তবু মনে রেখো (৮ম পর্ব)
.
পুষ্পিতার এমন বিদ্রুপাত্মক প্রশ্ন এবং চাহনিতে ইমাদ চোখ নামিয়ে নেয়। মনযোগ দেয় খাবারে। ডাইনিং রুম থেকে প্রস্থান করে পুষ্পিতা৷ ইমাদ খাবার শেষ করে তাড়াতাড়ি বাজারে গিয়ে হায়দার সাহেবকে বিদায় দেয়। তারপর পুরোটা দিন তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও পুষ্পিতা মাথার ভেতর থেকে যায়। সন্ধ্যা হতেই বুকের ভেতর শুরু হয় ঘরে ফেরানোর আন্দোলন। ক্ষুদ্র এই জীবনে কখনও এমন ঘরে ফেরার তাড়া তার ছিল না। এশার আজান শুনতেই দোকান বন্ধ করে দিল। নামাজ শেষে আজ আর ক্যারাম খেলতে গেল না। পুষ্পিতার সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিতে হবে। সিএনজিতে উঠে নয়টার আগেই চলে আসে বাড়িতে। রুমে গিয়ে দেখে পুষ্পিতা শুয়ে-শুয়ে বই পড়ছে। তার আগমনে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই ওর। কি সুন্দর দুই হাতে বই ধরে, পা লম্বা করে বিছানায় শুয়ে আছে। বাঁ পা ডান পায়ের ওপরে৷ ফলে দেখে মনে হচ্ছে নগ্ন দু’টো পায়ের পাতা যেন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আছে। তার বুকে ভীষণ শিরশিরে অনুভূতি হয়। কোনো কথা না বলে বাথরুমে চলে যায়। হাত-মুখ ধুতে ধুতে মনে হয় এভাবে চুপচাপ থাকলে হবে না। দু’জনের মধ্যে কাজে-অকাজে কথাবার্তা হওয়া দরকার। কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য কথা বলার বিকল্প নেই। এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে কথা বাড়াতে হবে। তাতে দু’জনের মধ্যকার অস্বস্তির অদৃশ্য দেয়াল ক্রমশই মিলিয়ে যেতে শুরু করে। টাওয়েল দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে চোরা চাহনিতে ইমাদ বইয়ের নামটা পড়ে নেয়। কবি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কর্মসূচিরই অংশ হিসাবে সে মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘এটা আবার কেমন বই। বইয়ের নাম নেই৷ ওপরে শুধু লেখকের নাম কবি তারাশঙ্কর বন্দোপধ্যায়।’
পুষ্পিতা বই দিয়ে মুখ ঢেকে হেঁসে ফেললো। ইমাদ টাওয়েল মেলে দিয়ে এসে বিছানায় বসে বললো,
– ‘কি? হাসা কি শেষ হয়েছে?’
পুষ্পিতা পুনরায় হেঁসে বললো,
– ‘বইয়ের নামই “কবি” আর লেখকের নাম তারাশঙ্কর।’
কথাটি বলে পুষ্পিতা আবার বইয়ের পাতায় মনযোগ দেয়। ইমাদ সতর্ক হয়ে যায়। কথা বাড়াতে গিয়ে আবার বালিকাকে বিরক্ত করতে যাবে না সে। কিন্তু পাশের বালিশে শুয়ে কি নিজের মতো মোবাইল টিপতে পারে না? যদিও এই ক’দিনের সম্পর্কের সঙ্গে এই দৃশ্যটা বড্ড বেমানান৷ ইমাদ তবুও অস্বস্তি নিয়ে ওর পাশের বালিশে শুয়ে যায়। অজান্তেই দু’টি দেহের স্পর্শ হয়। কেমন একটা শঙ্কা আর দ্বিধায় ইমাদের শরীর যেন কাঁপছে। ওর পাশে সে যেন বড়ো ভীষণ তুচ্ছ। পুষ্পিতা বই থেকে মুখ সরিয়ে তাকিয়ে আছে। তার যেন দমবন্ধ হবার জোগাড়। ওর অবাক দৃষ্টির কারণে হাত বিছানায় ফেলে রাখবে না-কি বুকে তুলে আনবে বুঝতে পারছে না।
ইমাদের বিকৃত অবস্থা দেখে পুষ্পিতাই বললো,
– ‘কোনো সমস্যা?’
ইমাদ অজুহাত খুঁজে না পেয়ে বললো,
– ‘না, একটু মাথা ব্যথা করছে।’
– ‘হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে। তাহলে আমি সোফায় গিয়ে বসছি।’
– ‘না, তা কেন?’
– ‘অসুস্থতার কারণেই হয়তো শুয়েছো, না হলে তো আমার পাশে শুইতে না তুমি।’
সে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘না সমস্যা নেই। বই পড়ছো, পড়ো।’
– ‘তুমি হয়তো ক্লান্ত, আমি গিয়ে খাবার দিতে বলি৷ খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।’
ইমাদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। পুষ্পিতা গিয়ে টেবিলে খাবার দিয়ে এসে বললো,
– ‘আসো।’
ইমাদ টেবিলে যেতে যেতে ভাবে পুষ্পিতা এখনও তার সঙ্গে কোনো বিশেষণ ছাড়া কথা বলে। চেয়ার টেনে টেবিলে বসে বললো,
– ‘তুমি খাবে না পুষ্পিতা?’
নামটা ইচ্ছা করেই জুড়ে দিল সে। ইচ্ছা করছে বারবার এই নাম ধরে ডাকতে। পুষ্পিতা অসম্মতি জানিয়ে বললো,
– ‘আমি বই পড়া শেষে খাব। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যাও। দেখতে কেমন অসুস্থ লাগছে।’
ইমাদ কোনোভাবেই যেন পরিবেশটা নিজের অনুকূলে আনতে পারছে না। তার শরীরে কোনো অসুখ নেই, ক্লান্তি নেই, ঘুমানোর তাড়া নেই। আছে অনুরাগ, কামনা, ভালোবাসা৷ মুখ ফুটে তবুও বলতে পারছে না সে। চুপচাপ খেতে শুরু করে। খাওয়া শেষে রুমে চলে যায়৷ বিষণ্ণ মনে বালিশে মাথা রাখে।
পুষ্পিতা খানিক পর এসে বললো,
– ‘আজ তুমি বিছানাতেই ঘুমাও। আমি নিচে থাকবো।’
ইমাদ প্রতিবাদ করে বললো,
– ‘না, আমার কোনো সমস্যা নেই, তুমি পালঙ্কেই ঘুমাও।’
পুষ্পিতা তার মুখের ভাষা, মনের আকুতি কিছুই বুঝলো না৷ বাতি বন্ধ করে ড্রিম লাইটের সুইচ টিপে দিয়ে বললো,
– ‘অসুস্থ অবস্থায় তুমি ফ্লোরে থাকবে আর আমি পালঙ্কে তা তো হয় না। ড্রিম লাইট জ্বেলে দিয়েছি ঘুমাও, আমি মায়ের রুমে গিয়ে বই পড়বো।’
পুষ্পিতা চলে যায় রুম থেকে৷ নিজেকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানব মনে হচ্ছে ইমাদের। একই রুমে একটা মানুষকে সে কথা বলে নিজের মনের ভাবটা বুঝাতে পারলো না। এরচেয়ে কি বোবারাই ভালো নয়? তারা তো ইশারা- ইঙ্গিতেও ভাব প্রকাশ করতে পারে। বিছানায় ছটফট করে তার নির্ঘুম সময় কাটছে। পুষ্পিতা বই শেষ করে বলেছে খেতে বসবে। ওর পড়া শেষ হবে কখন? কখন আসবে রুমে? ঘণ্টা দুয়েকের ভেতরে তার চোখ বুজে এলো নিদ্রায়। ঘুম ভেঙে গেল দূর থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আজানে। হাই তুলে উঠে বিছানায় বসে। রুমে ড্রিম লাইটের মৃদু আলো। ফ্লোরে তাকিয়ে দেখে পুষ্পিতা গুটি-শুটি হয়ে এদিকে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। হাত দু’টো বুকের কাছে ভাঁজ করে রাখা। দীর্ঘ সময় এভাবে তাকিয়ে রইল সে। তারপর যেন সম্মোহিত হয়ে ওর পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। ইচ্ছে করছে ওর নরম, কোমল গালটায় একবার হাত রাখবে। কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় হাত রাখা কি ঠিক হবে? একবার ভাবে তারই তো বৈধ স্ত্রী। পুনরায় ভেতর থেকে যেন কেউ বলে দেয়, তোমাদের দু’জনের সেই সম্পর্ক এখনও হয়ে উঠেনি৷ একবার হয়ে গেলে ঘুমন্ত অবস্থায় হাত দিলেও সমস্যা ছিল না। ইমাদ এবার ওর দিকে তাকিয়ে ফ্লোরেই শুয়ে রইল। একেবারে কাছাকাছি। পুষ্পিতার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। এভাবে কখন যে ঘুমিয়ে গেল বুঝতেই পারেনি। ভোরে ঘুম ভাঙলো কারও সুরেলা হাসির শব্দে। চোখ মেলেই দেখে পুষ্পিতা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাসি নয় যেন সংগীত।
– ‘কি হলো, তুমি কি রাতে পালঙ্ক থেকে পড়ে গিয়েছিলে? বালিশ বিছানা ছাড়া ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছো যে।’
ইমাদ চারদিকে তাকায়। বিভ্রান্তি কেটে গেল তার ক্ষীণ সময় পর। আজ তো বিছানায়ই ঘুমিয়ে ছিল। পুরো ঘটনা মনে পড়ে যায়। উঠে বসে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘আসলে নিজেই বুঝতে পারছি না কিভাবে এলাম।’
– ‘অসুখ-টসুখ হলো না তো আবার। না-কি এভাবে বাচ্চাদের মতো প্রায়ই পড়ে যাও।’
– ‘না না এভাবে পড়ি না কখনও।’
– ‘ডাক্তার আনতে বলবো না-কি? চোখও কেমন লাল। রাতে বললে মাথা ব্যথাও ছিল। জ্বর এলো না-কি?’
ইমাদের ইচ্ছা হলো বলতে ‘দেখো তো আমার কপালে হাত রেখে জ্বর এলো কি-না’ কিন্তু বলতে পারলো না সে। ফ্লোর থেকে উঠে বললো,
– ‘না তেমন কিছু হয়নি।’
পুষ্পিতা আবার হেঁসে বললো,
– ‘যাক পড়ে তো ব্যথাও পাওনি দেখছি।’
ইমাদ এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে বাথরুমে চলে গেল। সে এখানে ঘুমিয়ে গেল কিভাবে? নিজের প্রতি তীব্র বিরক্ত হলো। দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে বের হয়ে দেখে পুষ্পিতা নেই। মুখ-হাত মুছে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে আটটা বেজে গেছে। আজ কর্মচারী এসে দোকান খোলার কথা। খুলেছে কি-না কে জানে। তাকে কল দিতে যাবে, তখনই আবার পুষ্পিতা এসে বললো,
– ‘আঙ্কেল এসেছেন। আমাদেরকে রেডি হতে বললেন।’
– ‘এখনই?
– ‘হ্যাঁ কাল যে আসবাবপত্র এনেছেন। তাই বাড়িতে তোমার কাজ আছে বললেন।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘কেন তুমি জানো না ওরা এগুলোর জন্য গতকাল শহরে গিয়েছিলেন?’
ইমাদ সরল মনেই জবাব দিল,
– ‘হ্যাঁ বাবা গতকাল দোকানে গিয়ে বলেছিলেন।’
পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আসো নাশতা করবে।’
ইমাদ ওর সঙ্গে নাশতার টেবিলে গেল। দু’জন সামনা-সামনি দুই চেয়ারে বসে গিয়ে। মজিদা এনে নাশতা দেয়। পুষ্পিতা তার সঙ্গে নাশতা করতে বসেছে দেখে ভীষণ ভালো লাগে৷ ডাইনিং রুমের পশ্চিমের জানালাটা খোলা। বাইরে সবজি বাগান। চড়ুই পাখি ক’টা জানালায় এসে কিচিরমিচির করছে। মাঝে মাঝে বাতাস আসছে দূর-দূরান্ত থেকে। বড়োই সুন্দর, প্রশান্তির পরিবেশ। এর আগে এই রুমটা এতো সুন্দর মনেই হয়নি। এর আগে কোনোদিন চড়ুই পাখির কিচিরমিচির এতটা সুমধুর লাগেনি। পুষ্পিতা চায়ের কাপ হাতে জানালার কাছটায় যায়। চড়ুই পাখিগুলো উড়ে চলে গেল। বাইরে তাকিয়ে চুমুক দেয় পুষ্পিতা। ওর চা খাওয়ার ভঙ্গিতেও যেন আভিজাত্য ভাব উপচে পড়ছে। পুষ্পিতা চা শেষ করে চলে যাচ্ছে দেখে সেও উঠে দাঁড়ায়৷ রুমে এসে দেখে পুষ্পিতা চুলটা ভালো করে বেঁধে মাথার ওড়না দিয়েছে। ইমাদ ঢুকতেই বললো রেডি হয়ে নাও। সিএনজিকে কল দিয়ে এনেছেন। বেচারা অপেক্ষায় আছে।
ইমাদ অবাক হয়ে বললো,
– ‘তুমি কি রেডি?’
পুষ্পিতা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘কেন এইটুকু রাস্তা, সেজে-গুজে এতো ঢং করার কি আছে?’
বুকে যেন তির বিঁধেছে। এই কয়দিন কি একটু বেশিই করে ফেলেছে? পুষ্পিতা তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা সাজতে পারো। ওইদিন তোমাকে কি যে সুন্দর লেগেছিল। এতো সৌন্দর্য আমি আর কোনোদিন কোথাও দেখিনি। তুমি সাজতে থাকো একটা জনম। আমার কোনো বাঁধা নেই পুষ্পিতা।
কিন্তু ভাবনাগুলো কথার রূপ পেল না৷ বুকের ভেতর অপচয় হয়ে গেল। পুষ্পিতা ততক্ষণে রুম থেকে বের হয়ে গেছে৷ সেও তাড়াতাড়ি কাপড় পালটে নিয়ে বের হয়। পুষ্পিতা ওর মায়ের রুমে। সে শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম করে বিদায় নেয়। মহসিন সাহেব তাদের সিএনজিতে তুলে দিলেন। সাবিনা বেগম বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের অশ্রু মুছে নিচ্ছেন। সিএনজি চলতে শুরু করেছে। ইমাদ যতটুকু সম্ভব ওর ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। হঠাৎ সিএনজির আয়নায় চোখ পড়তেই মনে হলো তার কলিজাটা যেন কেউ মোচড়ে ধরেছে। পুষ্পিতার চোখে জল টলমল করছে। সংক্রামিত হয়ে তার চোখও ঝাপসা হয়ে এলো।
_চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম