রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৩১

0
670

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৩১

৫৩।
পরীক্ষার হলে মুখ ভার করে বসে আছে মারিয়া। প্রশ্ন দেখার সাথে সাথেই সে আকাশ থেকে পড়েছে। এই মুহূর্তে তার নিজের চুলগুলো নিজেরই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সে গতকাল পড়াশুনা না করে রাত জেগে প্রহরের সাথে ফোনে কথা বলেছিল। যদিও প্রহর তাকে অনেকবার পড়তে বসতে বলেছিল, কিন্তু সে প্রহরের কথা শুনে নি। যার ফলে আজ সে একটা লাইনও মাথা থেকে বের করতে পারছে না।
এদিকে নিবিড় খেয়াল করলো, মারিয়া অনেকক্ষণ ধরেই প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে আছে, আর খাতায়ও কিছু লিখছে না। তাই নিবিড় তার কলম দিয়ে মারিয়ার হাতে ঠোকা দিয়ে বলল,
“বসে আছো কেন?”

মারিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“কিছু পারছি না।”

নিবিড় কথাটি শুনে মাথা নিচু করে আবার লেখায় মনোযোগ দিলো। এদিকে মারিয়া বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“আল্লাহ, এতো কঠিন প্রশ্ন! ফাইনাল পরীক্ষার আর মাত্র চার মাস বাকী। আর আমি এখনো কিছুই পারি না? এখন আমি ফেইল করলে বর আমাকে কি ভাববে? গাধা মনে করবে। মহুয়া তো অনেক পড়াশুনা করে। যখন প্রহর দেখবে, আমার চেয়ে মহুয়া পড়াশুনায় ভালো, তখন আমাকে কি লজ্জায় না পড়তে হবে। এবারের মতো বাঁচিয়ে দাও আল্লাহ। আমি পরীক্ষা শেষ হলেই একটা রোজা রাখবো। সত্যি, একদম সত্যি।”

হঠাৎ নিবিড়ের ফিসফিসানি শুনে মারিয়া তার দিকে তাকালো। নিবিড় তখনই মারিয়াকে তার এক্সট্রা পেইজ দিয়ে বলল,
“আমি ভার দিয়ে লিখেছি। দেখো, প্রথম প্রশ্নটার ছাপ পড়েছে এই পৃষ্ঠায়। তাড়াতাড়ি লিখে ফেলো।”

মারিয়া নিবিড়ের দেওয়া পৃষ্ঠার উপর পেন্সিলের গুঁড়ো ফেলে তা বুঝে বুঝে লিখতে লাগলো। এভাবেই পুরো পরীক্ষায় নিবিড় এক্সট্রা পেইজ নিয়ে মারিয়াকে পাশ নম্বরটি তুলে দিতে সাহায্য করলো।

পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে মারিয়া নিবিড়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“নিবিড় আমাকে ক্ষমা করে দিস।”

নিবিড় মাথা নিচু করে মলিন হাসলো। মারিয়া আবার বলল,
“আমি প্রতিদিন তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করি। আর তুই তবুও আমাকে এতো বড় বিপদ থেকে বাঁচালি।”

নিবিড় মুচকি হেসে বললো,
“আমি আমার সাধ্যের মধ্যে যতোটুকু পারি সবটাই তোমার জন্য করবো। কারণ আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, মারিয়া।”

মারিয়া মলিন মুখে বললো,
“নিবিড় দেখ, আমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে। তাই তোর উচিত আমাকে ভুলে যাওয়া। তুই অনেক ভালো মেয়ে খুঁজে পাবি।”

“তোমার মতো কাউকেই পাবো না।”

“তোর মনে হচ্ছে, কারণ তুই নিজেকে সুযোগ দিচ্ছিস না। আর সবার প্রথমে তুই আমাকে তুমি করে ডাকা বন্ধ কর।”

“তুই করে বন্ধুদের ডাকে, প্রেমিকাদের তো তুমি বলেই সম্বোধন করে।”

“তোর এসব উদ্ভট কথাগুলো শুনলেই আমার রাগ উঠে যাই।”

নিবিড় মাথা নেড়ে বলল,
“আচ্ছা, আমি যাই। আজ তো পরীক্ষা শেষ। হয়তো এখন আর তোমার সাথে প্রতিদিন দেখা হবে না।”

কথাটি বলেই নিবিড় চলে গেল। আর মারিয়া নিবিড়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে ভাবলো,
“নিবিড় আমার কতো যত্ন নেয়। সবসময় আমাকে বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু মিস্টার বর আমাকে একটুও সময় দিতে চায় না। বরং আমার মনে হয় আমি জোর করেই তার সাথে কথা বলি। আমার বরটা কখন আমাকে নিবিড়ের মতো করে ভালোবাসবে? নাকি কখনোই বাসবে না!”

৫৪।

আজ প্রহর মারিয়াকে নিয়ে সাজেক যাচ্ছে। মারিয়া তো সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। তার আনন্দ যেন ঠিকরে পড়ছে। সে সাজেক গিয়ে কি কি করবে এ ব্যাপারে কয়েক বার মহুয়ার সাথে আলাপও করে ফেলেছে। এদিকে মহুয়া নিজ হাতে মারিয়ার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে। প্রহর ভাইয়া তোকে নিতে এসেছে।”

মারিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“চান্দু, তুই ব্যাগটা নিচে দিয়ে আয় তো।”

“আচ্ছা, আচ্ছা, যাচ্ছি।”

প্রহর নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল। আরিয়া ফেরদৌস মারিয়াকে বিদায় দিয়ে সকালেই অফিসে চলে গেছেন। মাহাথিও বাসায় নেই। মাফিন এখনই মারিয়াকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে অফিসে চলে যাবে। আর সূচনাকেও স্কুলে যেতে হবে। তবুও সূচনা প্রহরকে বাসায় আসতে বলেছিল, কিন্তু তাদের দেরী হয়ে যাবে তাই সে আর উপরে উঠে নি।

এদিকে মহুয়া মারিয়ার ব্যাগটি নিয়ে নিচে নেমে দেখলো, প্রহর মাফিনের সাথে গল্প করছে। মহুয়া প্রহরের সামনে এসে সালাম দিয়ে মারিয়ার ব্যাগটি এগিয়ে দিলো। মহুয়াকে দেখে প্রহরের বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো। সে কাঁপা হাতে ব্যাগটি গাড়িতে তুলে মহুয়ার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“মারিয়া কোথায়?”

“এইতো আসছে।”

“তুমি এতো কষ্ট করে ব্যাগটা নিয়ে নামতে গেলে কেন? আমিই না হয় আসতাম।”

এবার মাফিন বলল,
“আরেহ, ওটা সমস্যা না। মহুয়া তো মারিয়ার অর্ধেক কাজ নিজেই করে ফেলে।”

প্রহর কথাটি শুনে মনে মনে ভাবলো,
“মায়াবিনী, তুমি কতোই না মিষ্টি মেয়ে। হয়তো সবাই তোমার মতো মিষ্টি হয় না। যেই মানুষটি তোমাকে নিজের করে পাবে, সে অবশ্যই অনেক ভাগ্যবান মানুষ হবে। আর হয়তো আমি সেই ভাগ্যবান ছিলাম না।”

কিছুক্ষণ পর মারিয়া লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে চলে এলো। সে একটা ভারী কাজ করা লাল রঙের জামা পড়েছে। মুখে কৃত্রিম প্রসাধনী ব্যবহার করাই তাকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। কিন্তু তবুও প্রহরের দৃষ্টি যেন মারিয়ার দিকে পড়লোই না। মারিয়া মাফিন আর মহুয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িতে উঠে সে কিছুক্ষণ পর পর প্রহরের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু প্রহর অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। প্রহরের এমন খামখেয়ালি ভাবটা মারিয়ার মোটেও ভালো লাগছে না। তাই সে এবার নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কিছু বলছেন না যে?”

মারিয়ার কন্ঠ শুনে প্রহর বাস্তবে ফিরে এলো। সে পাশ ফিরে এক নজর মারিয়াকে দেখে আবার সামনে তাকিয়ে দেখলো কতো দূর এসেছে। এরপর আবার সোজা হয়ে বসে রইলো। মারিয়া আবার বলল,
“কিছু বলবেন না?”

প্রহর এবার ভ্রূ কুঁচকে মারিয়ার দিকে তাকালো। মারিয়া প্রহরের কপালে ভাঁজ দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“বলবেন না আমাকে কেমন লাগছে?”

প্রহর মুচকি হেসে বলল, “সুন্দর লাগছে।”

কথাটি বলে সে তার ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেল। মারিয়া প্রহরের এমন শুকনো উত্তর আশা করে নি। সে মলিন মুখে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো।

মারিয়া খুব আবেগী মেয়ে, আর অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় বিয়ে আর বর নিয়ে তার মধ্যে আলাদা উত্তেজনা কাজ করছে। যার ফলে বরের কাছ থেকে এমন শুকনো উত্তর পেয়ে সে শেষমেশ কেঁদেই দিলো। মুখে হাত দিয়ে মারিয়া তার কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। জীবনে কখনোই কারো কাছ থেকে অবহেলিত হয়ে সে কাঁদে নি। আজ প্রথম সে অবহেলা পেয়ে কাঁদছে। মারিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে আর তার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সেই পানিতে তার কাজল লেপ্টে চোখের নিচে নেমে গেছে।

গাড়ির জানালা বন্ধ থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই মারিয়ার ফুঁপিয়ে উঠার শব্দটি প্রহরের কানে চলে এলো। সে শব্দ শুনে সাথে সাথেই মারিয়ার দিকে তাকালো। কিন্তু মারিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে থাকায় প্রহর তার মুখটা দেখতে পাচ্ছে না। তবে সে নিশ্চিত মারিয়া কান্না করছে।

প্রহর ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাইয়া, সামনে একটু দাঁড়ান তো।”

ড্রাইভার গাড়ি থামানোর পর প্রহর তাকে কিছু টাকা দিয়ে বলল,
“পাশের দোকান থেকে দুইটা কেক, আর একটা বড় পানির বোতল নিয়ে আসুন।”

ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামার পর প্রহর মারিয়ার কাছে এসে বলল,
“তুমি কাঁদছো কেন?”

মারিয়া প্রহরের দিকে না ফিরে মাথা নাড়িয়ে বোঝালে সে কাঁদছে না। এবার প্রহর মারিয়ার দিকে ঝুঁকে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে দেখলো তার চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। মারিয়া সাথে সাথেই মাথাটি নিচু করে প্রহরের হাতটি সরিয়ে দিলো।

প্রহর এবার মারিয়ার একটি হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে বলল,
“কেউ কিছু বলেছে?”

মারিয়া না সূচক মাথা নাড়লো। প্রহর এবার মাথাটা আরেকটু ঝুঁকিয়ে মারিয়ার মুখটা দেখার চেষ্টা করলো, তখনই মারিয়া মুখ উঠিয়ে প্রহরকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।

প্রহর মারিয়ার এমন ব্যবহারে অবাক হয়ে বলল,
“তুমি এমন করছো কেন?”

মারিয়া এবার অভিমানী কন্ঠে বললো,
“আপনার তো আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আমিই তো জোর করে আপনার সাথে কথা বলি।”

মারিয়ার কথাটি শুনে প্রহর এবার বুঝলো সমস্যাটি কোথায় হয়েছে। সে মুচকি হেসে মারিয়ার গাল টেনে ধরে বলল,
“এটাই তাহলে অশ্রুপাতের কারণ!”

“হুম।”

“আচ্ছা, আমি দুঃখিত। এখন বলো, আমি তোমার সব কথা শুনবো।”

তখনই ড্রাইভার জিনিসগুলো নিয়ে চলে এলো। প্রহর প্যাকেট ছিঁড়ে একটা কেক বের করে মারিয়ার মুখের সামনে ধরে বলল,
“সাবধানে খেয়ো, নয়তো আবার রঙগুলোও খেয়ে ফেলবে।”

মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কিসের রং?”

প্রহর মারিয়ার ঠোঁটের দিকে ইশারা করলো। মারিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এটা লিপস্টিক। রং বললে কেমন শোনায় না? আর এই লিপস্টিক ওয়াটারপ্রুফ। তাই কোনো সমস্যা হবে না।”

প্রহর মাথা নেড়ে মারিয়ার কথাটি বুঝার চেষ্টা করলো। তারপর বলল,
“তুমি মারাত্মক পারফিউম ব্যবহার করো। মেয়েদের এতো বেশি সুগন্ধি লাগানো ঠিক না।”

“কেন?”

“ভালো না তাই।”

“কেন ভালো না?”

“এটা ছেলেদের আকর্ষণ করার একটা মাধ্যম। তুমি যখন নিচে নেমেছিলো তোমার পারফিউমের গন্ধে আমার নাকটা ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল।”

প্রহরের কথা শুনে মারিয়া হেসে বলল,
“নাক আবার ঝাঁঝরাও হয়? হুমম, তাহলে আমি তো দেখছি আপনার নাকের উপর অদৃশ্য বন্দুক চালিয়ে দিয়েছি। আর বরকে আকর্ষণ করানো কি খারাপ?”

“তুমি তো এখন বাইরে যাচ্ছো। আশেপাশে তো অনেকেই আছে। সবাই তো আর তোমার বর নয়।”

মারিয়া প্রহরের কথা শুনে আবার হাসলো। মারিয়ার খিলখিল করে হাসাটা প্রতিবারই প্রহরের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তবে এই দীর্ঘশ্বাস হতাশা বা আক্ষেপের নয়। এটা হয়তো স্বস্তির। তবে এই স্বস্তিটা সে কেন পাচ্ছে তা প্রহর নিজেও বুঝতে পারছে না।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here