বকুলতলা
৩৫.
চারিদিক থেকে কোলাহল এসে হইচই শুরু করে দিয়েছে। রিকশার তীব্র টুংটাং শব্দ কানে হা’র্তাল জারি করছে যেন! বিস্তৃত মাঠটা আজ ফাঁকা। সেদিনের তাগড়া ছেলেগুলো নেই। মাঠের সবুজ দূর্বাঘাসগুলো শুকিয়ে চুপসে গেছে। তাজা, সতেজ ভাবটা নেই। নির্মল বাতাসের ঝাপটা ছুঁয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। তরী আরেকটু ঠিক হয়ে বসলো। মাহাদ আগের মতোই তার কাঁধে মাথা হেলিয়ে বসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ। নড়ছে না। নিশ্বাস ক্ষীণ ভারী। লোকটা কি ঘুমিয়ে গেছে? তরী হালকা করে ডাকলো, “মাহাদ? ঘুমিয়ে গেছেন?”
মাহাদের উত্তর পাওয়া গেল না। তারা একটা বড়োসড়ো গাছের নিচে বসে আছে। গাছের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে, ছায়ায়। এখান থেকে ম্যানরোড দেখা যায়। কিছু কপোত-কপোতীকেও দেখা যাচ্ছে। হাতে হাত ধরে ফুটপাতে হাঁটছে তারা। হাতে হয়তো লাল কতগুলো ফুল, নয়তো বাদামের থলে। কোনো একটা বিষয়ে কথা বলতে বলতে সশব্দে হেসে উঠছে তারা। তরী কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো সেসব। হালকা নিশ্বাস ফেলে আবারও মাহাদকে ডাকতে লাগলো, “মাহাদ? উঠুন! এটা কোনো ঘুমানোর জায়গা হলো? দেড়ি হয়ে গেছে। বাসায় যাবেন না? মাহাদ?”
মাহাদ নড়লো না তবুও। তরীর আঙুলগুলো আরও শক্ত করে আগলে ধরলো। আস্তে করে বললো, “ঘুমাই নি।”
—“তাহলে? এতক্ষণ ঘুমের ভাণ করে ছিলেন?”
তার নির্লিপ্ত উত্তর, “নাহ্। ভালো লাগছিল। তাই চুপ করে ছিলাম।”
তরী ব্যাগের ভেতর থেকে ফোন বের করে সময় দেখে নিলো। বিকাল শেষে সন্ধ্যা হচ্ছে। এখান থেকে বাসায় যেতে লাগবে সর্বনিম্ন বিশ মিনিট, আধঘণ্টা। কিংবা তারচেয়েও বেশি। এমনিতেও রফিক সাহেব তার ওপর রেগে আছেন। উনার ধারণা তরীই কিছু করেছে এ বিয়ে নিয়ে। আবার আজকে কাজেও যাননি তিনি। সারাদিন বাসাতেই ছিলেন। কিন্তু মাহাদকে রেখে চলে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না। লোকটা দিন দিন এত এত মায়ার অধিকারী হচ্ছে! তরী মনে মনে হতাশ হয়। বাকি জীবনটা সে একা থাকতে চেয়েছিল। চাওয়াটা বোধহয় পূরণ হবে না, হওয়ার নয়।
সময় গড়ালো। রৌদ্রে আচ্ছন্ন আকাশ ক্ষীণ কালো মেঘলাটে রঙে ছেঁয়ে গেল। আচমকা মাহাদ এক উদ্ভট প্রশ্ন করে উঠলো, “তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো না তরী? শুধুই পছন্দ করো?”
কণ্ঠ স্বাভাবিক না। ভীষণ অস্বাভাবিক। ঠান্ডা, নির্লিপ্ত, শীতল কিছু। তরী একটুর জন্য থমকালো। পরক্ষণেই প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললো, “এভাবে বসেছেন কেন? পিঠে ব্যথা পাচ্ছেন না? ঠিক হয়ে বসুন। কোমড় বেঁকে আছে। সেলাই খুলে গেলে?”
অথচ মাহাদ দমলো না। একই প্রশ্ন আবারও শুধালো, “বাসো না?”
পরাজয় মেনে নিলো তরী। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,
—“বুঝতে পারছি না। আমার একটু সময় প্রয়োজন মাহাদ।”
—“আমার কেন যেন মনে হয়, তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসবেনা। না বাসো। কিন্তু আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না তরী।”
বলতে বলতে মাহাদ কেমন উদাস হয়ে উঠলো। তরীর কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। চোখের দৃষ্টি এসে স্থির হলো, মাঠের দূর কোথাও। তরী তার দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক নয়নে। সে না তাকিয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারছে তা। কিন্তু পাশ ফিরে তরীর চোখে চোখ রাখছে না। ভেতরটায় চাপা পরা কিছু সুপ্ত ইচ্ছে, কথা এক এক করে বলতে মন উতলা হয়ে উঠছে। বললোও সে। ধীর-স্থির ভাবে। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে।
—“তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তুমি তোমার বাবাকে কতটুকু ভালোবাসো, তাহলে তুমি কি উত্তর দেবে তরী? অনেক ভালোবাসা, তাই না? কিন্তু আমাকে কেউ এই প্রশ্নটা করলে আমি কিন্তু এভাবে উত্তর দিতে পারিনা। চুপ থাকি। আমার তখন নিজেকে অনেক অসহায় লাগে। এত কিছু করেছে আমার বাবা! আমার বাবার জন্যই আমার মা আমার কাছে নেই! অথচ আমি চাইলেও তাকে ঘৃণা করতে পারিনা। বাড়িতে গেলে যখন সে আহ্লাদ দেখায়, কাছে টানতে চায়– আমি তখন ভেতরে ভেতরে চমকে যাই। অবাক হই। আফসোসে ভেতরটা পু’ড়তে থাকে। তার মুখের দিকে তাকালে কান্না চলে আসে। বাবার আদর কেমন আমি জানি না। ছোটবেলায় কেউ আমাকে বাবার আদরের সাথে পরিচিত করায়নি। বরং অন্যদের দেখে হিংসে করেছি বরাবরই। এখনো করি। এখনো বাবার আদর কেমন জানতে চাই। কিন্তু সে যখন আদর করতে এগিয়ে আসে, রাগে-য’ন্ত্র’ণায় আমার শরীর কাঁপতে শুরু করে। আমি নিজেকে আটকাতে পারিনা। তার সব অন্যায় যেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এ খারাপ লোকটা আমার বাবা হতে পারেনা। তার আদরও খারাপ!
অথচ ভেতরে ভেতরে কিন্তু আমি ঠিকই বাবার আদর পেতে মা’রিয়া হয়ে উঠছি। চারিদিকে মাকে হন্য হয়ে খুঁজছি। কিন্তু প্রতিবারই আমাকে শূণ্য হাতে ফিরতে হচ্ছে। টেনেহিঁচড়ে একা করে দেওয়া হচ্ছে। আমি কেন একটা সুখী পরিবার পাইনি? আমি কেন সুখী না?
আমি কিন্তু অনেক হাসাহাসি করি। নিজেকে হাসিখুশি রাখি। অনেক মানুষের সাথে মেলামেশা করেছি। কষ্টগুলো নিজের গায়ে মাখতে চাইনা। কিন্তু রাতের বেলা! তখন কার সাথে হাসবো? মেলামেশা করবো? তখন তো আমার পাশে কেউই থাকে না। কৃত্রিম হেসে নিজেকে সুখী প্রমাণ করার প্রতিযোগিতায় দৌঁড় লাগিয়ে বিজয়ী হবার তাড়াও থাকে না। আমি ঘুমাতে পারিনা জানো? মাঝে মাঝে মাকে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নেও মা আমার জন্য কাঁদে। আমার এত কষ্ট হয়! আমি তোমাকে বলেছিলাম না? আমি কাঁদতে পারিনা? মিথ্যে বলেছিলাম। আমি কান্না করি তরী। বাচ্চাদের মতো চোখের পানি দিয়ে বালিশ ভিঁজিয়ে দেই। কিন্তু আমি ছাড়া সেটা কেউ দেখেনা।”
মাহাদ একটু থামলো। তরীকে একপলক দেখলো মাত্র। মেয়েটা মলিন মুখে চেয়ে আছে। কাঁদছে কি? বোঝা যাচ্ছে না। বরং নিজেই মাহাদের হাতটা প্রথমবারের মতো শক্ত করে ধরেছে। মাহাদ হাসলো নিঃশব্দে। দারুণ হাসি! স্নিগ্ধ। বলতে লাগলো, “আমি তোমাকে এতকিছু কেন বলেছি জানো? এইযে, তোমাকে পেলাম। আমার এখনো বিশ্বাস হয়না। আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। কিছু পাবো বলে আশা রাখতাম খুব কম। সত্যি বলতে, তোমাকে পাবো বলে সেই আশাও রাখিনি। শুধু অপেক্ষা করে যেতাম। তুমি আমার হলে হবে, না হলে ঠিকাছে। কিন্তু এটা চিন্তা করা মাত্রই আমার বুক ভারী হয়ে যেত। মনে হতো, আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। শরীর কাঁপতো। এত বাজে অনুভূতি! ইচ্ছে করতো তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে কোথাও চলে যাই। তুমি না ভালোবাসলে নেই। আমার একার ভালোবাসাই চলবে। কিন্তু পরে মনে হতো, সেই সুখটা তো আমি পাবো না যেটা আমি চেয়েছি। তুমি যদি আমাকে ঘৃণা করো?
আর এখন যখন তোমাকে পেলাম, স্বস্তি পাচ্ছিনা। ক্ষণে ক্ষণে তোমাকে হারানোর ভয়টা জেঁকে বসে। তুমি যদি মিথ্যা হও? আমাকে ছেড়ে চলে যাও?… এই তরী! তোমাকে আমার বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। মানুষকে বুকের ভেতর ঢোকানো যায়না কেন? ভালোবাসার পাশাপাশে তুমিও আমার বুকে থাকতে। যখন ইচ্ছে তোমাকে বের করে দেখতাম, কথা বলতাম। তুমিও আমার ভালোবাসা দেখতে পেতে। এত নি’ষ্ঠুর হতে না।”
মাহাদ উঠে দাঁড়িয়েছে। একা একাই। কোমড়ের ব্যথাটা সে যে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে, তরীকে বুঝতে দিচ্ছে না! তরী জানে, তবুও বুঝে। অন্যসময় হলে হয়তো লোকটা চোখমুখ কুঁচকে আহা’জা’রি করতো, “আমাকে একটু ধরে উঠাও তো তরী! কোমড়ে এত ব্যথা! দাঁড়াতে পারছি না। শক্তি থাকলে এখনই ওই বস্তির মালিককে ধুঁয়েটুয়ে রোদে শুকাতে দিয়ে আসতাম! আহ! এত ব্যথা!”
ভাবনার অকূল পাথারেই মাহাদ আওয়াজ লাগালো, “বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। চলো, চলে যাবো। তুমি তো মনে হয় ছাতা আনোনি, তাই না?”
তরী মাথা নাড়ালো। আনেনি। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে পরনের জামাটাও একবার ঝেড়ে নিলো। বালি, ময়লা লেগে গেছে একদম!
কাছে এসে শুধালো, “এখানে কিন্তু সিএনজি অত পাওয়া যায় না। হাঁটতে হবে। পারবেন?”
মাহাদ তক্ষুণি নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “হাত ধরো।”
তরী ধরলো। আলতো করে। সে আবার বললো, “একসাথে হাঁটবো।”
—“আপনি তো এখনই ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। ব্যথা সহ্য করতে পারবেন? রিকশা ঢেকে আনি? অর্ধেক রাস্তা রিকশা দিয়ে যাবো নাহয়।” তরীর চিন্তিত সুর।
মাহাদ মানলো না। প্রখর দিরুক্তি করলো। জোড় করে হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীর গলায় হু’মকি দিলো, “এ বিষয়ে আর একটা কথা বললে কিন্তু তোমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব তরী। অসুস্থ বলে কি আমার গায়ে শক্তি নেই মনে করেছো? অনেক আছে। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা