#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২৫
৪৫।
অফিসে ঢুকতেই নাহিদ হোসেনের মুখোমুখি হলেন আরিয়া। তিনি নাহিদকে দেখেও না দেখার ভান করে নিজের কেবিনে ঢুকে গেলেন। এদিকে নাহিদ মলিন দৃষ্টিতে আরিয়া ফেরদৌসের রুমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ রিদ্ধ সেন এসে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“বন্ধু, তোর মন খারাপ তাই না?”
নাহিদ হোসেন মলিন হেসে বললেন,
“ছেলে দুইটা মাকে হারিয়ে ফেলেছে, তাদের জন্য খুব খারাপ লাগছে। আমি তো মেনে নিয়েছিলাম রোকেয়া বাঁচবে না। জানিস, নিবিড়ের মা সত্যিই অনেক ভালো মেয়ে ছিলো। ওর মতো স্ত্রী পেয়ে আমি সত্যিই ভাগ্যবান।”
রিদ্ধ সেন সান্ত্বনার সুরে বলল,
“সৃষ্টিকর্তা তাকে ভালো রাখুক।”
নাহিদ এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“একটা কথা বলার ছিলো।”
“বল।”
“আরিয়া আমাকে একদমই সহ্য করতে পারে না। আমি আসলে বুঝতে পারছি না ও এমন কেন করছে।”
“আরিয়া কোনো পুরুষ মানুষকেই সহ্য করতে পারে না। ওর মধ্যে পুরুষদের প্রতি একটা বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে গেছে। মিরাজ যা করেছিলো, এরপর থেকে মেয়েটা একদম পালটে গেছে। ও কি বাস্তবতার চাপে কঠিন হয়ে গেছে, নাকি কঠিন হতে হতে পাথরই হয়ে গেছে, তা আসলে আমি নিজেও বুঝতে পারি না।”
“কিন্তু তোর সাথে তো, ঠিকই আগের মতো আছে।”
“আমি আর বাকীরা এক না। আরিয়া আর আমার সম্পর্কটা আলাদা। কেউ বুঝে না, কিন্তু আমরা বুঝি। একটা সময় ছিলো, আমাদের বন্ধুত্ব দেখে মানুষ ভাবতো, আমাদের অবৈধ সম্পর্ক চলছে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস করেছিলো, আমাদের সন্তানরা। আর আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে আমার স্ত্রী, ত্রয়ী। অনেক ভাগ্য করে এমন একটা বউ পেয়েছি। আজ যদি মিরাজও ঠিক সেভাবেই আরিয়াকে বিশ্বাস করতে পারতো, তাহলে ওরা অনেক সুখী হতো।”
“আরিয়া নিজেই তার এই জীবনটা বেছে নিয়েছে।”
রিদ্ধ সেন মাথা নেড়ে বললেন,
“আরিয়া কখনো সেই সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে চায় নি। ও আমার সাথে বিয়ের দিন পালিয়েও গিয়েছিলো, শুধু একটা আশ্রয়ের জন্য৷ কিন্তু ওর বড় ভাই জোর করে ওকে নিয়ে যায়, আর বিয়ে দিয়ে দেয় ওই অসভ্য লোকটার সাথে।”
“কিন্তু আমি তো এতো কিছু জানি না।”
“কিভাবে জানবি? তুই তো গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলি।”
নাহিদ আক্ষেপের সুরে বললেন,
“হ্যাঁ, চলে গিয়েছিলাম৷ ভেবেছিলাম, কখনোই সেই গ্রামে যাবো না। অনেক ভালোবেসেছিলাম আরিয়াকে। কিন্তু ও আমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে। হয়তো আজ সেই অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছে।”
“এভাবে কেন বলছিস, নাহিদ? এভাবে বলিস না। আরিয়ার কষ্টটা তুই দেখিস নি। ও অনেক সংগ্রাম করে এতো দূর এসেছে।”
নাহিদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
“রিদ্ধ, তুই এখনো আরিয়ার পক্ষপাত করা ছাড়িস নি। এখনো কি তোর ওর প্রতি…”
রিদ্ধ সেন নাহিদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“ত্রয়ী আর আমার দুই মেয়ের পর আমার কাছে আরিয়া ও তার সন্তানরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো একটা সময় ছিলো যখন আমি আরিয়াকে ভালোবাসতাম। কিন্তু সেই ভালোবাসা আমার অল্প বয়সের অনুভূতি ছিলো। আমার জন্য আরিয়া এখন শুধুই বন্ধু আর তার সন্তানদের আমি আমার দায়িত্ব মনে করি। এই দায়িত্ব আমাকে কেউ বুঝিয়ে দেয় নি। এটা আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়ে গেছে৷ আর ত্রয়ী, ওকে ছাড়া তো আমি কিছুই না৷ তাই প্লিজ কথার মোড় ঘুরিয়ে দিস না।”
নাহিদ হোসেন দেয়ালে হাত রেখে মলিন সুরে বললেন,
“আরিয়া সত্যিই আমার সাথে অন্যায় করেছে। তবুও আমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করি নি। বরং করছিও না। অতীতের সেই দিনটি তোর আর আরিয়ার জন্য হয়তো কিছুই ছিলো না। বরং তুই তখন খুশিই হয়েছিলি। কারণ তুই চাস নি, তোর আরিয়া অন্য কারো হোক। তবে এখন হয়তো তুই ত্রয়ীকে ভালোবাসিস। কিন্তু তখন তো তুই আরিয়াকেই ভালোবাসতি। আর তাই আরিয়ার দোষগুলো তোর চোখে পড়ে নি, আর এখনো পড়ছে না, ভবিষ্যতেও পড়বে না। কিন্তু রিদ্ধ, আরিয়া আমার সাথে অন্যায় করেছে, এটা মেনে নেওয়া উচিত। সে সত্যিই অনেক বড় অন্যায় করেছে। আর আমি এখন বুঝতে পারছি, মূলত তা-ই ও আমাকে সহ্য করতে পারছে না। কারণই ওর বর্তমান জীবনটা যে ওর অতীতের সেই অন্যায়ের শাস্ত, এটা হয়তো সে বুঝে গেছে।”
আরিয়া হঠাৎ পেছন থেকে বলে উঠলেন,
“আমি কোনো অন্যায় করি নি।”
নাহিদ হোসেন আর রিদ্ধ সেন আচমকা আরিয়ার কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকালেন। রিদ্ধ কিছু বলতে যাবে তখনই আরিয়া তাকে থামিয়ে বললেন,
“তুই কিছু বলিস না।”
এরপর নাহিদের সামনে দাঁড়িয়ে আরিয়া আবার বললেন,
“রিদ্ধ আমাকে নিয়ে অতীতে কি অনুভব করতো, তা তুমি এখন কেন তুলছো? থাক, অতীতের কথা না হয় পরে হবে। আগে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
নাহিদ হোসেন ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“কি প্রশ্ন!”
“তোমার ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছো কেন? আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য?”
রিদ্ধ সেন আরিয়ার কাছে এসে বললেন,
“আরিয়া, কি বলছিস তুই এসব?”
“ঠিক বলছি। আমার মেয়ে মারিয়ার সাথে প্রেম করার চেষ্টা করছে মিস্টার নাহিদ হোসেনের ছেলে নিবিড় হোসেন।”
নাহিদ রাগী কন্ঠে বললেন,
“আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো, আরিয়া। তুমি আমার ছেলেকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলতে পারো না।”
আরিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আর তোমার ছেলে যখন বাজে দৃষ্টিতে আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন? যেমন বাবা, তেমনই ছেলে। তুমিও তো তোমার ছেলের বয়সে থাকতে তাই করেছিলে। তাই শাস্তিও পেয়েছিলে। আর তোমার সাথে আমি যা করেছি, তাতে আমার কোনো আফসোস হয় না। কারণ তোমাকে ‘না’ বলার পরও তুমি আমার পেছনেই পড়েছিলে। আমি গ্রামে বড় হয়েছিলাম। গ্রামের পরিবেশ কেমন, তা তো তুমি জানোই। কথা রটতে এক সেকেন্ডও দেরী হয় না। তাই তোমাকে আটকানোর জন্য আমি এর চেয়ে ভালো কোনো পরিকল্পনায় খুঁজে পাই নি। আর তোমার ছেলে এখন তা-ই করছে। তাই তোমার ছেলেকে আটকানোর জন্য আমি অন্য কোনো ব্যবস্থা নেবো। তুমি তো অপমানিত হয়ে গ্রাম ছেড়েছো। তোমার ছেলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে।”
নাহিদ চেঁচিয়ে বললেন,
“দেশটা তো তোমার একার৷ তুমি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাই না? তুমি যখন ইচ্ছে তখন, যা ইচ্ছে তাই বলবে, আর আমি শুনবো? আমার ছেলের কোনো ক্ষতি করলে, আমি কিন্তু ভুলে যাবো তুমি কে?”
আরিয়া ফেরদৌস হেসে বললেন,
“আমি কে? কেন তুমি জানো না আমি কে? আমি আরিয়া ফেরদৌস। মাহাথি, মাফিন, মারিয়া আর মহুয়ার মা। এটাই আমার পরিচয়। ওদের জন্য আমি বেঁচে আছি। আর শুনো, আমি তোমার ছেলেকে আমার মেয়ের আশেপাশেও যাতে না দেখি।”
আরিয়া কথাটি বলেই চলে গেলেন। নাহিদ মাথায় হাত দিয়ে পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়লেন। রিদ্ধ তার কাঁধে হাত রাখতেই তিনি বললেন,
“মেয়েটা আমাকে এতো ঘৃণা কেন করে? থাক করুক, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমার ছেলের সম্পর্কে এমন কথা কেন বলবে?”
নাহিদ হোসেন সাথে সাথেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লেন। আজ যেহেতু নিবিড় কলেজে যাবে না, তাহলে এই মুহূর্তে তার বাসায় থাকার কথা। তিনি বাসায় এসে সোজা বসার ঘরে চলে এলেন। নিবিড় বাবাকে দেখে বলল,
“বাবা, তুমি তো গেলে আর আসলে। তোমার শরীর ঠিক আছে তো?”
নাহিদ ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। নিবিড় বাবার এমন দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, বাবা?”
নাহিদ হোসেন বললেন,
“শুনলাম, মারিয়ার পেছনে পড়ে আছিস। কলেজে কি পড়াশুনা করতে যাস, নাকি অন্যকিছু করতে যাস।”
নিবিড় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি মারিয়াকে মোটেও বিরক্ত করি না। হ্যাঁ, আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি কখনোই জোর খাটাই নি। মারিয়ায় আমাকে বুঝতে ভুল করেছে।”
“বুঝবে কিভাবে? যেমন মা, তেমন মেয়ে। মারিয়ার মা যেহেতু জেদি আর একরোখা, তাহলে সেও নিশ্চয় তেমনই হবে।”
“না, বাবা। মারিয়ার মন অনেক পরিষ্কার। আমি জানি না তুমি কেন বলছো, আন্টি জেদি আর একরোখা। কিন্তু মারিয়া অনেক ভালো। ও আন্টিকে ভয় পায়, তাই আমার ভালোবাসা মানতে পারছে না।”
“আর মানতে হবেও না। মারিয়া নামটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।”
নিবিড় আর কিছুই বললো না। বাবা বলেছে, মারিয়াকে ভুলে যেতে, আর তাই সে ভুলে যাবে, এটা তো সম্ভব না। বাবারা তো বলবেই। কোন বাবা-মা চায়, সন্তানরা প্রেম করুক? তাই নিবিড় বাবার বলা কথাগুলোই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো।
চলবে–