বকুলতলা
১০.
বাসস্টেন থেকে অনেক দূর মোটরসাইকেলটা রেখে এসেছিল মাহাদ। একটা বড়সড় গাছের নিচে। তরীকে বাসে উঠিয়ে প্রথমে সেখানেই গেল সে। পরে মনে পরলো, মোটরসাইকেলের তেল শেষ হয়ে গেছে সেই সকালেই! পকেটে টাকা নেই। মানিব্যাগটাও নেই। আনতে ভুলে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে মোটরসাইকেল রেখেই হেঁটে হেঁটে বাসায় পৌঁছাতে হয় তাকে। আধঘণ্টার রাস্তা! কম নয় কিন্তু! কড়া রোদে শরীর তখন ঘেমে একাকার। হাঁপিয়ে গিয়ে নিশ্বাসটাও অস্বাভাবিক প্রায়। কোনোমতে টেনেহিঁচড়ে ফ্যানটা চালালো মাহাদ। বিছানায় বসতে না বসতেই ফোনে কল এলো। মাহাদের বাবা রশিদের কল।
মাহাদ প্রথমে কল ধরতে না চাইলেও পরে কি মনে করে ধরলো, “হুম, বলো।”
রশিদ জবাবে তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারলেন না। তার শরীর ইদানিং ভালো যায় না। কিছু বলার আগেই খুকখুক করে কাশি চলে আসে। খুবই বিশ্রী ব্যাপার। এবারও জোড়েসোড়ে কেশে উঠে বললেন, “কেমন আছিস বাবা?”
—“আছি। ওখানে সবাই কেমন আছে?”
রশিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বেশি ভালো না। দোকানে ঝামেলা চলছে। তুই কবে আসবি?”
মাহাদ উত্তরে কিছু বললো না। ফোনের ওপাশ থেকে তার ছোটো বোনের কণ্ঠ ভেসে আসছে। হইহই করে চেঁচাচ্ছে সে। বারবার বলছে, “আব্বা, আমারে ফোনটা দাও। আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলমু। আব্বা, দাও না!”
জবাবে রশিদও বারবার নিচু স্বরে চুপ করতে বলছেন ওকে। সব শুনে মাহাদ বললো, “ফোনটা নূপুরকে দাও আব্বা। কথা বলি।”
রশিদ প্রথমে একটু গাইগুই করলেন। তারপর ফোনটা নূপুরকে দিয়ে দিলেন। আজকের মতো যে ছেলে আর তার সাথে কথা বলবে না, সেটা তিনি ভালো করেই জানেন।
ফোন কানে রেখে নূপুর ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে বললো, “কেমন আছিস ভাইয়া?”
—“ভালো। তুই?”
—“আমিও ভালো আছি। তুই কবে আসবি?”
—“আসবো, তোর বিয়ের সময়।”
নূপুর মুখ বাঁকিয়ে ফেললো। ভীষণ ভাবে নাক কুঁচকে বললো, “আমার বিয়ের এখনো অনেক দেড়ি। তুই বুড়া হয়ে যাচ্ছিস। তোর বিয়ে আগে। বাবা আর চাচা তো তোর জন্যে মেয়েও দেখে ফেলেছে। ওই যে, শবনম চাচীর মেয়ে আছে না? কুহু? সুন্দর করে মেয়েটা যে আমাদের বাসায় আসতো?”
মেয়ের তরতর করে বলা কথাগুলো শুনে মাথায় হাত রশিদের। এ মেয়েটার পেটে কিচ্ছু থাকে না। কতবার বলেছিলেন মাহাদকে যেন আগেই এসব না বলে। কিন্তু এ মেয়ে কি আদৌ সুধরাবার?
মাহাদ কথা বলছে না। নূপুর বার কয়েক হ্যালো, হ্যালো বললো। তবুও ফোনের ওপাশ শব্দহীন, চুপচাপ। পরপরই লাইন কেটে গেল। রশিদ বিরক্ত ভঙ্গিতে মেয়ের থেকে ফোন কেড়ে নিলেন। মাথার একপাশে চড় মেরে বললেন,
—“মাইয়া দেখতে গেছি এ কথা মাহাদরে কইতে গেলি ক্যান? তোরে মানা করছিলাম না?”
চড় মারা জায়গায় হাত বুলিয়ে বোকা হাসলো নূপুর। বললো, “ভুইলা গেছিলাম আব্বা।”
রশিদ সন্তুষ্ট হলেন না। কিচ্ছুক্ষণ রোষপূর্ণ চাহনিতে চেয়ে রইলেন। নূপুরও মুখ লুকিয়ে পালালো যেন। ঠিক পালালো না। সে তো হাঁটতে পারেনা। হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে কোনোমতে আস্তে আস্তে কেটে পরলো।
বাড়ির খোলা বারান্দায় মাহাদের দাদি নূরুন্নেসা বসে ছিলেন। হাতে সুঁই-সুতা। কোলে সুতীর বড়োসড়ো একটা কাথা। দিনের প্রায় অনেকটা সময় তিনি কাথা সেলাই-ই করেন।
কথায় সুঁই গাথতে গাথতে নুরুন্নেসা রশিদকে বললেন, “আমার দাদুভাই কবে আইবো কিছু কইছে?”
—“কইতে আর পারলো কই? তার আগেই তো নূপুর ঝামেলা পাকাই দিলো।”
—“দাদুভাইরে তাড়াতাড়ি আইতে ক। আর না আইলে শহরের কোনো চাকরি-বাকরি করুক। তুইও একটু শক্ত হইয়া কিছু কইছ রশিদ। আর কতো পোলাটায় বাপের টাকায় খাইবো?”
কথাটা যেন রশিদের পছন্দ হলো না। বিরক্ত কণ্ঠস্বরে বললো, “আমার পোলা আমি বুঝমু আম্মা। তুমি এত বেশি কও ক্যান? আমার এত সম্পদ কি আমি রাইখা দেওনের লাইগা বানাইছি?”
বলতে বলতে উঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তিনি। নুরুন্নেসা হাঁক ছাড়লো, “কই যাস রশিদ?”
রশিদ ততক্ষণে বাড়ি পেরিয়ে কাঁচামাটির রাস্তায় চলে এসেছে। মায়ের কথাটা শুনতে পেলেও উত্তর দিতে ইচ্ছে করেনি।
–
প্রণয় তখন মাত্রই বাসায় ফিরেছে। রয়েসয়ে ফ্রেশ হতেও চলে গেছে। যাওয়ার আগে অবশ্য খাবার ঘরে থাকা তরীর সাথেও তার চোখাচোখি হয়েছিল। ক্ষণিকের ঠান্ডা দৃষ্টির বিনিময়। তরীর যেন অস্বস্তিতে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। সে দ্বিতীয়বার আর এই অস্বস্তিকর দৃষ্টির সম্মুখীন হতে চায় না। তাই যত দ্রুত সম্ভব হাত চালিয়ে কাজগুলো শেষ করতে চাইছে। হঠাৎ প্লেটগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে রাখতে রাখতে সালেহা তরীর দিকে তাকালো। পরপরই কেনন আর্তনাদ দিয়ে উঠলো,
—“আপা? তোমার কাঁধে এইডা কিসের দাগ?”
তরীর পরনের জামাটার গলা বেশ বড়। ওড়না দিয়ে কোনোমতে গলার দিকটা পেঁচিয়ে রেখেছিল সে। কখন যে ওড়না সরে গেল!
তরী দ্রুত ওড়না ঠিক করলো। মৃদু স্বরে মিথ্যা বলতে চাইলো, “কি– কিছু না।”
সালেহা ভ্রু কুঁচকালো বাজে ভাবে। সহজেই মিথ্যেটা ধরে ফেলে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি কইরা কও আপা। কি হইছে? দুক্কু পাইছো কেমনে?”
তরী কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে ধমক দিলো, “বললাম তো কিছু না! এত বেশি প্রশ্ন করো কেন সালেহা?”
তরীর ধমকে একটুও মন খারাপ করলো না সালেহা। বরং দাঁত বের করে হাসলো। সে জানে, তরীর হয়তো মন খারাপ। নয়তো সালেহাকে কখনোই বকতো না।
প্রণয় খাবার ঘরে এসেই চেয়ারে বসে পরলো। তরীর দিকে আবারও সেই অস্বস্তিকর দৃষ্টি ফেলে শুধালো, “খাবারে কি কি আছে?”
—“মাংস, ভর্তা, লালশাক।”
—“কিসের ভর্তা?”
—“কাঁঠাল, শুটকি।”
প্রণয় একটু ভেবে বললো, “মাংস খাবো না। ভর্তা আর লালশাক দাও।”
প্রণয় সবসময় নিজেই বেড়ে খায়। অথচ আজ বেড়ে দিতে বলছে কেন কে জানে! সালেহাটাও পাশে নেই। প্রণয়ও খাবার বেড়ে দেওয়ার আশায় বসে আছে। তাই বাধ্য হয়ে তরীই খাবার বেড়ে দিতে লাগলো। সেসময় প্রণয় খুব আস্তে করে প্রশ্ন করলো, “দাগটা কি অর্ণবের দেওয়া তরী?”
তরী চমকালো খুব। চট করে একবার দেখে নিলো গলার কাছটা। নাহ্! সব তো ঠিকই আছে। বিস্মিত নেত্রজোড়া প্রণয়ের দিকে স্থির হতেই সে মুচকি হেসে আবার বললো, “আপনার বাবা-মাকে আমার একটুও পছন্দ না জানেন? এত স্বার্থপর মানুষ হয়?”
নিমিষেই চোখমুখ কঠিন করে তরী বললো, “আমার বাবা মা স্বার্থপর হলে আপনারা কি? ভালো মানুষ তো নিশ্চয়ই নন। আমার খারাপ সময়ে আপনার কখনো আমার ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতে এসেছেন? অথচ সময়ে সময়ে খোঁচা দিতে ঠিকই ভুলেন না!”
প্রণয় লহু হাসির রেশ নিয়েই বললো, “এটা তো আপনার খারাপ সময়ই তরী। আমরা কি আপনাকে আপনার খারাপ সময়ে এখানে থাকতে দিচ্ছি না?”
অপমানটা তীব্রভাবে গায়ে লাগলো। তরীর ফ্যাকাসে মুখশ্রী আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সেখানে আর দাঁড়ালো না সে। হনহনিয়ে ঘরে চলে গেল।
তরীর ঘরে কোনো ধরণের ঘড়ি নেই। সময় দেখতে হলে তাকে মোবাইলের স্ক্রীনের দিকেই তাকাতে হয়। কিন্তু মোবাইলটা বিছানায় পাচ্ছে না। বালিশের নিচে, টেবিলের ওপর, কোথাও নেই। ব্যাগ থেকে কি সে বের করেনি? মেঝের একপাশে রাখা মাঝারি ব্যাগটা হাতে নিলো সে। অনেককিছু ব্যাগটায়। ঘাটাঘাটি করার সময় একটা গোলাপ আর তার সাথে কস্টেপ দিয়ে লাগানো একটা চিরকুট পেল। গোলাপটার অনেকাংশ শুকিয়ে গেছে। গুটিকয়েক পাঁপড়িও ঝড়ে গেছে। তরী চিরকুট-টা কস্টেপ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। সাদা রঙের ছোটোখাটো কাগজ। একভাঁজ দেওয়া। ভাঁজের আড়ালে আঁকাবাঁকা কতগুলো লেখা। ১,২,৩ করে অনেকগুলো পয়েন্ট। তরী পরে দেখলো। বোঝা গেল, মাহাদের চিরকুট এটা। সে মিথ্যা বলার অনেকগুলো টিপস দিয়েছে। মিথ্যা বলার সময় এটা করা যাবে না, ওটা করতে হবে। পড়তে পড়তে তরী হেসে ফেললো। ম্লান অথচ অকৃত্রিম হাসি।
চিরকুট আর গোলাপ ফুলটি ব্যাগে রাখতে রাখতে তরী বিড়বিড়ালো, “আপনি আমাকে এত জ্বালান কেন মাহাদ?”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
বানান ভুল থাকতে পারে। পরে ঠিক করে দিবো ইনশাল্লাহ।