বকুলতলা
৩২.
হাসপাতালের বিছানায় বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে মাহাদের। এত শক্ত! জানালা মাড়িয়ে কোত্থেকে যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ চারিদিকে ঘুরঘুর করছে। মাথার উপর চলতে থাকা ফ্যান বোধহয় ইহজনমে বন্ধ করা হয়নি। সর্বোচ্চ গতিতে চললেও এত গরম! এত ভারী ভাব! অধৈর্য, ক্লান্ত চোখজোড়া আশপাশে ঘুরিয়ে সবকিছু পরখ করে নিলো মাহাদ। আপেলে কামড় দিতে দিতে তরীকেও দেখলো। মেয়েটা সলজ্জ ভঙ্গিমায় বসে আছে আগের মতোই। আড়ষ্টতা যেন নিশ্বাসে নিশ্বাসে বহমান, সুস্পষ্ট। নার্স এসেছেন অল্পক্ষণ হলো। আসার পর থেকেই কেমন আশ্চর্য হয়ে বারবার আড়চোখে দেখছেন তরীকে। তরীর উলটো জামা পরে আসার কারণেই হয়তো। যা মেয়েটাকে লজ্জায়, অস্বস্তিতে দারুণ ভাবে জড়োসড়ো করে দিচ্ছে।
মাহাদ ভ্রু, কপালে গুটিকয়েক ভাঁজ ফেলে নার্সটির দিকে তাকালো। ভীষণ বিরক্ত কণ্ঠে শুধালো, “এত কি দেখছেন ওকে? মেয়ে হয়ে মেয়েকে দেখতে লজ্জা লাগে না?”
নার্স থতমত খেলেন। চোখ বড়োসড়ো করে ক্ষীণ তোতলিয়ে বললেন, “মা–মানে?”
—“কাউকে কখনো উলটা জামা পরতে দেখেননি? আশ্চর্য!”
নার্সের হতভম্ব ভাবটা এবার খানিকটা মিইয়ে গেল। বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। তরীর দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে দ্রুত কেটে পরলো সেখান থেকে। এমন অদ্ভুত রোগী সে তার বিশ বছরের কর্মজীবনে কখনো দেখেনি! অনতত তার মনে পরছে না।
নার্স যেতেই তরী কটমট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ওভাবে কথা বললেন কেন নার্সের সাথে?”
—“কিভাবে? ভালো ভাবেই তো কথা বলেছি। উনার মতো তো আর গাঁধার চোখে তাকিয়ে থাকিনি।”
—“আমি গাঁধার মতো কাজ না করলে উনিও গাঁধার মতো তাকাতো না। উনার সাথে এমন করে কথা বলা আপনার একদমই উচিত হয়নি।”
অথচ ত্যাড়া স্বভাবের লোকটা সেকথা মানতেই চাইলো না। তার মতে, সব দোষ নার্সের! এই হাসপাতালের! সবচেয়ে বেশি দোষ তার অফিসের! ঘু’ষখোর অফিস একটা! কি ভ’য়াবহ বিশ্রী হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে তাকে। ফিনাইলের গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। অসহ্য লাগছে। মহা অধৈর্য হয়ে মাহাদ বললো, “ডাক্তারকে ডেকে আনো তো তরী! আমার আর এখানে ভালো লাগছে না। যা যা ফর্মালিটি আছে সেগুলো শেষ করে বাসায় যাবো।”
তরী যেন আঁতকে উঠলো,
—“চলে যাবেন মানে? আপনি অসুস্থ মাহাদ!”
—“অসুস্থ হলে কি হাসপাতালেই থাকতে হবে নাকি? তুমি থাকবা আমার সাথে? যেহেতু না, সেহেতু আমার এখানে থাকার মানেই হয় না। বউ ছাড়া হাসপাতালের পুরুষ রোগীরা কষ্টে কষ্টেই আধম’রা হয়ে যায়। নিশ্বাস নিতে পারে না। অসহায়ের ক্যা’ন্সার হয়ে যায়।”
মাহাদ আশেপাশে থাকলে তরীর হতাশ হতে হতেই সময় কেটে যায়। এখনো তার ব্যতিক্রম নয়। এই যে, মাহাদের বলা এরূপ কথায় হতাশার নিশ্বাসটা একটু শব্দ করেই ফেললো তরী। প্রশ্ন করলো, “আপনার বাবাকে আপনার এই অবস্থার কথা জানিয়েছেন?”
মাহাদের নির্বিকার উত্তর, “নাহ্।”
—“আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে কখন?”
—“সকালে।”
—“এখন বিকাল ৪টা বাজে। এতক্ষণে একটাবার কল দিতে পারেননি?”
—“দিয়ে?”
তরী গলায় জোড় দিয়ে বললো, “এমন করছেন কেন মাহাদ? আপনার বাবা হন তিনি। উনার জানার অধিকার আছে।”
মাহাদ মাথা তুলে তাকালো। চোখেচোখ রাখলো। অস্বাভাবিক ঠান্ডা চাহনি। গম্ভীর স্বরে বললো, “আমার বাবার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না তরী। সে যদি নিজ থেকে ফোন দেয়, তাহলে জানিয়ে দিবো।”
মাহাদের প্রতি তরীর ভালো লাগা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই তরীর হাতটা মাহাদের হাতের মাঝেই আটকে ছিল। এখনও আছে। মাহাদ হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরলো। হলদেটে হাতের পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ানোর অদম্য ইচ্ছে থাকলেও সেটা দামালো রয়েসয়ে। ধীর গলায় শুধালো, “তুমি কি আজ থাকবে না হাসপাতালে?”
—“না। বাসায় বলে আসিনি। বকবে পরে।”
—“কখন যাবে?”
—“একটু পরই।”
মাহাদ তাদের হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ সরাচ্ছে না। স্থির দৃষ্টি। আচমকা হাতের একদম মধ্যিখানে আলতো করে অধর ছোঁয়ালো সে। হাতের পিঠে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে ফেললো। ঢিমে যাওয়া কণ্ঠে বলতে থাকলো, “আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তরী। আমি সত্যি তোমাকে পেয়ে গেছি? তোমার হাত অধিকার নিয়ে ধরতে পারছি? চুমু খেতে পারছি? আমি এতটা আশা করিনি মেয়ে। নিজেকে এত ভাগ্যবান মনে হচ্ছে! এই এক্সিডেন্টটা আরও আগে হলো না কেন? তরী– আমার নিজেকে খুব এলোমেলো লাগছে। চলো না বিয়ে করে ফেলি। কষ্ট দিবো না সত্যি! একটা ছোট্ট কর বানাবো। তোমার আমার। আকাশকে আর ভয় করবো না। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবো, এই মেয়েটা আমার। আমি তাকে জিতে নিয়েছি।”
অন্যান্য রোগীরা চেয়ে আছে ওদের দিকেই। তাদের অবাক দৃষ্টি, কৌতূহল কিছুই এবার আর তরীকে অস্বস্তি, লজ্জায় ফেলতে পারলো না। সে চুপচাপ, নিঃশব্দে দেখে গেল এক পাগল প্রেমিককে। সুখের কান্নায় চোখ নমনীয় হতে চাইলো। তরী দিলো না। কাঁদলো না এক বিন্দুও। সময়ে সময়ে আসা আফসোসটা আবারও হানা দিলো, এই মানুষটা কয়েক বছর আগে এলো না কেন?
–
মাহাদের আর বাসায় যাওয়া হয়নি। হাসপাতাল থেকে কিছুতেই ডিসচার্জ দিবে না কর্তৃপক্ষ। বেশি প্রয়োজন হলে কালকে যেতে দিলেও দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আজকে কোনো ভাবেই সম্ভব না। ডাক্তারের এসব কথা শুনে মুখ বাঁকিয়ে মাহাদ শুধু এটুকুই বলেছিল, “এরা টাকার জন্য এমন করছে। ঠিকাছে, আমি টাকাটা দিয়ে দিবো। তবুও যেতে দিচ্ছে না কেন আমাকে? চারপাশের সব রোগীর বউ, বাচ্চা আছে। আমিই একা বিরহে ভুগছি। আমাকে সিঙ্গেলদের কেবিনে নিয়ে যেতে বলো। আমার এখানে দমবন্ধ হয়ে আসছে।”
অফিস থেকে কিছু কলিগ মাহাদকে দেখতে এসেছিল। তার এহেন কথায় হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে তারা। তরীও হাসে। নিঃশব্দে। মাহাদকে সঙ্গ দিতে এক ঘণ্টা বাড়িয়ে হাসপাতালেও থাকে। কিন্তু এরচেয়ে বেশি সে থাকতে পারবে না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে যেতে হবে।
বাসের পথটুকুতে প্রণয় গুণেগুণে ছয়বার কল দিয়েছে তরীকে। ব্যাগে রিং হতেই তরী ফোন বের করেছে, দেখেছে, এরপর রেখে দিয়েছে। কেন যেন মানুষটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। প্রণয়ের প্রতি এক ভিন্ন, অসহ্যকর ধারণা হয়ে গেছে তার। যা আরও প্রখর হয়েছে বিয়ের কথা শুরু হওয়ার পর থেকেই।
বাড়িতে আসা মাত্রই তরীকে দেখে আয়শা খাতুন তেঁতে উঠলেন যেন। রুক্ষ গলায় এক মুহুর্তও ব্যায় না করে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “এমন পাগলের বেশে কোথায় গিয়েছিলে তুমি? বলে যাওয়ার একটুও প্রয়োজন বোধ করো নি?”
উত্তর দিতে একটু সময় নিলো সে। আচমকা এভাবে হামলে পরায় হতভম্ব হলো ক্ষীণ। বিমূঢ় গলায় জানতে চাইলো, “কি হয়েছে মামী?”
—“আবার জিজ্ঞেস করছো! তোমার মামা তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল, রুমে গিয়ে দেখি তুমি নেই। শুক্রবারে তো তোমার ক্লাসও নেই৷ কোথায় গিয়েছিলে?”
—“একটু কাজ ছিল।”
আয়েশা খাতুন তরীকে আগাগোড়া আরও একবার দেখলেন। কণ্ঠে তেজ ঢেলে বললেন, “কি কাজ? এভাবে পাগলের মতো কোন কাজে গিয়েছিলে তুমি?”
প্রশ্নটা মুখের অদল পালটে দিলো। আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে এলো মুখটা। এমন বিস্ময়কর জেরাগুলো রাগিয়ে তুললো ভীষণ ভাবে। কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো, “আমার কাজ ছিল বলেছিই মামী। আমার ফ্রেন্ড সুমনা রোড এক্সিডেন্ট করেছে। ওকে দেখতেই হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়োয় ভুলে জামা উল্টো পরে চলে গিয়েছি।”
তরী এই প্রথবার আবিষ্কার করলো, সে গুছিয়ে মিথ্যা বলা শিখে গেছে। তার কোনোকালে সুমনা নামের কোনো বান্ধবী ছিল না, নেই। অথচ অকপটে বলা মিথ্যাটা আয়েশা খাতুন ধরতেই পারলেন না। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে, বিশ্বাস করে নিলেন।
—“তোমার মামা এখন বাসায় নেই। রাতে আসবেন। তখন একবার দেখা করে নিও।”
তরী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই কোত্থেকে সাহেলা এসে হাজির হলো তার পাশে। ফিসফিসিয়ে বললো, “কিছু বুঝছো আপা?”
তরী ভ্রু কুঁচকালো। সাহেলার মতো করেই বললো, “কি?”
—“এই শয়’তান ব্যাডি আচমকা তুমার পতি এত দরদ দেহাইতেছে ক্যান বুঝো নাই?”
তরী মাথা দুলালো। সে বুঝেনি।
—“তুমার লগে প্রণয় ভাইজানের বিয়া হইবো না? এহন থেইকাই তুমারে নিজের হাতের মুডায় রাখতে চাইতেছে। ব্যাডির মাথায় মেলা মিচকা শয়তা’নি আছে। সাবদানে থাইকো।”
শুনে তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বিয়েটা হবে না। হতে দেওয়া যাবে না। আস্তে করে বললো, “তুমি এখন কোথায় যাচ্ছো?”
—“তুমারে কথাডা কইবার লাইগাই আইছিলাম। কওয়া শেষ! আমিও এহন যাইগা। চুলায় ভাত বহাইছি।”
–
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গায়ের জামাটা পালটে একটা সুতীর জামা পরেছে তরী। খুলে রাখা জামাটা কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখেছেও। শুধুমাত্র এই জামাটার জন্য কি বিশ্রীরকম পরিস্থিতে পরতে হয়েছে আজ! তখন যতটা না লজ্জা লেগেছিল, এখন অতীত ভেবে আরও লজ্জা লাগছে। উফ! আশেপাশের মানুষ, মাহাদ, নার্স এরা সবাই কি না কি ভেবেছে তাকে! আয়েশা খাতুনের ভাষ্যমতে নিশ্চই পাগল?
বিছানার কাছ থেকে ফোনটা হাতে নিলো তরী। মাহাদকে একবার কল করে দেখবে কি? কল করার জন্য ফোনের লক খুললেও কলটা আর করা হলো না। ঘরের দরজা ভেড়ানো ছিল। হঠাৎ দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো প্রণয়। লোকটা কি একটু হাঁপাচ্ছে? অনেক অনেক জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ফেলছে, নিচ্ছে। যেন অনেক দূর পর্যন্ত দৌঁড়ে এসেছে সে। গায়ের জামাকাপড়গুলোও এলোমেলো। মুখটা শুকিয়ে আছে। তরী চোখ বড় বড় করে উদগ্রীব কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “আপনি এখানে কি করছেন?”
প্রণয় সেকথার জবাব দিলো না। নিশ্বাস নিতে নিতে বললো, “ফোন ধরোনি কেন তরী? কতগুলো কল দিয়েছি। কোথায় ছিলে এতক্ষণ? মা বললো তোমাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।”
—“পাওয়া না গেলে কি আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম?”
প্রণয় এতক্ষণ পায়ের হাঁটুতে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঝুঁকে ছিল ক্ষীণ। এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অবুজের মতো ডানে বামে মাথা নাড়ালো একবার। অর্থ্যাৎ, পাওয়া না গেলে সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতো না।
তরী আবার বললো, “যখন তখন আমাকে ফোন দেবেন না। ফোনই দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি আপনার সাথে কথা বলতে পছন্দ করিনা।”
কেন যেন এ কথাটার পিঠে প্রণয় কিছু বললো না। কেমন করে যেন তাকিয়ে রইলো। নির্মল দৃষ্টি।
—“আপনি এক্ষুণি মামাকে গিয়ে বলুন, আপনি বিয়েটা করছেন না।”
—“দুঃখীত তরী। আমি বলতে পারবো না।”
—“আপনি বুঝতে পারছেন না আপনার সঙ্গ আমার পছন্দ না? জোড় করছেন আমাকে?”
—“একটু একটু করছি। এতকাল জোড় করিনি বলেই তুমি আমার হও নি।”
রাগে শরীর জ্বলে উঠলো তরীর। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “আমি একজনকে পছন্দ করি। সেও করে। বিয়ে করলে আমি তাকেই করবো।”
প্রণয় কি একটু হাসলো? বোঝা গেল না।
—“কার কথা বলছো? মাহাদ?”
—“হ্যাঁ।”
—“পছন্দ আর ভালোবাসায় তফাত আছে।”
তরীর জোড় গলা, “সে আমাকে অনেক ভালোবাসে।”
প্রণয়ের ভেতরটা যেন জ্বলে গেল। কান্নারা দলা পাকালো। সে কারো সামনে কাঁদে না। আজ তরীর সামনে কাঁদলে কি মেয়েটা রাগ করবে? আটকে আসা কণ্ঠে ভীষণ আকুতি নিয়ে প্রণয় বললো, “আমার দিকে একটু তাকাও তরী। আমাকে ভালোবাসতে হবে না, পছন্দও করতে হবে। শুধু সাথে থাকো। ওই ছেলেটা অনেক তরী পাবে। আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই।”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা