#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬১
Writer তানিয়া শেখ
মধ্যরাত। নিস্প্রভ চাঁদের আলোয় রাতটা বড়ো ম্রিয়মাণ মনে হয়। পথঘাটে জমাটবদ্ধ অন্ধকার। নুড়িপাথরে বেছানো রাস্তার চারপাশে ঘন ঝোপঝাড়। ডান পাশে পরিত্যক্ত রেললাইন। বা’পাশে দীর্ঘ এক নদী বয়ে গেছে। সরু সেই নুড়িপাথরের রাস্তা ধরে হেঁটে চলছে অশীতিপর এক ব্যক্তি। মাথায় ক’গাছি পাটের তন্তুর মতো সাদা চুল, কুঁচকে ঝুলে পড়েছে মুখের চামড়া, চোখদুটো মরাপচাঁ মাছের চোখের মতো নির্জীব এবং দেহ কঙ্কালসার। দীর্ঘদেহী দেহটা খানিক বেঁকে গেছে। হাঁটছে অতি ধীর পায়ে। যেন এক এক পা গুনে গুনে ফেলছে। সে খেয়াল করছে তার উপস্থিতি টের পেতে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে জোনাকি, ঝিঁঝিপোকা আর পেঁচারদল। বৃদ্ধের ঠোঁটের কুঞ্চিত চামড়া আরো কুঁচকে যায়। প্রকৃতিও বুঝি বুঝিয়ে দেয় সে একা, অভিশপ্ত। কিছুপথ হেঁটে ক্লান্তিতে হাঁপিয়ে ওঠে। ধপ করে পাশের ঝাড়ের ওপর বসে পড়ল। ওমনভাবে বসার কারণে পুরোনো শরীরের চামড়ার এখানে ওখানে ছিঁড়ে কেটে যায়। বৃদ্ধ তাতে উঁহু! আহা! করে না। একটুবাদে আবার উঠে দাঁড়ায়। আরো কিছু পথ হাঁটার পর নির্জন বনমধ্যে পরিত্যক্ত দুর্গটা চোখে পড়ে। বেশ ঝাপসা সামনের দৃষ্টি। পাঁচ মিনিটের পথ বৃদ্ধ পঁয়ত্রিশ মিনিটে পার করে দুর্গের মুখে এসে শরীর ছেড়ে বসে পড়ল। কঠিন নিস্তব্ধতা দুর্গের মুখে। বৃদ্ধের শরীরে অর্ধেক ঢেকে আছে বেপরোয়া বেড়ে ওঠা সবুজ ঘাসে। একসময় এই দুর্গটি সমাদৃত ছিল। এর চাকচিক্যময়তা লোকের নজর কাড়ত। অসংখ্য সুন্দর, অসুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি এখনও দুর্গটি বয়ে বেড়াচ্ছে। সবার কদর একদিন শেষ হয়। কালের বিবর্তনে দুর্গটি এখন পরিত্যক্ত। মানুষের কদর যেখানে শেষ, প্রকৃতির কদর সেখান থেকেই শুরু। শ্রী ছাড়া দুর্গটিকে প্রকৃতি উড়াজ করে ভালোবেসেছে। হাঁটু সমান ঘাস, নানান আগাছা-পরগাছা আর উইলো বৃক্ষের সারির ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুর্গটি। চূড়ার শীর্ষে মেঘে ঢাকা আকাশে চাঁদটা লুকোচুরি খেলছে। বৃদ্ধ উঠবে তখনই খচখচ শব্দ কানে এলো। একটু যেন অবাকই হলো। তারমতে এই বনে কোনো পশু থাকার কথা নয়। ইতোমধ্যে নিজের রক্ত তৃষ্ণা মেটাতে সবগুলোকে নিধন করেছে। হয়তো দু একটা থেকেও যেতে পারে। সেই ভাবনায় উঠে দাঁড়ায় বৃদ্ধ। এই মুহূর্তে ভীষণ রক্ত তৃষ্ণা পেয়েছে তাঁর। গত একসপ্তাহ ধরে একফোঁটা রক্ত দাঁতে লাগাতে পারেনি। আজ দুপুর থেকে আশপাশে খুঁজেও কিছু পেল না। প্রাণীটির পায়ের শব্দে পিপাসার চাপ বেড়ে গেল। শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো কুঞ্চিত ঠোঁটের কোণা দিয়ে। হাওয়ায় অদৃশ্য হওয়ার শক্তি তেমন একটা নেই এখন। তবুও বারকয়েক চেষ্টা করল। সফল হলো। সত্যি দেখা পেল একটা হরিণ শাবকের। প্রসন্ন মনে ঘাস খাচ্ছে। বৃদ্ধকে দেখে কানখাড়া করে ভীত চোখে তাকাল। যেই না ভৌ দৌড় দেবে অমনি ওটাকে ধরে ফেলে বৃদ্ধ। কালক্ষেপণ না করে শ্বদন্ত বসিয়ে দেয় ওর গলার কাছে। কিছুক্ষণ ছটফট করে থেমে যায় হরিণ শাবক। শেষ রক্তটুকু শুষে নিয়ে বৃদ্ধ রক্তমাখা মুখটা তোলে। রক্তের নেশা সে কিছুতেই ছাড়তে পারল না। এই নির্জনতা, নিঃসঙ্গতার মাঝেও শারীরবৃত্তীয় চাহিদা কমে না। সংযম রক্ষা হয়ে ওঠে না। মানুষের রক্ত না হোক পশুই চলুক। কিন্তু মানুষ রক্তের মতো সঞ্জীবতা পশুর রক্তে নেই। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াবে ঠিক সেই সময়ই ঘটনাটা ঘটল। একটা তীর এসে ঢুকে যায় তার বুকের বা’পাশে। পুড়ে যাচ্ছে বুকের চামড়া। শুধু চামড়া নয় পুরো ভেতরটাও। কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় সেখান থেকে। তীরটা সাধারণ নয়। ওর মাথা পবিত্র জলে ভেজানো ছিল। পবিত্র জল পিশাচের দেহ সহ্য করতে পারে না। ভীষণ কষ্ট হয় ওদের। বৃদ্ধ শুনতে পায় চাপা গলায় কারা যেন কথা বলছে। কয়েকটা পায়ের শব্দ আশেপাশে টের পেল। তার দিকেই এগোচ্ছে। কালো আলখেল্লা পরিহিত চারটা ছায়া তাকে ঘিরে ধরে। ওদের একজন খেঁকিয়ে বলল,
“শয়তানটাকে অবশেষে বাগে পেয়েছি। আজ ওকে বধ করেই দম নেবো।”
পাশ থেকে আরেকজন বলল,
“ওকে শেষ করতে পারলে মনিব খুশি হয়ে আমাদের পুরস্কৃত করবেন। এইদিনটির অপেক্ষায় বহুকাল ধরে ছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে ওর অবস্থা দেখে আমার বড্ড মায়া হচ্ছে আজ। আচ্ছা, ওর এমন জীর্ণশীর্ণ দশা হলো কী করে?”
“প্রেমের বিরহে বুঝলে। প্রেম ভালোবাসা বড়ো সাংঘাতিক ব্যাপার। একবার যার হয়ে যায় হয় সে বাঁচে নয় সে মরে। শয়তানটা প্রেমে মরেছে।” প্রথমজন ব্যাঙ্গ করে হেসে উঠল। বাকি দুজন ওর সাথে হাসল। আগেরজন বলল,
“ধুর! পিশাচরা তো আগে থেকে মরা। মরার কী প্রেম হয়?”
“ওই তো প্রমাণ তোমার সামনে। ভালো করে দেখে নাও। যাকে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর মনে করা হতো। আজ সে প্রেমের বাণে আহত দুর্বল, অশীতিপর এক বৃদ্ধতে পরিণত হয়েছে। একে বধ করা এখন খুব সহজ।”
আগেরজন উবু হয়ে বসে থাকা তীর বিদ্ধ বৃদ্ধের পানে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। একদিন এই শয়তানটার জন্য একরাশ ঘৃণা ছিল যে চোখে আজ সেখানে কেবল করুণা জাগল। প্রথমজন তাড়া দিলো বাকিদের।
“অনেক কথা হয়েছে। আর দেরি নয়। এক্ষুনি চলো ওটাকে বধ করতে হবে।”
করুণার স্থায়িত্ব আর কতক্ষণ! তিনজন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। ওরা সতর্ক পায়ে এগিয়ে গেল পিশাচটার দিকে। কোচ থেকে তলোয়ার বের করে ওর দিকে উঁচু করতে কোথা থেকে এক পাল হায়েনার হিংস্র গর্জন শুনতে পেল। থমকে গেল ওরা। হঠাৎ বৃদ্ধ পৈশাচিক হাসি হেসে ওঠে। মুখ তুলে তাকায় ওদের দিকে। ঠোঁটের চারপাশে রক্তমাখা। বৃদ্ধ! না ওকে আর বৃদ্ধ লাগছে না এখন। হরিণ শাবকের রক্ত খেয়ে বয়সটা দশ, বিশ বছর কমিয়ে এনেছে। মাথায় কাচাপাকা পাতলা চুল। চামড়ার ভাঁজ কিছুটা মিশে গেছে। আগের চেহারা এবার বেশ বুঝা যাচ্ছে। সেই শ্যেনদৃষ্টি। সে উঠে দাঁড়ায় ওদের সামনে। ভয়ে চারজনের রক্ত হিম হয়ে এলো। তলোয়ার শক্ত করে ধরে আছে, কিন্তু শক্তি আস্তে আস্তে যেন নিঃশেষ হয়ে যায়।
“মারতে চেয়েছিলি তোরা আমায়?”
“না, নিকোলাস!”
দ্বিতীয়জন আর্ত কণ্ঠে বলে উঠল। নিকোলাস ক্রূর হাসল। এক পা এগোতেই চারজন পাঁচ পা পিছিয়ে যায়। এক ঝাঁক বাদুড় হঠাৎ উড়ে এসে ডানা ঝাপটাতে লাগল মাথার ওপর। তন্মধ্যে একটা এসে ঝুলে পড়ে নিকোলাসের বা’হাতের ওপর। শিকারি চোখে চেয়ে আছে চারজনের দিকে। নিকোলাস ওদের ভীত-সন্ত্রস্ত চেহারা দেখে বলল,
“সত্যি বললে আমি তোদের মারব না। বল কে তোদের পাঠিয়েছে আমাকে মারতে?”
শান্ত চোখে চেয়ে আছে নিকোলাস। এত শান্ত পূর্বে ওকে এরা দেখেনি। ভয় তবুও কমলো না ওদের। নিকোলাসের বুকে এখনও তীরটা গেঁথে আছে। তীরের চারপাশ দিয়ে বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া। তীরটাকে বের করার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না ওর মধ্যে। চারজনের নীরবতা বোধহয় বরদাস্ত করতে পারল না নিকোলাসে বা’বাহুর সাথে ঝুলে থাকা বাদুড়টা। দাঁত খেঁচিয়ে উঠল। সাথে সাথে মাথার ওপর উড়ন্ত বাদুড়গুলো নেমে এলো ওদের দিকে। প্রথম দুজন তলোয়ার সেদিকে তুললেও অপর দুজন ভয়ে উলটো দিকে দৌড়ে পালাল। সাথী দুজনকে পালিয়ে যেতে দেখে বাকি দুজন মনে মনে ওদের জঘন্যভাষায় গালি দেয়। বাদুড়গুলো কিন্তু ওদের আক্রমণ করল না। একদম তলোয়ারের কাছ ছুঁয়ে আবার আগের জায়গায় উড়তে লাগল চক্রাকারে। জঙ্গলে যেদিকে দুজন পালিয়ে গিয়েছিল একটুপর সেখান থেকে তীব্র আর্তনাদ শোনা গেল। পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল যুবক দুজন। নিকোলাসের কাঁধে ঝুলন্ত বাদুড়টা দাঁত বের আছে। যেন বিদ্রুপ করে হাসছে দুজনের ভয় পাওয়া দেখে। নিকোলাস আবার প্রশ্ন করল,
“কে পাঠিয়েছে তোদের?”
“বললে ছেড়ে দেবে আমাদের?” বলল দ্বিতীয়জন। নিকোলাসকে জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে বলল,
“ওকে বিশ্বাস কোরো না বন্ধু।”
“ও আমাদেরকে মেরে ফেলবে জবাব না পেলে।”
“দেখো ওকে। ওর দেহে আজ আর সেই অসীম শক্তি নেই। আমাদের সাথে পেরে উঠবে না। চলো এক্ষুনি ওকে শেষ করে ফেলি।”
দ্বিতীয়জন বয়স্ক নিকোলাসের দিকে তাকায়। ওরা যুবক। একসাথে লড়াই করলে নিকোলাসকে ঠিক হারিয়ে দিতে পারবে। প্রথমজনের কথায় সায় দেয় দ্বিতীয়জন। তলোয়ার হাতে ছুটে যায় নিকোলাসের দিকে। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার আগেই অদৃশ্য থেকে কেউ যেন আক্রমণ করে বসে ওদের। গলা চেপে ধরে হাত থেকে তলোয়ার কেড়ে নেয়। ছুঁড়ে ফেলে সামনে। আহত শরীর উঠে বসতে নিজেদের নিকোলাসের পায়ের কাছে আবিষ্কার করে। নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে আছে নিকোলাস। ওর পেছন থেকে দৃশ্যমান হয় আন্দ্রেই এবং নোভা। আন্দ্রেই হিংস্র গর্জন করে দ্বিতীয়জনের দেহের ওপর চড়ে বসে। কামড়ে ধরে ওর গলা। বিকট আর্তনাদ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। আন্দ্রেই রক্তমাখা মুখে তাকায় প্রথমজনের দিকে। তলোয়ারটা দু গজ দূরে পড়ে আছে। সেদিকে যাবে বলে উঠতে নিকোলাসের বাহুর ওপর ঝুলে থাকা বাদুড়টা আক্রমণ করে বসে। কামড়ে রক্তাক্ত করে উড়ে যায়। ওর গলা চেপে ধরে আন্দ্রেই। কর্কশ গলায় বলল,
“কে পাঠিয়েছে তোকে?”
“বলব না।”
আন্দ্রেই ওকে মারতে যাবে নিকোলাস থামিয়ে দেয়,
“আন্দ্রেই, ছেড়ে দে ওকে।”
“ভাই!” শুধু আন্দ্রেই নয় নোভাও বিস্মিত হয়। নিকোলাস আবার ইশারা করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ছাড়া পেয়ে যুবক হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিকোলাস ওকে বলল,
“যা, আমার সিদ্ধান্ত পালটে যাওয়ার আগে পালিয়ে যা।”
যুবকটি পালিয়ে গেল অন্ধকার জঙ্গলে। আন্দ্রেই অসন্তোষের সাথে বলল,
“ও তোমাকে মারতে এসেছিল, ভাই। আর ওকেই কি না বাঁচিয়ে দিলে? এটা ঠিক হলো না মোটেও।”
“ওহ!”
“ওহ?”
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে আন্দ্রেইর। নোভার ভীষণ খারাপ লাগে ভাইয়ের উদাসীনতা দেখে। নিকোলাসের উদাস দৃষ্টি বুকের ওপর পড়তে তীরটাকে একটানে বের করে আনে। একদলা মাংস বেরিয়ে এলো তীরের ধারালো মাথার সাথে। তীরের মাথায় লেগে থাকা মাংসের দলার দিকে চেয়ে রইল। মানুষ হলে হয়তো প্রচন্ড ব্যথা হতো এখন। আজ আবারও আফসোস হলো মানুষ নয় বলে। মানুষ কেঁদে কেঁদে চোখের জল ফেলে দুঃখ হালকা করে। নিকোলাসের বুক ভরা দুঃখ। বড্ড ভারী লাগে ভেতরটা। একটু যদি কেঁদে হালকা হওয়া যেত! একদিন কাঁদবে না বলে অভিশপ্ত জীবন বেছে নিয়েছিল। আজ একটুখানি কান্নার জন্য মাথা কুটে মরে। ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! হাতের তীরটাকে ফেলে দিলো। চোখের নিমেষে বুকের ক্ষতটা ঠিক হয়ে যায়। সব ক্ষতই পলকে ঠিক হয়ে যায়, কেবল ইসাবেলার কারণে সৃষ্ট ক্ষত দিনেদিনে আরো যেন দগদগে হয়। নিকোলাস মোটেও দুঃখ করে না তাতে। ইসাবেলাকে মনে রাখার এটাও যে একটা মাধ্যম। নিকোলাসের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। মলিন মুখে হেঁটে এলো দুর্গের দ্বারের কাছে। আন্দ্রেই পথ রোধ করে দাঁড়ায়। নিকোলাস বিরক্ত হয়,
“পথ ছাড় আন্দ্রেই।”
“এসব তোমাকে মানায় না ভাই। নিজেকে আয়নায় দেখো একবার। এই কী সেই নিকোলাস উইলিয়ামস? যে পৃথিবীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল? হতে চেয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়ী। যুগ, কালের উর্ধ্বে উঠে যার লক্ষ্য ছিল মহা ক্ষমতাধর হওয়া, মানুষের চোখে ভীতি সৃষ্টি করা। না, তুমি সে নও। আমার সামনে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে দুর্বল এক বৃদ্ধ। তুচ্ছ এক মানবীর মৃত্যুর শোকে আজ তুমি কোথায় নেমে এসেছ ভাই!”
নিকোলাসের নির্লিপ্ত চোখজোড়া দপ করে জ্বলে ওঠে,
“তুচ্ছ মানবী? খবরদার আন্দ্রেই, আমার বেলাকে তুচ্ছ মানবী বলবি না। হতে পারে তোর কাছে, তোদের কাছে ও তুচ্ছ মানবী। আমার কাছে ও আমার সব। ওকে ছাড়া আমি নিঃস্ব, রিক্ত রে আন্দ্রেই। তুই ঠিকই বলেছিস, এই আমি সেই আমি নই। ইসাবেলা ছাড়া আজ আমি কিছুই না। তুই বলেছিলি ও আমার দুর্বলতা। আজ ও নেই তবুও এত দুর্বল কেন আমি আন্দ্রেই? জানি এর জবাব তুই দিতে পারবি না। তুই ভালোবাসিসনি। আমার ব্যথা, আমার বিরহ তুই বুঝবি না।”
“ভালোবাসলে যদি এই পরিণতি হয় তবে আমি সানন্দে বলব, ভালোবাসা যেন কোনোদিন না হয় আমার। সামান্যের জন্য বেঁচে গেছ আজ তুমি। সময়মতো না এলে ওরা তোমাকে মেরে ফেলত। এখনও কী সতর্ক হবে না? এখনও কী হুঁশ হবে না তোমার?”
নিকোলাস ওর পাশ কাটিয়ে দুর্গের ভেতর প্রবেশ করে। শেওলা পড়া বসার ঘরের ঘুনে ধরা ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে বসল। ইচ্ছে হয় আন্দ্রেইকে বলতে,
“আজ কী মনে হয় জানিস আন্দ্রেই? মনে হয় সেদিন এই অভিশপ্ত জীবন বেছে না নিয়ে যদি মৃত্যুকে বেছে নিতাম। খুব ভালো হতো রে।”
নিকোলাসের কথা বলতে আর ভালো লাগছে না। চোখ মুদে দুলতে লাগল চেয়ারে। আন্দ্রেইর অসহ্য মনে হয় ভাইয়ের এই আচরণ। নিকোলাসকে বলল,
“তাহলে আর ফিরছ না কমিউনিটিতে?”
“তা তো কখনও বলিনি আমি।” আস্তে আস্তে চোখ খুললো নিকোলাস। আন্দ্রেই ক্ষোভের সাথে বলল,
“তবে এসব কী? এমন করে নির্জনে একা থাকা কেন? পাঁচ মাস, ভাই। পাঁচ মাস তুমি এখানে আছো। এই পাঁচ মাসে কমপক্ষে দশবার তোমার ওপর শত্রুরা হামলা করেছে। প্রতিবার সামান্যের জন্য বেঁচে ফিরেছ৷ আর তোমাকে এখানে থাকতে দেবো না। ফিরে চলো ভাই। কমিউনিটিতে তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন।”
“আর ক’টাদিন সময় দে আমাকে আন্দ্রেই। সত্যি বলছি, এরপর সাবধানে থাকব।”
“এই একই কথা আগেও বহুবার বলেছ তুমি।” নোভা এগিয়ে এসে বলল।
“বলেছি বুঝি? আচ্ছা, এবার সত্যি সত্যি সত্যি। তিন সত্যি করে বললাম।”
নোভা হতাশ মুখে মাথা নাড়ায় দুদিকে। আন্দ্রেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ইসাবেলার মৃত্যুর শোকে তুমি সব ভুলে গেছো ভাই। এমনকি আমাদেরও।”
“মৃত্যুর শোক! একে কী মৃত্যুর শোক বলে রে আন্দ্রেই? আমি মনপ্রাণে চাই এমন শোক কারো জীবনে না আসুক।”
নিকোলাস আবার চোখ মুদে দুলতে লাগল। আন্দ্রেইর মুখে ফুটে ওঠে অনুতাপ। ভেবেছিল ইসাবেলা চলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ হয়তো কিছুদিন সময় নেবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিছুদিন কিংবা কিছু বছরেও নিকোলাস ইসাবেলাকে ভুলবে না। নোভা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“চলো। ভাই আজও শুনবে না আমাদের কথা।”
আন্দ্রেই জানে নোভার কথা ঠিক। আশাহত, বিক্ষুব্ধ মনে ও দরজা মুখো ঘুরে দাঁড়ায়। একবার ভাবে নিকোলাসকে সত্যিটা বলে দেবে। আবার মন বদলে ফেলে। কোন মুখে বলবে ও? ভাইয়ের এহেন দশাও যে আর সহ্য হচ্ছে না। না, আন্দ্রেই সত্যি কথাটা বলে দেবে। স্বীকার করবে নিজের করা অন্যায়। তাতে যা হয় হোক। ভাইয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় পুনরায়। ও মুখ খোলার আগে নিকোলাস বলে ওঠে,
“আচ্ছা, আন্দ্রেই, তুই কী নিশ্চিত বেনাসের বাড়িতে সেদিন ইসাবেলাও পুড়ে মরেছিল? ধ্যাৎ! আমি কেমন বোকার মতো প্রশ্ন করছি। ও তো পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে৷ চেনার মতো অবশিষ্ট কিছুই যে ছিল না৷ ছাই দেখে তুই নিশ্চিত হবি কী করে? কিছু মনে করিস না। আমি তোকে বিশ্বাস করি। কিন্তু মাঝে মাঝে মনটা কেমন করে ওঠে। বিশ্বাস করতে চায় না বেলা আর নেই। মন বলে ও আছে। হুট করে একদিন সামনে এসে চমকে দেবে। বোকা মন। মনটা এত অবুঝ কেন যে!”
আন্দ্রেইর মুখটা হয়ে যায় ফ্যাকাশে। নিকোলাস দেখতে না পেলেও নোভার চোখ এড়ায় না। আন্দ্রেই দৃষ্টি সরাতে নোভার মুখোমুখি হয়ে গেল। ধরা পড়ে যায় ও, হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়।
চলবে,,,,