তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব—৮৫(শেষ খন্ড),৮৬

0
646

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৫(শেষ খন্ড),৮৬
Writer তানিয়া শেখ
পর্ব—৮৫(শেষ খন্ড)

শিশুটি বড়ো হতে লাগল। যে অন্ধকার প্রকৃতি ও শয়তানের ছায়ায় জন্ম নিয়েছিল তারই মাঝে। এই বিপদসংকুল ঘন জঙ্গল হয়ে উঠল ওর সব। বৈরি আবহাওয়াতে মানিয়ে নিলো নিজেকে। যেন এর সাথে জনম জনমের সখ্যতা। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর তারপর যৌবন এলো। জঙ্গলের বাইরের জগৎ ওর অজানা। কত প্রজন্ম এলো গেল কিন্তু ও যা তাই রইল। চোখের সামনে জন্ম হওয়া সিংহ শাবক, বাঘ ও বানর সবই একসময় নিস্তেজ হয়ে মিশে যেত মাটিতে সময়ের সাথে। ঝিরির জলে নিজেকে দেখত। একই আছে। একটুও পরিবর্তন আনেনি সময় ওর মধ্যে। বহুকাল জঙ্গলবাসী হয়ে, জন্তু জানোয়ারের সাথে থেকে স্বভাবও তেমন। কিন্তু আকার আকৃতি ওদের সাথে মেলে না। এই জঙ্গলের কোনো জীবের সাথেই না। সকলের একটা পরিবার ছিল। কিন্তু ও একা। ভীষণ একা! একজন অবশ্য ওর সাথে আছে। ওকে কি আর থাকা বলে!
জঙ্গলে কোণা কোণা ওর চেনা। কোন উদ্ভিদে কী কাজ, কোন ফলে মৃত্যু আর জীবন ততদিনে মুখস্থ। সিংহ কিংবা অজগর কাউকে ওর আর ভয় নেই। বরং ওরাই এই নিষ্ঠুর গোঁয়ারটাকে এড়িয়ে চলে। বহুকাল অতিবাহিত হলো এরপর। রোজ শিকার, জন্তু জানোয়ারের সাথে মারামারি তারপর অন্ধকার গুহার জীবন। এই একঘেয়েমি আর ভালো লাগে না। জঙ্গলের শেষে একটা খুব উঁচু পাহাড় আছে। যে অন্ধকারের বাসিন্দা ওকে বাঁচিয়েছে, লালন-পালন করেছে সে ওকে সাবধান করেছিল ওখানে না যেতে। শৃঙ্খল, নিয়মে ও আদেশ – নিষেধ মানা স্বভাব নয় ওর। অনেকবার অন্ধকারের বাসিন্দার কথা অমান্য করেছে। এরজন্য শাস্তিও পেয়েছিল। টানা চারদিন অদৃশ্য এক শেকলে অন্ধকার গুহায় বন্দি ছিল। এই বনের শত্রুগুলো তখন সুযোগ নিতো। বড্ড জ্বালাত এসে। ছাড়া পেলে এদের একটাও আর জীবিত থাকত না। অন্ধকার বাসিন্দার প্রভুত্ব দিন দিন অসহ্য হতে লাগল। কেন ও কারো গোলামি করবে? কীসের ঠেকা ওর? মুখে না বললেও অন্ধকার বাসিন্দা সব বোঝে। মানুষের মনের খবর পড়া খুব সহজ তার জন্য। দুজনের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। শাস্তি পর শাস্তি নামে যুবকের ওপর। একসময় যা সহ্য হয়ে যায়। এই শাস্তি ওকে আরও যেন শক্তিশালি, নির্ভীক করে। অন্ধকার বাসিন্দাকে দেখা যায় না। নচেৎ ওকে শেষ করতে যুবকের মিনিটও লাগত না। অন্ধকারের বাসিন্দা ক্ষিপ্ত হোন। অকৃতজ্ঞ মানুষ! যাকে সে প্রাণ দিলো, সব দিলো সে এখন ওকেই শেষ করার মতলব করছে। একে আর বাঁচিয়ে রাখবে না সে। কিন্তু হায়! যুবকের বুদ্ধি, শক্তির জোর এতই বেড়েছে যে দিনের আলোর সাহায্যে অন্ধকারকে ধোঁকা দিয়েছে। পালিয়ে গেছে অন্ধকারের রাজ্য ছেড়ে সেই উঁচু পাহাড়ে। এখানে দাঁড়িয়ে দূর লোকালয় দেখা যায়। যুবক অবাক হয়ে দেখে। তারপর একদিন উপস্থিত হয় সেখানে। জটা দীর্ঘ বাদামি চুল, মুখ ভর্তি আগাছার ন্যায় দাড়ি, নগ্ন পিঙ্গলবর্ণ দেহে হেঁটে হেঁটে মানুষ দেখে, চারপাশের সবকিছু দেখে। বিস্ময়ে বড়ো বড়ো হয়ে রয় মধুরঙা দুচোখ। মানুষেরা প্রথম কৌতূহল দেখায় তারপর পাগল ভেবে দূর দূর করে। ওই মধুরঙা দুচোখে চেয়ে কারও আবার মায়া হয়। দয়া করে উচ্ছিষ্ট খেতে দেয়৷ খাবার খেতে খেতেও অবাক হয় যুবক। অদ্ভুত স্বাদ কিন্তু খারাপ না। মানুষগুলোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। নিজের মতো এই মানুষগুলোই তবে ওর সহজাতী? অন্ধকারের শয়তানটা এতদিন ধোঁকায় রেখেছিল!দূরে রেখেছিল এদের থেকে। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে থাকে। সহজাতী নয় যেন আপন পরিবার পেয়েছে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর। সে কী আনন্দ ওর! সব আনন্দ চোখের জলে ভেসে যায় একদিন। এই সহজাতী আপনজনদের ক্রূরতা, লোভের স্বীকার হয়ে। জঙ্গলের জন্তু জানোয়ারও ওর সাথে এমন করেনি এরা যা করেছে। কষ্টে, ঘৃণা আর ক্রোধে জ্বলে ওঠে। ওর মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা জানোয়ারটা হুংকার তুলে জেগে উঠল। প্রতিশোধ নেয় বড়ো তৃপ্তির সাথে। লোকালয়ে থেকে এখন সে মানুষের মতো আচরণ শিখে নিয়েছে। দীর্ঘ জটা চুল ছেঁটে ঘাড় অব্দি করেছে। দাড়ি নেই। নগ্ন ময়লা দেহ পানি আর সুগন্ধি সাবানে ধুয়ে কাপড়ে ঢেকেছে। জংলী এবার সভ্য, সুদর্শন মানব যুবক। বুদ্ধি ও শক্তি বলে এই মানুষগুলোর ওপর ধীরে ধীরে আধিপত্য গড়ে তোলে। ক্ষমতাশালী এই যুবককে লোকে ভয়ে সমীহ করে চলে। বেশ আনন্দ, ফুর্তিতে কাটছিল যুবকের দিন। একরাতে নেশা করে, ফুর্তি করে বাড়ির পথে রওয়ানা হয়। ফিটনের পেছনের সিটে গা এলিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই। পরদিন হুঁশ ফিরতে নিজেকে সেই জঙ্গলে, অন্ধকার বাসিন্দার গুহায় আবিষ্কার করল। ভয় খেয়ে যায় তৎক্ষনাৎ। নেশার প্রভাব তখনও ছিল। হাত পায়ে জোর পেল না। অন্ধকার বাসিন্দা হো হো করে হেসে ওঠে ওর অসহায়ত্বে। শাস্তি দেয়, তিরস্কার করে। যুবকের নেশা কেটে যায়। রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকে গুহার ভেতরে। এক সপ্তাহ এভাবেই ওর ওপর অত্যাচার চালালো। যুবকের মুমূর্ষু অবস্থা। অন্ধকার বাসিন্দা ভাবল আর বাঁচবে না ও। এবার তাহলে এই অকৃতজ্ঞকে জানানোই যায় কেন ও কীভাবে ওর জন্ম। সত্যি বলতে এতদিন যুবক দেহের আঘাতে শুধু ব্যথিত হয়েছিল। যা সময়ে ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু সেদিন অন্ধকার বাসিন্দার সেই কথা শুনে ব্যথার চাপে দমবন্ধ হয়ে এলো ওর। এত কষ্ট এই জীবনে পায়নি। মায়ের অদেখা মুখ সেদিন যেন স্পষ্ট দেখতে পেল। কঙ্কালটি একটা রক্ত মাংসের নারীমূর্তি রূপ নিলো। এত সুন্দর মুখ অথচ তাতে কী দুঃখ! যার দুগ্ধ পান করেনি, যার কোলের উষ্ণতা গায়ে মাখেনি তারই কষ্টে যুবকের বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়। জন্মের পর যেভাবে আকাশ পাতাল এক করে কেঁদেছিল। সেদিন আবারও তেমন করে কাঁদল। শুধু কণ্ঠে যুক্ত হয় একটা শব্দ,

“মা, মা।”

“মনিব, মনিব।” ভীত চাকরটি হাত বাড়িয়ে বিছানায় উবু শুয়ে থাকা মনিবের কম্পিত দেহটা নাড়া দেয়। কয়েকবার ডাকতে শান্ত হয় তার মনিব। কিছুক্ষণ চুপ করে বসা গলায় বলে,

“স্নানের ব্যবস্থা কর।”

“জি, মনিব।” চল্লিশর্ধো চাকরটি দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে তাকায়। ওর মনিব এখনও বালিশে মুখ গুঁজে আছে। মানুষটার প্রতি এই এক সময় তার বড়ো মায়া হয়। মাথা নুয়ে নিঃশব্দে দরজার বাইরে চলে গেল। স্নানের ব্যবস্থা করে ডাকতে এসে দেখল মনিব কক্ষে নেই। গেল কোথায়? এই অবস্থায় তো তিনি কখনো বের হন না। দরজায় দাঁড়ানো প্রহরীকে জিজ্ঞেস করল,

“মনিব কোথায় গেছে?”

প্রহরী গম্ভীর গলায় বলল,

“গর্ভগৃহের দিকে যেতে দেখলাম।”

গর্ভগৃহে! এই অবস্থায় ওখানে গেলেন কেন? তারপর হঠাৎ করেই যেন জবাবটা পেলে গেল। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে।

মাটি কেটে কেটে নিচে সিঁড়ি গড়া হয়েছে। তা দিয়ে পা টিপে নিচে নামে। হাতে ছোটো একটা মশাল। জানালার বালাই নেই এখানে। মাঝে মাঝে কিছু ছিদ্রপথ তৈরি করেছে সরীসৃপেরা। সেসবের কল্যাণেই এখানকার সর্বত্র বিষাক্ত সব প্রাণীদের বিচরণ। অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে মাটি পেয়ে ওরা যেন আরও বেড়েছে সংখ্যায়। চাকরটির এ পথ চেনা। ওদেরকে এখন আর ভয় পায় না। কিছুদূর এগিয়ে মনিবের গর্জন শুনে থমে যায়,

“নোভালি!”
চাকরটি দৌড়ে সামনে যায়। ওর মনিব দাঁড়িয়ে আছে কাঁচের কারাগারের সামনে। পরনে কেবল একটা ট্রাউজার। ঘুম থেকে উঠেই এখানে চলে এসেছে। কাঁচের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রাগে কাঁপছে রীতিমতো। পশুর মতো গজরাচ্ছে। চাকরটি আরেকটু এগিয়ে গেল। কাঁচের কারগারে বন্দি পিশাচিনীটি হাসছে ওর মনিবের দিকে চেয়ে। আগেরবার যখন ওকে বন্দি করা হয়েছিল ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত থাকত। কিন্তু এবার আর তেমন নেই। গতবারের মতো মনিব ওর ওপর অত্যাচারের বুলডোজার চালায়নি। দাবী করছে সে ওকে ভালোবাসে। আদৌ কি তাই! চাকরটা বিশ্বাস করতে চায় না। পিশাচিনী ছোটো ছোটো পায়ে ওর মনিবের সামনের কাঁচের দেওয়ালের নিকটে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু স্পর্শ করে না। প্রলুব্ধ গলায় বলে,

“এত সকালে আজ! রাতে বুঝি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলে তুমি? কী দেখেছিলে বলো তো! উম..তোমাকে আমি আদর করছি? হঠাৎ তুমি দেখলে এ কী! নোভালি কোথায়? এ যে নিকোলাস। যার পা চাটছি কুকুরের মতো। হা, হা। কী সুন্দর স্বপ্নই না দেখছিস তাই না, ড্যামিয়ান?”

“আমার প্রিয় প্রিয় খুব প্রিয় স্লাট, খুব রস বেড়েছে দেখছি তোর।” চোয়াল শক্ত করে ক্রূর কুটিল হাসল ড্যামিয়ান। তারপর এগিয়ে গেল আরও কাছে। দুজনের মাঝে কেবল কাঁচের দেওয়াল। ড্যামিয়ান দুহাত রাখল তার ওপর। বলল,

“কে যে কার পা চাটে আর কুকুর হয় সে তো সময়ই বলে দেবে নোভালি মাই লাভ।”

“বাস্টার্ড একদম ওই সম্বোধন করবি না বলে দিলাম।”

“কোনটা মাই লাভ?” ড্যামিয়ান হাসল। নোভালি জবাব দেয় না। রাগে চোখ রক্তিম। ড্যামিয়ান সেই চোখে চেয়ে বলল,

“ইউ নো আই লাভ ইউ, লাভ।”

“ওহ! হাও সুইট।” চোখ পিটপিট করে। তারপর আবার বলল,” বাট ইউ নো না আই ফাকিং হেইট ইউ, বাস্টার্ড।” শেষে চিৎকার করে ওঠে নোভালি। ড্যামিয়ান ঠোঁট উল্টে বলল,

“আ’ম হার্ট বেবি। সিরিয়াসলি, বিলিভ মি।”

“সিরিয়াসলি বিলিভ মি মাই ফুট। জাস্ট গো টু হেল।”

“বিলিভ মি থেকে একটা কথা মনে পড়ল। কাল রাতে সত্যি তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম।” থেমে গেল। তাকাল পেছনে দাঁড়ানো চাকরটির দিকে। চাকরটি বোকার মতো দেখছিল ওদের। বিশেষ করে ড্যামিয়ানকে। সে যেন বহুরূপী। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। এই যে আবার বদলে গেছে,

“মনিব, স্নান..”

“আউট!” ওর হিংস্র দৃষ্টি থেকে পালিয়ে বাঁচে চাকরটি। ড্যামিয়ান আবার নোভালির কুপিত মুখে চেয়ে হাসল। বলল,

“স্বপ্নটা একটু প্রাইভেট তাই ওকে তাড়িয়ে দিলাম। তাহলে বলি শোনো, তুমি ঠিকই ধরেছ স্বপ্নে তোমাকে খুব আদর করছিলাম। উফ! নোভালি, নোভালি, মনে হচ্ছে এখনও তোমার স্পর্শ আমি অনুভব করতে পারছি।”

“শাট আপ, শাট আপ।”

ড্যামিয়ান থামে না। কণ্ঠে মদির এনে বলল,

“তারপর আদরে, ভালোবাসায় অনেকদিন কেটে গেল আমাদের। তুমি গর্ভবতী হলে। আমার সন্তানের মা হলে তুমি নোভালি, আমার সন্তানের মা।”

“বাস্টার্ড ও কেবল তোর স্বপ্নই। যা কোনোদিন পূরণ হবে না।”

“ভুল জানো তুমি। ড্যামিয়ানের স্বপ্ন সব সময় পূরণ হয়। এটাও হবে। আমাদের সন্তান হবে। পিশাচ রাজকুমারী ও নেকড়ে রাজার সন্তান।”

নোভালি এগিয়ে এলো। ওর রাগত চেহারায় ফুটে ওঠে তীব্র ঘৃণা আর ঠোঁটে ঠাট্টার হাসি,

“তোর স্বপ্নে, কেবল তোর স্বপ্নে। যা কোনোদিন পূরণ হবে না, আমার ভাই হতেই দেবে না। নিকোলাসের হাতে তোর মরণ হবে। নিশ্চয় হবে।”

“নিকোলাস, নিকোলাস!” গর্জে ওঠে ড্যামিয়ান। নোভালি ভড়কে যায়। ওর হিংস্র হয়ে যাওয়া চোখে তাকিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল।

“তোর ভাই আমাকে মারবে? দ্য গ্রেট পিশাচ নিকোলাস উইলিয়াম আমাকে মারবে? সেদিন আর আসবে না নোভালি। সামনে যে দিন আসবে তা হবে নিকোলাস ও ওর বংশ ধ্বংসের দিন। কিন্তু তার আগে তোকে আমার চাই। তোর গর্ভে আমার একটা সন্তান চাই। একটা মেয়ে সন্তান। ঠিক আমার মায়ের মতো।”

চলবে,,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৬
Writer তানিয়া শেখ

আন্না মেরিও তাতিয়ানাকে ডেকে পাঠালেন নিজের কক্ষে। ফুরফুরে মেজাজে মায়ের ঘরে ঢুকলো তাতিয়ানা।

“ডেকেছিলে, মা?” বলল ও।

আলমিরার দরজা খুলে কিছু খুঁজছিলেন আন্না মেরিও। খানিক উঁকি দিয়ে মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখলেন। তারপর আবার কাজে মনোনিবেশ করে বললেন,

“হুম। বসো।”

তাতিয়ানা বিছানার ওপর পা ঝুলিয়ে বসল। আন্না মেরিও বললেন,

“আজ বাসায় গেস্ট আসছে।”

মায়ের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,

“তা তো জানি। আমাকে কিছু করতে বলো না, আমি পারব না।”

“কথা শেষ করতে দাও। ডিনার ওরা এখানে করবে। ইসাবেলাকে বলো সন্ধ্যার আগে আগে তৈরি হতে।”

“শুধু ওর একার নাম বললে কেন? আমরা সকলে তৈরি হব।”

আন্না মেরিও মেয়ের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকান। কী যেন ভাবলেন। তারপর ঠোঁট শক্ত করে বললেন,

“ওইদিন ইসাবেলাকে যা বলতে বলেছিলাম বলেছিলে?”

“কোনদিন?”

মেয়ের পালটা প্রশ্নে কটমট করে বললেন,

“তোমার মনে নেই? ভাবো তো কোনদিন দুপুরে তোমাকে ওর ঘরে পাঠিয়েছিলাম।”

একটু ভাবতে মনে পড়ল তাতিয়ানার।

“ওহ! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমি তো… এই রে! আমি ওকে সে কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার মেয়েটা_”

“আমার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছিল যে তোমাকে পাঠিয়েছিলাম। কোনো কাজ তোমার দ্বারা হয় না কি।” রাগত গলায় বললেন আন্না মেরিও। তাতিয়ানা চুপসে গেছে। এত গুরুত্বপূর্ণ কথা কী করে ভুললো! উঠে দাঁড়ায় ও।

“আচ্ছা, এখনই গিয়ে বলছি।”

“থাক! খুব উপকার করেছ। আর প্রয়োজন নেই। নিজের কাজ করো গিয়ে। দয়া করে তুমি, তোমার হবু স্বামী আর মেয়েকে তৈরি করো সন্ধ্যার আগে।” সশব্দে আলমিরার দরজা বন্ধ করে হাতে কাপড় নিয়ে সরে এলেন। এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। তাতিয়ানা অসন্তোষ মুখে সেদিকে তাকিয়ে বলল,

“সবসময় রাগ দেখাবে। দয়া করে ব্লা ব্লা। মাতভেই!”

অদূরে পাইন গাছের আড়ালে সূর্যটা ডুবে গেল।গোধূলির লালিমা ছড়িয়েছে পশ্চিমে। ছোপ ছোপ কুয়াশা মুড়ানো চাদর ক্রমশ মেলে যাচ্ছে। একটু পর সন্ধ্যা নামবে। আন্না মেরিও রেইনিকে ধরে এনে ইসাবেলার কাছে বসিয়ে রেখেছেন। দুজনের কেউ কথা বলছে না। ইসাবেলা সজল চোখে জানালার বাইরে নামা অন্ধকারে তাকিয়ে আছে। মা’কে ও কত বুঝালো বিয়ে এখন করবে না।

“শোনো পাগল মেয়ের কথা। দেখা করলেই কি বিয়ে যায়?” বললেন আন্না মেরিও। ইসাবেলা মলিন মুখে বলল,

“আমার ইচ্ছে নেই দেখা করার। না করে দাও ওদের। প্লিজ মা।”

“বেলা, জেদ করো না। তোমার নানা তাদের নিমন্ত্রণ করেছেন। না করার ক্ষমতা আমার নেই। তাছাড়া আমি বুঝতে পারছি না দেখা করাতে সমস্যা কোথায় তোমার? পছন্দ না হলে না করে দেবে। কথা শেষ।”

“তোমাকে যদি বলতে পারতাম!” বিড়বিড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুখ কালো মেঘ ঢেকে গেছে। আন্না মেরিও ওর বিড়বিড় গুরুত্ব দিলেন না। পিটারের জন্য আর কতকাল কষ্ট পাবে মেয়েটা! সারাজীবন ওই গৃহছাড়া পুরুষটার জন্য মেয়েকে বিরহ করতে দেবেন না। সেই লোকের ভবিষৎবাণীর ভয়ও আছে। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ইসাবেলাকে সুপাত্রে পাত্রস্থ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়বেন। মায়ের মনের শঙ্কা সম্পর্কে না জানা ইসাবেলার মনে এখন একরাশ অভিমান জমেছে। মা যেন আজ নিষ্ঠুর, পাষাণ এক মূর্তি। এত অনুনয় করেও যার দয়া ভিক্ষা পাওয়া গেল না। মা বলেছে দেখলে কি বিয়ে হয়? ইসাবেলা জানে ও কথা কেবল কথা। ওদের পছন্দ হলেই নানা মার্কোভিক মত দিয়ে দেবেন। ইসাবেলা হ্যাঁ, না তখন কোনো কাজে আসবে না। এইদিন আসবে সে ও জানত। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসবে তার ধারণা ছিল না। নিকোলাসও নেই। কতদিন দেখে না ওকে! এত দেরি করছে কেন এবার? একা কী করবে এখন ও? চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে নিকোলাসকে এই ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত একটা চিঠি লিখল। চিঠিটা ভাঁজ করে ঘুরে রেইনকে বলল,

“রেইনি, আমার একটা কাজ করে দিবি?”

রেইনি সপ্রশ্নে ইসাবেলার হাতের চিঠিটার দিকে তাকায়। মুখ তুলে মাথা দুলালো।

“হ্যাঁ।”

ইসাবেলা জানালার বাইরে তাকাল। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আসেনি এখনও।

“পুব পাশের কবরস্থানটা চিনিস তো?”

রেইনি ভীত হলো কিন্তু মাথা নাড়ায়। ইসাবেলা ওকে অভয় দিয়ে বলল,

“ভয় পাস না। ওখানে পাঠাব না। ওর সামনের ভাঙা গির্জা আছে তার বেদীতে এটা রেখে আসবি। পারবি না?”

রেইনি না বলতে পারবে না। শুকনো ঢোক গিলে বলল,

“পারব।”

ইসাবেলা চিঠিটা ওর হাতে দিলো। তারপর ড্রয়ার থেকে দিয়াশলাই আর একটা ল্যাম্প দিয়ে বলল,

“ভয় পাস না। তোর গলায় তো ক্রুশ আছেই। ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে একদৌড়ে ওটা রেখে চলে আসবি।”

রেইনি আচ্ছা বলে দরজার কাছে গেল। আবার ঘুরে বলল,

“আন্নে এই ঘরে আমাকে না পেলে রাগ করবে যে।”

“আমি আছি তো। কিছু বলবে না। তাছাড়া, মা আসার আগেই তুই চলে আসতে পারবি।তাড়াতাড়ি যা। ওহ! রেইনি, পেছনের দরজা দিয়ে যাবি কিন্তু।”

রেইনি চলে গেল। ও ফিরে না আসা পর্যন্ত শান্তি হলো না ইসাবেলার। পাছে মা চলে আসে। তাতিয়ানা যদি ওকে খোঁজে। বার বার ঈশ্বরকে ডাকছিল। ঈশ্বর শুনেছেন ওর ডাক। কেউ টের পাওয়ার আগেই রেইনি নির্বিঘ্নে কাজ শেষ করে চলে এসেছে। মেয়েটা চুপচাপ আগের মতো বসে রইল। কিন্তু মুখ সাদাটে৷ হয়তো বাইরের ঠাণ্ডার কারণে। ইসাবেলা ওকে ফায়ারপ্লেসের পাশে বসতে বলল। নিরুত্তর বসল ওখানে। ওর এই নীরবতা ইসাবেলার ভালো লাগত না আগে। কিন্তু আজ ভালো লাগল। ও প্রশ্ন করলে ইসাবেলা জবাব দিতো কী করে?
একটু পর ইসাবেলার ডাক পড়ল নিচে। গভীর শ্বাস নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বুক দুরুদুরু করছে। কী এক অজানা আতঙ্কে তটস্থ ও। অজানা! না, তা তো নয়।
বসার ঘরে বসে আছে ওর মা, বোন ও মামি। সকলে প্রশংসা করল ওকে দেখে। সোনালী পাথর বসানো ব্লাউজ আর সাদা ঘাগড়া পরেছে ইসাবেলা। চুলগুলো পরিপাটি করে বাঁধা। আন্না মেরিও নিজে থেকে সাজিয়েছেন। অতিথিদের গাড়ির হর্ন শোনা গেল। ওর দুই মামা রজার ও ম্যাক্সিম উঠে দাঁড়ায়। ওদের দেখে ওলেগ, মাতভেই ও ভ্লাদিমিও দাঁড়ালো।

“তোমরা থাকো।” বলল ম্যাক্সিম। তারপর দুই ভাই সদর দরজার দিকে গেল।
ইসাবেলা মাথা নুয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে পরিস্থিতি অসহায় করে ছাড়ে। সামনের পথ হয় খুব সংকীর্ণ। কান্না পাচ্ছে খুব ইসাবেলার। হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকালো। ভ্লাদিমি বোনের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে চাপা গলায় বলল,

“তোর পছন্দ না হলে কিছু হবে না। চিন্তা করিস না। ভাই আছে তো তোর পাশে।”

ইসাবেলা ম্লান হাসল। ওর সত্যি জানার পরও এই ভাই কি এমন করে বলবে? মাতভেই ও তাতিয়ানাও পাশ থেকে অভয় দিলো ওকে।

সদর দরজা খুলে গেল। মুখ তোলেনি ইসাবেলা। ওর বুক কাঁপছে আগের চাইতে বেশি।

“ঈশ্বর, নানার যেন পছন্দ না, একটুও না হয়।” মনে মনে এই একটাই প্রার্থনা করছিল হঠাৎ ওর মা চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে ওঠলেন যেন। ক্ষুব্ধ চমকিত গলায় বললেন,

“তুমি?”

“আন্নে, আমার প্রিয় আন্নে।”

গলাটা শুনে চমকে তাকায় ইসাবেলা। ভয়ে জমে যায় সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে। মানুষ!

“বাবা, ড্যামিয়ান এখানে কী করছে?” রাগে চিৎকার করে ওঠেন আন্না মেরিও। ওলেগ স্ত্রীকে শান্ত করতে কাঁধে হাত রাখলেন। রাগ তাঁরও হচ্ছে খুব। তাতিয়ানা ও ভ্লাদিমি রক্তচক্ষু নিয়ে ড্যামিয়ানকে দেখছে। ইসাবেলাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে ওরা। মাতভেই সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে। মার্কোভিক শীতল গলায় মেয়েকে বললেন,

“শান্ত হও আন্নে।”

“আমার প্রশ্নের জবাব দিন আগে বাবা। এই শয়তানটা এখানে কেন?”

“সংযত হয়ে কথা বলো আন্নে।” রজার ধমকের সুরে বলল। ওলেগ তাকে উদ্দেশ্যে করে বলেন,

“আমার স্ত্রীকে ধমক দেবে না রজার।”

এবার ম্যাক্সিম এগিয়ে এলো। সে পিতার মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল,

“আন্নে, বোন আমার, দু’মিনিট শান্ত হয়ে বসো তোমরা। ড্যামিয়ান এসো।”

“ও এখানে বসবে না। খবরদার ভাই।” আন্না মেরিও বড়ো ভাইকে সতর্ক করেন। ম্যাক্সিম পিতার দিকে তাকায়। মার্কোভিক উঠে দাঁড়ান এবার।

“এসো ড্যামিয়ান, এখানে এসে বসো।”

আন্না মেরিও সহ ওর প্রতি বিরূপ দৃষ্টিপাত করা মানুষগুলোর দিকে বিদ্রুপের হাসি হেসে মার্কোভিকের ছেড়ে দেওয়া চেয়ারে গিয়ে বসল ও। রজার ও ম্যাক্সিম ছাড়া সকলে বিস্ময়ে বিহ্বল।

“আমি আজ এক্ষুনি চলে যাব। ওলেগ সবাইকে গুছিয়ে নিতে বলো।”

ওলেগ স্ত্রীর কথাতে মাথা নাড়ালেন। তাতিয়ানা ও ভ্লাদিমি ইসাবেলাকে ধরে দাঁড় করায়। চোখ নামিয়ে রেখেছে ইসাবেলা। দেহটা অবশ হয়ে আসছে বুঝি। ড্যামিয়ানকে ও কিছুতেই দেখবে না। ওরা ডাইনিং ছেড়ে যাবে বলে পা বাড়াতে মার্কোভিক বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলেন,

“কোথাও কেউ যাবে না। শুনেছ তোমরা।”

আন্না মেরিও হাসলেন।

“রিয়েলি বাবা! এখন আপনি আমাদের বন্দি করবেন না কি?”

“দরকার পড়লে তাই করব।”

“চেষ্টা করে দেখুন।” আন্না মেরিও ঘুরে দাঁড়াতে ড্যামিয়ান বলে ওঠে,

“থামো আন্নে।”

“আমার নাম মুখে নিবি না শয়তান। তোকে এখনও চুপচাপ দেখছি এ তোর ভাগ্য।”

আয়েশ করে চেয়ারে বসল ড্যামিয়ান। পা তুললো টেবিলের ওপর। ক্ষীণ কুটিল হাসি ঠোঁটে।

“এত ক্ষোভ আমার ওপর তোমার আন্নে! অথচ, এই তুমি একদিন কত ভালোবাসতে আমাকে। ভুলে গেছ সেই দিন। আন্নে, আমার প্রিয় আন্নে, তুমি জানো তো আই লাভ ইউ।”

পায়ের জুতো খুলে ড্যামিয়ানের দিকে ছুঁড়ে মারলেন আন্না মেরিও। দুহাতে সহজে লুফে নিলো সেটা ও। আগের মতো হাসছে।

“আন্নে!” মার্কোভিক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন।

“সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো তুমি আন্নে। ক্ষমা চাও ওর কাছে।”

“ক্ষমা! ওর কাছে? জীবনেও না।”

মার্কোভিক তেড়ে আসতে ভ্লাদিমি ও মাতভেই আন্না মেরিওর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। ড্যামিয়ান এবার গম্ভীর মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠল।

“অনেক নাটক হয়েছে। মার্কোভিক তোমার মেয়েকে স্টাডি রুমে নিয়ে এসো।”

“কোথাও যাব না আমি।”

“অবশ্যই যাবে তুমি আন্নে।” ড্যামিয়ান ইসাবেলার রক্তশূন্য মুখে চেয়ে ক্রূর হেসে বলল,

“মেয়েকে বাঁচাতে এ ছাড়া তো আর উপায় নেই তোমার।”

চমকে তাকায় ওর দিকে ইসাবেলা। ড্যামিয়ানের দৃষ্টি যেন মুহূর্তে ওকে সম্মোহিত করল। দেখায় সেই ভয়ংকর অতীত। যা ভুলতে কত বছরই না লেগেছিল ছোট্ট ইসাবেলার।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here