#নিনীকা
#পর্ব_১৯_ও_২০
#পর্ব_১৯
বিয়ের সাজগোজের পর যখন নিনীকার ক্লাবে যাবার পালা এলো, নিনীকার শরীর স্থির হয়ে এলো। গাড়ির গেটে গিয়ে পা অবশপ্রায়। মাহবুবা একটু জোর করে টানলেনও। নিনীকা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।বিড়বিড় করে বললো,
—-পাপা, আমায় ড্রপ করে দিয়ে আসো না।
পাপা চোখ মুছতে মুছতে হেসে বললেন,
—এ কেমন কথা? সবাই কি ভাববে?
মাহবুবা বললেন,
—প্লিজ, চলো। নিনীকার ভালো লাগবে।
পুরো রাস্তাটায় নিনীকা পাপার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চুপ কেঁদে গেল।
বড়ফুফু একবার শুধু জিজ্ঞেস করলেন,
—এত চুপচাপ যে? কিরে নিনী ভয় লাগছে? জানিস আমার বিয়েতে আমি…
নিনীকা কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললো,
—ঘুম পাচ্ছে আমার ফুফু। প্লিজ কথা বলো না।
ক্লাবগেটে গাড়ি থামবার পরও নিনীকা ঠায় বসে রইলো। মাকে প্রায় ঠেলে নামিয়ে দিতে দিতে বললো,
—তোমরা যাও তো মা। যাস্ট পাঁচমিনিট, আমি পাপার সাথে আসছি।
গাড়ির দরজাটা আটকে দিয়ে নিনীকা ভেজা চোখটা টিস্যুতে মুছতে মুছতে বললো,
—আমায় মিষ্টি দেখাচ্ছে তো পাপা?
নিনীকার ঘোমটাটা আরেকটু টেনে দিয়ে পাপা বললেন,
—শুধু মিষ্টি না মামণি, মনে হচ্ছে ইউ আর দ্য মোস্ট বিউটিফুল এন্ড দ্য হ্যাপিয়েস্ট ব্রাইড ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।
গুড লাক!
নিনীকা পাপার দু-হাত প্রায় চেঁপে ধরে বললো,
—তুমি মাকে সবসময় ভালোবাসবে প্রমিস করো।
সান্ত্বনার গলায় পাপা জবাব দিলেন,
—আচ্ছা প্রমিস!
অসহায় মুখ করে নিনীকা বললো,
—আরেকটু কথা বলো না পাপা। আমি সত্যিই রওনককে ঠিকঠাক ভালোবাসতে পারবো তো? এই নতুন সম্পর্ক আমার ভালো লাগছে না পাপা। বিয়ে কেন করতে হয় বলো তো?
নিনীকার চোখ আবার ছলছল করছে।
আশিকুল সাহেব গভীর মমতায় নিনীকার মাথায় হাত রাখলেন। আদুরে গলায় বললেন,
—জানো মামণি? ছোটবেলায় রক্তে তোমার ভীষন ভয় ছিল। একটা মুরগি জবাই দেখলে তুমি বলতে, মানুষ কি নিষ্ঠুর পাপা! জ্যান্ত একটা প্রাণী কেটে ফেলতে পারে! আমরা ভাবিইনি তুমি ডাক্তারি পড়তে পারবে। অথচ এখন কিন্তু তোমার স্বপ্নই সার্জন হওয়া। জ্যান্ত মানুষ কাটাকুটি। গ্লাভসে রক্ত মাখামাখি করে কাজ! জীবনে যখনি যেটা তোমার সামনে প্রয়োজনীয় ছিল, তা কিন্তু তুমি ভালোবেসে করেছো মামণি।
—পাপা ওটা তো প্রফেশনের খাতিরে ভালোবাসতে হয়েছে।
—তোমায় কে বললো বিয়েটা প্রফেশন নয়?
বিয়ে হলো জীবনের সবথেকে বড় প্রফেশন। এর প্রতি সবসময় তোমাকে সৎ আর দায়িত্বশীল থাকতে হবে।একেও ভালোবেসে চালিয়ে যেতে হবে।
—আমরা কিন্তু প্রফেশনাল কাজে বেতন পাই, পদন্নোতি পাই পাপা। তাহলে?
—বিয়েতেও কিন্তু তেমন মামণি। এ থেকে তুমি জীবনের অনেক কিছুই পাবে। জন্মসূত্রে পাওয়া সম্পর্কগুলোর পর আমাদের জীবনে সবথেকে বড় যে সম্পর্কগুলো আমরা অর্জন করি, তা কিন্তু বিয়ের মধ্য দিয়েই আসে। আর পদোন্নতি বলতে এই যে বউ থেকে মা হবে একদিন, দাদীমা হবে একদিন।
নিনীকা শব্দ করে কেঁদে উঠলো। উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
—আমার এতো বুদ্ধিমান পাপা! আমার এত বুদ্ধিমান পাপা! সবকিছুতে কি যুক্তি!
—তোমার কিন্তু মামণি রওনককে সময় দিতে হবে। যতটা সময় তাঁর দরকার ততটুকুর চাইতেও বেশি।তোমার জন্য যখন তাঁর মাথায় হাত পড়বে, তখনি নিজেকে সমর্পণ করবে।
—আমি সময় দিবো পাপা। অবশ্যই সময় দিবো।
পাপা নিনীকার কপালে চুমু খেয়ে দ্রুত নেমে গেলেন।
নিনীকাকে রিসিভ করতে সবাই গাড়ির দরজায় ভীড় করছে।
গাড়ির দরজাটা খুলে ইলা সাদরে হাতটা বাড়িয়ে দিলো নিনীকার দিকে।
—ওয়েলকাম নিনীকা। কি সুন্দর লাগছে গো তোমাকে!
ইলার হাতটা ধরে নিনীকা নিজেকে সামলে নিয়ে স্মিত হেসে গাড়ি থেকে নামলো। সাথে সাথে জ্বলে উঠলো অসংখ্য ক্যামেরার ফ্লাশ। চেরী রেডের পাড়ের উপর সোনালী কাজের লাল জমিনের বেনারসীতে এক অপূর্ব সুন্দরী বধূ ধীর পায়ে সবুজ গালিচার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাকে সাদরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাঁর হবু বরের একসময়কার ভালোবাসার মানুষ “ইলা”। সে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। নিনীকা শক্ত করে ইলার হাতটা চেপে ধরে আছে। দুপাশের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে নিনীকা মৃদু হেসে এগিয়ে যেতে থাকলো, আর কেউ যাতে না বুঝে এমনভাবে চাপা গলায় বলতে থাকলো,
—আপনি কাঁদবেন না ইলা ম্যাম। প্লিজ কাঁদবেন না।
নিনীকার অনেক আগেই রওনক ক্লাবে পৌঁছেছে। ফটোসেশানে সবার অভিযোগ, স্যার আপনার কপাল কুঁচকে আছে কেন? রওনক কি করে বুঝাবে, সে রাজারাণির নামের বর্ণ খুঁজছে! নিনীকা ক্লাবে আসতেই রওনকের গলা শুকিয়ে এলো আরো। এখনি তো উত্তর চাইবে। বিয়ের রেজিস্ট্রিটা হবার আগেই উত্তর না দিতে পারলে ইজ্জত বলে আর কিছু থাকলো না। ফটোশ্যূটে যখন প্রথম সে আর নিনীকা পাশাপাশি বসলো, নিনীকা রওনকের ডান হাতে চিমটি কেটে বললো,
—বাহ্! শেরোয়ানিতে আপনাকে তো রাজা চন্দ্রগুপ্তের মতো লাগছে।
রওনকের উত্তরটা তখনি মনে পড়লো। ইটস চন্দ্রবিন্দু!
রওনক কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—আমি কি একটু পানি খেয়ে আসতে পারি রাণী বিন্দুবতী?
নিনীকা হাসলো মিষ্টি করে। মিহিকণ্ঠে বললো,
—না। একদম না। বিয়ের পুরো অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া অবধি আপনাকে পানিবিহীন অবস্থায় থাকতে হবে রাজা। রাণীর কঠোর আদেশ নো জলপান, নো জলত্যাগ।
রওনক হেসে ফেললো। সাথে সাথেই পাশের থেকে কেউ বলে উঠলো, হেই নাইস স্মাইল! কাপলের এই ক্লিকটা নিতেই হবে।
চারপাশ থেকে অসংখ্য ক্যামেরার আলো একের পর এক জ্বলছেই।
নিনীকা শাড়ি ঠিক করার অজুহাতে, কুঁচি ঠিক করার অজুহাতে বারবার চোখে আসা জল টিস্যুতে চেপে নিচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে আছে ইলা। নিনীকা ইশারায় ডাকলো, এসো আমাদের সাথে ছবি তুলো।
ইলা গেল না। খুশিতে তার চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে। ইলা মনে মনে বললো, হে অসীম দয়ালু, এদের জীবন তুমি আনন্দে ভরিয়ে দাও। দু-হাত দিয়ে আনন্দ ঠেলে সরিয়েও যেন এরা আনন্দময় মুহূর্ত থেকে বের না হতে পারে।
#পর্ব_২০
ক্লাবে এসে অবধি বড় ফুফু সোহলেকে ধমকাচ্ছেন।
—এই যে গাধা ম্যানেজার, গেস্ট ওয়েলকামের এই ব্যবস্থা? স্পষ্ট করে লিখা আছে এই সিঁড়ি দিয়ে কনেপক্ষ, এই সিঁড়ি দিয়ে বরপক্ষ। তোমার স্যারের সব নায়িকারা এই সিঁড়ি দিয়ে কেন উপরে যাচ্ছে?তারা তো বরপক্ষের। আর এই যে আমাদের মালা দেওয়া হলো, সব হলুদ গোলাপ কেন? লাল গোলাপ কি কম পড়েছে?
—ম্যাম, সবাই ভিআইপি গেস্ট! কিছু বললেই সমস্যা। উনারা যেভাবে কমফোর্টেবল ফিল করেন, সেই সিঁড়িতেই যাচ্ছেন। আর মালাতে ইয়েলো রোজটাকে থিম করা হয়েছে ম্যাম। দেখেন সবার ইয়েলো।
—থিমের কি ধরন! আর এইসব পেটখোলা, হাঁটুখোলা নায়িকাকে বিয়েতে ডেকেছো কেন? আমাদের পক্ষের কত মুরুব্বী এসেছে জানো? এদের পাহাড় পর্বতময় রূপ দেখতে তো এরা আসে নাই।মুরুব্বিদের তো একটা মিনিমাম সম্মান দেখাবে! এদের আলাদা করে রিসাপশানেও তো বলা যেত?
সোহেল মাথা নিচু করে ধমক শুনছে। এই পাগলা মহিলার কি কোনদিনই আকেল হবে না! বিয়েতে বলা এখানের সব স্টার স্যারের খুব কাছের। এরা স্যারের ফ্যামিলি ফ্রেন্ডস। এদের বিয়েতে না বললেই কি হতো? অনলি রিসাপশানে বললে মাইন্ড করতো। রাগটা চেপে সোহেল বললো,
—ম্যাম, ভুল হয়ে গেছে। আমি যাই?
—কোনো যাওয়াযাওয়ি নাই। এই সিঁড়ির ধারে দাঁড়িয়ে থাকবে। কনেপক্ষ বরপক্ষ আলাদা করে ওয়েলকাম। আর এই যে হাত ধোয়ার সব পানিতে গোলাপ পাপড়ি, টিস্যু পেপার সার্ভ করছে, তাও ভেতরে গোলাপ পাপড়ি। একগ্লাস ঠান্ডা পানিও কাউকে দিলে, ট্রেভর্তি গোলাপ পাপড়ি! এসবের মানে কি? ওয়াশরুমের বেসিন পর্যন্ত গোলাপে গোলপময়!
লাখ লাখ টাকার গোলাপ তো তুমি হাত ধোয়াধোয়ি, আর মোছামোছি করেই শেষ করেছো। টাকার মর্ম তুমি কি বুঝবে? তোমার টাকা তো আর যাচ্ছে না। সোহেল একটু হেসে বললো,
—উনারা ভেরি ইম্পর্টেন্ট গেস্ট। উনাদের কাছে ডেকোরেশনটা অনেক মানে রাখে। আর ম্যাম আপনাদের জামাইর টাকার বিশাল একটা গাছ আছে, গাছ কি বলি বাগান আছে; ও এরকম হাজার বিয়েতেও ফুরাবে না। টেনশান করবেন না ম্যাম।
ফুফু আরো রেগে গেলেন। প্রায় লোকজন শুনিয়ে বলতে থাকলেন,
—হাউ ডেয়ার ইউ! টাকার বাগান আছে বলে তুমি সব ওড়াতে শুরু করলে! টাকা রোজগার কত কষ্টের জানো? আমি এক্ষুণি তোমার চাকরি খাচ্ছি দাঁড়াও। ভি আই পি গেস্ট কি তোমাদের একার? আমাদের তরফে মিনিস্ট্রি থেকে পর্যন্ত লোক আসছে। মিনিস্টারই এসেছেন ৫জন।
সোহেল মনে মনে বললো, এই দারোগা মহিলাকে আমি ছাড়বো না। একটা সুযোগ দাও আল্লাহপাক!
বিয়ে পড়ানোর সময় নিনীকা যত তাড়াতাড়ি কবুল বললো, তত তাড়াতাড়ি চোখের পাতাও পড়ে না।
বড়ফুফু এটা নিয়েও ক্ষেপলেন।
—একটু তো দাম দেখাবি নাকি? ফট করে বলে ফেললি কেন? এত তাড়া! হুহ।
নিনীকা বিরক্তি চেপে বললো,
—বিয়ে করতেই তো এলাম। মিটে গেলেই ভালো।আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে ফুফু। খাবো কখন? পাপা খেয়েছে?
ফুফু মাথায় প্রায় হাত দিয়ে বললেন,
—-কি সর্বনাশ নিনী! এমন খাই খাই স্বভাবের বিয়ের কনে বোধহয় তুই প্রথম।
নিনীকা গলার স্বরটা আরো নামিয়ে বললো,
—তুমি প্লিজ যাও তো ফুফু। খাওয়ার ব্যাপারে তাড়া দাও। আর বলো, রওনক যেন আলাদা খায়। ও পাশে বসলে খেতে লজ্জা করবে।
ফুফু বিরক্ত মুখে ম্যানেজারকে ডাকলেন।
—গাধাটা যে আবার কোথায় গেল!
খাওয়ায় নিনীকা একা বসতে পারলো না। রওনক বসেছে। রওনকের অনেক ক্লোজ হিরো-হিরোইন বসেছে। তাদের সামনে খাওয়া অসম্ভব! তারপরও একটু স্বাভাবিক লাগতো যদি ইলাটা পাশে থাকতো। বিয়ে হওয়ার পর থেকে ইলার পাত্তা নেই। সে কি চলে গেছে না বলেই? কাউকে কি জিজ্ঞেস করবে?
নিনীকা চুপচাপ বসে রওনকের সেলিব্রিটি বন্ধুবান্ধবীদের গালগল্প শুনলো এবং খাবার নাড়াচাড়া করলো। এ কেমন শাস্তির বিয়ে? যার বিয়ে, যাদের জন্য এই আয়োজন, তাদেরই কিনা ঠিক করে খাওয়ার সুযোগ নেই? এদিকে নতুন জুতোতে পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে। হাঁটতে কষ্ট! জুতো কি খুলে ফেলবে? পেটিকোটের নাড় অসম্ভব টাইট লাগছে, একটু ঢিলা করা দরকার! ব্লাউজের ভেতরে পিঠের দিকে কি একটা খোঁচাচ্ছে খুব। কাউকে কি বলবে একটু দেখতে? মাথার টায়রা অনেক কষ্ট দিচ্ছে, এক্ষুণি খুলে ফেলা উচিত। পাপা কই? মা কই? কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। এক গ্লাস ঠান্ডা কোক খাওয়ার দরকার। আধখাওয়া পেটে বিশ্রী ঢেকুর উঠছে। ওয়াশরুমে একবার যাওয়া দরকার। উফ! বিয়েতে এত কষ্ট কেন? নিনীকার এত বান্ধবী এসেছে বিয়েতে এরা সব কই? আশেপাশে সব আননোন ফেইস!
নিনীকা মোবাইল বের করলো। পাপাকে ফোন করা দরকার ।কাছে আসতে বলতে হবে।
পাপা আসতেই, নিনীকা প্রথম যে কথাটা বললো,
—রওনকদের তাড়াতাড়ি করতে বলো, আমি বাসায় যাবো। প্লিজ!
পাপা হেসে ফেললেন। নিনীকার পাশে বসতে বসতে বললেন,
—শ্বশুরবাড়ি যাবার এতো তাড়া মামণি! এখনো তো কিছু ফর্মালিটিস বাকি। তোমায় সঁপে দেয়া হয়নি। মুখ দেখাদেখি বাকি। রওনকের মাও আসেননি। ও’র তো গার্ডিয়ান কেউ নেই। তোমায় শ্বশুরবাড়ি রেখে আসতে আমাকেই যেতে হবে।
নিচু হয়ে পায়ের জুতোর বেল্টটা খুলতে খুলতে নিনীকা মনে মনে বললো,
“আই হেইট ফর্মালিটিস” এই পৃথিবীতে কিছুই “আমার” নয়। সব “আমাদের ফর্মালিটিসের”।
চলবে
#তৃধা_আনিকা