তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব—৮১

0
592

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮১
Writer তানিয়া শেখ

পরদিন যখন ইসাবেলার ঘুম ভাঙল তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। আজ সূর্য ওঠেনি। তাপমাত্রা নেমে গেছে। জানালার বাইরে তুলোর মতো তুষার পড়ছে। সারারাত জ্বলতে থাকা ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভে ছাইয়ে চাপা পড়েছে। এই সুযোগে বাইরের হাড় কাঁপানো শীত ঢুকে পড়েছে ইসাবেলার কক্ষে। লেপটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিলো। একটু নড়াচড়া করতে ব্যথায় দাঁত কামড়ে ধরে।

“শেমলেস বিস্ট!”
ইসাবেলা জানে এই শব্দটি শুনলে নিকোলাসের ইগো সন্তুষ্ট হতো। রাতের উষ্ণ মুহূর্ত মনে পড়ে যায়। এখনও যেন অনুভব করছে নিকোলাসের স্পর্শ। লজ্জায় বালিশে মুখ গুঁজে রইল। সমস্ত শরীরে ক্লান্তি আর অদ্ভুত এক ভালোলাগার স্পর্শ জড়িয়ে আছে। নিকোলাস যে বালিশে মাথা রেখেছিল, যেপাশে শুয়েছিল সেদিকে তাকালে বৃহৎ শূন্যতার গিরি তৈরি হয় হৃদয়ে। ওকে না দেখা পর্যন্ত এই শূন্যতার শেষ নেই। হঠাৎ গলার কাছে চিনচিনে ব্যথা টের পেল। গতকাল নিকোলাস মিলন মুহূর্তে ওর রক্ত পান করেছে। ব্যথা আর সুখের চরম উত্তেজনায় উন্মাদ, দিশেহারা করে ছেড়েছিল। দেহ নিয়ে, সৌন্দর্য নিয়ে হীনম্মণ্যতা যা ছিল সব যেন এই চাদরে দলিত মথিত হয়েছে। জীবনের বিশেষ এই মুহূর্তটিকে ইসাবেলার জন্য চিরস্মরণীয় এবং সবচেয়ে মধুর করেছে নিকোলাস। শুষ্ক ঠোঁটে লাজুক হাসি জেগে ওঠে।

“বেলা, জেগেছ?” তাতিয়ানা দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল। ওর কোলে তাশা। পেছন পেছন আজ্ঞাকারী দাসীর ন্যায় এলো রেইনি। ইসাবেলা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ভাগ্যিস ওর পরনে নাইটি ছিল। কিন্তু সেটাও এই মুহূর্তে নিরাপদ নয়। সর্বাঙ্গে স্বামীর ভালোবাসার স্মৃতি বহন করছে। তাতিয়ানা দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। থুতনি পর্যন্ত লেপ টেনে নিলো। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকা সবচেয়ে নিরাপদ এই মুহূর্তে। কান খাঁড়া করে আছে। না! আর তো ওদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। চলে গেল কী?

“উহ!” গালে কামড়ের ব্যথায় চকিতে তাকাল। তাশা ওর শিওরে দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তোর মতো সাদা দাঁত বের করে হাসছে। খালার আর্ত আরক্ত মুখ দেখে খুব যেন মজা পেয়েছে।

“বে-ল, বে-ল।” বাবার মতোই ডাকে খালাকে। আদুরে হাতে খালার গালটাতে হাত বুলিয়ে দেয়। কাজটা যে মায়ের প্ররোচনায় করেছে। নয়তো কি খালাকে কষ্ট দেয়! ইসাবেলার রাগ উবে যায় ওর মুখে নিজের নাম শুনে। ইচ্ছে করে দুহাতে জড়িয়ে মুখ ভরে চুমু দিতে, আদর করতে।

“এবার তুই তাশাকে নিয়ে যা।” স্মিত হেসে বলল রেইনিকে তাতিয়ানা। মেয়েটি হাসল না। কিংবা বলা যায় হাসেই না। দিনে দিনে বাড়তে থাকা ওর গম্ভীরতা তাতিয়ানাকে অস্বস্তি দেয়। রেইনি নীরবে মাথা নাড়িয়ে তাশাকে কোলে তুলে নিলো। আশ্চর্যের কথা তাশা আপন পিতা-মাতা থেকেও এই মেয়ের সান্নিধ্য এখন বেশি পছন্দ করে। একটা গম্ভীর বালিকাকে কোনো শিশু কী করে এত পছন্দ করতে পারে!

ওরা দুজন চলে যেতে তাতিয়ানা কোমরে হাত রেখে বোনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“তাহলে তুমি ঘুমের ভান ধরে পড়েছিলে? জানতে পারি কেন?” প্রশ্ন করল তাতিয়ানা। ইসাবেলা ঠোঁট শক্ত করে বলে,

“এমনিতেই। তুমি কিন্তু কাজটা ভালো করোনি। মাতভেইকে বলে দেবো মেয়েকে তুমি বিপথে নিচ্ছো।”

“বিপথে?” ভ্রু তুলল তাতিয়ানা।

“হ্যাঁ, ওর নিষ্পাপ মস্তিষ্ককে ম্যানুপুলেট করছো।”

বোনের রাগ কেন যেন মাঝেমাঝে উপভোগ করে তাতিয়ানা। বিছানার ওপরপাশে যেতে যেতে বলল,

“ওহ! এখন আমি ম্যানুপুলেটিভ মা হয়ে গেলাম? হলে হয়েছি। তোমার মতো অলস আর ঘুম কাতুরে বোনকে শায়েস্তা করতে মেয়েকে আরও ম্যানুপুলেট করব। একশবার করব।”

“কী শয়তানমার্কা বোনই না দিয়েছে আমাকে ঈশ্বর! বেচারা মাতভেই! মাঝে মাঝে ওর জন্য আমার চিন্তা হয়।”

“বেচারা মাতভেই! হু! ও কোনো বেচারা টেচারা নয়।” তারপর বিড়বিড় করে বলে, “তোমার ওই বেচারা মাতভেই আমাকে বেচারি করে ছাড়ে তা কি জানো? জানলে যে তুমি আর মা খুশিতে লাফিয়ে উঠবে সে আমি খুব ভালো জানি।” হঠাৎ মনে হয় ওর গাল দুটো গরম হয়ে উঠেছে। ইসাবেলা লক্ষ্য করার আগে ঘুরে ওপর পাশের জানালা খুলে দিতে উদ্যোত হয়।

“জানালা খুলছো কেন? শীতে মেরে ফেলবে?”

গলা ঝেড়ে জানালা না খুলে ফিরে এলো তাতিয়ানা। বিছানায় বসতে গেলে চেঁচিয়ে ওঠে ইসাবেলা।

“বসবে না ওখানে?”

ভ্রু কুঁচকে যায় তাতিয়ানার।

“কেন?”

ইসাবেলা কী করে বলবে ওখানে ওর নিকোলাস শুয়েছিল। ওই স্থানে অন্য কেউ বসলে ভালো লাগবে না।

“উ-ম… আ-ম…”

“কী উম আম.. করছো বলোতো? এখানে বসলে সমস্যা কী? রাতে হিসু করে দাওনি তো?” তাতিয়ানার পুনরায় বসতে গেলে ফের চেঁচিয়ে ওঠে ইসাবেলা।

“বসবে না।”

“মেজাজ কিন্তু খারাপ করছো এবার তুমি ইসাবেল।” বিরক্ত হলো তাতিয়ানা।

“কাল রাতে ওই পাশে কার্ল ঘুমিয়েছিল। তুমি নিশ্চয়ই কার্লের শোয়া জায়গায় বসবে না। আমি হিসু করিনি তবে ও করেছে। গন্ধ পাচ্ছো না?”
নাক কুঁচকে বলল,

“কী গন্ধ!”

কার্ল এ বাড়ির নতুন পালিত কালো বেড়াল। ছোটোবেলা থেকেই বেড়াল অপছন্দ তাতিয়ানার। কার্লকে তো আরও বেশি। এই দুটো একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। তাতিয়ানার ব্যবহারিক কোনো জিনিস সামনে পেলে তাতে মলমূত্র করবেই কার্ল। নানার প্রিয় না হলে এই কার্লকে তাতিয়ানা মেরেই ফেলতো মনে হয়। মানুষ আর প্রাণীতে এমন শত্রুতা থাকতে পারে তা ওদের না দেখলে ইসাবেলা জানতোই না। তাতিয়ানার গা রি রি করে উঠল। লাফ দিয়ে সরে গেল চার হাত দূরে।

“ইয়াক!” মুড একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে তাতিয়ানার। কী যে বলতে এসেছিল তাও ভুলে গেল। এই রুমে এসেছিল প্রসন্ন মনে। এখন রাগে ঘৃণায় তিক্ত ভেতর। বিছানার দিকে আবার তাকালো। মনে হলো কার্ল ওর সামনেই বিছানায় মূত্র ত্যাগ করছে। তারপর হাত নাড়িয়ে ইশারায় কাছে ডাকছে। না! আর এক মুহূর্ত নয় এখানে। দরজার দিকে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল। কী ভেবে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“খুব গন্ধ তাইনা ইসাবেল?”

“হুম, খুব।” নাক চেপে অভিনয় করল ইসাবেলা। তাতিয়ানা দ্রুত পায়ে ওর জানালার কাছে এলো। দুহাতে ঠেলে জানালা খুলতে শো শো করে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকলো।

“কী করছো তুমি!”

“বন্ধ ঘরে গন্ধ একটু বেশি লাগে। এখন আরাম পাবে তুমি।”

ইসাবেলা স্পষ্ট দেখতে পায় তাতিয়ানার ঠোঁট বেঁকে গেছে। রাগে চেঁচিয়ে ওঠে,

“তাতিয়ানা, আই হেইট ইউ।”

“অ্যান্ড আই লাভ ইউ মাই ডিয়ার সিস্টার।”

হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল তাতিয়ানা। কী যেন বলতে এসেছিল ইসাবেলাকে? ধ্যাৎ! পরে মনে করবে।

রাতে নিকোলাস এলো। কেন যেন খুব লজ্জা করছিল ইসাবেলার। নিকোলাস ওর ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল,

“চলো আজ তোমায় আমার দুর্গে নিয়ে যাব।”

“যেখানে তুমি থাকো।”

“হুম।” নিকোলাসের বলতে ইচ্ছে করছিল, যেখানে আমরা থাকব। কিন্তু রিয়েলিটি হলো, ইসাবেলা ওখানে কেবল বেড়াতে যাবে থাকতে নয়। প্রাচীন নির্জন, ভুতূরে বাড়িতে কি মানুষ থাকতে পারে!

নিকোলাস ওকে নিয়ে চললো নিজের আবাস্থলে। এই প্রথম স্বামীগৃহ যাচ্ছে। ভীষণ এক্সাইটেড ফিল করছে ইসাবেলা। দুর্গে পৌঁছে সরাসরি বাগানে নিয়ে এলো নিকোলাস ওকে। প্রাচীন, জড়-জীর্ণ এই দুর্গে একমাত্র এই স্থানটিতে প্রাণের রেশ আছে। বাতাসে ফুলের সুবাস। দিনের বেলা পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। নিকোলাস দূরে দাঁড়িয়ে রাতে ঝিঁঝির ডাক শোনে। কাছে গেলে ওরা চুপ করে যায়। পিশাচকে বুঝি ওরাও ভয় করে। ওদের সাথে কথা বলা গেলে নিকোলাস বলত,

“ভয় কেন পাস রে তোরা? আমার রুচি অনেক হাই বুঝলি? তোদের খাব না। ডাক, প্রাণ খুলে ডাক।”

ইসাবেলার হাত ধরে বসল একপাশের বেঞ্চে। কোনো এক কারণে খুব বেশি ঠাণ্ডা নয় এ স্থান। এখন তুষার পড়ছে না। মেঘমুক্ত আকাশে তারার মেলা। রূপোলী থালার মতো চাঁদ। এখানে বসে দূরের সাদা বরফের সমতল সাদা চাদরের মতো মনে হয়। অন্যপাশে বিশাল ঘন বন। রাতের সৌন্দর্যে অভিভূত হয় ইসাবেলা। নিকোলাস ফের ওর শীতল ঠোঁটে চুমু দেয়। ইসাবেলা দীর্ঘ করে সেই চুমু। হঠাৎ নিকোলাসকে চমকে দিয়ে বিয়ের ব্যান্ড পার্টির মতো বেজে ওঠে ঝিঁঝি পোকা। আজ নিজের ভেতরের শূন্যতা টের পায় না নিকোলাস। বড্ড সম্পূর্ণ,সন্তুষ্ট মনে হয়। ইসাবেলা যদি আরও আগে আসত ওর জীবনে! সেই মানব যৌবনবেলায়!
এক হাতে ইসাবেলার কোমর জড়িয়ে টেনে নিলো খুব কাছে। আদুরে বেড়ালের মতো গুটিশুটি হয়ে রইল ইসাবেলা। মাথাটা নিকোলাসের কাঁধের কাছে, মুখ গলায় লুকানো। ভালোলাগায় দুচোখ বুঁজে এলো ওর। নিকোলাস মাথার ওপর চুমু খেয়ে বলল,

“ঠিক আছো তুমি?”

“হুম।”

“সত্যি?”

ইসাবেলা চোখ খুললো। নিকোলাসের শার্টের বোতাম নিয়ে খেলতে খেলতে নিচু গলায় বলল,

“উমম..ঠিক আছি আমি।”

“কাল নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আ’ম সরি, লাভ।”

“নিকোলাস! বললাম তো ঠিক আছি। চিন্তা করো না।” মনে মনে বলল,”তুমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলে? আমিই ছিলাম যে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করেছিল। নির্লজ্জ নতুন বউ।”

নিকোলাস হাত বাড়িয়ে দেয় ওর মুখের কাছে।

“কামড় দাও।”

“হুঁ?” কিছুটা চমকে তাকায় ইসাবেলা।

“ভয় পাচ্ছো? ভেবেছো তোমাকে আমার মতো করতে চাচ্ছি?”

মাথা দুদিকে নাড়িয়ে পরিহাসসূচক মুচকি হাসল ও। আবার বলল,

“তা যদি পারতাম তবে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে সাধুপুরুষ হচ্ছি। না, কোনো অভিযোগ করছি না। তোমার ভালোবাসা সত্যি যেন ঈশ্বরের দূত। যে আমার মাঝের পাপীকে ধীরে ধীরে একজন সাধু পুরুষে বদলে দিচ্ছে। আমি বুঝেও এবার চুপ করে আছি। কোথাও না কোথাও ঈশ্বরকে জিতিয়ে দিতে সাপোর্ট করছি। কেন করছি জানো? তোমার ভালোর জন্য। তোমার জন্য সব করতে পারি, বেলা। সাধুপুরুষের মতো নিঃস্বার্থ হওয়া সেখানে কিছুই না।”

ইসাবেলা ওর হাতটা ধরে কামড় দিলো। ও যদি ওর জন্য পিশাচ থেকে সাধুপুরুষ হতে পারে, ইসাবেলা পিশাচ হতে পারবে না? তাছাড়া ওর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ওয়াদা করেছিল।

“যথেষ্ট, বেলা।”

নিকোলাসের রক্তের ঝাঁঝালো ধাতুরূপ স্বাদ ক্রমশ মিষ্টি আর নেশাযুক্ত হতে লাগল। ইসাবেলা নেশাগ্রস্তের মতো চুষছে।

“বেলা, থামো।” সতর্ক করল নিকোলাস। ইসাবেলা যেন শুনতেই পায়নি। বাধ্য হয়ে ইসাবেলার ওর পেছনের চুল ধরে টেনে ওর মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নেয়।

“থামতে বলেছি।”

রক্তমাখা ঠোঁটটা জিহ্বাতে চেটে মুখটা পছন্দের খাবার না পাওয়া শিশুর মতো করুণ করে।

“টের পাচ্ছো কিছু?”

ইসাবেলা সপ্রশ্নে ওর দিকে তাকায়। কী টের পাবে?

“ব্যথা। তোমার দেহের ব্যথা কি টের পাচ্ছো?”

আশ্চর্য হয়ে অনুভব করল ওর দেহের সেই ব্যথাগুলো উপশম হয়েছে। নিকোলাস হাসল। আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল,

“তোমার স্বামীর রক্তের ম্যাজিক দেখলে তো?”

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here