#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_৮
নতুন ভাড়া করা বাড়িতে নিশাতের এখন আলাদা ঘর। নিশাত ঘরটা নিজের মতো করে সাজিয়েছে। দেয়ালে আয়না লাগিয়েছে বড়। খাট পেতেছে জানালার পাশে।সারাদিন বিছানায় রোদ লাগে। এখনো পর্দা কেনা হয়নি। কক্সবাজার ঘুরে এসেই নিশাত ভালো এক জোড়া পর্দা কিনবে গাঢ় বেগুনি রঙের। বেগুনি পর্দার ফাঁক গলে বিছানায় রোদ। তবে খাটে বসলেই দেয়ালের বড় আয়নায় মুখ দেখা যায়। নিশাত মাঝে মাঝে বিছানায় বসে আয়নায় তাকিয়ে কথা বলে। এই সময় আয়নার মানুষটা নিশাত থাকে না। আয়নার মানুষটা তখন শাকিব হয়ে যায়। শাকিবের সাথে নিশাতের কথাবার্তা চলে অনেকটা এরকম।
আয়না- এই নিশু, আমাকে একটা গান শোনাও তো। একটানা কাজ করে মাথা ঝিম ধরে গেছে। তোমার গান শুনে ঝিম ছাড়াবো।
নিশাত- গান শুনতে হলে মিউজিক প্লেয়ারে শুনুন। আমাকে বলছেন কেন? আমি তো মিউজিক প্লেয়ার না। আয়না- মিষ্টি গান শুনতে ইচ্ছে করছে না নিশু। হেঁড়ে গলার হাউকাউ গান শুনতে ইচ্ছে করছে। ব্রেইন এলোমেলো তো, হরিবল কিছুতে তাই ফোকাসড হতে চাচ্ছে।
নিশাত- আমি হেঁড়ে গলায় গান করি? হরিবল আমার গান?
আয়না- তুমি এত রাগ করছো কেন? ভালো গান যে আমি শুনতে চাই, তা তো না। তোমার গলায় হরিবল টাইপের গানই তো শুনতে চাই। কণ্ঠ ভালো হলে দেখা যেত তোমার গান শুনতে আমার ইচ্ছে করছে না। তখন তোমার ভালো গান, সুরেলা কণ্ঠ দিয়ে কী লাভটা হতো শুনি? এখন তো তোমার গান আমার জন্য এক ধরনের রিলাক্সিং থেরাপি। হার্শ মিউজিক থেরাপি। নাও গান ধরো।
নিশাত গান ধরে না। অভিমান করে বসে থাকে।
আয়না- আশ্চর্য! দুই ঠোঁট নেড়ে একটু গান গাওয়া, সেটাও পারবে না। ঠিক আছে। আমি ঠোঁটের শাস্তির ব্যবস্থা করছি।
আয়না শাকিব ঠোঁটের কী শাস্তির ব্যবস্থা করবে এটা ভেবেই নিশাত লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তারপর সে আয়না থেকে মুখ সরিয়ে নেয়। নিশাতের আয়নাকথনের এই হলো নমুনা। রাতের আয়নাকথনের সময় নিশাত আরো বেশি লজ্জা পায়। কারণ শাকিব তখন ঠৌঁটের শাস্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অন্য রকম শাস্তি দেয়। যে শাস্তির কথা ভেবে ভেবে নিশাত বারবার আনন্দে শিউরে উঠে। নিশাত ঠিক করে রেখেছে সামনের সপ্তাহেই সে শাকিবদের বাড়ি যাবে। যাবার সময় সে সবার জন্য উপহার কিনে নিয়ে যাবে। উপহার হাতে দিয়ে বলে আসবে, আগামী শুক্রবার দুপুরে আপনারা সবাই আমাদের বাসায় খেতে আসবেন। যদি আমাদের গরীবখানায় আসতে আপনাদের ভালো না লাগে, তাহলেও ব্যবস্থা আছে। আমি নিজের হাতে রান্না করে এখানে খাবার নিয়ে আসবো। নিজে পাত পেড়ে বেড়ে খাওয়াবো। কী কী খাবেন, চট করে একটু বলুন তো! আপনাদের পছন্দমতো আমি রান্না করবো।
বড়লোকদের এই এক ঝামেলা। তারা নিজেদের পছন্দের বাইরে কিছু খেতে পারে না। তাদের সামনে পঞ্চাশ আইটেম দিলেও তারা নিজেদের পছন্দের খাবারটাই বেছে বেছে খাবে। গরীবদের এই ব্যাপার নেই। তাদেরকে যাই খেতে দেওয়া হয়, তারা মনের খুশিতে খায়। পেটে না সহ্য হলেও খায়। গপগপ করে খায়।
আচ্ছা আজ গিয়ে শাকিব স্যারদের বাড়ির সামনে থেকে একবার ঘুরে এলে কী হয়? দু’দিন পর যে বাড়ি তার আপন ঠিকানা হবে, সে বাড়িতে এখন থেকেই যাওয়া আসা রাখা উচিত।
নিশাত বেশ যত্ন করে তৈরি হলো। চোখে মোটা করে কাজল দিলো। ঠোঁটে লিপস্টিক দিলো। কানে ছোট্ট এক জোড়া দুল পরলো। কপালে টিপ দিতে গিয়েও সেটা ব্যাগে নিয়ে নিল। এখন টিপ দিতে লজ্জা লাগছে। টিপটা সে একদম শাকিবদের বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দেবে। বলা তো যায় না, শাকিব স্যারের সাথে কখন দেখা হয়ে যায়! তবে গায়ের কালো জামা সে বদলালো না। মনে মনে বললো, হে কালো জামা আশা করি খুব শীঘ্রই তোমার দিন শেষ হবে। অতঃপর আমার জীবনের রঙিন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে।
নিশাত তৈরি হয়ে বেরোতেই রাবেয়া রেগে গেলেন।
-“এখন কোথায় যাস? তোর না ইউনিভার্সিটি বন্ধ?”
-“কাজ আছে মা। কিছু নোটস ফটোকপি করাতে হবে। আমার ছাত্রীর কাল ক্লাস টেস্ট আছে। ওকে একটু দেখিয়ে দিতে হবে।”
-“কখন ফিরবি?”
-“এখনো বলতে পারছি না। নাও ফিরতে পারি।”
-“নাও ফিরতে পারি, এটা কোন ধরনের কথা।
-“এটা জীবনধর্মী কথা, মা। এই জীবনের কোনো বিশ্বাস নেই। এখন কিছু ঘটলে, তখন আর নেই! হয়তো আমার এই যাওয়াই শেষ যাওয়া হলো অথবা ফিরে এসে দেখলাম তুমি নেই।”
রাবেয়া মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার ইচ্ছে করলো, তিনি উঠে গিয়ে নিশাতকে দুটো চড় দেন। চড় দিয়ে বলেন, মরার কথা বলতে তোর মুখে আটকায় না? তোকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন জানিস? এইসব স্বপ্ন পূরণ না করে মরে যাবার কথা বলছিস?
রাবেয়া মনের ইচ্ছেটা চাপা দিলেন।
-“তাড়াতাড়ি ফিরবি নিশু। তুই এলে আমি বেরোবো। তোর হালিম চাচার শরীর খারাপ। এই নিয়ে দু-বার ফোন করেছেন যাবার জন্য। আমি গেলেই উনি ডাক্তার দেখাতে যাবেন।”
-“আমি চলে আসবো মা।”
নিশাত দাদীর ঘরে উঁকি দিলো।
দাদীমার শাড়ির ভয়াবহ অবস্থা। তিনি অর্ধনগ্ন হয়ে শুয়ে আছেন। শরীরের নিচের অংশ কোনো রকমে ঢাকা। বাকি শাড়িটা মেঝেতে লটকে আছে। নিশাত দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
-“শাড়ি ঠিক করো দাদী। আমি তোমার ঘরে আসবো।”
-“ঘরে আসলে আসবি। শাড়ি ঠিক করতে পারবো না। তোর যা আমারও তা। এইখানে ঢাকাঢাকি নাটকের কী আছে?”
-“ভুল বললে দাদীমা। তোমার যা আমারও তা বলে যে দেখতেই হবে এমনটা কিন্তু নিয়মে নেই। এরকম হলে পৃথিবীর সবাই নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াতো। লজ্জাস্থান এক হলেও লজ্জাবোধ সবার জন্য আলাদা।”
সবুরা বিরক্ত গলায় বললেন,
-“আমার লজ্জা শেষ হইয়া গেছে। জীবন যেমন শেষের দিকে লজ্জাও শেষের দিকে।”
নিশাত কঠিন গলায় বললো,
-“আমার লজ্জা শেষ হয়নি দাদীমা। আমার লজ্জার এখন পূর্ণযৌবন। আমার খাতিরে শাড়ি ঠিক করো।তোমাকে এরকম দেখতে আমার খুব লজ্জা করছে।”
-“পারবো না। শাড়ি পরা ঝামেলা লাগে। যেটুকু পইরা আছি সেটুকুই খুইলা ফেলতে ইচ্ছা করতেছে। শরীরের যন্ত্রণায় বাঁচি না। আবার শাড়ির যন্ত্রণা! এত লজ্জা করলে, লজ্জা নিয়া বিদায় হ। ঘরে আসতে হবে না। আমি নেংটা হইয়া থাকবো।”
নিশাত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো৷ দাদীমা শাড়ি ঠিক করলেন না। যেমন ছিলেন তেমন করেই শুয়ে রইলেন।
নিশাত ঘরে গিয়ে দাদীমাকে তুলে বসালো। শাড়িটা ঠিক করে পরিয়ে দিলো।
-“পরাইয়া লাভ নাই। একটু পর খুইল্লা যাবে। দিনের মধ্যে একশোবার নেংটা হই। একশোবার উদাম হই।
গেঞ্জি প্যান্ট হইলে ভালো ছিল। খোলাখুলির ঝামেলা নাই।”
নিশাত মনে মনে ঠিক করে ফেললো, আজ ফিরবার সময় সে দাদীর জন্য টি-শার্ট আর পায়জামা নিয়ে আসবে।
-“তোর জন্য একটা সুখবর আছে। শীঘ্রই তোর বিয়া হবে৷ আধাবুইড়া এক কালা বান্দরের সাথে। কলা খাওয়া বান্দর না। গু খাওয়া বান্দর! মুখের ভেতরে সবসময় গু। চেহারার কাটিংও গুয়ের মতো প্যাঁচ খাওয়া।”
-“তুমি দেখেছো তাকে?”
-“সরাসরি দেখি নাই। স্বপ্নে দেখেছি। গতরাতে ফজরের নামাজ পইড়া ঘুমাইতে গেছি, দেখি তোর জামাই আসছে। আমার পায়ে ধইরা সালাম কইরা বললো, আমি আপনাদের নিশুর বর। আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কিসের জন্য দোয়া করবো? সে বললো, গু খাওয়ার জন্য দোয়া করবেন৷
জিগাইলাম, এতকিছু থাকতে গু খাবা কেন? বান্দর কয় কী জানোস? কয় গু খাইতে আমার ভালো লাগে তাই খাবো। আমি মুচকি হাসি দিয়া জিগাইলাম, তুমি না হয় গু খাইয়া থাকতে পারবা। আমার নাতনি নিশু কী খাইবো? সে বললো, আমি যা খাই, নিশুও তা খাবে। আমি ছেইড়া গু খাইলে সেও খাইবো। ছেইড়া গু বুঝছস? ডায়রিয়ার গু।”
নিশাত দাদীমায়ের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলো।
-“সালাম করতাছোস কেন? তোর কি পরীক্ষা?”
-“ওমা আমার বর তোমাকে সালাম করবে আর আমি করবো না?”
-“তোর বর কখন সালাম করলো?”
-“এই তো বললে, স্বপ্নে দেখেছো! নাও এখন আমার জন্যও দোয়া করো।”
-“তোর আবার কিসের দোয়ার দরকার?”
-“আমার বরের সাথে আমি যাতে সুন্দর করে সংসার করতে পারি সেইজন্য দোয়া করবে।”
-“গু খাওয়া একটা মানুষ তাও তোর সংসার করার এত ইচ্ছা।”
নিশাত উদাস গলায় বললো,
“রুইয়ের পোনা, ইলিশের পোনা
যার যার স্বামী,
তাঁর তাঁর কাছে খাঁটি সোনা।”
নিশাত দাদীমার দুই হাতে চুমু খেলো আলতো করে। লিপস্টিকের অনেকটাই সবুরার হাতে লেগে গেল। তিনি সেটা নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে নিলেন।
নিশাত হাসলো।
-“লিপস্টিক দেবে? আমার ব্যাগে আছে।”
সবুরা মাথা নাড়লেন।
-“এটা তোমার জন্য দাদী। গ্রহণ করে আমায় বাধিত করো।”
-“এইডা কী?”
নিশাত জবাব দিলো না।
সবুরা প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন।
-“নিশু, তুই কি আমারে অবিশ্বাস করতাছোস? আমি কিন্তু সত্যই তোর একটা গু খাওয়া জামাই দেখছি।”
-“দেখলে দেখেছো। তো?”
-“তোর যে সামনে মহাবিপদের দিন আসতেছে এইডা বুঝতেছোস? তোর জামাই গু খায়, এইডা কত বেইজ্জতি কারবার ধরতে পারছোস?”
নিশাত দাদীমাকে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বললো,
-“আমি যাকে পছন্দ করি সে যে কত ভালো তুমি তা জানো না দাদীমা। জানলে বলতে এই ছেলে দুনিয়ার যা খুশি খাক, তাও তুই কিন্তু এর সাথেই থাকবি। তোর সুখ শুধু এই ছেলের কাছে।”
সবুরা বিড়বিড় করতে থাকলেন, তোরে নিয়া এইডা কী স্বপ্ন দেখলাম! উফ!
নিশাত দাদীমার বিড়বিড় উপেক্ষা করে বেরিয়ে এলো।
দাদীমা উপহারের প্যাকেটটা খুলে কেমন চমকান সেটা সামনে থেকে দেখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সম্ভব নয়! দাদীমা এরপরই একটা বিশাল হট্টগোল শুরু করবেন।
নিশাত ঘড়ি দেখলো, বারোটা একুশ বাজ। সে গলা ঝেড়ে বললো, একটা সুন্দর দিনের সুন্দর দুপুরে তোমায় স্বাগতম নিশাত।
নিশাত রিকশা নিলো। সে এখন পিয়াসাদের বাড়ি যাবে। আজ পিয়াসাকে পুরষ্কৃত করার দিন।
~চলবে~
#তৃধাআনিকা