ে উঠল। নিকোলাস শুনতে পায়। ও জীবন্মৃত। মৃতের ন্যায় নিথর শুয়ে থাকলেও সব শুনতে পায়, বুঝতে পারে। কেবল নড়েচড়ে উঠতে পারে না দুপুরের আগ পর্যন্ত। ইসাবেলা কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসল বিছানার ওপর। গা ঘেমে একাকার। আজকাল বেজায় দুঃস্বপ্ন দেখছে ও। পুরো জীবনটাই যেন এখন ওর কাছে দুঃস্বপ্ন। হঠাৎ পাশে শায়িত নিকোলাসের দিকে চোখ পড়তে দৃষ্টি স্থির হলো। দুঃস্বপ্নের মাঝেও খানিক সুখের স্বপ্ন থাকে। যে স্বপ্ন মনকে একটা অন্যরকম অনুভূতি দেয়। সেটা অবশ্য ঘৃণা টিনা নয়। তবে কী? হয়তো বন্ধুত্বের মতো বিশেষ কিছু। এই যে নিকোলাস ওর এত সেবা শুশ্রূষা করছে, বার বার বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে এর জন্য বন্ধু ভাবা তো দোষের কিছু নয়।
“হুম, এই পিশাচই কিন্তু তোমার আজকের এই দশার জন্য দায়ী।”
ইসাবেলা মাথা নাড়ায়,
“না, আজ আমি যেখানে আছি আমার নিজের কারণে আছি। ওর কোনো দোষ নেই। তবে হ্যাঁ, ও যে পিশাচ তা আমি এখনও মানি। কিন্তু ভেবে দ্যাখো একবার, একটা পিশাচ হয়েও আমাকে ও মারেনি বরং সাহায্য করছে। আমাকে খুব অবাক করে এই ব্যাপারটা।”
ইসাবেলার দ্বিতীয় সত্তা ভেবে জবাব দেয়,
“আমার কী মনে হয় জানো? ও তোমাকে পছন্দ করে।”
“যা! কী ভুলভাল বকছ?” সলজ্জে হাসে ও। তারপর আবার নিকোলাসের মুখের দিকে তাকায়। ও মিথ্যা বলবে না আজ। নিকোলাস ওকে আকৃষ্ট করে। এমন সুদর্শন যুবক কাকেই বা না আকর্ষণ করবে। আর ও! ইসাবেলা হাসে। ওকে তো পিটারই ছেড়ে গেছে। আকর্ষণীয় হলে নিশ্চয়ই ছেড়ে যেত না। নিকোলাসের কাছে ও কেবল নির্বোধ। তাছাড়া কর্নেলার পতিতালয়ে একবার বলেছিল তো, ইসাবেলাকে সে পছন্দ করে না। তাহলে কেন এত কেয়ারিং। এখনও মনে পড়ে জ্ঞান ফেরার পর কতটা চিন্তিত দেখাচ্ছিল ওকে। এরপর প্রতিটি দিন ইসাবেলার সেবা শুশ্রূষা করেছে ঠিক আপনজনের মতো। রোজ নিয়ম করে খাওয়ানো, স্নান করতে সাহায্য, ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ইসাবেলার সব কাজই ও করেছে। এমনটা ও আশা করেনি। অন্তত নিকোলাসের কাছে তো নয়ই। ওর প্রতি নিকোলাসের এই করুণা বুঝে ওঠে না। হ্যাঁ, এ করুণা ছাড়া আর কী? কিন্তু একজন পিশাচ তো করুণা করে না। এই কয়েক মাসে নিকোলাসের নিষ্ঠুর, নির্মম রূপ দেখেছে। ও ধ্বংসের নামান্তর। কেবল ধ্বংস করতেই দেখেছে ওকে ইসাবেলা। মানুষকে ও করুণা করে না। ইসাবেলাও তো মানুষ তবে ওর বেলায় নিকোলাসের এই পরিবর্তন কেন? দরজায় নক পড়তে সচকিত হয়। নিকোলাসের গায়ে চাদর টানা নেই। পায়ের কাছ থেকে ওটা এনে ওর গলা অব্দি জড়িয়ে দিতে বেশ বেগ পেতে হলো। ব্যথা হচ্ছে পায়ে। কোনোমতে আগের স্থানে বসে বলল,
“আসুন।”
গৃহকর্ত্রী ট্রে হাতে ভেতরে ঢুকলেন। মধ্যবয়সী মমতাময়ী এক নারী লিভিয়া। কী এক কারণে তার মুখটা সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। দু একবার জিজ্ঞেস করেও জবাব পায়নি। নিকোলাস এবং ওর এ নিয়ে সন্দেহ হয়েছে। ডাক্তারকে প্রশ্ন করেছিল নিকোলাস। তিনি বলেন, যুদ্ধের কারণে এমন ভীত থাকে সর্বদা। মৃত্যু ভয়ে বুকের কাছে ক্রুশ ধরে দিনরাত বাইবেলের অংশ জপতে থাকে। জবাবে সন্তুষ্ট না হলেও চুপ করে যায় নিকোলাস। অন্যদিনের মতো আজও লিভিয়া বিড়বিড় করতে করতে ট্রেটা পাশে রাখল। তারপর নিকোলাসের দিকে তাকাল একবার। ইসাবেলা ভেবেছিল অন্যদিকে মতো পায়ের অবস্থা জানতে চাইবে। জবাব পাওয়া মাত্র আবার বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম হলো। লিভিয়া ওর পায়ের কাছে বসে প্রশ্ন করল,
“ও কি রোজ এমনই করে দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়?”
“না, আসলে রাতে আমাকে কয়েকবার ওয়াশরুমে যেতে হয় তো। তাছাড়া ওই ঘটনার পর আজকাল খুব দুঃস্বপ্ন দেখছি। রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়। ও রাতভর জাগে আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে। এতেই ধকল পড়ে যায় বেশি। একটু বেলা পর্যন্ত তাই ঘুমায়।” মিথ্যা বলল ইসাবেলা।
“ওহ!”
আর কিছু বলল না। ইসাবেলা প্রথম যখন লিভিয়ার মুখে রাশান ভাষা শুনেছিল বেশ উৎফুল্ল ছিল। মাতৃ ভাষায় কথা বলার মতো শান্তি দুটো নেই। দেশ থেকে আলাদা হয়ে ও যেন খুব উপলব্ধি করেছে এই কথাটা। কিন্তু লিভিয়ার সাথে কথা বলে মজা পায় না। এমন ভীতসন্ত্রস্ত অস্বাভাবিক আচরণ করা মানুষের সাথে কথা বলে কেই বা মজা পাবে? লিভিয়া উঠে দাঁড়ায়। তারপর আবার বসে। ঝুঁকে এসে বলে,
“তোমাকে একটা কথা বলব ইসাবেলা? ভয় পাবে না তো?”
লিভিয়ার ওমন বিস্ফোরিত লাল চোখ, ভীত গলার স্বর আর হঠাৎ ঝুঁকে আসাতে ও একটু ঘাবড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“না, বলুন।”
“ওরা আজ আসবে। কদিন ধরে বাড়ির চারপাশে ঘুরছে বুঝলে? কিছু একটার গন্ধ পেয়ে গেছে ওরা। গতরাতেও লনে একজনকে দেখেছি নিচ থেকে তোমাদের জানালার সোজা তাকিয়ে থাকতে। আমার ভীষণ ভয় করছে জানো তো?”
শক্ত করে ক্রুশটা ধরে বিড়বিড় করতে লাগলেন। তার চোখে এবার স্পষ্ট আতঙ্ক। ইসাবেলা ভাবল সোভিয়েত সৈন্যদের ভয়ে বুঝি এমন করছে সে। আবার ভাবে, সৈন্যরা রাতের আঁধারে এসে ঘুরে যাবে কেন? ওরা যে কতটা নির্মম আর নিষ্ঠুর সেদিন জঙ্গলে দেখেছিল ও। লিভিয়া আবার বললেন,
“তোমার স্বামীকে আমার ভালো লাগে না ইসাবেলা। কেমন যেন ওদের মতো গন্ধ ওর গায়ে।”
“কাদের মতো?” প্রশ্নটা করেই বসল ও। লিভিয়া বলল,
“রক্তচোষাদের মতো।”
ইসাবেলা আঁতকে ওঠে। রক্তচোষা! পৃথিবীতে কি আরও রক্তচোষা আছে? ও জানত নিকোলাস এবং ওর পরিবারই বুঝি এমন। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“ওরা এই গায়ে থাকে?”
“হ্যাঁ।”
“এই গাঁয়ের সকলে জানে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু সকলে এমন ভাব করে যেন কিছুই জানে না। লুকিয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমরাও পালাব আজ।”
“আপনারা পালাবেন আজ?”
“হ্যাঁ, তোমরা চাইলে সাথে যেতে পারো। যাবে?”
“কখন যাবেন?”
“এই ঘণ্টাখানেক পরে।”
ইসাবেলা ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘন্টা খানেক মানে তখন দশটা বাজবে। নিকোলাস জাগবে না। এদের বলতেও পারবে না নিকোলাস সম্পর্কে।
“না, থাক।”
“সব জেনেও যেতে চাইছ না?”
“আমার পায়ের অবস্থা তো দেখছেন। এই অবস্থায় কী করে যাই বলুন?”
“তোমার স্বামীকে জাগিয়ে তোলো। সে কোলে করে নিয়ে যাবে, যেভাবে এখানে নিয়ে এসেছিল। তাছাড়া খুব বেশি কষ্ট তো হবে না। বাড়ির বাইরে গাড়ি দাঁড়ানো থাকবে। তোমাকে কেবল কোলে করে নিচ পর্যন্ত নামাবে ও। এক কাজ করো, এখনই জাগিয়ে তোলো ওকে।”
লিভিয়া নিকোলাসের দিকে ফিরে তাকাল। ইসাবেলা স্পষ্ট দেখতে পেল নিকোলাসের গলার অ্যাডাম অ্যাপেল ওপর নিচে হতে। লিভিয়া ওর দিকে সরে বসে বলল,
“এক কাজ করি, আমিই বরং ডেকে সবটা বলি ওকে। তোমাদের নতুন বিয়ে তো। তুমি হয়তো লজ্জা পাচ্ছো বলতে।”
লিভিয়া হাত বাড়াল নিকোলাসের দিকে। লিভিয়ার অন্য হাতে শক্ত করে ধরা ক্রুশ। ইসাবেলার হঠাৎ স্মরণ হলো ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর দিনের স্মৃতি। ক্রুশের কারণে নিকোলাস আর আন্দ্রেই কষ্ট পেয়েছিল। সঠিক নিয়ম জানলে সেদিন হয়তো ওরা দুজনই শেষ হতো এই ক্রুশের আঘাতে। এদিকে ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে নিকোলাসের মুখ। শ্বদন্ত চিকচিক করছে ঠোঁটের আড়ালে। যে কোনো সময় বেরিয়ে আসতে পারে। লিভিয়া ছুঁতে যাবে ওমনি ওর হাতটা ধরে ফেলল ইসাবেলা।
“আমি পরে ডেকে সব বলব ওকে। রাতভর ঘুমায়নি বেচারা। প্লিজ কাঁচা ঘুম থেকে তুলবেন না। ওর মাথা যন্ত্রণা করবে।”
লিভিয়া রুষ্ট মুখে বলল,
“তুমি বিশ্বাস করোনি আমার কথা, না? ওরা যে আসবে বিশ্বাস করছ না। বেশ, থাকো আরামের ঘুম নিয়ে। আমার কী? সাবধান করার করে দিয়েছি আমি। এবার যা ইচ্ছে হয় করো।”
লিভিয়া অপ্রসন্ন মুখে উঠে দাঁড়ায়। শেষবার নিকোলাস আর ওর দিকে চেয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
চলবে,,,
এর বেশি আমি আর লিখতে পারলাম না আজ। আগামী পরশু আমার একটা পরীক্ষা আছে। সুতরাং দুই/তিনদিন কোনো গল্প হয়তো দেওয়া সম্ভব হবে না।