তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৩৭

0
636

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৭
Writer তানিয়া শেখ

ডিসেম্বর মাস, বরফে মোড়া পুরো গাঁ। পায়ের নিচ, গাছের শাখা, পত্র আর বাড়ির ছাঁদে পুরু বরফের আস্তরণ পড়েছে। ঘরে ঘরে চলছে ক্রিসমাসের প্রস্তুতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ক্রিসমাসের আমেজে খানিক ভাটা ফেলেছে। গ্রামের অনেক গৃহের কর্তা যুদ্ধে, কেউ বা যুদ্ধাহত হয়ে কষ্টে পার করছে দিন। তাদের সংসারের বেহাল দশা। অনেকে আবার প্রিয়জন হারিয়ে শোকে কাতর। শোকটাকে বুকে করে প্রতিবাদ জানাতে ছোটে হিল অফ ক্রসেসে। মাদাম আদলৌনা যুদ্ধে শহিদ হওয়া স্বামী এবং আহত পুত্রের স্মরণে বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে এই হিল অফ ক্রসেসে এসেছেন। শুধুমাত্র স্বামী শোকেই নন, আর সবার মতো তিনিও মৌন প্রতিবাদ জানান এখানে এসে। পুরোটা স্থান জুড়ে বড়ো বড়ো ক্রস। মাদাম আদলৌনা সাথে আনা ক্রসটা বেঁধে দেন সেখানে। এরপর নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। টের পান পেছনে দাঁড়ান মেয়েটার স্থির দৃষ্টি তাঁরই দিকে। বিনয়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। মাদাম আদলৌনা বসা থেকে উঠতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন। বয়স হয়েছে তাঁর। হাড় দুর্বল, সহজে উঠতে বসতে পারেন না এখন। মেয়েটি এগিয়ে এসে হাতটা ধরে তাঁকে দাঁড়াতে সাহায্য করে। খুব কম হাসেন মাদাম আদলৌনা। কিন্তু এই মেয়েটির আদব তাঁকে বড়ো বিমুগ্ধ করে। বিমুগ্ধতা ঠোঁট হাসি এনে ছাড়ে। দুজন পাশাপাশি হেঁটে অন্যদিনের মতো বাড়ি ফিরছে। ক্রিসমাসের আগে আগে প্রয়োজনীয় বাজার করে নেবেন বলে ভাবলেন মাদাম আদলৌনা। মেয়েটার জন্য একটা ভালো পোশাক কেনার ইচ্ছে হলো তাঁর। হাঁটতে হাঁটতে বললেন,

“কোন রঙটা পছন্দ তোমার ইসাবেল?”

ইসাবেলা হয়তো বুঝল পছন্দের রঙ জানতে চাওয়ার কারণ। বলল,

“আমার তো যথেষ্ট পোশাক আছে মাদাম আদলৌনা। অযথা নতুন পোশাকের দরকার কী?”

“ক্রিসমাসে পুরোনো পোশাক পরতে দেবো তোমাকে আমি? না!”

“ওগুলো তো অতটাও পুরোনো নয় মাদাম আদলৌনা। আমার বেশ চলবে।” মুচকি হাসল ইসাবেলা। মাদাম আশাহত গলায় বললেন,

“তবে নেবে না নতুন পোশাক?”

মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। তারপর বলে,

“একটা অনুরোধ রাখবেন মাদাম আদলৌনা?”

“আগে শুনি তো।”

“নতুন পোশাকের টাকা দিয়ে আমরা কিছু খাবার কিনি। গাঁয়ের অনেকে এই সময় না খেয়ে আছে। খাবারগুলো পেলে ওরা বরং খুশিই হবে।”

মাদাম আদলৌনা থেমে যান। ইসাবেলা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কথাগুলো বলে ঠিক করল কি না তাই ভাবছে। মাদাম আদলৌনা মুচকি হাসতে ঠিকবেঠিকের হিসেব চুকে গেল। হাসল ও। মাদাম আদলৌনা ইসাবেলাকে আশ্রয় দিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগেছিলেন একসময়। বড্ড করুণ অবস্থায় ওকে জঙ্গলে পেয়েছিলেন তিনি। ছেলের জন্য প্রায়ই জঙ্গলে বিশেষ এক ঔষধি পাতা সংগ্রহ করতে যান। বাড়ির পাশের জঙ্গলের পাতাগুলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। একজন বলল মাইল কয়েক দূরের দক্ষিণের বড়ো জঙ্গলে অনেক রয়েছে পাতাগুলো। মাদাম চাইলে কয়েকটা গাছও এনে লাগাতে পারেন। চারিদিকে তখন সোভিয়েত সৈন্যের টহল। কিন্তু একমাত্র সন্তানের সুস্থতার জন্য যে কোনো রিস্কই তিনি নিতে পারেন। আত্মরক্ষা করে জঙ্গলে গিয়েছিলেন। খুব ঝড়-বৃষ্টি ছিল সেদিন। ছাতাটা ঝড়ের দাপটে উড়ে যায়। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বেশ বড়ো একটা গাছের নিচে আশ্রয় নেন। ঝড় থামল। বৃষ্টিও কমে গিয়েছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে পাতাগুলো খুঁজে কয়েকটা গাছ সমেত তুলে নিলেন। বাড়ি ফিরবেন এমন সময় কান্নার শব্দ কানে এলো। কৌতূহলে সাবধানে এগিয়ে গেলেন। কাঁদায় মাখামাখি করে পড়ে ছিল ইসাবেলা। সাহস করে কাছে গিয়ে দেখলেন ততক্ষণে মূর্ছা গেছে ও। ওই অবস্থায় তো আর বাড়িতে আনতে পারতেন না। জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলেন। ইসাবেলার জ্ঞান ফিরতে মাদাম আদলৌনাকে দেখে প্রথমে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছিল ও। চোখ- মুখ ছিল ফ্যাকাশে। মাদাম আদলৌনা ওকে অভয় দিয়েও কোনো কথা মুখ থেকে বের করতে পারলেন না। বেশ মায়াও হলো ওর ওই দুরবস্থা দেখে। সঙ্গে নিতে চাইলে রাজি হলো না। মাদাম আদলৌনা বুঝলেন, কারো অপেক্ষা করছে ও। তিনি অনেকক্ষণ বসলেন ওর পাশে। অথচ, তিনি নিজেও সন্দিহান ছিলেন মেয়েটাকে সাথে নেওয়ার ব্যাপারে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। কেউ এলো না দেখে মাদাম ওকে বুঝিয়ে রাজি করলেন। একা জঙ্গলে থাকাটা নিরাপদ নয়। ইসাবেলা নিরুপায় হয়ে রাজি হলো। ওকে দাঁড় করাতে গিয়ে মাদাম আদলৌনা টের পেলেন এক পা আহত ওর। কোনোরকমে ধরে রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে এলেন। সেখানে মাদামের ঘোড়া গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। ইসাবেলা গাড়িতে উঠেও পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিল। মাদাম কারণ জিজ্ঞেস করলে মাথা নত করে ফুঁপাতে লাগল। তিনি ভাবলেন ওর পায়ের কারণে হয়তো আপনজন ফেলে চলে গেছে। সান্ত্বনা দিলেন। তাঁর সন্তানের কষ্ট ইসাবেলার মধ্যে দেখে করুণা আরো যেন বেশি হলো। বাড়িতে আনার কিছুদিন পরেই মাদাম আবিষ্কার করলেন ইসাবেলা রাশিয়ান। কিছু কারণে লিথুনিয়া আর রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো নয়। দু দেশের জনগনের মধ্যেও এর প্রভাব পড়েছে। মাদাম আদলৌনা একবার ভেবেছিলেন ইসাবেলাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলবেন। কিন্তু তাঁর ছেলে মাতভেই মায়ের মনের খবর টের পেয়ে নিষেধ করে এমন কাজ করতে। একটা অসহায় মেয়েকে কেবল ওর জাতিগত কারণে এভাবে বিপদের মুখে ছেড়ে দেওয়া অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা বলে মনে করে মাতভেই। তাছাড়া ইসাবেলার প্রতি ওর বিশেষ মায়া আছে বলে ধারণা মাদাম আদলৌনার। দুজনের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। পঙ্গু ছেলের মন রক্ষার্থে ইসাবেলাকে বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। মাতভেই প্রায় ইসাবেলা নিয়ে বলে,

“ইসাবেল, খুব ভালো মনের মেয়ে মা। খুব সরল আর পবিত্র ওর মন। ঠিক একটা ফুল যেন। ওর সান্নিধ্যে গেলে অপবিত্রতা দূর হয়ে যায়। ওকে তুমি তাড়িও না মা। আমি কথা দিয়েছি আমার পা’টা একটু ভালো হলে রাশিয়া পৌঁছে দিয়ে আসব ওকে।”

ছেলের কথা শুনে প্রথম প্রথম বিরক্ত হতেন। কিন্তু এখন তিনি নিজেও মানেন ইসাবেলা ভালো মেয়ে। নিজেকে রেখে অন্যকে নিয়ে যে ভাবে সে খারাপ হয় কী করে?

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের পার্শ্ববর্তী রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।

“চলো কিছু বাজার করে নিই।” বললেন মাদাম আদলৌনা। ইসাবেলা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। বাজার ঘুরে ঘুরে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ির পথে রওনা হলেন। মাদামের হাতে একটা ব্যাগ আর ইসাবেলা নিয়েছে দুটো। ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে অনেক কিছু কিনেছেন মাদাম। ইসাবেলার অনুরোধে অতিরিক্ত ময়দা এবং বাটারও কেনা হয়েছে। সাথে কিছু মাংস। উদ্দেশ্য অনাহারে থাকা মানুষগুলোকে অন্তত একবেলা খাওয়ানো। বাড়ির কাছাকাছি ব্রিজের কাছে এসে থেমে গেল ইসাবেলা। সূর্যের তেজ বাড়াতে বরফ গলতে শুরু করেছে। ঝিলের পাড়ের বরফ গলে দুটো হলুদ টিউলিপ দেখা যাচ্ছে।

“মাদাম, আপনি বাড়িতে যান আমি আসছি।” হাতের জিনিসগুলো রেখে দৌড়ে গেল সেদিকে। ফুল দুটো দেখে ওর হৃদয় এবং চোখ প্রশান্তিতে ভরে যায়। ছিঁড়বে কি না ভাবতে লাগল। পেছন ফিরে বলল,

“মাদাম?”

“হ্যাঁ, বলো।”

“ফুলদুটো ভীষণ সুন্দর।”

“ছিঁড়ে আনো।”

“সত্যি ছিঁড়ব?”

“তাই তো করতে ছুটে গেছো।”

“না, থাক।” মনমরা হয়ে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। ফুল গাছেই সুন্দর। হাতে এলে মূর্ছে যাবে। মাদাম ব্রিজের ওপর থেমে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“ছাগলে খেয়ে নেবে দেখলে। তুমি বরং ছিঁড়েই আনো ইসাবেলা।”

“এত সুন্দর ফুল ছাগল খেয়ে নেবে!”

“ছাগলের তো আর তোমার আমার মতো সৌন্দর্য জ্ঞান নেই। ওরা যা দেখে খাদ্য হিসেবেই দেখে। আর কথা বাড়িও না। চলে এসো তাড়াতাড়ি। ঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে। মাতভের গোসলের সময় হলো।”

ফুল ছিঁড়া নিয়ে এতক্ষণ দোনোমোনো ছিল। মাতভেইর কথা মনে পড়তে ফুলগুলো ছিঁড়ে নিয়ে রেখে যাওয়া ব্যাগ তুলে চললো বাড়ির দিকে। মাদাম আদলৌনা হাতের ব্যাগ সহ কিচেনে ঢুকেছেন। পরনের সোয়েটার খুলতে খুলতে বললেন,

“মাতভেই কী করছে দেখে এসো তো ইসাবেলা।”

“এক্ষুনি যাচ্ছি।”
হাতের ব্যাগ নামিয়ে সোয়েটার খুলে ফুলদুটো নিয়ে চলে এলো দোতলায়। মাতভেইর দরজায় নক করতে ভেতর থেকে জবাব এলো,

“এসো ইসাবেল।”

আহত পা মেলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসেছিল মাতভেই। হাতে নতুন বই। ইসাবেলা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওর সামনে বসে বলল,

“দেখো কী এনেছি!”

হাতের বইটা কোলের ওপর রাখল মাতভেই। গোল চশমা নাকের ওপরে ঠেলে ইসাবেলার হাতের ফুলগুলোর দিকে তাকাল।

“হলুদ টিউলিপ!”

“সুন্দর না?”

“খুব। তা কোথায় পেলে এই সুন্দরীদের?”

খিলখিল করে হেসে উঠল ইসাবেলা।

“ব্রিজের পাশে। তোমার পছন্দ হয়েছে?”

“অনেক।”

মাতভেই বইটা পুনরায় খুললো। ইসাবেলা উঠে বেডের পাশের ছোট্ট টেবিলের ফুলদানির পাশে রাখল টিউলিপ দুটো। ফুলদানির ফুলগুলো নেতিয়ে পড়েছে। ওগুলো নিয়ে নিচে এলো। মাদাম কিচেনে নেই। ইসাবেলা ফুলদানি পরিষ্কার করে নতুন পানি ভরে আবার ওপরে উঠে এলো। আগের স্থানে ফুলদানিটা রেখে টিউলিপ দুটো ওতে রাখল। মাতভেই বই থেকে মুখ তুলে ওর হাসিমুখ দেখে মুচকি হাসল। ইসাবেলা ওর দিকে ফিরতে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মাতভেই। মুখোমুখি বসল ইসাবেলা।

“কী পড়ছ?”

“বই।” বিদ্রুপের সুরে বলল মাতভেই। ঠোঁট উলটে ফেলে ইসাবেলা। ওর গাল টেনে দিয়ে মাতভেই বলল,

“তুমি এত কিউট কেন?”

“উঁহু, মাতভেই!” গাল ডলতে ডলতে রেগে তাকাল ইসাবেলা। মাতভেই বইটা রেখে পাশ থেকে নতুন একটা বই বের করে বলল,

“এটা ধরো।”

“আমার জন্য?”

“হুম, এটা পড়লে বাল্টিক ভাষা আরো ভালো বলতে পারবে। যদিও অনেক স্পষ্ট এখন তোমার উচ্চারণ। তবে আরো চর্চা করতে হবে। কোথাও সমস্যা হলে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ঠিক আছে?”

“ইয়েস, স্যার।” স্যালুট করতে মাতভেই হাসল আবার। ওর সাথে ইসাবেলাও। ইসাবেলার হাসি মুখে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল মাতভেই। এই মেয়েটার মুখ কারো কথা মনে করিয়ে দেয়। কত স্মৃতি তখন ভাস্বর হয় হৃদয়পটে! ইসাবেলার মাথার স্কার্ফ থেকে কয়েকটা চুল বেরিয়ে এসে কপালে পড়েছে। ঝুঁকে তর্জনী দিয়ে ছুঁয়ে কানের পাশে গুঁজে দিলো মাতভেই। ইসাবেলার হাসি থেমে যায়। একদৃষ্টে চেয়ে আছে মাতভেইর চোখে।

“বেল?” ইসাবেলার গালের একপাশে হাত রাখল মাতভেই। ইসাবেলা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। এই নৈকট্য ওকে অস্বস্তি দেয়। সরে বসতে গিয়েও জড়তা জাগে।

“বেল?”

“হুঁ?”

“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো?”

“হ্যাঁ।”

মাতভেই মুচকি হেসে ওর কপালে চুমু দিয়ে আগের মতো সরে বসল। ইসাবেলা কিছুই যেন বুঝল না। ভুরু কুঁচকে বলল,

“কেন বললে ওকথা?”

“কোন কথা?” বইয়ে ফের মনোযোগ দিলো মাতভেই।

“বিশ্বাস করি কি না।”

“আমি কাছে যাওয়াতে অস্বস্তি হচ্ছিল তোমার। ভেবেছিলে কিছু বোধহয় করে ফেলব, তাই না?”

লজ্জিত হয় ইসাবেলা। মাতভেই শব্দ করে হাসল।

“তোমাকে মাস দুই আগে কী বলেছিলাম মনে আছে?”

“হ্যাঁ, তুমি আমাকে বন্ধু ভাবো।”

“এক্সাক্টলি, তাহলে আমার সাথে এখনো সহজ হও না কেন তুমি? এত জড়তা কীসের? তুমি কি অন্যকিছু ভাবো__”

“না, না। আমি বন্ধু আর বড়োভাই ছাড়া আর কিছু ভাবি না তোমাকে। কসম করে বলছি।”

গলা ছুঁয়ে বলল ইসাবেলা। ওর আতঙ্কিত মুখ দেখে না হেসে পারে না মাতভেই।

“বোকা মেয়ে, আমি তো এমনিতেই বলেছি। আয়নায় তাকাও কেমন আতঙ্কিত হয়ে আছে তোমার মুখ। সামান্যতেই ঘাবড়ে গেছো। এসব কিন্তু ভালো লক্ষণ নয় ইসাবেল।” দুষ্টু চোখে ভুরু নাচাতে লাগল মাতভেই। ইসাবেলা রুষ্ট মুখে উঠে দাঁড়ায়। হাতের বইটা দিয়ে মাতভেইর বাহুতে বাড়ি দিয়ে বলে,

“তুমি সবসময়ই এমন ফাজলামো করো মাতভেই। ধ্যাৎ! ভালো লাগে না। আর কখনো ফুল এনে দেবো না তোমাকে।”

“আচ্ছা, সরি। এই নাকে ধরেছি।”

“লাগবে না তোমার সরি। অসভ্য কোথাকার।”

গাল ফুলিয়ে বেরিয়ে যায় মাতভেইর ঘর থেকে। মাদাম আদলৌনা কিচেনে দুপুরের খাবার তৈরি করছিলেন। চুলায় মাতভেইর গোসলের পানি গরম হচ্ছে। ইসাবেলার গোমড়া মুখ এসে বসল চুলার পাশে।

“আবার কী হয়েছে?” জানতে চাইলেন মাদাম আদলৌনা। ইসাবেলা বলল,

“কিছু না।”

হাঁপ ছেড়ে আটা গুলতে লাগলেন মাদাম।

“তোমার কারণে ছেলেটার মুখে একটু হাসি দেখি। না হলে পায়ের কারণে ছেলে আমার ডিপ্রেশনে ভুগছিল। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল মাতভেই। দিনরাত বন্ধ ঘরে বসে দুশ্চিন্তা করত। কথা বলাও ছেড়ে দিয়েছিল। তোমার কারণে ছেলেটা আমার আবার আগের মতো হয়েছে। কোনোদিন ওর পা ঠিক হবে কি না জানি না, কিন্তু ও বাঁচার আশা আর ছাড়বে না। তুমি ওকে সেই মনোবল জুগিয়েছ। কৃতজ্ঞ আমি তোমার কাছে ইসাবেলা।”

“এসব বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না মাদাম। কৃতজ্ঞ তো আমি আপনাদের কাছে। অচেনা একটা মেয়েকে আপন সন্তানের মতো গৃহে আশ্রয় দিয়েছেন। মাতভেই ছোটোবোনের মতো ভালোবাসা দিয়েছে। আপনাদের এই ঋণ আমি কিছুতেই পূরণ করতে পারব না।”

মাদাম হাত ধুয়ে ইসাবেলাকে কাছে ডাকেন। ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলেন,

“সৃষ্টিকর্তা তোমার দুঃখ কষ্ট লাঘব করে দিন। সুখী হও জীবনে মা।”

ইসাবেলা সরে এসে মাদামের হাতটা ধরে অশ্রুসজল চোখে বলে,

“মাতভেই আবার হাঁটবে। আবার আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরবে ও। আপনি চিন্তা করবেন না ওকে নিয়ে।”

“হুম, তাই যেন হয় মা।”

মাদাম আবার ব্রেড বানানোর কাজে লেগে যান। ইসাবেলা স্যুপ তৈরির প্রস্তুতি নেয়। স্যুপ তৈরির সামগ্রীর মধ্যে গাজর খুঁজে পেল না।

“মাদাম গাজর তো আনা হয়নি।”

“আহ! ভুলে গেছি।”

“এখন গিয়ে নিয়ে আসব?”

“ঠিক আছে। সাথে দু হালি ডিমও এনো।”

পার্স থেকে টাকা বের করে দিলেন ইসাবেলাকে। ব্রিজের পথে গেলে সময় বেশি লাগে। সময় বাঁচাতে পুব দিকে জঙ্গলঘেরা হাঁটু সমান বরফের ওপর দিয়ে রওনা হয়। এই পথে যেতে ওর ভালোয় লাগে। পাখির কূজন শুনতে শুনতে এগিয়ে যায়। দুপুর হতেই সূর্যের তেজ ম্লান হয়। মৃদু বাতাসে উড়ে আসা বরফের ছাঁট বাড়িয়ে দেয় ওর গায়ের কাঁপুনি। শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে মুখ থেকে ধোঁয়া ওড়ে। বাজারে পৌঁছে কেজি খানেক গাজর আর দু হালি ডিম নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয় আবার। ডিম আর গাজর একটা ব্যাগে ভরে বা’বাহুর সাথে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। ডান হাতে চিকন লম্বা একটা গাজর। ওটা এক এক কামড়ে চর্বণ করতে করতে জঙ্গলের পথ ধরে এগোচ্ছিল। হঠাৎ একটা পরিচিত গন্ধে পা জমে গেল। সেই সোঁদা মাটির গন্ধ! ডান হাতের অর্ধ খাওয়া গাজর ঠোঁটের কাছের থেমে আছে। বা’বাহু শক্ত হয় ব্যাগের ওপর। ঘুরে তাকায় বা’দিকে। না কেউ নেই। ধীরে ধীরে ডান দিকে ঘুরতেই চমকে ওঠে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। পরনে সেই কালো আলখেল্লা। হুডি ঘাড়ের ওপর পড়ে আছে। চট করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় ইসাবেলা। কান্নার তরঙ্গ ওর বুকে আছড়ে পড়ে। চোখ দু’টো ভীষণ জ্বলছে। হাত- পা জমে যাওয়ার উপক্রম। ডান হাতের গাজর মাটিতে পড়ে যায়। ব্যাগটাও হয়তো পড়ত, ইসাবেলা বাহু শক্ত করে। এতদিন বাদে নিকোলাসকে দেখে বুকের বা’পাশে গোপন ব্যথাটা নড়ে উঠল। প্রকাশ্যে আসার জন্য বেপরোয়া। আর দুর্বল হতে চায় না ইসাবেলা। যে নির্দয়ভাবে ছেড়ে গেছে তার প্রতি কোনো আবেগ জাহির করবে না। দ্রুত পদে হাঁটতে লাগল সামনে। যত এগোচ্ছে সেই পরিচিত গন্ধটা ততই হারিয়ে যাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ইসাবেলার। চেপে রাখা কান্নাটা বানের জলের মতো ফুঁসে ফেঁপে বেরিয়ে এলো চোখ দিয়ে। চোখ মুছতে মুছতে ছুটল বাড়ির দিকে। পেছন ফিরে তাকাবে না ও। নিকোলাসের জন্য ওর মনে আর কোনো স্থান নেই। কিন্তু মন যে সেকথা মানতে চাইল না। এত উপেক্ষা আর ব্যথার পরেও নিকোলাসকে আরেকবার দেখার সাধ জাগে। থেমে যায় ইসাবেলা। ঘুরে দাঁড়ায় জঙ্গলের দিকে। নিকোলাসের ছায়াও এখন আর নেই সেখানে। ঠোঁট শক্ত করে চেপে ব্রিজে ওঠে। বিড়বিড় করে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে,

“কেন নিকোলাস? কেন? আর যে সহ্য হয় না আমার। হৃদয় ভাঙার ব্যথা কত সাংঘাতিক যদি জানতেন আপনি নিকোলাস! যদি বুঝতেন সেদিন কতটা আঘাত আমায় দিয়েছেন! বোকা আমি, ভুলে যাই কারো দুঃখে আপনার কিছু এসে যায় না। ভুলে যাই আপনার কাছে কিছু আশা করা বোকামি। এত কিছু জেনেও আমার মন বার বার একই ভুল, একই বোকামি করে। কী করব এই মনকে নিয়ে আমি? কী করব!”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here