বকুলতলা
২৮.
মাহাদের সাথে কাটানো পরের মুহুর্তগুলো বিষাদ হয়ে উড়ে গেল। দুজনের কেউই বাঁধা দিলো না। উড়ছে যখন উড়ুক। উড়ে চলে যাক। কিছু অভিমান রয়ে গেলেও কিছু বিষাদ উড়ে যেতে হয়। কেননা অভিমান গুলো আপনাকে কাছে আসতে শিখাবে। নয়তো এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিবে। কিংবা অভিমানের রেশ ধরে হলেও আপনি তাকে মনে রাখবেন। কিন্তু বিষাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উলটো হয়ে যায়। তাকে মনে করে কষ্ট পাবেন বলে সেই মানুষটাকে আপনি মনেই করতে চাইবেন না। তারপর একদিন এমন ভাবে স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে যাবে যে, তখন ধ্যান, জ্ঞান আপনার কাছে থেকেও নেই।
হাঁটতে হাঁটতে তরীকে তার এলাকা অব্দি পৌঁছে দেয় মাহাদ। অতটুকু সময়ে লোকটা চুপচাপই ছিল। কথা বলেনি। তাকায়নি। হাতটা শক্ত করে ধরেছিল শুধু। এলাকার কাছাকাছি পৌঁছাতেই হাত ছেড়ে দিলো। শান্ত গলায় শুধালো, “মন ভালো হয়েছে?”
বাজে প্রশ্ন। ভিত্তিহীন প্রশ্ন। মন ভালো হবে কিভাবে? মাহাদ কি সুযোগ দিয়েছে মন ভালো করার? উলটো আরও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তরীর ইচ্ছে করছে, এক্ষুণি গ্রামে চলে যেতে। এই শহরের বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া খুব কঠিন। শহরটা বড্ড অচেনা তার জন্য। অচেনা এখানকার মানুষগুলো, অলিগলিতে হওয়া অচেনা ভয়ে আঁতকে উঠা ক্ষণগুলো। শুধু চেনাজানা আছে ওই দুটোমাত্র চরিত্রের সাথে। যারা তার জীবনে এসে তার এলোমেলো ভাবনাকে আরও এলোমেলো করে দিয়েছে। চরিত্র দুটো কিন্তু পুরুষ। নাম কিন্তু মাহাদ আর প্রণয়।
তরীর উত্তরের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো মাহাদ। উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো, “হয়নি ভালো?”
—“না।”
—“কেন হয়নি?”
জবাবে এবারও নিশ্চুপ সে। মাহাদ একটু করে এগোলো। এক কদম। তরীর গালের শুকিয়ে যাওয়া পানিকণার দাগে আলতো করে হাত বুলালো। বললো, “তুমি শুধু একবার বলে দাও তরী, আমার উপস্থিতি, কাছে আসা তোমার ভালো লাগে না। কথা দিচ্ছি, আর তোমার মুখোমুখি হবো না। কিন্তু খবরদার! মিথ্যে বলবে না। আমি কিন্তু বুঝে যাবো।”
তরী শুনলো। শুনলোই শুধু। কিছু না বলে হেঁটে চলে এলো বাড়িতে। তার এখন আর কান্না আসছে না। অথচ বুকটা ভীষণ কাঁন্নায় হাঁসফাঁস করছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানির জন্য আর্তনাদ করছে। মাহাদটা এত অবুজ! তরীর নিষ্ঠুর হৃদয়কে গলানোর আপ্রাণ চেষ্টায় মজে থাকে সারাদিন। কিন্তু তরী তো স্বার্থপর না। তার মতো শত দাগ লাগানো মেয়েটা কিভাবে দাগহীন ছেলেটার সাথে জড়িয়ে যাবে?
তরী সেই যে ঘরে ঢুকেছে, আর বের হয়নি। দুপুরের পর পানি ছাড়া পেটেও কিছু যায়নি। সালেহা অবশ্য দুতিনবার খেতে ডেকেছিল। তরী একবাক্যে খাবে না জানিয়েছে। মাঝরাতে আবার দরজার ওপাশে প্রণয়ের কণ্ঠও শুনতে পাওয়া গিয়েছিল। ক্ষীণ স্বরে খাওয়ার জন্য ডাকছিল লোকটা। তরী তখন বিছানায় অন্যমনস্ক হয়ে শুয়ে আছে। সিলিংয়ের দিকে নিশ্চল চোখজোড়া ভ’য়া’বহ ভাবে স্থির। ন’টার দিকে বরকত সাহেব কল করেছিলেন। তরীর বড় বোন বাঁধনকে নাকি ওর শ্বশুড়বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কারণ বলতে এটুকুই, বাঁধন চতুর্থবারের মতো মৃ’ত সন্তান জন্ম দিয়েছে। এখন এই অ’লক্ষী মেয়েকে বাঁধনের স্বামী, শ্বাশুড়ি কেউই রাখতে চাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে বরকত সাহেব বিকালবেলা মেয়েকে নিয়ে এসেছেন।
সব শুনে তরী একটা বড়োসড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পীড়াদায়ক দীর্ঘ নিশ্বাস। কেন যেন মনে হতে লাগলো, সবকিছুর মূল সমস্যা আসলে সে-ই। তার সঙ্গে জড়িত একটা মানুষও ভালো নেই। সবাই কষ্টে আছে। ধুঁকে ধুঁকে শেষ হচ্ছে।
–
অর্ণব বাচ্চাদের অত পছন্দ করতো না। বলা চলে দেখতেই পারতো না। যখন জানলো তার নিজের স্ত্রীই অন্তঃসত্ত্বা, তখন মেজাজ দারুণ তেঁতে উঠলো তার। তরীর হাতে কয়েকটা ঔষধ ধরিয়ে দিয়ে বললো, “এটা খেয়ে নাও। আমি এখনই বাচ্চা চাইনা। আশা করি আমার মতের বিরুদ্ধে যাবে না তুমি।”
তরী তখন অন্য খেয়ালে বসবাস করছে। তার ছোট্ট পেটে ছোট্ট একটা মানুষ বেড়ে উঠছে। যার ছোট ছোট হাত থাকবে। পা থাকবে। এট্টুক একটা মুখ থাকবে। আধো আধো বুলিতে তরীকে মা বলে ডাকবে সে। কথাগুলো ভাবলেই তরীর শরীরে শিহরণ জাগে। মনে হয়, অর্ণব যা খুশি করুক। তার কিচ্ছু যায় আসে না। এই ছোট্ট আদুরে সোনাটা তার হলেই চলবে। কিন্তু অর্ণব সেখানেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। পড়ালেখাটাও ততদিনে বন্ধ করে দিয়েছে। বাসা থেকে বের হওয়ার কোনো মাধ্যম অবশিষ্ট নেই। তরীর নিজেকে মানসিক রোগী মনে হচ্ছিল। সে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না নিজ সন্তানকে মে’রে ফেলতে। অর্ণব প্রথমে ধৈর্য ধরে বোঝাতে লাগলো। নিজের রূপ পালটে ফেললো একদম। তরীকে ভীষণ কৃত্রিম ভালোবাসা দেখিয়ে রাজী করাতে চাইলো। কিন্তু তরী তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অটল! ততদিনে অবশ্য সে অর্ণবকে চিনে ফেলেছে। এ যে অর্ণবের কেমন ভালোবাসা, সেটাও অজানা নয়।
সেদিন বুধবার ছিল। তরীর স্পষ্ট মনে আছে। সন্ধ্যার দিকে সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে মাত্র ঘরে ঢুকেছে সে। ফুলস্প্রিডে ফ্যান চালিয়ে সোফায় বসেছে। ওমনি কোত্থেকে অর্ণব দৌড়ে এলো। নে’শা করে শরীরের তাল নেই। হেলছে, দুলছে। কিন্তু চোখ মুখ ভীষণ শক্ত। রাগে ভরপুর। টেবিল থেকে গর্ভপাতের ঔষধগুলো হাতে নিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, “তুই এইগুলা খাবি না?”
অর্ণবের আচরণ দেখে তরী ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল। হাত-পা কাঁপছিল আগাম আত’ঙ্কের কথা ভেবে। তবুও থেকে থেকে উত্তর দিয়েছিল, “নাহ্।”
জেদ যেন তক্ষুণি অর্ণবের মাথা চড়া দিয়ে উঠে। ভ’য়ংকর ক্রোধের সঙ্গে ঔষধের পাতা থেকে তিন, চারটা ঔষধ নিয়ে তরীর মুখে ঢুকিয়ে রুঢ় ভাবে মুখ চেপে ধরলো। তরীর শরীরের ওপর প্রায় উঠে বসেছিল অর্ণব। মুখ এমন ভাবে চেপে ধরেছিল যে, তরীর মনে হচ্ছিল গালে আঙুল ডেবে যাচ্ছে। মুখের ভেতরটায় ক্ষীণ নোনতা স্বাদও পাচ্ছিল। বোধহয় দাঁতের সাথে লেগে গালের ভেতরের চামড়া কেটে গেছে। অর্ণবের কিন্তু সেসবে বিন্দু মাত্র পাত্তা নেই। সে তার মতো চেঁচাচ্ছে ঔষধ গিলে ফেলার জন্য। পানি ছাড়া কি ঔষধ আদৌ গেলা যায়? কিন্তু তরী গিলে ফেলেছিল। নোনতা র’ক্ত, থুথু একাকার হয়ে একটা ঔষধ গলা চেপে একটু একটু করে নামছিল। সেটাও অর্ণবের ভালো লাগছিল না। অনবরত বিশ্রী বিশ্রী গা’লি দিচ্ছিল তরীকে। একসময় ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। তরীকে অসহ্য লাগছিল তার। মেয়েটাকে যতবার দেখছে, ততবারই মা’রার জন্য হাত,পা নিশপিশ করছিল। শেষে পা দিয়ে তরীর পেটে লাগাতার কয়েকবার আ’ঘা’ত করলো সে। তরীর সব যেন অন্ধকার হয়ে আসলো নিমিষেই। চোখ উলটে গেছে। ঝাপসা সব। মুখে থেকে রয়ে যাওয়া ঔষধগুলো বেরিয়ে এসেছে। যন্ত্রণাগুলো সহ্য করতে পারছিল না তরী। ঝড়ে যাচ্ছিল দমকা বাতাসে বকুলফুলের মতো।
তরীর শ্বাশুড়ির নাম ছিল উম্মে নাহার। মহিলার নাম যতটা স্নিগ্ধ, মহিলা ততটাই কর্কশ, বদমেজাজি। তরীর সাথে কখনো কথা না বললেও তিনিও কিন্তু কম অত্যা’চার করেন নি। নিরবে যু’দ্ধ চালাতেন তরীর সঙ্গে। তরী প্রেগন্যান্ট জেনেও কাজের বেলায় একচুলও ছাড় দেননি। কিন্তু সেদিন ছেলের এহেন আগ্রাসী কান্ডে কিভাবে যেন তার মনে একটু হলেও মায়া জাগলো। বরকত সাহেবকে ফোন করে তরীর অবস্থা জানালেন। বরকত সাহেব তৎক্ষণাৎই বেরিয়ে পরেছিলেন মেয়ের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ততক্ষণে দেড়ি হয়ে গেছে। ঘরের সাদা ঝকঝকে টাইলসের মেঝেটা র’ক্তে রঞ্জিত হয়ে শুকিয়ে গেছে বহু আগে। আশেপাশে কোথাও অর্ণব নেই। সে অনেক আগেই চলে গেছে। বরকত সাহেব একা একাই মেয়েকে কোলে তুলে হাসপাতালে রওনা হলেন। তরী বেঁচে গেলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না। তরী হারালো ওর মা হওয়ার ক্ষমতা।
মেয়ের এরূপ অবস্থা তরীর মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। নিজেকে দোষী করছিলেন বারবার। তার জন্যই তো তার মেয়ের এ অবস্থা! তিনিই তো মেয়েকে ওই ন’রপ’শুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে অর্ণব নামক বিষ অজান্তেই তাকেও খেয়ে ফেললো। ওইযে উঠোনের বকুলগাছটা? ওখানেই তরীর মাকে কবর দেওয়া হয়েছে। প্রিয় বকুলতলার ছায়াতলে। ভয়ে এজন্য তরী সেখানে এখন আর যায় না। বকুলগাছের নিচে একটু আরাম করে বসে না। মনে হয়– মনে হয় মা যেন ওকে ডাকছে। চিৎকার করা কান্নায় ভারী করে দিচ্ছে আশপাশ। যেন জড়িয়ে ধরতে চাইছে ওকে। ক্ষমা চাইছে। তরীর এত ভয় হয়! এত এত ভয় ও কখনো পায়নি। কখনো না।
মায়ের মা’রা যাওয়ার, বাচ্চা হারানোর বেশিদিন হয়নি তখনো। অর্ণব এরমধ্যেই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। তরী যদিও খুশি হয়েছিল। কিন্তু একটা বিষয় ও তখনো বুঝতে পারেনি। ছেলেটা তো ওকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। তাহলে তার সাথে এমন করলো কেন? পরে জানা গেল, অর্ণব আসলে তরীকে কখনো পছন্দই করতো না। কলেজে প্রথম দেখা, পছন্দ করা এসবই বানোয়াট। তরীকে অর্ণব বিয়ের আগে কখনোই দেখেনি। বরং নিজের ছেলের বউ হিসেবে মাতব্বরই তরীকে পছন্দ করে এনেছিলেন। মাতব্বরের কথাতেই তরী, তরীর পরিবার, সবার সাথে এতকাল ভালো মানুষী করে গেছে অর্ণব। মাতব্বর মা’রা যেতেই ভেতরকার ঘৃণা উপচে আসলো। তরী তো ধ’র্ষিতা। ধ’র্ষিতা মেয়েদের এমন মানসম্মানী লোকেরা বিয়ে করে না। ভালোবাসে না। ওদের ওই অপবিত্র গর্ভ থেকে অপবিত্ররাই জন্মায়।
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা