#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৮
Writer তানিয়া শেখ
থমথমে রাত। গহীন অরণ্যের মাঝে একদল নর -নারী হাঁটু ভেঙে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছে। সামনে বহু পুরোনো মদভর্তি বোতল, ক্রন্দনরত পাঁচটা শিশু আর ভীতবিহ্বল অর্ধ নগ্ন দুজন তরণী। প্রার্থনারত নর -নারীর মুখে অদ্ভুত শব্দ। অশুভ শক্তিকে আহ্বান করছে ওরা। অদূরে জ্বলছে তিনটে মশাল। সেই মশালের আলোতে অস্বাভাবিক ওদের চাহনী। রাত গভীর হতেই অশুভ শক্তির প্রতি আহ্বান আরো জাগ্রত শোনায়। অশুভ এক আবহাওয়া চারিদিকের ঘন কালো অন্ধকারে জড়িয়ে যায়। ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে নেকড়ের গর্জন। একটা দুটো এমন করে অসংখ্য নেকড়ের গর্জনে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। ধীরে ধীরে মানুষগুলোর দিকে অগ্রসর হয়। প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে থাকা নর-নারীরা কাঁপছে থরথর করে। শীতে নয়, আতঙ্কে। কিন্তু সেই আতঙ্ক চোখ ওদের পর্যন্ত পৌঁছাছে না। চোখে তখন কেবল লোভ আর লালসা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। চাপা গোঙানির শব্দ শুনতেই ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হলো ওদের।
“প্রভু, প্রভু।” আগের চাইছে জোর গলায় ডাকল ওরা। হঠাৎ অনেকগুলো কালো বাদুড় উড়ে এসে ঘিরে ধরল। তারপর সেই বাদুড় একটা মানুষের অবয়ব নেয়। দু-হাত শূন্য তুলে উঁচু গলায় পিশাচ বন্দনা করে। ঝুঁকে পড়ে মূর্তিটির সামনে। আবেগ ঢেলে পড়ল ওদের গলায়,
“প্রভু, প্রভু।”
আপাদমস্তক কালো আলখেল্লা পরা দীর্ঘদেহি এক মানব মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে। চোখ দুটো এবং নাক হুডির আড়ালে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওর রক্তিম ঠোঁটের দু’পাশের সাদা দাঁত। জ্বলন্ত বুভুক্ষু চোখে এক পাল নেকড়ে এসে থামল দু’পাশে। সদর্পে পায়চারি করতে করতে মূর্তিটি বলল,
“আমি খুশি হইনি তোদের কাজে। সন্তুষ্ট করতে পারিসনি আমাকে তোরা।”
রাগে ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করে। সামনে বসা এক মধ্যবয়সী নারী থুতনি তুলে সরাসরি চেয়ে বলে,
“খুশি হননি? আপন স্বামী-পুত্রের শেষ রক্ত পান করেছি আপনাকে সন্তুষ্ট করতে। গোরু- ছাগল, পাখি কিছুই বাদ রাখিনি। আর কী করব বলুন প্রভু। আর কী করলে অমরত্ব পাব আমি?”
আলখেল্লা পরিহিত মূর্তিটি এগিয়ে এসে রমণীর চোয়াল চেপে নিকটে এনে বলে,
“ব্যস এইটুকু! এখনো এই গাঁয়ে জীবন্ত মানুষের হাসি শোনা যায়, ঘরে ঘরে পবিত্র মানব শিশু জন্মায়, ঈশ্বরের আরাধনায় গির্জার ঘণ্টা বাজে। আমি চাই এসব বন্ধ হোক। গাঁয়ে জীবন্ত নয় জীবন্মৃতের হাসি শোনা যাবে, মানব শিশু জন্মাবে পিশাচের গোলামি করতে, গির্জায় ঘণ্টা ঈশ্বরের নয় আমার আরাধনায় বাজবে। তোরা সবকটা অকর্মা। তোদের দিয়ে এসবের কিছুই হয়নি। গোলামিটাও ঠিকমতো করতে পারিস না তুচ্ছ মানুষ। আবার অমরত্ব চাস? গোলাম, অমরত্ব নয় তোকে মৃত্যু দেবো।”
ঠোঁটের পাশের সাদা সুচালো দাঁত দু’টো মুহূর্তে নারীর নগ্ন কাঁধে গেঁথে যায়। অসহ্য যন্ত্রণা ছটফট করতে লাগল। খানিক পরে নারীর আর্তনাদ থেমে যায়। মাটিতে পড়ে গেল ওর নিথর, প্রাণহীন দেহ। বাকিরা আতঙ্কিত। নত মাথায় ক্ষমা প্রার্থনা করছে। কিন্তু ওরা জানে না, ক্ষমা শব্দটা পিশাচের অভিধানে নেই। এরা কেবল আপন স্বার্থে চলে। ওই নারীর মতোই দশা হয় বাকিদের। নেকড়েদের রাতের খোড়াকে পরিণত হতে হয়। ওদের আহাজারি, নেকড়ের গর্জন আর পিশাচটার পৈশাচিক হাসিতে কেঁপে ওঠে রাতের নির্জনতা। শিশু আর তরুণীদের তুলে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় পিশাচ মূর্তিটি। মুহূর্তে আবার সেই নিশুতি নিস্তব্ধতা।
গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ইসাবেলা। গলা অব্দি কম্বল টানা। ঘুমের ঘোরে বা’কাঁত হলো। বন্ধ ঘরে আচমকা দমকা হাওয়া বইতে লাগল। জানালার পর্দা উড়ে একপাশে সরে যায়। বাঁকা চাঁদ আকাশে। চাঁদের আলো এসে পড়ল ঠিক ইসাবেলার শিওরে। মাথার কাছের জানালার ফাঁক গলে একটু একটু করে ঘরে ধোঁয়া ঢুকল। স্বরূপে আবির্ভূত হলো নিকোলাস। নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় ইসাবেলা মাথার পাশে। অনিমেষ চেয়ে আছে চন্দ্রালোকিত ইসাবেলার মুখশ্রীতে। এই নিস্তব্ধতার মধ্যেও একটা শব্দ ওর কানে এসে লাগল। ঢিপ, ঢিপ, ঢিপ। হাত রাখল বুকের বা’পাশে ওপর। শব্দটার উৎপত্তি এখান থেকে। শব্দ বেজে ওঠে কেবল এই ঘুমন্ত তরুণীর কাছাকাছি এলে। ও নিকোলাসের সব এলোমেলো করে দিয়েছে। ঘৃণা করে ম্যাক্স এবং তাঁর বংশধরদের। কিন্তু ইসাবেলাকে কেন ঘৃণা করতে পারছে না? মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এতদিন দূরে থাকার পরেও আবার এই মেয়ের সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে আসার পূর্বে পণ করেছিল ইসাবেলার খোঁজ নেবে না। দুদিন না যেতেই সে পণ ভেঙেছে। পাবে না জেনেও গিয়েছিল সেই জঙ্গলে আর লিভিয়ার বাড়িতে। কোথাও ছিল না ইসাবেলা। গত চারমাস মনকে বুঝিয়েছে ও ইসাবেলার পরোয়া করে না। যা করেছে তাতে একটুও অপরাধবোধ নেই। কিন্তু সেদিন ইসাবেলাকে না পেয়ে, ওর সাথে কিছু ঘটেছে এই ভয়ে পূর্বের সব কথা অর্থহীন হয়েছে। ওর নির্মমতা ওকেই শতগুণে আঘাত করেছে। ক্ষুব্ধ হয় নিজের ওপর। কেন এত নিষ্ঠুর হলো সে? কেন? ভেতর থেকে জবাব এলো,
“এই নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতাকে একদিন স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিস তুই। ধ্বংস ছাড়া এ স্বভাব থেকে তোর নিষ্কৃতি নেই।”
নিকোলাস জানে এ সত্যি। জানে বলেই নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি। ইসাবেলাকে বলেনি কতটা পছন্দ করে ওকে। অপ্রকাশিত অনুভূতি যত সহজে উপেক্ষা করা যায় প্রকাশ্যে এলে তা কঠিন হয়। তাছাড়া ম্যাক্সের বংশধরদের সাথে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় না। এই ম্যাক্স নাম নিকোলাসের ভালোলাগাকে ক্রোধে পরিণত করে। সেই ক্রোধের স্বীকার হয়েছে ইসাবেলা। বার বার এমনই হবে। কষ্ট পাবে ইসাবেলা। এই একজন মানুষকে কষ্ট দিয়ে শান্তি পায় না নিকোলাস। নিজের শান্তির জন্য হলেও ইসাবেলাকে কষ্ট দিতে নারাজ। এ নিয়ে স্বভাব আর মনে চলে তুমুল লড়াই।
“আমি তোমায় ব্যথা দিয়েছি বিনিময়ে ঘৃণা, ক্ষোভ আমার প্রাপ্য। এই প্রাপ্য আমি অস্বীকার করি না, বেলা। কিন্তু আজ যখন দেখেও মুখ ফিরিয়ে চলে গেলে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল আমার। অস্বীকার করতে ইচ্ছে হলো তোমার এই রাগ, ক্ষোভকে। বেলা, এখন কি তুমি আমাকে ঘৃণা করো? হয়তো করো। এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ, আমার মন চাইছে কিছু অস্বাভাবিক হোক। নিষ্ঠুর হওয়ার সাথে সাথে কেমন স্বার্থলোভীও আমি, তাই না বেলা?”
বিদ্রুপের হাসি নিকোলাসের ঠোঁটে। ইসাবেলার শিওর থেকে উঠে জানালার কাছে যায়। পেছন ফিরে শেষবার ওর মুখটা দেখল।
“জানি না, কোন তীব্র আকর্ষণ আমার সকল নিয়ন্ত্রণে ধ্বস নামায়! চঞ্চল হয় মন। আসব না, দেখব না ভেবেও গন্তব্য শেষ হয় তোমার দুয়ারে। আমি চাই না আবার চাই তোমায়, বেলা। এই চাওয়া না চাওয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্ব কোনোদিন শেষ হবে কি না জানি না, শুধু জানি তোমাকে ভুলে থাকা আমার দ্বারা আর হবে না। আমি চাইলেও সেটা এখন অসম্ভব। এই অনুভূতির যন্ত্রণা যদি কেউ বুঝত!”
যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে গেল নিকোলাস। মিনিট বাদে ইসাবেলা ডান পাশ ফিরল। ধীরে ধীরে সিক্ত চোখ মেলে তাকায়। বালিশের কোণাটা দুহাতে চেপে ধরে মুখ গুঁজে কান্নার শব্দ গোপন করার চেষ্টা করে। মনে মনে ভাবে, একি স্বপ্ন ছিল? নিকোলাস কি স্বপ্নে এসেছিল? যা শুনল সব কি ওর স্বপ্ন? কিন্তু সেই সোঁদা মাটির গন্ধ যে স্পষ্ট পেয়েছিল ও। নাক টানল আরেকবার। এখনো এই ঘরে গন্ধটার রেশ রয়ে গেছে। তবে সত্যিই এসেছিল ওর ঘরে নিকোলাস? ওই কথাগুলো স্বপ্নে নয় বাস্তবেই বলেছে? ইসাবেলার সর্ব শরীর অসাড় হয়ে এলো। অস্থির হয়ে ওঠে চিত্ত। নিকোলাসের মনের কথা জেনে কীভাবে প্রতিক্রিয়া করবে ভেবে পেল না। কাঁদতে কাঁদতেই হেসে উঠল, পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে হয়ে গেল। এভাবে বিক্ষিপ্ত মনে নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো ঘণ্টা পর ঘণ্টা। রাত ভোর হওয়ার পথে। ইসাবেলা আবার বা’পাশে ফিরে শোয়। সামনের অন্ধকারে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। একসময় জলে ভরে উঠল আঁখি।
“আপনাকে ঘৃণা করতে পারলে বুঝি ঠিক হতো, কিন্তু সেই ঠিক আজ আমার কাছে বেঠিক নিকোলাস। আপনাকে ঘৃণা করা ইহজীবনে আমার হবে না। পিটারকে আমি ভালোবাসতাম, ভেবেছিলাম এই অনুভূতি কখনো বদলাবে না। আজ দেখুন, ভালোবাসি কথাটা ভালোবাসতাম হয়ে গেল। বেঈমান, বেহায়া হলো আমার মন আপনার কারণে নিকোলাস।” দু-হাত বুকে জড়ো করে বলে,” ঈশ্বর, আর দেখিয়ো না তাঁকে। এ মন বড়ো দুর্বল। একবার একজন ভেঙেছে, জোড়াতালি দিয়ে বেঁচে আছি। এবার ভাঙলে যে আর বাঁচতে পারব না। যা আমার হবে না তাতে আর মন মিশিয়ো না। দয়া করো প্রভু, এই দুর্বল মনের ওপর করুনা করো।”
ইসাবেলার রাত ভোর হলো অশ্রু বিসর্জন দিয়ে। ভোরের দিকে আবার ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে মাতভেইর ডাকে। ঘুম জড়ানো চোখে দরজা খুলে আবার ফিরে এলো বিছানায়। কম্বল টেনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। মাতভেইর ক্রাচের ঠক ঠক শব্দ বিছানার পাশে এসে থামে। বিছানার একপাশ দেবে যায়। ইসাবেলার রাতের কান্না হঠাৎ ফিরে আসে। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে মাতভেই।
“বেল, কী হলো তোমার? কেন কাঁদছ?”
কোনো জবাব নেই। ফুঁপিয়ে কাঁদছে ইসাবেলা। মাতভেই আর প্রশ্ন করল না। ইসাবেলা ওকে নিজের জীবনের অনেক কিছুই বলেছে। নিজের পরিবার পরিজনের কথা, পিটারের কথা। অসুস্থতার কারণে বায়ুবদলে বাড়ি থেকে দূরে আসা। আততায়ীর হাতে ভ্যালেরিয়ার মৃত্যু তারপর সেখান থেকে পালিয়ে একের পর এক বিপদ কাটিয়ে এই পর্যন্ত লিভিয়ার আশ্রয়ে থাকা ইত্যাদি। মাতভেই বিশ্বাস করেছিল ওর কথা। মেয়েটার প্রতি করুণা জন্মেছিল। কথা দিয়েছে পা’টা চলার মতো ঠিক হলেই বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বাড়ির কথা মনে পড়ছে, বেল?”
ইসাবেলা মাথা ঝাঁকাল হ্যাঁ সূচক। হাঁপ ছেড়ে আহত পায়ের দিকে তাকায় মাতভেই। পা’টা যে কবে ঠিক হবে! কবে পৌঁছে দেবে আপন দেশে মেয়েটাকে!
ক্যাম্প এবং যুদ্ধ স্থলের অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় পায়ের টিস্যু অকেজো হতে থাকে। অসহনীয় ব্যথা হতো। ওর সাথের কয়েকজন সৈন্যের মৃত্যু ঘটেছিল এই রোগে। মাতভেই মরেনি কিন্তু ওর ডান পা’টা প্রায় অকেজো হয়ে যায়। ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বলেছেন এ পা আর ভালো হবে না। পঙ্গু দিয়ে তো যুদ্ধ হয় না। ফিরতে হলো বাড়িতে ওকে। মাদাম আদলৌনা আশা ছাড়েননি। আধুনিক ঔষধ যা পারেনি ভেষজপাতা দিয়ে তাই চেষ্টা করছেন। আজকাল মাতভেই সামান্য অনুভব করে পায়ে। হতাশা ভুলে নিজেও মনে মনে আশা করে একদিন দুপায়ে দাঁড়াবে। ইসাবেলা সেই আশায় জোর বাড়িয়ে দিয়েছে। এই মেয়েটাকে দেওয়া কথা ওর মনোবলে শক্তি জোগায়। মাত্র পঁচিশ বছরের জীবন। কত কী দেখার, করার বাকি আছে। ওই যে মেয়েটা- যাকে মাতভেই মন দিয়ে বসে আছে। যে মাতভেইর জীবনের প্রথম প্রিয়তমা। পরপর দুটো রাতের সঙ্গীনি ছিল মেয়েটি। ওই দুই রাতই শ্রেষ্ঠ রাত মাতভেইর জীবনে। এরপর আর দেখা হয়নি, বলা হয়নি মনের কথা। ইসাবেলাকে রাশিয়া নিয়ে যাওয়ার পর সে আরেকবার ওই ক্লাবে যাবে। খুঁজবে মেয়েটাকে। প্রায় দু’বছর হতে চললো। এতদিনে মেয়েটার নিশ্চয়ই নতুন সঙ্গী হয়েছে? অথবা প্রেমিক? এখন কি মাতভেইকে চিনবে? মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে এসব ভেবে।
ইসাবেলা চোখ মুছে উঠে বসল। এতক্ষণ কেঁদে বড্ড হালকা লাগছে। মাতভেইর প্রশ্ন এড়াতে বিছানা ছেড়ে নেমে সোয়েটার পরে নেয়। অবিন্যস্ত চুলগুলোর ওপর স্কার্ফে পরতে পরতে বলল,
“নাস্তা করেছ মাতভেই?”
“না, একসাথে নাস্তা করব বলেই ডাকতে এলাম।”
“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি রুমে গিয়ে বসো।”
“রুমে নয়, আজ লনে বসে নাস্তা করব।”
“লনে! মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? এত ঠাণ্ডার মধ্যে লনে বসলে পায়ে সমস্যা হবে তোমার।”
“হবে না। পায়ে একসাথে তিনটে গরম মোজা আর বুট পরে নেবো।”
“না।”
“প্লিজ বেল। একসপ্তাহ ঘরে বসে বোর হয়ে গেছি। শুধু আধঘণ্টা বসব।”
“মাদাম রাগ করবেন।”
“করবে না। আমি মানিয়ে নিয়েছি।”
“সত্যি?”
“শতভাগ।”
“আমার বিশ্বাস হয় না।”
মাতভেইকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল ইসাবেলা।
“এই না সেদিন বললে আমায় বিশ্বাস করো?”
“সে আলাদা কথা ছিল। এখন আমি মাদামের ঘরে গিয়ে নিজের কানে শুনে আসব।”
“অবিশ্বাসী নারী।”
মেকি ক্ষোভ প্রকাশ করে মাতভেই। ইসাবেলা চোখ পাকিয়ে মুচকি হেসে মাদামের ঘরে গেল। মাদাম আদলৌনা ঘরে নেই। নিচে খুঁজেও পেল না। মাতভেই প্রস্তুতি নিয়ে ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। লনের দিকে যাবে অমনি পেছন থেকে ওর সোয়েটারের টেনে ধরে ইসাবেলা।
“না, আর এক পা এগোবে না।”
“প্লিজ বেল!”
“মাদাম রাগ করবেন মাতভেই।”
“মা গির্জায় গেছে। আসতে দুপুর হবে। মাত্র আধঘন্টার ব্যাপারই তো। মা জানবে না।”
“আমি মাদামের থেকে কিছু লুকাব না। বাইরে কি পরিমাণ তুষার পড়েছে দেখছ? তোমার পায়ের জন্য লনে বেরোনো ঠিক হবে না এখন।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসার ঘরে এসে বসল মাতভেই। ইসবেলার খারাপ লাগল ওর বিমর্ষ মুখ দেখে। একটুখানি ভেবে কিচেনে গেল। ফিরে এলো প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে।
“চলো আমার সাথে।”
“না, এখানেই বেশ আছি।”
“বাব্বাহ! কী রাগ। ওঠো বলছি।”
জোরপূর্বক দাঁড় করিয়ে নিয়ে এলো পুর্ব দিকের বড়ো জানালার পাশে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের বরফ আচ্ছাদিত গাছ, বাড়ি সবই দেখা যাচ্ছে। অদূরের সাদা বরফে মোড়া জঙ্গলের খানিকটাও চোখে পড়ে। হিম বাতাস বইছে। মাতভেই জানালা ঘেঁষে হাত বাড়ায় বাইরে। তুষার বৃষ্টিতে ভিজে গেল ওর হাত। হাসি মুখে সামনে চেয়ে রইল। বন্ধ ঘরে বসে এই খোলা হাওয়া, শীতল বাতাস ও মিস করছিল। প্রাণভরে শ্বাস নিলো।
ইসাবেলা ভেতরের ঘর থেকে ছোট্ট টেবিল আর দুটো চেয়ার এনে রাখল। টেবিলের ওপর চকলেট রোল, গরম কফি, কুকিজ আর প্যান কেক দিয়ে সাজিয়েছে। মাতভেই বসল চেয়ার টেনে। ইসাবেলা বসার ঘরের ফায়ারপ্লেস থেকে কয়েক টুকরো উত্তপ্ত কয়লা একটা লোহার পাত্রে এনে মাতভেইর পায়ের নিচে রেখে হাত ঝাড়া দিয়ে বলল,
“শেষ।”
ঘুরে দাঁড়ায় মাতভেইর দিকে।
“এবার খুশিতো?”
সানন্দে মাথা নাড়ে মাতভেই। ইসাবেলা সবটা দেখে নিয়ে বলে,
“একমিনিট, আরেকটা জিনিসের অভাব। আমি যাব আর নিয়ে আসব।”
এক ছুটে দোতলায় উঠে গেল। কিছুক্ষণ পর নেমে এলো একটা বই হাতে। মাতভেইর সামনে নিবেদনের ভঙ্গিতে বইটা দিয়ে বলল,
“মহারাজ, আজকের এই ব্রেকফাস্টটা আরো একটু চমৎকার করতে কবিতার বইটা পাঠ করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।”
বইটা হাতে নিয়ে রাজার ভঙ্গিতে মাতভেই বলল,
“অনুরোধ রক্ষা করা হলো বালিকে।”
তারপর দুজনে হো হো করে হেসে ওঠে। ইসাবেলা মাতভেইর সামনের চেয়ারে গিয়ে বসে। একটুকরো প্যান কেক মুখে দিয়ে ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিতে দিতে বই থেকে কবিতার লাইন আওয়াতে লাগল মাতভেই। চকলেট রোল চিবুতে চিবুতে দুহাতের মাঝে গাল রেখে মুগ্ধ হয়ে শুনছে ইসাবেলা। ঠোঁটের হাসি দেখে কে বলবে এ কেবল নিজের মনকে ভুলিয়ে রাখার ছল।
চলবে,,,