#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৫৪:
৮৮।
প্রহরের ইদানীং সবকিছুই এলোমেলো লাগছে। মারিয়া কেন তার সাথে ঠিকভাবে কথা বলছে না এই প্রশ্নই তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। দু’দিন পরই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে মারিয়া বাসায় ফিরে আসে। মাসুমা আকতার মারিয়াকে দেখে বললেন,
“মারিয়া, সিয়ার বোনের বিয়েতে কি কি করলে? অনেক মজা করেছো, তাই না?”
মারিয়া আনন্দিত কন্ঠে বলল,
“মা, আমরা অনেক মজা করেছি। আপনাকে সব শুনাবো। কিন্তু বাসায় না। আমরা বিকেলে চা খেতে খেতে ছাদে বসে সিয়ার আপুর বিয়ের গল্প করবো। প্রিয়াও তো এখন নেই। ও আসলে আরো ভালো লাগবে।”
“আচ্ছা, তুমি তাহলে ফ্রেশ হয়ে এসো।”
মারিয়াও মুচকি হেসে রুমে চলে গেলো। মারিয়ার পুরোনো অভ্যাস কোথাও গেলে কি করেছে, কি খেয়েছে, কেমন লেগেছে, এসব বিষয় নিয়ে গল্প করা। আগে মহুয়ার সাথে গল্প করতো, এখন প্রিয়া আর শাশুড়ীর সাথে। তবে মাসুমা আকতার মারিয়ার কোনো কথায় বিরক্ত হোন না। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে মারিয়ার কথা শুনেন। তাই মারিয়া তো একদিন শাশুড়িকে বলেই ফেলেছিল,
“সবাই বলে মেয়েরা নাকি শাশুড়িকে বেশি ভয় পায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উলটো। আমি আমার মাকেই বেশি ভয় পাই।”
মাসুমা আকতার মারিয়ার কথা শুনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
“আমিও তো এখন তোমার মা। জানো, মেয়েরা কতো ভাগ্যবতী হয়! তাদের তো দু’টো মা থাকে। আর এক মা বকলে, আরেক মা তো আদর করবেই। দু’জনই একসাথে কেন শুধু শুধু বকবে, বলো!”
এদিকে মারিয়া গোসল করে একটা টি-শার্ট, আরেকটা ঢিলেঢালা সেলোয়াড় পরে রুম থেকে যেই না বের হতে যাবে, তখনই প্রহর রুমে ঢুকলো। প্রহরকে দেখেই মারিয়া বিছানায় থাকা উড়নাটা গায়ে দিয়ে আবার রুম থেকে বেরুতে যাবে, তখন প্রহর হুট করে মারিয়ার হাত ধরে ফেললো। মারিয়া নির্বিকার ভাব নিয়ে বলল,
“আপনার হাতটা হয়তো ভুলে আমার হাতের সাথে লেগে গেছে, একটু ছাড়িয়ে দিন। আমার ক্ষিধে লেগেছে, আমি খেতে যাচ্ছি।”
প্রহর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“তুমি নিজেই ছাড়িয়ে নাও। আমার এতো সময় নেই।”
মারিয়া এবার ভ্রূ কুঁচকে প্রহরের দিকে তাকালো। সে হাত ছাড়াতে গেলে প্রহর আরো শক্ত করে তার হাতটা ধরে রাখলো। মারিয়া বিরক্তির সুরে বলল,
“প্লিজ, এখন ছাড়বেন, নাকি মাকে ডেকে বলবো, যে আপনি অনর্থক আমাকে আটকে রেখেছেন!”
প্রহর ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “বলেই ফেলো।”
মারিয়া এবার রাগী দৃষ্টিতে প্রহরের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রহর কিছুক্ষণ পর মারিয়াকে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমার সমস্যাটা কি! আমার অনুমতি না নিয়ে তুমি সিয়ার বোনের বিয়েতে কেন গিয়েছিলে?”
মারিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“বিয়ের খাবার হজম হয়ে গেছে, আর আপনি এতোদিন পর পুরোনো কথা তুলছেন?”
“কারণ ওইসময় কথা শেষ হয় নি। তুমি আমাকে কিছু বলার সুযোগও দাও নি। হুট করে ব্যাগ গুছিয়ে চলে গিয়েছিলে।”
মারিয়া চুপ করে রইলো। প্রহর বলল,
“তোমাকে টি-শার্ট পরতে বারণ করেছিলাম।”
“আজকে বাবা বাসায় আসবেন না। উনি সকালে ঢাকায় গেছেন। এখনো কি আপনার সমস্যা আছে?”
প্রহর আর কিছুই বললো না। কারণ সে নিজেও জানে আজ বাবা বাসায় থাকবে না। কিন্তু তবুও মারিয়ার পরনে টি-শার্ট দেখে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। কারণটা কি সে প্রহরের টি-শার্ট পরে নি, তাই? প্রহর মনে মনে বললো,
“ও তো আগে আমার টি-শার্ট পরতো। কিন্তু এখন কেন পরছে না।”
প্রহরের হাত আলগা হতেই মারিয়া হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। আর এদিকে সে আলমারি খুলে তার টি-শার্টগুলো ভালোভাবে দেখতে লাগলো। কয়েকটা নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিয়েও দেখলো। কিন্তু তার মনে হচ্ছে না কোনো দুর্গন্ধ আসছে। তাহলে মারিয়া কেন তার জামা গায়ে দেয় না? প্রহরের ইচ্ছে করছে মারিয়াকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করতে! কিন্তু প্রশ্ন করার যৌক্তিকতাও পাচ্ছে না। এমন তো নয় যে সব বউ তার বরের জামা পরেই বসে থাকে। এটা মারিয়ার ক্ষেত্রেই হয়তো ব্যতিক্রম ছিল। আর এমন ব্যতিক্রম ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করার মতো অধিকার প্রহর এখনো অর্জন করে নিতে পারে নি, কারণ সে নিজেও মারিয়াকে এই ব্যাপারে বারণ করেছিল। এখন যদি সে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, তাহলে মারিয়া নিশ্চিত উত্তর দেবে,
“আপনার তো খুশি হওয়া উচিত। এটা তো আপনারই অপছন্দের ছিল। আপনিই তো বলেছেন আপনার জামাগুলো আমি পরে পরে ময়লা করে ফেলছি।”
প্রহর এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রেশ হতে চলে গেলো। এদিকে মারিয়া খাওয়া-দাওয়ার পর প্রিয়াকে নিয়ে শাশুড়ীর রুমে চলে এলো। তারা দু’জন মাসুমা আকতারের দু’পাশে শুয়ে রইলো। মাসুমা আকতার তার বিয়ের গল্প বলছিলেন। আর এদিকে প্রহর খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে এসে মারিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। অনেকক্ষণ পরও যখন মারিয়া আসছে না, তখন সে নিজেই রুম থেকে বেরিয়ে মারিয়াকে খুঁজতে লাগলো। শেষমেশ মায়ের রুমেই তাকে পেলো। প্রহর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“মারিয়া একটু এদিকে আসো।”
মারিয়া শাশুড়িকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।”
মাসুমা আকতার প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মারিয়া ঘুম। কি লাগবে প্রিয়াকে বল।”
প্রহর হনহন করে আবার রুমে চলে এলো। ইদানীং তার মেজাজটাও যখন তখন বিগড়ে যায়, আর সে এর জন্য একমাত্র মারিয়াকেই দায়ী করছে। এই মুহূর্তেও তার রাগে চেঁচামেচি করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু স্বভাবতই সে খুব শান্ত। আর হঠাৎ তার সাথে এই ব্যতিক্রমী স্বভাবটা যাবে না, তাই সে চুপচাপ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
বিকেলে প্রিয়া চুলায় চা বসিয়ে দিলো, আর মারিয়া পাকোড়া বানাতে লাগলো। দু’জনই রান্নাঘরে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। তাদের বিরামহীন কথা শুনে প্রহর রান্নাঘরে এসে রাগী কন্ঠে বলল,
“সেই কখন থেকেই ভ্যানভ্যান করছো। একটু চুপ থাকতে পারো না?”
মারিয়া সেই মুহূর্তে খুব মজার কথায় বলছিল। কিন্তু হঠাৎ প্রহরের মুখে এমন কথা শুনে তার মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে গেলো। সে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে আবার রান্নায় মনোযোগ দিলো। তবে প্রহর মারিয়ার সেই মলিন হাসিটা দেখে ফেলেছিল। আর এরপর থেকেই তার মনটা ছটফট করতে লাগলো। সে রুমে এসে ভাবতে লাগলো,
“মারিয়াকে ওভাবে বলা বোধহয় ঠিক হয় নি। ভালোই তো লাগতো ওর কথা শুনতে। কিন্তু সব গল্প প্রিয়ার সাথেই বা কেন করবে! আমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসেছি, অথচ ওর তো কোনো পাত্তায় নেই।”
মারিয়া পাকোড়া রান্নার পর প্লেটে সাজিয়ে নিলো। প্রিয়া তিন কাপ চা ট্রেতে নিয়ে এক কাপ চা ডায়নিংয়ে রেখে কিছু পাকোড়া প্লেটে তুলে দিতে দিতে প্রহরকে ডাকলো। প্রহর ডায়নিংয়ে বসতে বসতে বললো,
“তোরা বসবি না? মা কোথায়?”
“আমরা ছাদে বসবো। তোর তো আমাদের ভ্যানভ্যান শোনার ক্ষমতা নেই, তাই।”
“এসব কি প্রিয়া! মারিয়াকে ডাক।”
প্রিয়া কোনো উত্তর না দিয়ে ট্রে নিয়ে ছাদে চলে গেলো। এদিকে মারিয়া সিয়ার বোনের বিয়েতে কি কি করেছে তা বলতে লাগলো। আর প্রহর চুপিচুপি ছাদে উঠে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
মারিয়া বলল,
“মা, আন্টি তো বারবার আপনার কথায় বলছিলো। প্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ছিল, নয়তো ওকে তো টেনেটুনে নিয়ে যেতাম।”
প্রিয়া বলল,
“মারিয়া তুমি মহুয়াকে নিয়ে যাও নি কেন?”
“আরেহ ও কখনো যাবে না। ও এসব বিয়েতে যাওয়া তেমন একটা পছন্দ করে না। মানুষের ভীড়ে ও খুব ইতস্ততবোধ করে।”
“তাই নাকি! বাতিঘরে মানুষের ভীড় নেই?”
“আমি তো জানি না। আমি শুধু একবার গিয়েছিলাম। আমার ওখানে ভালো লাগে নি। সবাইকে দেখলে মনে হবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।”
“ভাইয়া কিন্তু ওখানেই যায়। মহুয়ার সাথে দেখা হয় না?”
প্রিয়ার কথা শুনে প্রহরের মুখ শুকিয়ে গেলো। সে প্রিয়াকে থামানোর জন্য তাদের দিকে এগিয়ে এলো। মারিয়া তখনই বলে উঠল,
“মহুয়া তো বলেছিল দেখা হয়।”
প্রহর মায়ের পাশে বসে বলল,
“কার সাথে দেখা হয়!”
প্রিয়া বলল,
“ভাইয়া তোর সাথে নাকি মহুয়ার দেখা হয়!”
“হুম, মাঝে মাঝে হয়। কেন?”
মারিয়া বলল,
“মাঝে মাঝে কোথায়! প্রায় প্রতিদিনই তো হয়।”
প্রহর ভড়কে গেলো। চেঁচিয়ে বললো,
“তোমাকে কে বলেছে প্রতিদিন হয়? আমার থেকে তুমি বেশি জানো নাকি!”
প্রহরের রাগী কন্ঠ শুনে মারিয়া শাশুড়ির দিকে তাকালো। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“মহুয়া বলেছিল আপনি প্রতিদিনই বাতিঘরে যান। ওর থেকেই শুনেছি। আমি তো জানতামও না আপনাদের দেখা হয়। ও তো আরো বলেছিল আপনি ওকে মাঝে মাঝে কবিতাও শুনান।”
এরপর মারিয়া প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনি নাকি অনেক ভালো কবিতাও লেখেন। মহুয়া অনেক প্রশংসা করছিল।”
প্রিয়া বলল,
“হ্যাঁ, ভাইয়া তো সেই স্কুল থেকেই কবিতা লিখতো।”
“তুমিও জানতে?”
“হ্যাঁ, সবাই জানে।”
মারিয়া মলিন দৃষ্টিতে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও তাহলে শুধু আমিই জানতাম না। আমি তো মহুয়ার কাছ থেকেই প্রথম জেনেছি।”
কথাটি বলে মারিয়া চায়ের কাপ আর পাকোড়ার বাটি ট্রেতে উঠিয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
“মা, আমি রেখে আসি এগুলো।”
মাসুমা আকতার মাথা নাড়লেন। এরপর মারিয়া যাওয়ার পর তিনি প্রহরের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“ছি! তোর মতো বেহায়া মানুষ আমি এই জীবনে একটাও দেখি নি।”
প্রহর স্থির দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমরা আমাকে ভুল বুঝছো।”
“তোকে আমার চেনা হয়ে গেছে। আমার তো মারিয়ার জন্য খারাপ লাগছে। মেয়েটা একটু হলেও তোর মনে কি চলছে তা আন্দাজ করতে পারছে। এখন শুধু সত্যটা পুরোপুরি জানা বাকী।”
প্রহর ভীত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও এসব কখনোই জানবে না। আমি ওকে কিছুই জানাবো না।”
মাসুমা আকতার তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“ছি! তোকে নিয়ে আমি একটা সময় গর্ব করতাম। আর এখন নিজের উপর ঘৃণা হয়, কেন তোর মা হয়েছি সেই দুঃখে।”
কথাগুলো বলে মাসুমা আকতার চলে গেলেন। তার পিছে পিছে প্রিয়াও ভাইয়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে গেলো। আর প্রহর সেখানেই স্থির হয়ে বসে রইলো। মহুয়ার প্রতি তার মনে একটা মায়া সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সে মহুয়াকে পাওয়ার আশা কখনোই করে না। কারণ সে জানে মহুয়াকে পাওয়া কখনোই সম্ভব না। তবে ইদানীং তার মনে মারিয়ার প্রতি আলাদা আকর্ষণ সৃষ্টি হচ্ছে। হয়তো সে আবার প্রেমে পড়েছে। কিন্তু সে এখনো বুঝতে পারছে না, কেন সে এই আকর্ষণ অনুভব করছে, যেখানে মারিয়ার কোনো স্বভাবই তার পছন্দের না। তাহলে কি ভিন্ন স্বভাবের মানুষের প্রেমে পড়া সম্ভব? না, এটা প্রেম নয়। এটা অন্যকিছু। কিন্তু সেটা কি তা প্রহর নিজেও জানে না।
চলবে-