#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৭)
বেশ আপ্যায়ন চলছে এহসানের হবু শ্বশুর বাড়ির লোকদের। আয়নাদের বাড়িতে তো হুট করে রাতের খাওয়া হয়েছে তাই আয়োজন খুব একটা হয়নি। কিন্তু এহসানের আম্মা পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই বিশাল আয়োজন করেছেন। তার আয়োজনের বহর দেখে আয়নার বাবা ইতস্তত করছেন খুব। আজ ভেবেছিলো শুধু দু তিনজন এসে দেখে যাবে পাত্রের বাড়িঘর। কিন্তু এহসানের মায়ের ফোন করে জোরাজোরি করায় বাধ্য হয়েই তাদের মোটামুটি মুরুব্বি বলতে যে ক’জন আছে সবাইকেই নিয়ে আসা। এহসানও আজ ছুটি নিয়ে বাড়িতে আছে। আয়নাদের বংশে খুব একটা আত্মীয় স্বজন নেই তাই লোকজনের সংখ্যাও খুব কম। আয়নার বাবা তার দাদার একমাত্র সন্তান কিন্তু তার দাদার বড় একটা ভাই ছিলো সেই ভাইয়ের দুজন ছেলে। বংশে এখন মুরুব্বি বলতে আয়নার বাবার সেই চাচাতো ভাই দুটোই। এদিকে আয়নার মায়ের দিককার আত্মীয়ও তার মামা। তাই আয়নার বাবা তার সেই চাচাদের আসতে বলেছিলেন। ছোট চাচা ব্যস্ত থাকায় শুধু বড় চাচাই এসেছেন। আয়নার বাবা, মা, তার মামা-মামী আর তাসিনের মামী বাড়িতে ছিলেন বলে তাকেও জোর করেই নিয়ে এসেছেন। তারা ছেলের বাড়ি এসে সবাই খুব অবাক হলো। এ বাড়িতে তো এলাহী কান্ড যেন আজই বিয়ের কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। তাসিন বার কয়েক ফোন করেছে একবার মায়ের কাছে একবার মামীকে আর ভোর সকালেই করেছিলো ফুপুকে। কারণ সে সুপ্রভার মাধ্যমেই জেনেছে তাদের বাড়িতে সবাই এই বিয়ের জন্য খুব প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তাসিন এবার ফুপিকে ফোন করে খুব নরম আর বিনতির সুরে কিছু কথা বলেছে সেই সাথে আয়নার মতামতের কথাও বলেছে। ফুপি আজ কথা বলতে গিয়ে খুব কেঁদেছে সেই সাথে এও বলেছে তিনি তাসিনের ওপর একদমই রাগ করেননি, অভিমানও না। বরং কষ্ট পেতেন তাসিন যদি তার মায়ের কথা মেনে আয়নাকে ভালো না বাসা সত্ত্বেও বিয়ে করতো। তাসিন নিজের দিক থেকে একদম পরিষ্কার আছে সে কিছুতেই সমঝোতার কোন সম্পর্কে জড়াতে চায়নি কখনো। এতে নাতো সে মানসিক ভাবে সুখী থাকতো আর না আয়নাকে রাখতে পারতো। ফুপির সাথে কথা শেষ করেই সে আয়নাকেও কল দিয়েছিলো। আয়না ফোন তুলে লাউডে দিয়ে চুপচাপ বসেছিলো। তাসিন কল না কাটতে দেখে বুঝলো আয়না কথা বলবে না তবে শুনবে। তাই সে তাকে ডাকলো, “আয়না।”
……
কোন জবাব এলো না আয়নার পক্ষ থেকে। তাসিন আবার বলল, ” এ্যাই আয়না তুই কষ্ট পাস না বোন। বিশ্বাস কর আমি অনেক ভেবেছি তোকে নিয়ে। তোকে আমার অর্ধাঙ্গিনী করতে পারলে তোর চেয়েও বেশি খুশি আমার মা হতো, আমার ফুপিটাও হতো। আমি জেনে বুঝে আমার এত আপন মানুষগুলোর খুশি কি নষ্ট করতে পারি বল! নষ্ট করার কথা কেন বলছি এবার তা শোন, আমরা চাইলেই বিয়ে করতে পারি, কিন্তু সেই বিয়েটা সারাজীবন গলার কাঁটার মত বিঁধে থাকতো সারাজীবন। আমার এখনও মনে পরে তোর জন্মের পর আমি তুহিনের চেয়েও বেশি তোকে কোলে নিয়েছি। তুহিন তো তোর সমবয়সী তোর থেকেও পাঁচ মাসের বড়। আমি তোদের দুজনের মধ্যে বরাবর তোকেই বেশি আদর করেছি কারণ আমার ছোট্ট একটা বোন চাওয়া ছিলো। সেই চাওয়া তোকে পেয়ে পূরণ হয়েছিলো। মাকে জিজ্ঞেস করিস আমি তুহিনকে একদমই সহ্য করতে পারতাম না কারণ আমার ভাই না বোন চাওয়া ছিলো। তোর জন্মের পর থেকেই আমি তোকে মাইশার মত আদর স্নেহে রেখেছি এখন হুট করে সবাই যদি বলে তোকে বিয়ে করতে তখন আমার এত বছরের ভাবনার ওপর কেমন প্রভাব পড়বে! কি করে আমি তোকে বউ..”
এ পর্যন্তই তাসিনের কথা হয়। তারপর আয়না কল কেটে দেয় কিছু না বলেই। বাড়ির লোকজন যখন এহসানদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তখন থেকে এখন পর্যন্ত আয়না বিছানাশ পড়ে কাঁদছে। বাড়িতে আয়না একা বলেই আজ নুড়ি আর মাইশাকেও রেখে গেছে এ বাড়িতে। দুপুরে পটল আর তুহিনও চলে আসবে তারপর তারা এখানেই খাবে একসাথে। কিন্তু আয়নার কান্নায় অস্থির হয়ে তার আশপাশে পায়চারী করছে মাইশা আর নুড়িও একবার ঘরে একবার রান্নাঘরে ছুটছে। বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষেরই জানা আয়নার মনের খবর আর তাই অনেকেই মনে মনে তাসিনকে বকছে। নুড়ি বিড়বিড় করে বকছে কোন এক অজানা মেয়েকে। তার ধারণা তাসিন কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে। মাইশাও ভাইকে মনে মনে কটুকথা শোনাচ্ছে আয়না আপাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। বকছে মনে মনে মাছুমা নিজেও তার ছেলেকে কেন ঘরের মেয়েটাকে পরের ঘরে পাঠাতে হবে! এহসানদের বাড়ি এসে অব্দি সে কারো সাথে কথা বলেনি। এ বাড়িতে এসে সবার উজ্জ্বল মুখশ্রী দেখতেই মাছুমার মনে হলো আয়না খারাপ থাকবে না এখানে বিশেষ করে এহসানের ঘরে ঢুকে তার মনে হলো এই ছেলেটা বেশ গোছালো। তাসিনও পরিপাটি কিন্তু এই ছেলেটার ঘর বলছে ছেলেটা আরো অনেক গোছালো এখানে একটা ধূলোকণাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল মনে হচ্ছে। আর ঘরের আসবাব দেখে মনে হচ্ছে হবু বউয়ের প্রয়োজনটাই আগে ভেবেছে সে। তাসিন আর তুহিনের মুখে শুনেছিলো ছেলেটা আয়নাকে পছন্দ করে। কিন্তু এ ঘরে পা দিয়ে মনে হচ্ছে ছেলেটা খুব ভালোও বাসবে আয়নাকে আর তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সব করতে পারবে। ঘরটা নতুন করে সাজানো তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। খাটটা পুরনো হলেও পড়ার টেবিল, ড্রেসিংটেবিল, তিন পাল্লার আলমারি আর খালি ফটোফ্রেমগুলো একদমই নতুন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো বাড়িটাই দেখলো মাছুমা এবং ভুল করেই অথবা ইচ্ছাকৃত কিনা কে জানে মাছুমা এহসানের ঘরের বারান্দায় উঁকি মেরেছিলো। সেখানে টবে করে চারটে গোলাপ গাছ এবং চারটাই হলুদ গোলাপের। মাছুমার মনে পড়ে যায় আয়নার বছর কয়েক আগের কথা। তাসিন বাড়িতেই ছিলো তখন আর আয়না খুব সম্ভব তখন ক্লাস এইটে পড়ে৷ তাদের আম বাগানে তাসিন একটা লিচু গাছ লাগাচ্ছিলো তা দেখে আয়না বাঁধা দেয়। মাছুমা আরো একটা আম গাছের চারা নিয়ে সেখানেই আসছিলেন লাগাবেন বলে। আয়না বারণ করে, “তাসিন ভাই এদিকটায় আর গাছ লাগিয়ো না।”
কেন? কৌতুহলী হয়ে তাসিন প্রশ্ন করতেই আয়না বলে এখানে চারটা গোলাপ গাছ লাগাবো।
তাসিন বিরক্ত হয়ে বলে না এখানে সে এটাই লাগাবে। তার ঘরের জানালা এদিকটায়। আয়না জেদ ধরে তাসিন ঝাড়ি মারে। তারপর বিরক্ত হয়ে বলে ঠিক আছে একটা গোলাপ গাছ এনে এদিকেই লাগিয়ে দিবে। আয়না মানতে চাইলো না। তার নাকি চারটা গাছই লাগবে তা শুনে তাসিন জিজ্ঞেস করে চারটা কেন! আয়না তো লাজুক লাজুক মুখ করে বলে একটা তার একটা গাছ তার বরের বাকি দুইটা থাকবে বাচ্চা গাছ তাদের ছানাপোনা। মাছুমা তখন পেছন থেকে শুনে খুব হেসেছিলেন৷ কিন্তু অবাক করা ব্যপার হলো এত বছর পুরনো কথা আয়নার পছন্দ এই ছেলের জানার কথা নয়। তবে কি এই গাছগুলোর এখানে থাকাটা কাকতালীয়!
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই এহসানের বড় চাচা, ফুপু আর তার মা তিনজনেরই আবদার ছিলো সময় নিয়ে তারা এখানেই একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে যাক। এহসান অবশ্য কথাটা পাত্তা না দিয়ে বলেছিলো আরো সময় নেক তারা। আয়নার বাবা বললেন, পরবর্তীতে আপনারা গিয়ে সামনে আগান।
এ কথাতেই পরিষ্কার তারাও আগাতে চায় সামনে। ব্যস সে মুহূর্তেই বড়রা নিজেরা আলোচনা করে ঠিক করলেন এক সপ্তাহ পরে আকদ হবে। যেহেতু আয়না এখনো বিয়ের বয়সী হয়নি মানে সাংবিধানিক বয়সটা হয়নি বিয়ের তাই অনুষ্ঠানাদি করে পরেই আনা হবে। এহসান মানলো না। সে বলল সে অপেক্ষা করবে আয়নার বয়স আঠারো হোক আর তার সামনে পরীক্ষা সে কারণেও আপাতত এসব থাক। বড়রা এমন কিছু মানেন না তারা ভাবেন শুভ কাজ ফেলে রাখতে নেই এতে বাঁধা আসে। হতে পারে এগুলো কুসংস্কার কিংবা প্রথার নামে ভুল ধারণা তবুও তারা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন বিয়েটাই হবে একটু না হয় বয়সটা বাড়িয়ে নেবে বিয়ের কাগজে! এহসান অবাক হয়ে যায় সকলের কথায়। সে আইনের লোক আর তাকেই কিনা বলছে বেআইনি কাজ করতে!
চলবে
(আজকের জন্য তাসিন মেহতাব – সুপ্রভা শিকদার আউট অফ পার্ট 🫣)