রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৫৯:

0
831

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৫৯:

৯৬।
আজ মারিয়া আর মহুয়ার জন্মদিন। কিন্তু প্রহর মারিয়ার পরিবর্তে রাত বারোটায় মহুয়াকে কল করে শুভেচ্ছা দিয়েছে। মারিয়া সেই মুহূর্তে শুধু প্রহরের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কারণ তার আর কিছুই বলার মতো ভাষা ছিল না। আজ সারাদিন প্রহর মারিয়ার সাথে কোনো কথা বলে নি। বেশিরভাগ সময় বাইরেই ছিল। দু’একদিন নিবিড়ের সাথে বেশি বন্ধুত্ব রাখায় তাদের সম্পর্কের এই পরিণতি হয়েছে। কাল রাত বারোটায় নিবিড়ই সর্বপ্রথম মারিয়াকে শুভেচ্ছা দিয়েছিল, যা মারিয়া মোটেও আশা করে নি। প্রহরের স্থানটা নিবিড় এতো সহজে নিয়ে নিল!
মারিয়া রুম বন্ধ করে বসে আছে। তার মনে এখনো ক্ষুদ্র আশা আছে। সে ভাবছে হয়তো সন্ধ্যা নাগাদ কোনো সারপ্রাইজ পেয়ে যাবে। কিন্তু প্রহর তো একেবারে রাত ১ টায় বাসায় ফিরেছে। মাসুমা আকতার ছেলের কর্মকান্ডে প্রচুর বিরক্ত। বিয়ের পর মারিয়ার প্রথম জন্মদিন, কিন্তু তার বরের কোনো খোঁজ নেই।

এদিকে মারিয়া বাসায় ফোন করে জানতে পারলো, আজ মহুয়াও সারাদিন বাসায় ছিল না। প্রহর আর মহুয়া যে সারাদিন একসাথেই ছিল সে বিষয়ে তার আর কোনো সন্দেহ নেই।

এদিকে প্রহর রুমে ঢুকতেই মারিয়াকে মেঝেতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সে কাছে যেতেই মারিয়া উঠে বসলো। মারিয়ার চোখগুলো কাঁদতে কাঁদতে ফুলে গেছে। সে ঠিকভাবে চোখ দু’টি খুলতেও পারছে না। প্রহর কিছু বলতে যাবে মারিয়া বলল,
“কাল আমার জন্মদিন ছিল।”

প্রহর চুপ করে রইলো। মারিয়া উঠে দাঁড়ালো। আর কয়েক পা এগুতেই শরীরের ভার ছেড়ে দিতেই প্রহর ধরে ফেললো। মারিয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমি আপনাকে এতোদিন খুব বিরক্ত করেছি। আমি জানি, আমার সাথে থাকতে আপনার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু তবুও আপনাকে সহ্য করতে হবে। এখন আমি বাসায় ফিরে গেলে মা খুব কষ্ট পাবে। কারণ মা সারাজীবন বাবার জন্য অনেক কিছুই সহ্য করেছে। আমি মাকে বুঝাতে চাই না যে আমিও তার মতো মন্দ ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি। আর আমি নিজেকে মারতে পারবো না, কারণ আমার সেই সাহস এখনো হয় নি। আপনি আমাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করুন। আমি এতোদিন নিবিড়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছি, শুধু আপনাকে নিজের কাছাকাছি রাখার জন্য। আমি চেয়েছি, আপনি মহুয়ার চেয়ে আমাকে বেশি গুরুত্ব দেন। কিন্তু আপনি তো আমাকে কখনোই ভালোবাসেন নি। আপনি তো মায়াবতীকে ভালোবেসেছিলেন। আমার সাথে তো ভুল করে বিয়ে হয়েছিল।”

প্রহর স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো। সে এবার মারিয়াকে আরো শক্ত করে নিজের কাছে টেনে আনলো। মারিয়া এখনো বিড়বিড় করে কথা বলেই যাচ্ছে।

“প্রহর আমি প্রতিদিন অনেক আতংকে থাকি, মনে হয় হুট করে যদি আপনি মহুয়াকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন? মহুয়াকে আমি অনেক ভালোবাসি, আপনাকেও খুব ভালোবাসি। অন্য কোনো মেয়ে হলে আমি যুদ্ধ করে আমার বরকে নিজের করে নিতাম। কিন্তু মহুয়ার সাথে কিভাবে যুদ্ধ করবো? ও ছাড়া আমাকে কেউই বুঝে না। ছোট থেকেই মা কাজের জন্য বাইরেই ছিল, মহুয়াই ছিল আমার অনেক কাছের। আমি ওকে আমার শত্রু বানাতে চাই না। আমি চাই ও অনেক সুখী হোক। কিন্তু ও যদি আপনার সাথে সুখী হতে চাই, আমি কোথায় যাবো? মা আর ভাইয়ারা আপনাদের সম্পর্ক কখনোই মেনে নেবে না। তখন দেখা যাবে আপনার জন্য মহুয়ার সাথে সবার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। যদি আমি কখনো অনেক বড় রোগে আক্রান্ত হই, বা আমার এক্সিডেন্ট হয়, তবুও আমার মৃত্যুর পর মা আপনাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। কারণ আপনি তো বিবাহিত পুরুষ, আর মহুয়ার জন্য তো এর চেয়ে ভালো পাত্র আসবে। কিন্তু একটা উপায় আছে আপনাদের সবাইকে সন্তুষ্ট করার। যদি আমি আপনার সন্তানের মা হই, আর এরপর যদি মারা যাই, তখন মা হয়তো আমার বাচ্চার জন্য মহুয়াকে আপনার সাথে বিয়ে দেবে। তখন সবাই সুখী হবে!”

মারিয়ার কথা শুনে প্রহরের চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। কিন্তু সে কিছু বলতে পারছে না। তার কথাগুলো গলায় আটকে গেছে। কারণ কোনো ভাষায় আজ মারিয়াকে শান্ত করতে পারবে না।
মারিয়া আজ সারাদিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কান্নাকাটি করেছে। তাই তার শরীরে কোনো শক্তি নেই। তার চোখে এখন রাজ্যের ঘুম। সে ঘুমের ঘোরেই প্রলাপ বকছে,
“প্রহর, আমাকে শুধু কয়েক বছর ভালোবাসলেই হবে। এরপর আমি আর কাউকে বিরক্ত করবো না। আমি রোজ চাইবো আমার মৃত্যুতেই যেন সবার জীবনে সুখ আসে। প্লিজ, কয়েক বছর ভালোবাসবেন? আমি আপনার সাথে মারিয়া হয়ে বাঁচতে চাই। অনেকদিন তো মহুয়ার মতো নিজেকে সাজিয়েছি। শাড়ি পরেছি, চুড়ি পরেছি, বই পড়তে ভালো লাগে না, তবুও আপনাকে দেখানোর জন্য দু’টো বই শেষ করেছি। কিন্তু তাও আমি আপনার মায়াবতী হতে পারি নি। আমার জন্য আপনি একটা কবিতাও লিখলেন না। আমার অনেক খারাপ লেগেছে। কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই, কারণ দোষটা হয়তো ভাগ্যের। তবুও কয়েক বছর আমাকে ভালোবাসেন। আমার আপনার হাত ধরে পাহাড়ে উঠতে হবে, বরের সাথে কাশ্মির যাওয়াটা আমার পুরোনো স্বপ্ন। ওটাও পূরণ করতে হবে।”

প্রহর মারিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই সে অস্ফুটস্বরে কিছু বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু প্রহর আর ঘুমাতে পারে নি। সে মারিয়ার পাশে শুয়ে-বসে, টুসটুসীর ঘুমন্ত মুখ আর আকাশের তারাদের দেখে পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছে।

সকালে ঘুম ভাঙার পর মারিয়া দেখলো প্রহর তার আশেপাশে নেই। সে বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো প্রহর টুসটুসীর খাঁচার পাশে শুয়ে আছে। সে কাছে যেতেই প্রহরের ঘুমন্ত মুখটি দেখে ফুঁপিয়ে উঠলো। মারিয়ার ফুঁপিয়ে উঠার শব্দে প্রহর চোখ খুলে মারিয়াকে দেখে মারিয়ার সামনে দাঁড়াতেই সে বলল,
“আমি আজ থেকে প্রিয়ার সাথে ঘুমাবো। আপনি এভাবে বারান্দায় ঘুমাবেন না, প্লিজ।”

প্রহর কিছু বলতে যাবে মারিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“থাক, কিছু বলতে হবে না।”

কলিংবেলের শব্দ শুনেই মারিয়া রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বসার ঘরের কাছে আসতেই দেখলো মহুয়া এসেছে। প্রিয়া বলল,
“মারিয়া তো এই মাত্র উঠেছে। তুমি বসো।”

প্রহর রুম থেকে বের হয়ে মহুয়াকে দেখে ঘাবড়ে গেলো। সে মারিয়ার হাত ধরে বলল,
“আমি তোমার সাথে একটু কথা বলবো। এদিকে আসো।”

“পরেও বলতে পারবেন। আমি তো এতো তাড়াতাড়ি আপনাকে ছাড়ছি না। আরো অনেকদিন আমাকে সহ্য করতে হবে।”

“মারিয়া, তুমি যা জেনেছো সব অতীত ছিল। এখন মহুয়া আমার কাছে শুধুই তোমার বোন।”

“হ্যাঁ, তাই হয়তো আমাদের বিয়ের পরও আপনার মহুয়ার রূপ দেখে মায়া লাগতো। তার নাম রেখেছেন মায়াবতী। এতো মায়া মহুয়ার মাঝে! ছোট ভাইয়ার হলুদের দিন আপনি বাসায় এসে আমার বোনের শাড়ি পরা সৌন্দর্য কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন, কিন্তু আমার দিকে একবারো তাকান নি। চাঁদনি রাতে হঠাৎ দেখা কবিতাটি আপনি মহুয়াকেই শুনিয়েছিলেন, আমি তো আজ অবধি আপনাকে একটা কবিতাও বলতে শুনি নি। বাতিঘর আপনার প্রিয় স্থান, কারণ আপনি সেখানে গেলে মায়াবতীকে দেখেন। আর এদিকে বিয়ের পর থেকে আপনার বাসায় ফেরার অপেক্ষায় আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। সাজেক যাওয়ার আপনার কোনো ইচ্ছে ছিল না। শুধু বাধ্য হয়ে গিয়েছিলেন। আর এখন বলছেন অতীত? দু’সপ্তাহও হয় নি আপনাকে আর মহুয়াকে ফুচকার দোকানে দেখেছিলাম, এর আগেও আরো অনেক বার দেখা হয়েছিল আপনাদের। তাহলে আপনার অনুভূতি অতীত কিভাবে হলো? আমি বাতিঘরে গিয়ে জানলাম, আপনি প্রতিদিন নাকি মহুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ওখানে সবাই হয়তো আপনাদের প্রেমের সাক্ষী। আমি ওখানে গেলেই সব জেনে নিতে পারবো। কিন্তু আমি যাবো না। এখন যতোটুকু জেনেছি, সেটাই যথেষ্ট হয়েছে।”

“আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাবে, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।”

“আমি বুঝেছি। দোষ তো আমার। একটা কাজ করুন, আমাকে মেরে ফেলে আপনার প্রেমিকাকে বিয়ে করে নিন।”

“মারিয়া, ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি ও এসব জানেই না।”

“যাই হোক মহুয়া সকাল সকাল কেন এসেছে? নিশ্চিয় আমি সব জেনে গেছি, তাই আমাকে বোঝাতে এসেছে। কাল রাতে হয়তো বারান্দায় বসে বসে সব বলে দিয়েছেন।”

প্রহর চুপ করে রইলো। সে অপরাধ করেছে। বিয়ের পর মারিয়ার কাছে আসতে না পারলেও অন্তত মহুয়ার কাছ থেকে দূরত্ব রাখা উচিত ছিল। কিন্তু সে মহুয়ার মধ্যেই ডুবে ছিল। সে তার ভুল মেনে নিচ্ছে। কিন্তু এখন তো সে মারিয়ার সাথেই সুখী হতে চায়৷

মারিয়া বসার ঘরে এসে মহুয়াকে দেখে বলল,
“হঠাৎ কেন এসেছিস?”

মহুয়া মারিয়ার এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হলো। সে হাসিমুখে বলল,
“তোর সাথে দেখা করতে এসেছি।”

মারিয়া পেছন ফিরে একনজর তাকিয়ে বললো,
“উনি ভেতরেই আছেন। আর এতো ঘুরিয়ে কথা বলতে হবে না। আমি সব জেনে গেছি। এখন যা করার সামনা-সামনি কর। লুকোচুরি করলে ভালো দেখায় না।”

মহুয়া মলিন মুখে বললো,
“কি বলতে চাচ্ছিস!”

“সোজাসুজি বলছি, প্রহর রুমে আছে, দেখা করে আয়। কাল সারাদিন তোর সাথে সময় কাটিয়ে সারারাত তোকে নিয়েই স্বপ্ন দেখেছে।”

মহুয়া মারিয়ার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বলল,
“মারিয়া, তোকে জন্মদিনের উপহার দিতে এসেছি। আমি জানি না তুই কেন এমন করছিস! কিন্তু ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসে। তোর আর নিবিড়ের কথাবার্তা বলাটা উনি মেনে নিতে পারে নি।”

মারিয়া মহুয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি কারো সাথে কথা বললে উনার শরীর জ্বলবে, আর উনি যে বউকে ভুলে অন্য মেয়ের সাথে রংঢং করছে সেটা দেখে কি আমার শরীরে শীতল হাওয়া বইবে ভাবছিস? নাকি আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে তোদের রংঢং দেখবো!”

মহুয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমি বাসায় চলে যাচ্ছি। তোর জন্য উপহার এনেছিলাম। আমার সাথে তো কথাও বলিস না। ফোন দিলে কল কেটে দিস। কালকে বাসায়ও আসিস নি। প্রতিদিন এভাবেই কথা বলিস। মারিয়া, সন্দেহপ্রবনতা খুব খারাপ অভ্যাস। এটা ছেড়ে দে।”

মারিয়া প্যাকেট থেকে একটা বই বের করলো। বইয়ের নাম, ‘রংধনুর মাঝে।’ দেখলো বইয়ের উপরে লেখকের নামের জায়গায় লেখা, ‘নুসরাত মহুয়া।’ মারিয়া চমকে উঠে বলল,
“তোর নিজের বই?”

মহুয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। মারিয়া বইয়ের প্রথম পাতা উলটে দেখলো উৎসর্গে লেখা,
“আমার প্রিয় বোনু মারিয়া।”

মারিয়া মহুয়ার বই বের হয়েছে দেখে মনে মনে খুশি হলেও মুখে শক্ত ভাব রেখে বলল,
“ঘুষ দিচ্ছিস?”

মহুয়া অবাক দৃষ্টিতে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ঘুষ মানে!”

“এভাবে আমাকে পটিয়ে আমার বরকে নিয়ে ফেলতে চাইছিস? তুই অনেক চালাক। আমিই বোকা, তাই এতোদিন তোদের সম্পর্কটা সহজ ভাবে নিয়েছিলাম।”

প্রহর বসার ঘরে এসে মারিয়ার কথাগুলো শুনে কিছুটা রেগে গেলো। সে মারিয়ার হাত চেপে ধরে বলল,
“প্রিয়া ওদিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। বাসায় মা-বাবা আছে। তুমি আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো।”

এরপর মহুয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“মহুয়া, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। এখন অন্তত তুমি বাসায় যাও।”

মারিয়া নির্বিকার দাঁড়িয়ে প্রহরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মহুয়া চলে যাওয়ার পর প্রহর মারিয়ার হাত ধরে কিছু বলতে যাবে, তখন মারিয়া বলল,
“অন্তত এখন! তাহলে কি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে?”

প্রহর মলিন মুখে বললো,
“আমি ভুল করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

মারিয়া আর কিছু বললো না। সে শুধু প্রহরকে দূরে সরিয়ে দিলো। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে ভার্সিটির হোস্টেলে উঠে গেলো। যদিও হোস্টেলে সিট পাওয়া ওতো সহজ ছিল না। কিন্তু কিছুদিন আগেই একটি মেয়ে সিট ছেড়ে দেওয়ায় সে সহজে সিট পেয়ে গেলো। তবে মাসুমা আকতার মারিয়ার হোস্টেলে উঠার পক্ষে ছিলেন। তিনি ভাবছেন, আপতত মারিয়াকে দূরে রাখলেই প্রহর নিজেকে শুধরে নিতে পারবে। পাশে থাকলে প্রহর তার অপরাধটা অনুভব করতে পারবে না।
এদিকে মারিয়া তার মা আর ভাইদের বলেছে, পড়াশুনার চাপ থাকলে হোস্টেলে থাকবে, কারণ বাসায় মাঝে মাঝে প্রহরের আত্নীয়রা আসে, তাই পড়ালেখা হয় না। আরিয়া ফেরদৌস মেয়ের কথায় সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বললেন,
“চাপ থাকলে এখানেও চলে আসা যেতো।”

মারিয়া উত্তরে বলল,
“এখন বড় হয়েছি, আমার টুকটাক কাজগুলো সবার উপর চাপ ফেলবে। এখন ভাবীও অসুস্থ। মহুয়ার মতো সবকিছু সামলে চলার মতো সামর্থ আমার এখনো হয় নি। তাই ওখানে আসছি না। আর হোস্টেলে আমি নিজের মতোই চলতে পারবো। অন্য কাজের চাপ পড়বে না। বাসায় এসে বসে থাকলে সুন্দর দেখাবে না। ভাবী সুস্থ থাকলে আসতাম।”

আরিয়া ফেরদৌস মেয়ের কথা পুরোপুরি মেনে না নিলেও আংশিক মেনে নিয়েছেন। তাই আপতত হোস্টেলে উঠতে কোনো বাঁধা নেই।

চারমাস পর-

মাফিন ও স্বস্তিকার প্রথম বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে। আর স্বস্তিকা সেই শোকে পাথর হয়ে আছে। প্রথম বার মা হওয়ার অনুভূতিটা সে খুব উপভোগ করেছিল, কিন্তু তিন মাসে তার মিসক্যারিজ হয়ে গেছে। মাফিন স্বস্তিকাকে এ নিয়ে কোনো সান্ত্বনা দেয় নি। কারণ স্বস্তিকার অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরায় এর জন্য দায়ী। সে কনসিভ করেছে এটা শুনার পর থেকে হাঁটাচলা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিল, আর তার বাইরের খাবারের প্রতি ঝোঁকটা আগের চেয়েও বেশি বেড়ে গিয়েছিল। আর এসব ব্যাপারে মাফিনের কোনো ধারণায় ছিল না। মা অথবা, ভাবী পাশে থাকলে হয়তো কোনো পরামর্শ দিতে পারতো। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, হালকা ব্যায়াম আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত ছিল।

এদিকে মাহাথি ও সূচনার একটি ছেলে সন্তান হয়েছে। মাহাথি তাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। আর আহ্লাদী কন্ঠে বলছে,
“পুটুসটা একদম বাবার মতো হয়েছে।”

সূচনা মাহাথির হাত ধরে বলল,
“পুটুস না ওর নাম মায়াদ।”

মাহাথি বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, ছোট মিস্টারের নাম মায়াদ বিন মাহাথি রাখা হলো। কিন্তু বাবা তো তোমাকে পুটুস বলেই ডাকবে।”

এবার আরিয়া ফেরদৌস মায়াদকে কোলে নিয়ে কেঁদে দিলেন। আর সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমার দোয়া থাকবে, আমাদের মায়াদ যাতে সুস্থ থাকুক, আর তার বাবা-মার বাধ্য সন্তান হোক, এবং সবসময় তার বাবা-মার সাথেই থাকুক। একটা মায়ের কাছে এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কিছুই নেই।”

এদিকে মাফিনও মায়াদকে দেখতে হাসপাতালে এসেছে। আরিয়া ফেরদৌসও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সে মায়ের দিকে একবারো তাকায় নি। এরপর ভাতিজাকে কোলে নিতেই মাফিনের চোখ ছলছল করে উঠলো। সে সূচনাকে বলল,
“ভাবী, মায়াদকে বেশি শাসন করো না। নয়তো আবার হাত ফসকে বেরিয়ে যাবে।”

সূচনা বলল,
“মারা তো শাসন করবেই। কিন্তু ছেলে যদি চাচার মতো অভিমানী হয়, তাহলে হয়তো আফসোস করা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।”

মাফিন মাথা নিচু করে মায়াদকে মাহাথির কোলে দিয়ে বলল,
“মায়াদের ছোট ভাই অথবা বোন আসার খবরটা আর তোমাদের দিতে পারলাম না। দু’দিন আগে, আমাদের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে।”

আরিয়া ফেরদৌস ছেলের কথা শুনে তার হাত ধরে বললেন,
“তুমি স্বস্তিকাকে ফেলে এখানে কেন এসেছো?”

“বাবা হতে পারি নি, তাই বাবা হওয়ার অনুভূতিটা একনজর দেখতে এসেছি। তোমাদের সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস আমার নেই। আমি শুধু একসাথে দু’পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারছিলাম না, তাই একজনকে বেছে নিয়েছি। কিন্তু আমি তাও সুখে নেই। তোমাদের ছাড়া আমার ভালো লাগে না। নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একা। কিন্তু তবুও ভাবি, আমি থাকলে হয়তো বাসায় এখনো সেই ঝগড়াঝাঁটিই চলতো।”

আরিয়া ফেরদৌস ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“পৃথিবীতে সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব না। তাই হয়তো ছেলেরা প্রথমে মাকেই ভুলে যাওয়ায় উপযুক্ত মনে করে। একবার সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে না। এতো ভীতু হলে হয় না, বাবা।”

মাফিন মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো। তবে সে ফোনে মায়াদের একটা ছবি তুলে নিয়েছে। আর বাসায় আসার পর সেই ছবিটা স্বস্তিকাকে দেখানোর পর থেকেই তার কান্না যেন আরো বেড়ে গেছে। সে ছবিতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“আমি একজন মায়ের কাছ থেকে তার ছেলেকে আলাদা করেছি, তাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমার বাচ্চাকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়ে আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিয়েছে। আমি তো শুধু মাফিনকে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছি, মাফিনের সব মনোযোগ যাতে আমার দিকেই থাকে। কিন্তু আজ বুঝেছি, শুধু স্বামী থাকাটা যথেষ্ট নয়। শাশুড়ি, জা, ননদ সবার পাশে থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেই সময়ে আমি মায়ের শাসন শুনে নিজেকে শুধরে নিতে পারতাম, সেই সময়ে আমি একা একা নিজের মতো চলেছি। ভাবী পাশে থাকলে আমাকে অন্তত শিখিয়ে দিতো, কিন্তু আমি তো ভাবীর কথা মানতেই চাইতাম না। সবসময় তাকে শত্রু ভাবতাম। কিন্তু উনি আমাকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসতো। মহুয়া-মারিয়া ওদের সাথে গল্প করলে হয়তো আমি মানসিকভাবে সুস্থ থাকতাম। কিন্তু আমি তো টিভি দেখতেই ব্যস্ত থাকি। ভাবী ভাগ্যবতী, তাই তিনি সুখ নিজে অর্জন করে নিয়েছে। আর আমি নিজেই নিজেকে অসুখী করেছি। আমি ভুল করেছি। আমি আমার দোষে আমাদের বাচ্চাটা হারিয়ে ফেলেছি।”

স্বস্তিকার অশ্রু যেন আজ থামছেই না। সন্তান হারা মায়েদের আর্তনাদ হয়তো এমনই হয়। কেউ সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে হারায়, কেউ জন্ম দেওয়ার পর। কিন্তু সন্তানকে হারানোর যন্ত্রণা সবারই একই।

পরের দিন মাফিন স্বস্তিকাকে নিয়ে গেলো মায়াদের কাছে। স্বস্তিকা মায়াদকে কোলে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আর সূচনাকে বলল,
“ভাবী, আপনার বাবুটা মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। কি আদুরে ছেলেটার হাত-পা ভাবী! ভাবী আমি ওকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি?”

সূচনা মুচকি হেসে বললো,
“মায়াদের ছোট আম্মু কি এখন তার ছেলেকে কোলে নেওয়ার জন্য অনুমতি চাইবে? মায়েদের অনুমতি নিতে হয় না।”

স্বস্তিকা সূচনাকে জড়িয়ে ধরলো। সূচনার অপারেশন হওয়ায় এখনো ব্যথা যায় নি, স্বস্তিকা জড়িয়ে ধরতেই সে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। স্বস্তিকা সাথে সাথেই ছেড়ে দিয়ে ভীত কন্ঠে বললো,
“ভাবী, সরি। আমি খেয়াল করি নি। আমি যেখানেই যাই, গোলমাল বাঁধিয়ে ফেলি।”

সূচনা বলল,
“গোলমাল ছাড়া বাসাটা শূন্য শূন্য মনে হয়৷ মায়াদ আমাকে কি বলেছে জানো?”

“কি বলেছে?”

“ও নাকি ছোট আম্মু আর ছোট আব্বুর সাথেই বাসায় ঢুকবে।”

স্বস্তিকা মায়াদের হাতে চুমু খেলো। এরপর ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মায়াদকে তার বাবার বাসায় আনা হলো। আর ছোট অতিথির আগমনে ঘরের ছেলেও তার বউকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছে। এরপর স্বস্তিকা আরিয়া ফেরদৌসের কাছে ক্ষমা চাইলো। তিনিও ক্ষমা করে দিলেন। মাফিনও তার পরিবার ফিরে পেয়ে খুব খুশি। আরিয়া ফেরদৌস নিজের গুছানো সংসারটি দেখে হাসলেন। তিনি হেরে যান নি। সৃষ্টিকর্তা হয়তো পরীক্ষা নিয়েছিলেন। আর সেই পরীক্ষার সময় ফুরিয়েছে। কারণ আজ বহু কষ্টের পর তার জীবন ধূসর রং ত্যাগ করে বিচিত্র রং ধারণ করেছে। যেই বিচিত্র রঙের মধ্যে আছে বেগুনির স্পর্শ, যেটি তার কষ্ট করে চারটা সন্তান মানুষ করার সাক্ষী। সেই জীবনে আছে নীল রঙের স্পর্শ, যেটি তাকে মাহাথির মতো অনুগত সন্তান পাওয়ার অনুভূতি দিয়েছে, কখনো বা প্রকাশ করেছে তার সব হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। তার জীবনে সবুজ রঙের স্পর্শ তাকে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করেও মা হওয়ার অনুভূতি দিয়ে আরেকবার বেঁচে থাকার আশা দেখিয়েছি। আর হলুদের স্পর্শ তাকে কিছু প্রিয়জন দিয়েছে যাদের পাশে থাকা, আর ভালোবাসা ছাড়া হয়তো তার জীবনটা কখনোই সুন্দর হতো না। কারণ ভালোবাসা ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। যেখানে লাল রঙের স্পর্শে তার জীবনটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল, আজ সেই জীবনে কমলা রঙের স্পর্শে আরিয়া ফেরদৌস একজন সফল মা আর একজন সফল নারী। তার জীবনটা রংধনুর মতোই সকল অনুভূতির স্পর্শে প্রস্ফুটিত।

জীবনে শুধু একটা দিক পেয়ে সুখী হওয়া যায় না। প্রকৃত সুখী তো তারাই যারা সুখী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে, চেষ্টা করেছে, ধৈর্য ধরেছে, তার পর সফল হয়েছে।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here