#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৩
Writer তানিয়া শেখ
তাশাকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নামল তাতিয়ানা। মেয়েটাকে ঘুম পাড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না। কারণে অকারণে কেঁদে চলে। বিছানায় শায়িত মেয়ের শীর্ণকায় দেহটা দেখল। এই কদিনে আরো যেন শুকিয়ে গেছে ও। ডাক্তার, কবিরাজ কিছু বাদ রাখেনি, কিন্তু ফল শূন্য। ভীষণ চিন্তায় দিন কাটছে তাতিয়ানার। হঠাৎ ওর চোখ চলে গেল জানালার বাইরে। এখান থেকে গেস্টরুমটার জানালা দেখা যাচ্ছে। ওই ঘরে মাতভেই থাকে। ওকে পায়চারি করতে দেখা গেল। হারিকেনের মৃদু আলোতে দেওয়াল ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় তাতিয়ানা। রাত পৌনে বারোটা। এত রাতে পায়চারি করছে কেন মাতভেই? নিশ্চয়ই মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। শব্দ করে হাঁফ ছাড়ল তাতিয়ানা৷ মেরুন রঙের গোলাপি নাইটির রোবটা পরে নিয়ে নিঃশব্দে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সমস্ত বাড়ির ভেতর ভূতুরে নিস্তব্ধতা। বসার ঘরের হারিকেনের সলতে কমিয়ে রাখা হয় রাতে। আবছা আলোতে পায়ে পায়ে হেঁটে গেস্টরুমের দরজার সামনে এসে থামল। হঠাৎ মনে হলো এত রাতে কেন এসেছে এখানে? এই তো মাসখানেক আগেও মাতভেইকে ও চোখে সহ্য করতে পারত না। অথচ, আজ ওকে নিয়ে কত ভাবছে! এই ভাবনা কি দুর্বলতার লক্ষণ নয়? না, আর কোনো পুরুষের প্রতি দুর্বল হবে না ও। ঘুরে দাঁড়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য। দু’পা এগোতে গেস্ট রুমের দরজা খুট করে খুলে গেল। পেছনে মাতভেইর গলা শুনতে পায়।
“অ্যানা!”
নিরুপায় হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় আবার তাতিয়ানা। কী বলবে এখন ও? বেকায়দায় পড়ে গেল। তবুও একটুখানি নার্ভাস হেসে বলল,
“তোমার ঘরে আলো জ্বলতে দেখে___” তাতিয়ানার অস্বস্তি টের পাচ্ছে মাতভেই। ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দরজা পুরো খুলে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভেতরে এসো।”
মাতভেইর সৌম্য মুখটার দিকে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে পাশ কেটে ভেতরে ঢুকলো ও। রুমের দরজা ভিজিয়ে পাশ থেকে চেয়ার টেনে মাতভেই বলল,
“বসো।”
তাতিয়ানা বাধ্য মেয়ের মতো বসল চেয়ারটাতে। ওর মুখোমুখি হয়ে বসে মাতভেই। তাতিয়ানা বলল,
“তাশাকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নামতেই তোমার রুমের দিকে চোখ পড়ল। এত রাতে পায়চারি করতে দেখে ভাবলাম নিশ্চয়ই মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করছ। তাই_”
“তাই আমার খোঁজ নিতে এলে?”
কানের পেছনে চুল গুঁজে মাথা নাড়ায় তাতিয়ানা। তারপর হাতদুটো কোলের ওপর রাখল। দৃষ্টি স্থির সেখানে। কেন যে বিচলিত হচ্ছে ও। মাতভেই ওর দিকে অনিমেষ চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তাতিয়ানার আর সহ্য হলো না এই নীরবতা ও মাতভেইর দৃষ্টির তপ্ততা। উঠে দাঁড়ায় হুট করে।
“আমি বরং এখন আসি।”
বলেই দরজার দিকে পা বাড়াল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। আচমকা মাতভেই ওকে টেনে ধরে গভীর চুম্বন দিলো ঠোঁটে। তাতিয়ানা বিস্ময়াহত হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। বিস্ময় কাটতে পায়ের পাতায় ভর করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে মাতভেইর গলা। কিছুসময়ের জন্য ওরা একে অপরকে ছাড়া আর কিছু মনে রাখে না। দুজনের শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে একসময়। কপালে কপাল রেখে তাতিয়ানার আনত মুখের দিকে তাকায় মাতভেই। ধীরে ধীরে চোখ তোলে তাতিয়ানা। এতক্ষণে যেন ঘোর কাটল ওর। চোখে ভেসে ওঠে নানান অনুভূতি। ঠোঁট আলগা করতে মাতভেইর তর্জনী রেখে বলে,
“প্লিজ, কিছু বলো না অ্যানা।”
তাতিয়ানা বিরোধিতা করতে গিয়েও মাথা নাড়ে। সরে দাঁড়ায় মাতভেইর কাছ থেকে। কী যে হচ্ছে ওর সাথে। ভাবছে এক হচ্ছে আরেক। আবার মাঝে মাঝে ভাবনা চিন্তা ছাড়াই কাজ করছে। এই যে মাতভেই আচমকা চুমু খেয়ে বসল আর ও চুপচাপ তা হতে দিলো? এখানে আসাই ওর উচিত হয়নি। নিজের ওপর রাগ হলো। ওকে ঠোঁট উলটাতে দেখে মাতভেই মুচকি হাসে। ওর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে ঠোঁটের একপাশে চুমু দিয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। এবার আর চুপ থাকল না তাতিয়ানা। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছো আমি তোমাকে অপছন্দ করি।”
“একদম না।” টেবিলের ওপর রাখা এলোমেলো কাগজ গুছাতে গুছাতে বলল মাতভেই। তাতিয়ানা স্পষ্ট শুনতে পায় মাতভেই হাসি দমানোর চেষ্টা করছে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“বাস্টার্ড, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।”
মাতভেই ঘুরে দাঁড়ায়। এখনও ওর ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। ধীর পায়ে এগিয়ে তাতিয়ানার কাছে গিয়ে বলে,
“আর আমি তোমাকে ভালোবাসি অ্যানা। কেবল তোমাকে এবং সবসময় তোমাকেই ভালোবাসব। তুমি যতবার প্রত্যাখ্যান করবে ততবারই আমি এই একই কথা বলব।”
ক্ষোভে ফুঁসতে লাগল তাতিয়ানা। এত অপমানের পরও কেউ এভাবে ভালোবাসি বলতে পারে? কেন হার মানে না মাতভেই?
“কেন? কেন এত অপমানিত হচ্ছ তুমি? ভুলে যাও আমাকে মাতভেই। তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার।”
“কে বলেছে আমাকে দেওয়ার মতো কিছু নেই তোমার। তাশাকে দিয়েছ তো।”
“আর ভালোবাসা? ওটা চাও না আমার কাছ থেকে?”
মাতভেই ওর মুখটা দুহাতে তুলে বলে,
“ওটা কি চেয়ে পাওয়ার জিনিস? তোমার মনের দরজা আমার জন্য যখন খুলবে আমি ঠিক খুঁজে নেব ওটা।”
“যদি খুঁজে না পাও?”
“পাবো। আমার বিশ্বাস আমি পাবো। বলো, আমার জন্য একটুখানি মনের দরজা খুলবে অ্যানা?”
তাতিয়ানা মুখ নামিয়ে নেয়। কী জবাব দেবে সহসা ভেবে পায় না। মাতভেই হার মানবে না। তাতিয়ানার মুখটা আরো কাছে আনল।
“অ্যানা?”
চোখ তোলে তাতিয়ানা। ছলছল চোখে মাতভেইর চোখে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। খুলে দেয় ভাঙা হৃদয় আগলে রাখা দরজাটা। মাতভেইর চোখে মুখে বিজয়ীর হাসি। বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে তাতিয়ানাকে। তখনই তাশার আর্ত চিৎকারে দুজনে ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায়। ছুটে যায় ওর ঘরের দিকে। বাড়ির সকলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তাতিয়ানার ঘরের কাছাকাছি আসতে কান্নার শব্দ থেমে যায়। ওরা ঘরে ঢুকে দেখল কোথাও তাশা নেই। রুমের জানালা খোলা। তাতিয়ানার স্পষ্ট মনে আছে রাতে জানালা বন্ধ করে দিয়েছিল ও। তাশাকে সকলে যখন হন্যে হয়ে খুঁজছিল, তখনই বাড়ির পেছনের পুকুরপাড় থেকে ওর কান্নার গলা শোনা গেল আবার। ভ্লাদিমি আর মাতভেইর আগে বেরিয়ে এলো। ওদের পেছন পেছন বাড়ির বাকিরা। পুকুরপাড়ে এসে থমকে দাঁড়ায় সকলে। কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে অন্ধকারে পুকুরের পানি হীরের মতো চকচক করছে। ঠিক তার মাঝে ওদের চোখ পড়ল। কেউ যেন ডুবছে। ওরা ভালো করে বুঝে ওঠার আগে পানির বুদবুদ ছেড়ে শূন্যে ভেসে উঠল তাশার ক্ষীণ দেহটা। ওর ভয়ার্ত চিৎকারে রাতের নিস্তব্ধতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়। যেমনভাবে পানির তলা থেকে তাশার দেহটা শূন্যে উঠেছিল তেমন করেই আবার পানির তলায় অদৃশ্য হয়ে যায়। তাতিয়ানা চিৎকার করে সেখানেই জ্ঞান হারায়। ইসাবেলা নিজেকে সামলে নিয়ে বোনকে ধরল। মাতভেই আর ভ্লাদিমির কিছু ভাবার মতো অবস্থায় নেই। এক লাফে পানিতে নেমে এলো ওরা। আন্না মেরিও গলার রোজারিও ধরে ঈশ্বরের নাম জপছিলেন। আর সবার মতোই আতঙ্কিত তিনি। তাশা তার কতটা জুড়ে আছে তা শুধু তিনিই জানেন। অনেক খুঁজাখুজির পর তাশাকে কোলে তুলে পুকুর পাড়ে এলো মাতভেই। ওর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তাশার ফ্যাকাশে শরীর মাটির ওপর রাখা হলো। পেট থেকে পানি বের করার চেষ্টা করছে মাতভেই। তাতিয়ানার জ্ঞান ফিরে এসেছে। তাশার এমন অবস্থা দেখে পাগলের মতো বিলাপ করছে ও। ইসাবেলা কোনোমতে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না ইসাবেলা। তাশা ওদের পরিবারের জান পাখি। ঈশ্বরের কাছে ওর সুস্থতা কামনা করছে ও। বাড়ির চাকর-বাকর, পাড়া প্রতিবেশীরা ভিড় করেছে। সকলের চোখে পানি। মাতভেইর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। কাঁপছে থরথর করে। কাঁপা গলায় বার বার মেয়েকে ডাকছে। অনেকটা পানি পেটে গেছে তাশার। মুখে হাওয়া দিচ্ছে মাতভেই৷ অনেকক্ষণ পর তাশা শ্বাস নিলো। কাশতে কাশতে কেঁদে ওঠে। সকলে সমস্বরে ঈশ্বরের বন্দনা করে উঠল। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে প্রাণ ফিরে পায় যেন মাতভেই। তাতিয়ানা ছুটে এসে ওদের দুজনকে জড়িয়ে ধরল।
সেদিন রাতের পর থেকে একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন এলো তাশার মাঝে। একেবারে চুপ করে গেল তাশা। না কাঁদে আর না কথা বলে। ওর চোখে সারাক্ষণ আতঙ্ক খেলা করছে। প্রথমে বাড়ির সবাই ভেবেছিল হয়তো ভয় পাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। কিন্তু সকল রকমের চিকিৎসা করানোর পরও অবস্থার উন্নতি হলো না। ওই ঘটনার পর থেকে তাশার প্রতি বাড়ির সবাই খুব বেশি সতর্ক হয়েছে। একা এক মুহূর্তের জন্যেও ওকে কেউ ছাড়ছে না। তাতিয়ানা এসবের জন্য নিজেকে দায়ী করে। সেদিন যদি ওকে একা ছেড়ে না যেত তবে এমনটা হতো না। কিন্তু মাতভেই ওকে বুঝায় এসবে ওর কোনো হাত নেই। সান্ত্বনা দেয় যা হয়েছে সবটাই দুর্ঘটনা। তবুও অনুতাপ যায় না তাতিয়ানার। ইসাবেলা এবং আন্না মেরিও মাতভেইর সাথে একমত নয়। যদিও খোলাখুলি দুজনের কেউ ই সেটা বলেনি। আন্না মেরিও মনে করেন তাশার সাথে ঘটা ওই ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। অশরীরী কোনো ছায়ার হাত রয়েছে এতে। অতটুকু মেয়ে এত রাতে পুকুরপাড়ে যাবে কী করে? এমনভাবে শূন্যেই বা উঠল কেন? গোপনে এ ব্যাপারে চার্চের ফাদারের সাথে আলাপ করেছেন। তাশাকে সুরক্ষার জন্য ফাদার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। আন্না মেরিও তা যথাযথভাবে পালন করছেন।
এদিকে ইসাবেলা সরাসরি অশরীরী নিয়ে ভাবছে না কিংবা মাথায় এই ব্যাপারটা সেভাবে আসেনি। সকলে যখন তাশাকে নিয়ে ঘরে ফিরল হঠাৎ করে ইসাবেলার যেন কিছু মনে পড়ে গেল সেদিন। ফিরে এলো পুকুর পাড়ে। আগের মতো কালো লাগছিল না চাঁদটা। মেঘের ফাঁক দিয়ে সভয়ে বুঝি উঁকি মারছিল সেটা৷ পুকুরের পানি তখনও জ্বলজ্বল করছিল। একটু খেয়াল করতে দেখতে পেল সেই বস্তুটি। বস্তু! না, ঠিক বস্তু নয়। এ যে সেই ফুলের পাপড়ির কয়েকটা। এত ম্লান আলো বেরুচ্ছে ওগুলো থেকে যে সহজে ঠাহর করা যায় না অন্ধকারে। ইসাবেলার বার বার মনে হচ্ছে ওই ফুলটার সাথে তাশার ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে। কিন্তু কী? দিনরাত ভেবেও যেন কূলকিনারা করতে পারছে না।
“বেলা, ঘরে আছিস মা?”
দরজার বাইরে আন্না মেরিওর গলা শুনে জানালার পাশ থেকে সরে এলো ইসাবেলা। জবাব দিলো,
“আছি মা। এসো।”
“কী করছিলি?” ভেতরে ঢুকে বললেন আন্না মেরিও। ইসাবেলা বলল,
“এই বসেছিলাম। কিছু বলবে মা?”
“তোর ছোটো কাকার শরীর শুনেছি ভালো যাচ্ছে না। তাশার এই অবস্থায় সবাই মিলে তাকে দেখতে যাওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তুমি বরং আজ তোমার দাদু দিদাকে নিয়ে কাকাকে দেখে এসো। আমরা কাল পরশু একদিন যাব।”
“ঠিক আছে মা।”
“দুপুর পড়ে এলো। এখনই বেরিয়ে পড়লে ভালো হয়। তুমি তৈরি হয়ে নিচে এসো। ভ্লাদিমিকে বলে গাড়ি বের করাচ্ছি আমি।”
আন্না মেরিও চলে যেতে ইসাবেলা তৈরি হয়ে নিলো। নিচে নেমে দেখল দাদু দিদা ইতোমধ্যে গাড়িতে চড়ে বসেছেন। তাশাকে একবার দেখতে গেল। ঘুমিয়ে আছে ও। পাশে তাতিয়ানা ঝিমাচ্ছে। মেয়ের চিন্তায় ওর খাওয়া ঘুম হারাম হওয়ার উপায়। মাতভেই নিঃশব্দে রুমে ঢুকলো। ওর মুখটা আরও শুকিয়ে গেছে। ইসাবেলাকে দেখে তবুও ম্লান হাসল। তাতিয়ানা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে পড়ে যাচ্ছিল। মাতভেই ওর মাথাটা আলগোছে কাঁধের ওপর রাখে। এত দুশ্চিন্তা, দুঃখের মাঝেও ইসাবেলার বড়ো ভালো লাগল এই দৃশ্য দেখে।
ইসাবেলার ছোটো কাকার বাড়ি প্রায় মাইল খানেক দূরে। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। কাকার পেটের রোগ আছে। ইদানীং সমস্যা প্রকট হয়েছে। কাকা-কাকির সাথে কথা বলে ইসাবেলা ছোটো তিন কাজিনকে সাথে করে বাড়ির পাশের ছোট্ট বাগানে এসে বসল। ওর কাজিনদের একজন ওর সমবয়সী যুবতি। বাকি দুজন বালক। বালক দুটোর একটা আবার ভীষণ চঞ্চল। একস্থানে বসে বসে আড্ডা দেওয়া ওর ঠিক জমে না। জেদ করতে শুরু করল ফার্মে যাবে৷ ওর প্রিয় ঘোড়াটাকে এখন যে করেই দেখবে ও। ইসাবেলাও অনেকদিন কাকার ফার্ম দেখেনি। কত রকমের পশু-পাখি পালা হয় সেখানে! ইসাবেলা রাজি হলো যেতে। ফার্মের কাছাকাছি যেতে বালক দুজন এক ছুটে সেখানে ঢুকে পড়ল। ইসাবেলার সমবয়সী কাজিনটাও ভাইদের সতর্ক করতে করতে ছুটল পেছনে। ওদের দেখে নিজের ছোটোবেলা মনে পড়ে গেল ইসাবেলার। মুচকি হাসতে হাসতে ফার্মের গেটের দিকে পা বাড়ায়। এমন সময় পাশের রাস্তা দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি গেল। সবই ঠিক ছিল যতক্ষণ না নাকে এসে লাগল সেই পরিচিত গন্ধটা। ইসাবেলার সর্ব শরীর মুহূর্তের জন্য জমে যায় বরফের ন্যায়। ঘোড়া দুটো বিকট শব্দে হ্রেষাধ্বনি তুলে থেমে গেল কিছুদূর গিয়ে রাস্তার ওপর। ইসাবেলার বুক ঢিপঢিপ করছে। ধীরে ধীরে ঘোড়ার গাড়িটির দিকে ফিরল ও। মন চাচ্ছে এক ছুটে গাড়িটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে৷ কিন্তু পা যে নড়ছে না৷ অবশেষে কি ওর বিরহের অবসান ঘটবে আজ? ঠোঁট কাঁপছে ভেতর থেকে ঠেলে আসা কান্নায়। এই যে সুখের ক্রন্দন। আকাশে গোধূলির রঙ মুছে গিয়ে দিকে দিকে আঁধার ছড়াতে লাগল। যত এগোচ্ছে ততই সোঁদা মাটির গন্ধ তীব্র হয়ে নাকে এসে লাগছে ইসাবেলার। গাড়ির কাছাকাছি যেতে দুটো পা বেরিয়ে এলো গাড়ির বাইরে। ইসাবেলা থমকে দাঁড়ায়। বলিষ্ঠ, দিঘল দেহটা গাড়ি ছেড়ে বাইরে নামল। দাঁড়াল ইসাবেলার সামনে। ওর মুখের ওপর সন্ধ্যার আঁধার জমে আছে। ইসাবেলা মুখ না দেখলেও চিনতে পারে নিকোলাসকে। আঁধার ঠেলে এগিয়ে এলো নিকোলাস। ইসাবেলা ছুটল ওর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে, কিন্তু নিকোলাস অদৃশ্য হয়ে যায়। মুখ থুবড়ে রাস্তার ওপর পড়ল ইসাবেলা। আহত সিক্ত চোখজোড়া তুলতে নিকোলাসকে আবার সামনে দেখতে পেল। নিস্প্রভ চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ ওর দিকে নিকোলাস। তারপর ইসাবেলা ওকে বলতে শুনল,
“তুমি আমার হৃদয় ভেঙেছ, বেলা। তুমি আমার হৃদয় ভেঙেছ।”
চলবে,,,
পরের পর্ব শীঘ্রই পাবেন। আগের মতো নিয়ম করে।