#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩০)
“উহুম আজ ডিনার করবো না। অনেক ক্লান্ত আমি বাড়ি গিয়ে বিছানায় পড়বো এখন।”
সুপ্রভার চোখেমুখে সত্যিই ক্লান্তি স্পষ্ট। তাসিন ভাবলো তবে কফির অফার তো করাই যায়!
“আচ্ছা ডিনার না হয় বাদ কফি অন্তত খাওয়া যায়!”
সুপ্রভা চোখ দুটো বড় বড় করে তাসিনের দিকে তাকালো।
“এই যে আমার চোখের দিকে তাকান দেখেন কত্তগুলো ক্লান্তি কাজল মেখে ছড়িয়ে আছে। এখন কফি খেলে এই রাতভর না ঘুমিয়ে হুতুমের মত চোখ খোলা থাকবে সকাল হলেই দূর্বল হয়ে বিছানায় আধমরা পড়ে থাকতে হবে। হুহ”
হঠাৎ সুপ্রভা এমন করে বলল কথাটা যা শুনে তাসিন প্রথমে চমকে আর পরে একদম থমকে গেল। সুপ্রভা একদম তার মুখোমুখি এসে গিয়েছিলো কথাটা বলার সময়। তাসিনের হৃৎপিণ্ড তো যেন চমকে গিয়েই ধুকপুক এর গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এই মেয়েটা সত্যিই একটা ঝড় বৈ আর কিছু নয়। এ ঝড় যা শুধু তাসিনের বুকের ভেতর আর মস্তিষ্কেই আঘাত হানে।সুপ্রভা কফি না খেলেও তাসিন খেলো এবং সুপ্রভা নিঃশব্দে পাশে বসে সঙ্গ দিলো। তাসিন অবশ্য বলেছিলো কফি, ডিনার বাদ একটা বার্গারই না হয় খাক তার স্পেশাল ইচ্ছেমত চিলিসস মিশিয়ে। সুপ্রভার মন চাইলো না কিছুই মুখে দিতে অগ্যতা তাসিনের কফি শেষ হতেই দুজন উঠে পড়লো। আজ অবশ্য একটা টিশার্ট কিনেছে তাসিন তবে কোন বাছ বাছাই করেনি। একটা শপে ঢুকে যা পছন্দ হলো তাই দাম মিটিয়ে নিয়ে নিয়েছিলো। আর তার এহেন কান্ড দেখে সুপ্রভা তো হা করে চেয়েছিল অনেকক্ষণ। এখন ফিরতি পথে আবার একটু ঝামেলা হলো রিকশা নিয়ে। দুজন দু গলিতে যাবে তাই দুটো রিকশা দরকার ছিলো কিন্তু এই সন্ধ্যায় আজ বৃষ্টি না থাকলেও রিকশা সংকট দেখা দিলো। কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে একটা রিকশার দেখা পাওয়া গেল। তাসিন জোর করলো যেন সুপ্রভা চলে যায় সে অপেক্ষা করবে আরেকটু। অন্য কোন রিকশা পেলে তাতে চলে যাবে। সুপ্রভার মনে হলো বেচারা অফিস করে এমনিতেই তো ক্লান্ত থাকার কথা। তাই সংকোচ এড়িয়েই তাসিনকেও উঠে যেতে বলল। দুয়েকবার না করেও পরে তাসিন উঠেই বসলো রিকশায়। রাতের আকাশ আজ গাঢ় অন্ধকার নয়। মাথার ওপর থালার মত মস্ত চাঁদ, তারারও দেখা মিলছে। সেই সাথে শহুরে পথের নিয়ন কিংবা সাদা আলোয় ঝকঝকে চারিপাশ। রিকশায় বসা দুজনই কিছুটা সময় চুপচাপ কাটিয়ে দিল। মুখে কারো কথা নেই, খুঁজেই পাচ্ছে শব্দ তারা। রিকশা যখন সুপ্রভার হোস্টেলের সামনে তখন তাসিন মুখ খুলল, “বাড়ি যাও কতদিন পরপর?”
চকিতে ফিরে তাকালো সুপ্রভা। তাসিনের মুখে কেন তাকালো সে নিজেও জানে না।
“নির্দিষ্ট করা সময় নেই। যখন ইচ্ছে হয় কিংবা কোন ছুটি থাকে তখন যাই। এবার তো পরীক্ষা আছে এ মাসের শেষে তাই একেবারে আগামী মাসে যাবো। খুব সম্ভবত মেজদার বিয়ের ডেটও পরবে তখন।”
“ওহ!”
রিকশা পৌঁছে গেছে হোস্টেলের সামনে। সুপ্রভা রিকশা থেকে নামতেই তাসিন বলে উঠলো, বেশি পাকামি করতে হবে হোস্টেলে যাও।”
অবাক হয়ে তাকালো সুপ্রভা। কি করল সে! রিকশাওয়ালাকে তাসিন চলতে বলেই আবার সুপ্রভাকে বলল, “ভাড়ার টাকা দেওয়ার মত মাতব্বরিটা অন্যদের সাথে দেখিয়ো।”
হি হি করে হেসে উঠলো সুপ্রভা। সে রিকশা থেকে নেমেই পার্সের জিপ খুলেছিলো তা দেখেই তাসিন বুঝলো সে ভাড়া বের করছে। বোকা লোক! সে তো শুধু ফোনটা বের করে সময় দেখছিলো। নয়টা বেজে গেলে হোস্টেলে ঢুকতে পারবে না সে ভয়েই তটস্থ সে। তাসিনের রিকশা চলে গেছে চোখের আড়ালে। হাসি থামিয়ে ফোন চোখ বুলালো। আটটা পঁচিশ বেজে গেছে ইশ, ডিনারটা বোধহয় করেই আসা যেত! এতে হয়তো আরো কিছুটা সময় লোকটা পাশে থাকতো। লজ্জা লাগছে সুপ্রভার এখন। আজ সারাটাদিন সে কিসব যে চিন্তা করেছিলো তাসিনকে নিয়ে! আর এমন সব চিন্তা আজকাল যখন তখন মাথায় ঘোরে।
“সত্যি করে একটা কথা বলতো আয়না।”
হাতের বইগুলো আয়নার টেবিলের ওপর রেখেই দপ করে চেয়ারে বসলো তুহিন। স্কুলে পড়াকালীন সন্ধ্যা হতেই মায়ের বকা খেয়ে পড়ার টেবিলে বসতে হতো কিন্তু এখন আর এসব ভাল্লাগে না। কিন্তু মা’তো হিটলারের ছোট বোন এখনও কলেজ পড়ুয়া তুহিনকে বকাবকি করে পড়া নিয়ে। তাই ইচ্ছে করেই একাউন্টিং পড়াটা সন্ধ্যায় রেখেছে। এলাকারই এক সিনিয়র ভাইয়ার কাছে সে একাউন্টিং পড়তে যায় কিন্তু আজকে ভাইয়াটার জরুরি কাজ থাকায় ছুটি দিয়েছে। সে তাই সুযোগ পেয়ে ফুপির বাড়ি এসেছে। অবশ্য এখানে আসার পেছনে একটা উদ্দেশ্যও আছে। সে তার বন্ধু মাধ্যমে জানতে পেরেছে থানার নতুন অফিসারটা নাকি আয়নাকে পছন্দ করে। এমনকি প্রায়ই লোকটা কলেজের আশেপাশে ঘুরে সেই খবরটাও এলাকায় মোটামুটি চাওর হয়েছে ইয়াং ছেলে মেয়েদের মুখে। তাই তুহিন আজ এটাই জানতে চাইছে আয়নার কাছে, “সত্যি করে একটা কথা বলতো আয়না।”
আয়না রান্নাঘর থেকে আমড়ার আচার নিয়ে এসেছে বাটিতে করে। সেই আচারের বাটি তুহিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “কি কথা?”
“ওই যে পুলিশটা এহসান নাম করে সে নাকি তোর কলেজের সামনে ঘুরঘুর করে রোজ?”
আয়না বিছানায় বসে নিজেও একটা আমরা তুলে নিলো বাটি থেকে।
“ঠিকই শুনছিস ওই বেডা প্রত্যেকদিনই চোরের মত এদিক ওদিক থাকে। আমি দেখে ফেললে ভাব এমন করে যেন হুট করে দেখা হইছে।”
আমড়াটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে কথাটা বলেই আয়না জিভ বের করে তাতে বাচ্চাদের মত লেহন দিলো। এরপরই মুখটাকে এমন বিকৃত করলো যেন এটা আমড়া নয় নিম পাতার রস কেউ তার মুখে ঢেলে দিয়েছে। তুহিনও মজা পেয়ে হো হো করে হাসছে। তাদের কথার মাঝেই আয়নার মা এসে ভাতিজাকে বলল, “বাবু খাবার খেয়ে যাইস আজকে তোর পছন্দের চিতল মাছ আছে।”
ফুপির মুখে পছন্দের মাছের কথা শুনে তুহিন খুশি হয়ে গেল। তারপরই আবার বলল, “ব্যাটা পুলিশ এখন নিজেই চোর হয়ে গেছে রে আয়না। আমার বন্ধুরা বলাবলি করছিলো রায়হানকে নাকি খুব টাইট দিয়েছে আর এখনও নজরে রাখে যেন তোর ধারে কাছে না আসতে পারে।”
এ কথা আয়নাও জানে। একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে এই পুলিশ ব্যাটা। ভয় হয় কোন বিপদে ফেলবে নাতো আবার! রায়হান পুলিশের ছেলে হয়েই কতরকম ধমকি, হুমকি দিয়েছিলো এখন আবার আরেক পুলিশ এসে তার প্রেমে পাগল। যদি এ ব্যাটাও নিজের কোন পাওয়ার দেখাতে চায়! কথাটা ভাবতেই আয়নার মুখটা রাতের মত কালো হয়ে এলো। এই যে তার রুপে এত এত ছেলে, পুরুষ পাগল হয়ে যায় তাসিন ভাই কেন হয় না? তাসিন ভাইয়ের পছন্দ কি আরো বেশি সুন্দর! তার সৌন্দর্য কি তাসিন ভাইয়ের পছন্দের লেভেল পর্যন্ত যায় না! কদিন আগেও তো তার ক্লাসমেট তনিমার ভাই এসে প্রপোজ করে গেল। লোকটা শহরে থেকে পড়াশোনা করছে দেখতেও তাসিন ভাইয়ের মত আবার স্বভাবেও নাকি লোকটা তাসিন ভাইয়ের মত নাক উঁচু তবে সে লোক কেন তাকে পছন্দ করল! অনেক ভেবে একটা কথা মনে পড়লো আয়নার। তাসিন ভাইয়ের মনে কি আগে থেকেই অন্য কেউ আছে? এই একটা কথা মনে হতেই ঝুপ করে মন খারাপের বৃষ্টি শুরু হলো। পাশে বসা তুহিনও তার মন খারাপ ধরতে পেরে বলল, ভাইকে নিয়ে ভাবছিস নাকি?
সবাই বোঝে আয়নার মন শুধু ওই অহংকারী তাসিন ভাইটাই বোঝে না!
নতুন কেনা টি শার্টটা একটু নেড়েচেড়ে দেখে নিলো তাসিন। একটু আগেই মা ভিডিও কল দিয়েছিলো তখনও তার হাতে এটাই ছিল। আজ আর মায়ের ফোন ইগনোর না করে ধরলো। স্ক্রীণে মায়ের মুখটা ভেসে উঠতেই তার হাসি হাসি মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। আয়নার জন্য তৈরি হওয়া এক ঝামেলায় আজ কতটা দিন পর মায়ের মুখটা দেখতে হলো। মায়ের মুখটা কি একটু জীর্ণ লাগছিলো! লাগছিলো বোধহয়। তার মায়ের মুখটা সর্বদা উচ্ছল দেখায় থাকুক সে রাগে কিংবা খুশিতে। কিন্তু আজ তাতে উচ্ছলতা নেই শুধু অভিমানটা ছিলো। ভালোমন্দ তেমন কথাও তো বলল না আজ। শুধু তার খোঁজখবর নিয়ে রেখে দিলো। তবে রাখার আগে টি শার্টটা দেখে একটা কমপ্লিমেন্ট দিয়ে গেল আর তাতেই তাসিনের বুকে প্রশান্তি নেমেছে। মা টি শার্টটা দেখে বললেন, “ভি নেক টি শার্ট কিনেছিস! তোকে এই গলায় ভালো মানায়।”
ব্যস, মন ভালো হতে আর একটুও বাকি নেই। আজ আর আয়না এবং বিয়ে নিয়ে কোন তর্ক, যুদ্ধ হয়নি। খুশিতে মন আরেকটু নাচতে নাচতে এক কাজ করে বসলো। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে কোন কারণ ছাড়াই সুপ্রভাকে একটা মেসেজ করে দিলো, “গুড নাইট মিস-তুফান।”
চলবে
(গত পর্বে পোস্ট রিয়াক্ট ৫০০+ কি করে হলো কিছুই বুঝলাম না। যাইহোক,খেলা কেমন উপভোগ করছেন সবাই? আমি তো লেখা কম খেলায় বেশি মনযোগী ছিলাম আজ। এখন নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার বাণী খুঁজছি)