বকুলতলা ৩.

0
780

বকুলতলা

৩.
খাবার টেবিলে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে তরী। এতগুলো মানুষের সামনে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। সবার পরনেই জাঁকজমক পোশাক। একমাত্র সে-ই শুধু সুতীর একটা পাতলা কামিজ পরে আছে। ওড়না দিয়ে কপাল অব্দি ঘোমটা টেনে রেখেছে। এরমধ্যে প্রণয় কোত্থেকে এসে তার পাশের চেয়ারটাতেই বসেছে। কেন? আর কোনো চেয়ার কি খালি ছিল না? সে তরীর পাশে বসতেই যে প্রণয়ের ভাই-বোনেরা তীক্ষ্ণ চোখে তাকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে নিচ্ছে। তরীর ভালো লাগছে না এসব। অস্বস্তিতে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে। এখান থেকে উঠে যেতে পারলেই যেন বাঁচে! আড়চোখে প্রণয়ের দিকে তাকাতেই সে প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে বললো, “কি হয়েছে? এত নড়াচড়া করছেন কেন?”

তরী ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “কই? কিছু হয়নি।”
উত্তরটা যেন ভালো লাগেনি প্রণয়ের। সে দু’সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তরীর দিকে। কি যেন খুঁজছিল ওই কাজলহীনা চোখের গভীরতায়। তারপর গাঢ় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আপনি প্রচুর মিথ্যা বলতে জানেন।”
তরী হকচকায়, ভড়কায়, চমকায়। ভেতরকার দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলে। মাথা নুইয়ে এক লোকমা ভাত মুখে দিতেই মনে পরে, স্যুপ খেতে গিয়ে জিহ্বা ক্ষীণ পুড়িয়ে ফেলেছিল সে। খাবারগুলো বিষাদ লাগছে।

আয়েশা খাতুনকে সর্বদা গম্ভীর ব্যক্তিত্বেই দেখেছে তরী। কখনো হাসতে দেখেনি। কিংবা তার সাথে কখনো নাজুক কণ্ঠে কথাও বলতে দেখেনি। সে ভেবেছিল, তিনি হয়তো এমনই। কিন্তু না। তিনি শুধু তরীর বেলায়ই এমন। রুক্ষ, গম্ভীর, কঠোর।
ভাত চিবুতে চিবুতে আচমকা আয়েশা খাতুন শুধালেন, “তুমি কি এখনো হলে সীট পাওনি তরী?”

তরী তখন মাত্রই পানি পান করছিল। দ্রুত পানিটুকু গিলে নিয়ে জবাব দিলো,
—“এবছর হয়তো খালি পাবো না মামী।”
—“তাহলে? এখন কি করবে? এভাবে তো মানুষের বাসায় দিনের পর দিনে পরে থাকা যায় না।”
কি সাবলীল ভাবে বলে দিলো কথাটা! তরী কি এমন সাবলীল ভাবে নিতে পারলো? একদমই না! সেখানের প্রত্যেকটা মানুষের তুচ্ছ, নগন্য দৃষ্টি তাকে বুঝিয়ে দিলো, সে কতটা হীন এ বাড়িতে।
তরীর মামা প্রতিবাদ করতে চাইলেন, “এভাবে বলছো কেন আয়েশা? থাকুক মেয়েটা, যতদিন থাকার।”
আয়েশা খাতুন স্বামীর দিকে কঠিন নজরে তাকালেন। কিছু বলতে নিবেন, তার আগেই তরী অল্প হাসার চেষ্টা করে বললো, “মামী ঠিক বলছে মামা। এভাবে আসলেই থাকা যায় না। আমি চিন্তা করেছি, আমার মতো যারা হলে সীট পায়নি, তাদের সঙ্গে মিলে একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাট খুঁজবো থাকার জন্য।”
—“চিন্তাটা মন্দ না। তাই-ই করো।” বললেন আয়েশা খাতুন।

তরীর গলা দিয়ে আর খাবার নামছে না। তবে টেবিল থেকে উঠতেও পারছে না সে। বেয়াদবি হয়ে যায়। পাছে না আবার এরা ওর মা-বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলে! এক সেকেন্ড গড়ালো, দুই সেকেন্ড গড়ালো, তিন সেকেন্ড গড়ালো। তরী তখন শাহাদাত আঙুলে প্লেটের ভাত এদিক-ওদিক করছে। সেই আঙুলের গতিবিধি একবার পরখ করে আচমকা খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো প্রণয়। আয়েশা খাতুন জিজ্ঞাসু দৃষ্টে চেয়ে জানতে চাইলেন, “কি হয়েছে? উঠলি কেন?”
—“খাওয়া শেষ।”
গম্ভীর কণ্ঠ। প্রণয় আর দাঁড়ালো না। স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হেঁটে লাইব্রেরী ঘরে চলে গেল।

____________

সময়টা বোধহয় সকাল ন’টা। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজে মেঘ ডাকছে। তরী একবার জানালার বাহিরে তাকিয়ে আকাশটা দেখে নিলো। তারপর টেবিল থেকে ছাতা নিয়ে ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে সালেহাকে বললো, “আমি খাবার টিফিনে নিয়ে নিয়েছি সালেহা। রুমে তোমার জন্য নাস্তা ঢেকে রেখেছি। খেয়ে নিও।”
বলতে বলতে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল সে। প্রণয় আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল। খুব রেগে। তরীর দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়। লোকটাকে নিয়ে মাথা না ঘামানোর খুব চেষ্টা করে তরী। কিন্তু কেন যেন, প্রণয়কে তার স্বাভাবিক মনে হয় না। অন্যরকম লাগে। এখন একরকম, তো পরে আরেক রকম।

তরীর মামার বাড়িটা অভিজাত এলাকায় অবস্থিত। প্রায় সবারই গাড়ি-টাড়ি আছে। রিকশা তেমন আসে না এখানে। রোজ তরীকে এলাকার মোড়ে এসে রিকশা নিতে হয়। আজ মাহাদই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। তরীর সাথে মাহাদের সচরাচর সকালবেলা দেখা হয়না। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাঘুরির পর মাহাদ রাতে ঘুমাতে যায় দেড়িতে। সেই হিসেবে ঘুম থেকে উঠেও দেড়িতে।
তরী একটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখলো, জ্বরে শুকিয়ে গেছে মাহাদের মুখশ্রী। এলোমেলো, উষ্কখুষ্ক চুল। হয়তো চিরুনির ছোঁয়া লাগায়নি। নেত্রজোড়া টকটকে লাল। তাকিয়ে থাকতে পারছে না। বারবার পলক ঝাপটাচ্ছে। সিগারেটে পুড়ে যাওয়া শুষ্ক বেগুনি অধরের প্রায় জায়গায় চামড়া উঠে গেছে। অল্প ফর্সা গায়ের রঙ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। তাকে দেখে কেমন করে যেন হাসলো লোকটা। বাইকে উঠে বসলো। গমগমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আজকেও কি আমার বাইকে উঠবে না?”

তরী উত্তর দিলো না। কিছু পলক চেয়েই রইলো। তারপর কি ভেবে আস্তে আস্তে এগিয়ে বাইকের পেছনে বসলো। হাসলো মাহাদ। নিঃশব্দ হাসি। বাইক স্টার্ট করার মাঝে তরীই প্রথমে কথা বললো, “জ্বর কমেছে আপনার?”
—“হু।”
—“সকালে খেয়েছেন কিছু?”
—“ডারাজে বউ অর্ডার করেছি। হোম ডেলিভারি আসতে বারোটার বাজবে। তখন বউকে বলবো নাস্তা বানাতে। তারপর খাবো।”
আবারও ত্যাড়া কথা! তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জিজ্ঞেস করলো, “কাজের আন্টি আসবে আজকে?”
—“জানি না।”

তরী আর কথা বাড়ালো না। মাহাদ তাকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিলে ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা নিয়ে বললো, “এখানে কিছু খাবার আছে। খেয়ে নেবেন। নিন।”
মাহাদ নিলো না বক্সটা। পালটা প্রশ্ন করলো, “তুমি খেয়েছো?”
তরী চোখ পিটপিট করলো। সে মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত না। মিথ্যা বললে যেকেউ বুঝে যায়, সে মিথ্যা বলছে। তবুও চেষ্টা করে দেখলো, “হ-হ্যাঁ। সকালে খেয়ে বের হয়েছি।”

প্রতিউত্তরে মুচকি হাসলো মাহাদ। বাইক স্টার্ট করতে করতে বললো, “তুমি সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারো না তরী। আমার থেকে শেখো, আমি অনেক সুন্দর মিথ্যা বলতে পারি।”
তরী শুনলো না যেন। গলার জোড় বাড়ালো,
—“আপনি বক্সটা নিন। আমি ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেব।”

উত্তরে এবার মাহাদ ভীষণ চুপচাপ। নিষ্প্রভ চোখে তরীর দিকে তাকিয়ে রইল অনেক্ষণ, অনেকটা সময় নিয়ে। ঠোঁট নাড়িয়ে কি যেন বললোও সে। তরী শুনতে পায়নি কিছু। একটা হাহাকারও না।

____________

বিকালে মাহাদ আর বাইক আনলো না। প্রচন্ড দূর্বলতায় বাইক চালানোটা কুলাতে পারবে না। অথচ তরীর সামনে কত স্থির হয়েই না বসে আছে। যেন সে একদম সুস্থ। আচ্ছা, মাহাদ কি তরীকে বোকা ভাবে? তরী কিন্তু অতটা বোকা না। সে অনেক কিছুই বুঝে। মাঝে মাঝে কিছু জিনিস বুঝেও না বোঝার মতো করে থাকে। সব কিছু আসলে বুঝতে নেই।

মোড়ের দোকানে ঝগড়া বেঁধেছে। মারাত্বক ঝগড়া। একটা বুড়ো লোককে অল্প বয়সী কিছু ছেলে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। ক চিল্লাচিল্লি! ঝগড়া দেখার জন্য যাত্রী থেকে শুরু করে আশেপাশের অনেকেই রাস্তায় ভীড় জমিয়ে রেখেছে। সামনে এগোনো যাচ্ছে না। মাহাদ আর তরীর রিকশাটাও সেই রাস্তায় এসে থামলো। তরী খেয়াল করলো, তীক্ষ্ণ চোখে মাহাদ ঝগড়ার স্থানেই চেয়ে আছে। চোখ-মুখ কি নিদারুণ কঠিন! ভীতু তরী আগেভাগেই মানা করতে চাইলো, “মাহাদ—”
এবং সাথে সাথেই তাকে থামিয়ে দিলো মাহাদ। বললো,
—“তুমি রিকশাতেই বসে থাকো। আমি দেখছি কি হয়েছে।”

মাহাদ রিকশা থেকে নামতে চাইলেই তার হাত ধরে ফেললো তরী। প্রায় তৎক্ষনাৎ কেমন কেঁপেও উঠলো। মাহাদ ঠিক নেই। লোকটার সারা শরীর ভীষণ রকমের গরম হয়ে আছে। তরী অনুনয়ের সুরে বললো, “যাবেন না মাহাদ। আপনি অসুস্থ।”
—“ঠিক আছি আমি। তুমি এখানেই বসে থাকো। নড়বে না।”

তরী হাত শক্ত করে ধরে রইলো। মাহাদকে কিছুতেই যেতে দেবে না। মাহাদ অল্প হেসে শুধালো, “তোমাকে আমি প্রথম কোথায় দেখেছিলাম, জানো?”
—“কোথায়?”

আলতো জোড় প্রয়োগে তরীর হাত ছাড়াতে ছাড়াতে মাহাদ উত্তর দিলো, “বকুল গাছের নিচে, তুমি বকুল ফুল কুড়াচ্ছিলে।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here