রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৬০ (অন্তিম পর্ব):

0
1418

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৬০ (অন্তিম পর্ব):

৯৭।
হাসপাতালে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে মারিয়া। আর মারিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহুয়া। মাসুমা আকতার এক পাশে স্থির হয়ে বসে নিরবে কাঁদছেন। আরিয়া ফেরদৌস তার পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রিয়াও একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আর খালেদ সাহেব, মাহাথি ও মাফিন রক্তের জন্য এদিক-ওদিক ছুটছে। প্রহরকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। গতকাল সে বাইক চালানোর সময় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল। এরপর ঘটনাস্থলে থাকা একজন লোক তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আর তিনিই প্রহরের ফোন থেকে মাসুমা আকতারকে কল দিয়ে হাসপাতালের ঠিকানা দিলেন। এরপর থেকে সবাই হাসপাতালে। এরপর প্রহরের শারীরিক পরীক্ষা করে বোঝা গেলো, বাইক চালানোর সময় সে হার্ট এট্যাক করেছিল। তাই বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে।

এদিকে কাঁদতে কাঁদতে মারিয়ার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কারণ আজ তার জন্যই প্রহরের এই পরিণতি। চারমাস ধরে সে হোস্টেলে থাকছে। আর এই চারমাসে সে শ্বশুড়বাড়ি এলেও প্রহরের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চলছে। কিন্তু প্রহর এসব মানতে পারছে না। সে অনেক চেষ্টা করেছে মারিয়াকে তার অনুভূতির কথা বোঝানোর। কিন্তু মারিয়া ভাবছে, সত্যটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই প্রহর এখন তার যত্ন নেওয়ার অভিনয় করছে। মারিয়া হোস্টেলে থাকলে প্রহর প্রতিদিনই অফিস শেষে মারিয়ার ক্যাম্পাসে গিয়ে তাকে ফোন করে নিচে আসতে বলতো শুধু একনজর তাকে দেখার জন্য। মারিয়া মাঝেমাঝে প্রহরের অনুরোধে নিচে নেমে আসতো আর তখন প্রহর তাকে দূর থেকে দেখে চলে যেতো। কিন্তু বেশিরভাগ সময় মারিয়া লুকিয়ে লুকিয়ে প্রহরকে দেখতো, আর বলতো, তার পক্ষে নিচে নামা সম্ভব না। তখন প্রহরের মলিন মুখটা দেখে তার অনেক খারাপ লাগতো।

প্রহর শেষ চার মাসে একদম পালটে গেছে। সে আর আগের মতো নেই। সে এখন আর টুসটুসীর খেয়াল রাখে না। খাঁচাটা প্রিয়ার বারান্দায় রেখে এসে বোনকে বলেছিল,
“এদের আদর-যত্ন করার মতো আমার আর কোনো শক্তি নেই। যেদিন আমি আমার প্রিয় মানুষটির যত্ন নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবো, সেদিন এদের দায়িত্ব নেওয়ার চিন্তা করবো।”

প্রিয়া সেদিন শুধু ফ্যালফ্যাল করে ভাইয়ের বিধ্বস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রহর অনেকদিন তার প্রিয় বইগুলো ধরে নি, আকাশের চাঁদ দেখে নি, বাতিঘরে যাওয়া তো বহুদূর। সে অফিস থেকে মারিয়ার ক্যাম্পাসে চলে যায়। আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে, মারিয়াকে ফোন করে, আর মেসেজ দেয়। আর দিনশেষে হতাশা নিয়ে বাসায় ফেরে।
অসম্ভব যন্ত্রণায় সে দিন কাটাচ্ছিল। পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না। তারা নাকি খুব শক্ত মনের হয়। তাহলে সে কেন এতো দুর্বল হয়ে পড়ছে? হয়তো নিজের ভুলে মারিয়াকে হারানোর ভয়ে তার এই দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে৷ সে অনুভব করতে পারছে, ঠিক এভাবেই সে দিনের পর দিন মারিয়াকে অবহেলা করেছিল। মারিয়ার ফোন রিসিভ করতো না, আক্দের পর মারিয়া অনেকবার তার সাথে এখানে-ওখানে দেখা করতে চেয়েছিল, কিন্তু সে কাজের বাহানা দিয়ে যায় নি। আর আজকে সেই স্থানে সে নিজেই। মারিয়া এখন পড়াশোনার বাহানা দিয়ে তার সাথে দেখা করে না।

মানুষের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তারা যা চায়, তা না পেলে হয়তো জোর করে আদায় করে নেবে, নয়তো তা পাওয়ার আশায় রাত-দিন ছটফট করবে। কিন্তু প্রহরের জন্য এটি মানসিক চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে সে এখন লাইফ সাপোর্টে।

গতকাল রাত থেকে মারিয়া, মাসুমা আকতার আর খালেদ সাহেব হাসপাতালে আছেন। বাকীরা আজ সকালে এসেছে। এরপর মাহাথি দুপুরের দিকে মারিয়া, মহুয়া এবং প্রিয়াকে তাদের বাসায় নামিয়ে দেয়। যদিও মারিয়া হাসপাতালেই থাকতে চাইছিল। কিন্তু মাসুমা আকতার জোর করেই পাঠিয়ে দিলেন।

মারিয়া ঘরে এসে প্রহরের জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলো। সে কিছুক্ষণ প্রহরের শার্ট আঁকড়ে ধরে কান্নাকাটি করলো, এরপর তার বইগুলো বুকের সাথে চেপে ধরে মেঝেতে বসে রইলো। অনেকক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর সে নিজের গালে নিজেই চড় খেতে লাগলো, আর পাগলের মতো কান্নাকাটি করতে লাগলো। মহুয়া শব্দ শুনে রুমে আসতেই মারিয়া চেঁচিয়ে বলল,
“যা এখান থেকে। তুই কখনো আমার সামনে আসবি না। তোর জন্য আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। তোকে কতোবার বলেছি, প্রহরের কাছ থেকে দূরত্ব রাখতে, কিন্তু তুই ইচ্ছে করেই আমার কথা শুনিস নি। কারণ তোর প্রহরকে ভালো লাগতো।”

মহুয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। মারিয়ার কথা মিথ্যে না। সে প্রহরের প্রতি দুর্বল ছিল। কিন্তু সে এতোদিন মনকে বুঝিয়েছে এটি শুধুই বন্ধুত্ব। হয়তো তার প্রথম কোনো ছেলের সাথে এতো কথাবার্তা হয়েছে, তাই এমন অনুভব হয়েছিল। কিন্তু না, এই অনুভূতি বন্ধুত্বের নয়। এটি অন্যরকম ভালো লাগা। মহুয়া প্রহরকে পছন্দ করতে শুরু করেছে, এটা সে প্রহরের সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখার পর থেকেই বুঝেছে। চার মাস আগে মহুয়া বইটি মারিয়াকে দিয়ে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রহরের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথায় বলবে না। আর এরপরই প্রহরের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো ভেবে তার খারাপ লাগা শুরু হয়। সে নিজে প্রহরকে ফোন না দিলেও ভেবেছে প্রহর তার সাথে কথা বলবে, কিন্তু প্রহর তো মারিয়ার মাঝেই ব্যস্ত ছিল। আর এরপর থেকেই মহুয়া প্রতিদিন প্রহরকে ভুলে থাকার চেষ্টায় একটার পর একটা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে গেছে। কিন্তু আজ মারিয়ার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে তার নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। সে কিভাবে পারলো মারিয়াকে এতো কষ্ট দিতে?

অনুভূতির উপর কারো জোর নেই। সেটি ভালো হোক বা খারাপ হোক, তাই হয়তো পৃথিবীতে এতো নিয়ম, এতো আইন, এতো অনুশাসন। এই নিয়মের বিরুদ্ধে গেলে একের পর এক সংসার ভেঙে যেতো, আইনের বিরুদ্ধে গেলে একের পর এক মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যেতো, আর অনুশাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষ সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতো। মহুয়ার অনুভূতি নিয়ম এবং অনুশাসনের বিরুদ্ধে। আর সে তো শুধু অনুভবই করেছে। তার সেই অনুভূতি প্রকাশ করার সাহস নেই। কারণ সে নিজেই তার মায়ের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।

মারিয়া প্রহরের দেওয়া জিনিসগুলো নিয়ে বসে আছে, তাদের বিয়ের শাড়ি ও গহনা, প্রহরের দেওয়া চুড়ি, মেকাপ বক্স, শাড়ি, গাজরা, জুতো, কানের দুল আর চকোলেটের খালিবক্সগুলো। চকোলেট শেষ হয়ে গেলেও মারিয়া বক্সগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। জিনিসগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েই প্রহরের ড্রয়ারে একটা চাবি পেলো। সে চাবিটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো, “চাবিটা কিসের?”

মারিয়া কি ভেবে উঠে দাঁড়ালো। এরপর সে কাঠের আলমারীটি খুলে তাকের নিচে বন্ধ ড্রয়ারে চাবিটি ঘুরাতেই দেখলো ড্রয়ারটি খুলে গেছে। মারিয়া ড্রয়ার খুলে অবাক হয়ে গেলো। কয়েকটা শাড়ি আর কিছু জামা, আরো কিছু ছোট ছোট বক্স সাথে কিছু চিরকুট। মারিয়া তাড়াতাড়ি রুম বন্ধ করে, পুরো ড্রয়ারটি টেনে বের করে মেঝেতে রাখলো। তারপর ড্রয়ারে থাকা জিনিসগুলো দেখতে লাগলো।

প্রথম চিরকুটে লেখা,
“তোমার কাজল টানা চোখে, আমি অদ্ভুত মায়া দেখেছি। আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। হয়তো তোমায় ভালোও বেসে ফেলেছি।”

মারিয়া প্যাকেটটি খুলে দেখলো সাদা, লাল, নীল, গোলাপী, সবুজ আর কালো রঙের কয়েকটা ব্রেন্ডের কাজল। মারিয়া পরের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে দেখলো উপরে লেখা,
“টিপ পরলে তোমাকে আশালতা মনে হয়।”

আরেকটি প্যাকেটে তিনটি শাড়ি একসাথে আছে। একটি নীল, ও আরেকটি বাদামী বর্ণের সুতির শাড়ি, আর অন্যটি সোনালি রঙের সিল্কের শাড়ি। প্রতিটি শাড়ির সাথে একেকটি চিরকুট। প্রথম শাড়ির চিরকুটে লেখা,
“তুমি শাড়ি পরতে পারো না, কিন্তু আমি তোমাকে রোজ গুছিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিতে চাই।”

দ্বিতীয়টাতে লেখা,
“যেদিন বিয়ের ফটোশুট করছিলে, আমি হয়তো সেদিন তোমার শাড়ি পরা রূপের প্রেমে পড়েছিলাম।”

তৃতীয়টিতে লেখা,
“এই শাড়িটা সেদিন পরবে যেদিন আমরা দ্বিতীয়বার সাজেক যাবো। প্রথম বার আমি তোমাকে যেই ভালোবাসা দিতে পারি নি, এখন তার সবটা দিতে চাই। আমি তোমাকে প্রথম থেকে অনুভব করতে চাই। হঠাৎ তোমার প্রতি আমি এতো দুর্বল হয়ে যাচ্ছি কেন বলো তো!”

এরপর আরেকটি প্যাকেটে দুইটা টি-শার্ট, একটা শর্ট টপস, আর একটা মিনি স্কার্ট। মারিয়া অবাক হয়ে কিছুক্ষণ জামাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। প্যাকেটের উপর আরেকটা চিরকুট। সেখানে লেখা,
“তুমি প্রথমবার আমার সামনে যখন ছোট ছোট ড্রেস পরেছিলে, আমি খুব ইতস্ততবোধ করেছিলাম। কারণ আমার দৃষ্টিতে এগুলো অস্বাভাবিক। তবে এগুলো যতোই অস্বাভাবিক হোক, আমি জানি তোমার খুব ভালো লাগে। তুমি যখন রাতে আমার পাশে শুয়ে ফোনে এসব জামার ছবি দেখতে, আমি তখনই বুঝেছিলাম, তোমাকে সাজাতে হবে তোমার পছন্দমতো। তবে জামাগুলো শুধু আমার সামনেই পরার অনুমতি আছে। আর কোথাও কিন্তু না। মারিয়া, তুমি শুধু আমার সামনেই সেজেগুজে থেকো, কেমন?”

এরপর আরো কয়েকটি প্যাকেটের মধ্যে বিভিন্ন রঙের লিপস্টিক, ব্রেসলেট, রিং, আর সেই সাদা শাড়িটা। মারিয়া সেটি হাতে নিয়ে শেষ চিঠিটি খুললো। সেখানে লেখা আছে,
“আমি না চাইতেও হয়তো তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু এখন আমি তোমার যত্ন নেবো। খুব যত্ন নেবো। বিয়ের পর ভালোবাসা এতো চমৎকার, সেটা তোমাকে বিয়ে না করলে আমি কখনোই অনুভব করতাম না। তোমার খিলখিল করা হাসির শব্দ, উদ্ভট সব কথাবার্তা, অনর্থক আয়নার সামনে নিজেকে দেখে যাওয়া, হুটহাট আমাকে জড়িয়ে ধরা, তোমার মুখে মিস্টার বর ডাক শুনা, তোমার তুমি করা বলা, আমার জামা পরে বসে থাকা, ঘুমের ঘোরে হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করা, এসব আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। ইদানীং এসব কমে যাচ্ছে। আমি আমার মারিয়াকে ফিরে পেতে চাই। তুমি কোথায় হারিয়ে গেছো? তুমি কি আমার কাছে আবার ফিরে আসবে আগের মতো? আজ তোমার জন্মদিন। তবে এই জন্মদিনের উপহারগুলো আমি একমাস ধরে কিনেছি আর সাজিয়েছি। মারিয়া, তুমি কি আমার সাথে কাল থেকে নতুন সকাল দেখবে?”

মারিয়া চিঠিটি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আর বললো,
“আল্লাহ, একটা সুযোগ দাও আমাকে। আমি কি পেয়ে আবার হারিয়ে ফেলবো? সবাই বলে লাইফ সাপোর্ট থেকে খুব কম মানুষই ফিরে আসে। ওই কম মানুষের মধ্যেই যাতে আমার প্রহর থাকে। আমি ওকে আবার ফিরে পেতে চাই। আমি আমার বরকে আর কষ্ট দেবো না।”

দুইদিন পর প্রহরের জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয় নি। এদিকে মারিয়াকে পাশে দেখে প্রহর চাপ মুক্ত হয়েছে। মারিয়াও সারাক্ষণ প্রহরের পাশেই ছিল।

বারো দিন পর প্রহরকে বাসায় আনা হলো। সে এখনো দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারছে না। খালেদ সাহেবই ছেলেকে সাহায্য করছেন। মারিয়া শুধু তাকে খাইয়ে দেওয়া আর জামা-কাপড় পালটে দেওয়ায় সাহায্য করছে। মাঝ রাতে প্রহরকে ওয়াশরুমে নিতে গেলে হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয়, আর বিছানা থেকে হুইল চেয়ারে তাকে বসাতে গিয়ে মারিয়ার গলার পানি শুকিয়ে যায়। মাঝে মাঝে প্রহর নিজেই চেষ্টা করতে গিয়ে হাতে চাপ পড়াই হাতের ব্যথা আরো বেড়ে যায়। আর মারিয়া খালেদ সাহেবকে মাঝরাতে ঘুম থেকে জাগাতে অনেক ইতস্ততবোধ করে। কিন্তু মাঝে মাঝে প্রিয়া এসে মারিয়াকে সাহায্য করে। আর এভাবেই মারিয়া আর প্রহরের ভালোবাসা নিরবে গভীর হতে থাকে।

অন্যদিকে মাফিনের কলেজ বন্ধু আইনুল ইহসান হুট করে মহুয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেই। ইহসান সুদর্শন না হলেও খুব ভদ্র ছেলে, আর ডাক্তারি পড়াশুনাও শেষ করে ফেলেছে। মাফিনের প্রস্তাবটি পছন্দ হয়। কারণ সে ইহাসানকে ভালোভাবে চেনে। মহুয়ার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত হয়তো আসবে না। আরিয়া ফেরদৌসও ছেলের যোগ্যতা দেখে রাজী হয়ে যান। ইহসানের বাবা নেই, দুই ভাইয়ের পর সে শেষ সন্তান। আর বিয়ের পর সে মা আর স্ত্রীকে নিয়ে নিজস্ব ফ্ল্যাটে উঠবে। তাই মহুয়া সুখে থাকবে সেই চিন্তা করে মাহাথিও সম্মতি দিয়ে দেয়।
এরপর ইহসানের মা আর ভাবীরা মহুয়াকে দেখে গেলো। তাদের মহুয়াকে পছন্দ হয়েছে, আর সেদিনই রিং পরিয়ে দিলো। এদিকে মহুয়া মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালো। সে প্রহরের প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলো। আর সেই মুহূর্তে তার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায় ছিল বিয়ে। আর হয়তো আল্লাহ তার ইচ্ছেটা পূরণ করেছে। তাই সেও বিয়েতে রাজী হয়ে গেলো।

৯৮।

প্রহর এখন মোটামুটি সুস্থ হয়েছে। এখন আর হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয় না। দেয়াল ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে পারে। তবে তাকে ক্রাচ ব্যবহার করতে হয়। সে কাল থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। সরকারী চাকরী হওয়ায় সে বেঁচে গিয়েছিল। নয়তো এতোমাসের ছুটি তাকে সহৃদয়বান কোনো বসই দিতো। আজ অফিস থেকে ফিরে সে চুপচাপ নিজের ঘরে বসেছিল। মারিয়া তার সাথে এখন অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আগের মতোই হাসে, কথা বলে, অধিকার দেখায়। কিন্তু তবুও তার অস্থিরতা আর অপরাধবোধ কমছে না। সে মারিয়া আসার আগেই ড্রয়ারটি খুলে মারিয়ার জন্য কেনা সব উপহার বিছানায় সাজিয়ে রাখলো। মারিয়া রুমে এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রহর ক্রাচে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“এগুলো তোমার জন্মদিনে দেওয়ার জন্য কিনেছিলাম। কিন্তু ওইসময় তুমি নিবিড়ের সাথে খুব যোগাযোগ রাখতে, রাত-দিন ফোনে হেসে হেসে কথা বলতে, আমি তখন জানতাম না তুমি আমাকে দেখানোর জন্য এমন করতে। আমি ভেবেছিলাম, আমার অবহেলা পেয়ে হয়তো তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছো। অনেক রাগ হয়েছিল। মনে মনে ভাবতাম, মারিয়ার কি এতোটুকু ধৈর্য ছিল না? আমাকে কি একটু সময় দেওয়া যেতো না? তাই রাগ করে আর উপহারগুলো দেই নি। তবে আমি ভুল ছিলাম। তোমার মতো ধৈর্যশীল মেয়ে, আমি একটাও দেখি নি। মারিয়া, আমরা কি আরেকবার আমাদের সম্পর্কটাকে সুন্দর করার চেষ্টা করতে পারি না? আমাকে কি তোমার মিস্টার বর হওয়ার সুযোগ দেবে?”

মারিয়া ধীরে ধীরে প্রহরের কাছে এসে তাকে আস্তে করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার প্রেম-ভালোবাসায় কোনো আকর্ষণ ছিল না। আমার স্বপ্ন ছিল শুধু ট্রাভেল করা। কিন্তু বিয়ের পর আমি তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলি।”

প্রহর মারিয়ার মুখে তুমি ডাক শুনে একহাত দিয়েই তাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মারিয়া আনন্দিত কন্ঠে বললো,
“দাঁড়াও, সরি বসো। আমি দেখি আমার মিস্টার বর আমার জন্য কি এনেছে।”

মারিয়া উপহারগুলো আগে দেখে ফেললেও, প্রহরের সামনে সে তা প্রকাশ করলো না। সে একটার পর একটা চিরকুট দ্বিতীয়বার পড়ছে আর হাসছে। এদিকে প্রহর ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মারিয়া হেসে বলল,
“এভাবে কি দেখছো? আমাকে কি বেশি সুন্দর লাগছে?”

“দেখছি, তুমি খুব সুন্দর অভিনয় করো।”

“মানে?”

“তোমার হাসি দেখে বুঝায় যাচ্ছে, তুমি এগুলো আগে দেখেছ।”

মারিয়া প্রহরের কাছে এসে বলল,
“শুনো, আগে দেখলেও এই অনুভূতিটা আলাদা। এখন তুমি আমাকে দেখে বুঝতে পারবে, তোমাকে পেয়ে আমি কতো খুশি। এরপর আমাকে ছেড়ে আরেক জায়গায় তোমার মন দেওয়ার আগে, আমার এই হাসিটাই মনে পড়বে। আর তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাবে।”

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারিয়ার হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে আবদ্ধ করে বলল,
“আমি কখনোই তাকে ভালোবাসি নি। আমার মনে শুধুই তার প্রতি মায়া ছিল। আর আমি মায়া ভালোই কাটিয়ে উঠতে পারি। বরং পেরেছিও। কারণ মায়া কাটানোর জন্য মায়াবী কোনো অস্তিত্বের প্রয়োজন। তুমি তো আমাকে মায়ার সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছো। আর বিয়ে এমন একটা পবিত্র সম্পর্ক, যেখানে সৃষ্টিকর্তায় মায়া ঢেলে দেন। আর এর প্রমাণ হলো, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

মারিয়া মুচকি হেসে বললো,
“তাহলে এখন থেকে আমাকে শাড়ি পরিয়ে দেবে, সাজিয়ে দেবে, আর ভাতও খাইয়ে দেবে।”

প্রহর চোখ বড় বড় করে বলল,
“প্রতিদিন!”

“প্রতিদিন না মাঝে মাঝে খাইয়ে দিলেই হবে। আর শুনো আমরা একসাথে ঘুরতে যাবো।”

“হুম, আগামীকাল তোমার পাসপোর্ট তৈরী করতে যাবো। এরপর খুব শীঘ্রই আমরা দু’জন তোমার ড্রিম প্লেইস কাশ্মিরে যাচ্ছি।”

এদিকে মারিয়া মহুয়ার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে এই খবর পেয়ে তার সাথে দেখা করতে গেলো। মারিয়াকে দেখে মহুয়া জড়িয়ে ধরলো। মারিয়া তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই তো প্রহরকে ভালোবাসিস তাহলে আরেকজনকে বিয়ে করছিস কেন?”

মহুয়া মারিয়ার হাত ধরে বলল,
“এভাবে বলিস না। আমি তো ভাইয়ার সাথে আর যোগাযোগও করি না। আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি বুঝতেই পারি নি, প্রহর ভাইয়ার সাথে কথাবার্তা বলাটা তোদের সম্পর্কে এতো প্রভাব পড়বে।”

“তুই তো উনার সাথে রাত জেগে কথা বলতি। এখন বলিস না যে! দেখাও করিস না হয়তো। আগে তো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতি।”

“ভাইয়ার সাথে আমি রাত জেগে কথা বলি নি। ভাইয়া ওই সময় তোকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান করছিল। আমার সাথে একদিন হুট করে শপিংয়ে দেখা হয়ে গেলো। আমি গিয়েছিলাম, ভার্সিটির প্রোগ্রামের জন্য শাড়ি কিনতে। তুই তো জানিস আমাদের ক্যাম্পাসে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল!”

“হ্যাঁ, তুই সবুজ শাড়ি পরেছিলি।”

“হ্যাঁ, ওইদিন ভাইয়া তোর জন্য শাড়ি কিনতে গিয়েছিল। সেদিন সৌজন্যতার খাতিরে আমার শাড়ির টাকাটা উনি দিয়ে দিয়েছিল। অনেকবার আমাদের দেখা হয়েছিল, কিন্তু আমাদের কথার বিষয় সবসময় তুই ছিলি। ভাইয়ার পরিচিত প্রকাশনী ছিল, তিনি আমাকে বই ছাপাতে সাহায্য করেছিল। আর আমি তাকে তোর পছন্দের জিনিসগুলো খুঁজে দিতাম, বাকীটা উনি নিজের পছন্দে কিনেছিল।”

“তুই সত্যিই প্রহরকে ভালোবাসতি না?”

মহুয়া কান্নাভেজা চোখে মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি এখন তোকে কিভাবে প্রমান দিলে তুই বিশ্বাস করবি?”

“আমি তোকে বুঝি, চান্দু।”

মহুয়া মারিয়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। মহুয়া বলল,
“আমি আমার বোনকে হারাতে চাই না। আমি তোর কাছে আমার মারিয়াকেই ফিরে পেতে চাই, যেই মেয়ে আমার সাথে হাসতো, কথা বলতো, সবকিছু শেয়ার করতো। এভাবে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ আমাকে মুক্তি দে।”

মারিয়া মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“চল, আজ থেকে আমরা অতীত ভুলে সব আগের মতো শুরু করি, একদম প্রথম থেকে। যখন আমাকে মায়ের পেট থেকে বের করে তোর পাশে শুইয়ে দিয়েছিল, আর আমরা দু’জন একসাথেই কেঁদে উঠেছিলাম। এরপর একসাথে হেসেছি, খেলেছি। জানিস সবার কাছে বিয়ের আগে মা বেশি প্রিয় হয়। কিন্তু আমি তোকে আমার প্রিয় মানুষ মনে করি। প্রহর আসার আগে আমার সব ভালোবাসা তোর জন্য ছিল। মাকে এরপরে ভালোবাসতাম। কিন্তু এখন!”

মহুয়া মলিন মুখে বললো,
“কিন্তু এখন কি?”

মারিয়া মুচকি হেসে বললো,
“এখন আগে প্রহর, তারপর আমার চান্দু। তারপর মারিয়া’স হিটলার মাদার, আরিয়া ফেরদৌস।”

“যাহ, ফাজিল, মা শুনলে কি ভাববে?”

“মা জানে এগুলো মারিয়ার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। যাদের আমি ভালোবাসি তাদেরই আমি স্পেশাল নাম দেই। যেমন মিস্টার বর, চান্দু, হিটলার মাদার, মিষ্টি ভাবী।”

“ভিলেন ভাবীও কি খুব প্রিয় নাকি!”

“চান্দু, ভাবী এখন আর ভিলেন নেই। উনার জন্য নতুন নাম ভাবছি।”

মহুয়া হাসলো। দু’বোনের সমস্যারও সমাধান হয়ে গেলো। শুধু মহুয়ার অনুভূতিটাই চাপা পড়ে গেলো।

মাঝে মাঝে কিছু অনুভূতি চাপিয়ে রাখলেই হয়তো তার বিনিময়ে পরম শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়। আজ মহুয়া তার প্রহরের প্রতি অনুভূতিটা চাপিয়ে রেখেছে, মারিয়া হয়তো বুঝেছে, হয়তো বা বুঝে নি। কিন্তু মহুয়া বিনিময়ে তার বোনকে ফিরে পেয়েছে।

ছয় মাস পর খুব ধুমধাম করে মহুয়া আর ইহসানের বিয়ে হয়ে গেলো। মহুয়া এখন অনেক ভালো আছে। সে কখনো কল্পনায় করে নি ইহসানের মতো এতো যত্নশীল স্বামী পাবে। রাত হলে ইহসান তার গল্প শুনে ঘুমায়, বেশিরভাগই মহুয়ার কোলে তার ঘুমাতে ভালো লাগে। ডাক্তারদের পড়াশুনা আজীবন চলে, তা মহুয়া ইহসানের অবস্থা দেখেই বুঝেছে। কিন্তু এতো ব্যস্ততার মধ্যেও ছেলেটা তাকে এতো ভালোবাসে, তা মহুয়ার খুব অবাক লাগে। তবে দিনশেষে সে সুখেই আছে তার নতুন মানুষকে নিয়ে।

এদিকে প্রহর মারিয়াকে নিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছে ঘুরতে। তাদের প্রথম পরিকল্পনা কাশ্মির, এরপর চায়না। এয়ারপোর্টে এসেই মারিয়া নিবিড়কে দেখতে পেলো। নিবিড় মারিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি তোমাকে দেখতে এসেছি।”

“হঠাৎ, এখানে?”

নিবিড় চোখ বন্ধ করলো। তার বাবার কথাগুলো মনে পড়ে গেলো।
নাহিদ হোসেন শেষবার আরিয়া ফেরদৌসকে বলেছিলেন তাকে পাওয়ার কোনো সুযোগ কি হবে? কারণ তিনি জানেন আরিয়াও তাকে ভালোবাসে। কিন্তু আরিয়া ফেরদৌস উত্তরে বলেছিলেন,
“কিছু ভালোবাসা এমন সময় আসে, যেটিকে ভুল সময় বলে। আর কিছু ভালোবাসা অপূর্ণ থাকাই ভালো। আমি আমার সন্তানদের নিয়ে সুখেই আছি। তারাই আমার সুখের শেষ ঠিকানা।”

নাহিদ হোসেন আরিয়াকে ভুলতে পারবেন না। আবার ছেড়েও যাবেন না। তিনি আরিয়ার বন্ধু হয়েই তার পাশে থাকবেন। তিনি অপেক্ষায় আছেন, হয়তো একদিন আরিয়া তার হবে। হয়তো বা মৃত্যুর পর। আর সব ভালোবাসার সমাপ্তি কি পৃথিবীতে হয়? পৃথিবীতে আছে সমাজ, নিয়ম, বাঁধা। মৃত্যুর পর এতো নিয়ম নেই। তাই তখন ভালোবাসতেও বাঁধা নেই। পরের জন্মে তিনি আরিয়াকেই চান, তাই এই জন্মে তিনি রাত-দিন সৃষ্টিকর্তার কাছে তার ইচ্ছের কথা জানান।

এদিকে নিবিড় বাবার বলা কথাগুলো মারিয়াকে বলল,
“তুমি আমার ভুল সময়ে আসা ভালোবাসা। যাকে ধরে রাখা আমার নাগালের বাইরে ছিল। কিন্তু ভালোবাসা আমার নাগালের মধ্যেই আছে। তাই আমি তোমার সাথে শেষবার দেখা করে একটা কথায় বলবো, আমি সবসময় তোমাকে ভালোবাসবো, যতোদিন আমার জীবনে তোমার স্থান নেওয়ার মতো কেউ না আসে।”

মারিয়া বলল,
“আমি চাইবো খুব শীঘ্রই যাতে সেই মানুষটা তোর জীবনে চলে আসে।”

প্রহর মারিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালো। তাদের দু’জনের চোখে হাসি। নিবিড় তাদের ভালোবাসা দেখে মুচকি হেসে চলে এলো। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। তবে সে এখন থেকে মারিয়াকে পরের জন্মের জন্য চেয়ে যাবে। পরকালে হয়তো সে মারিয়াকে পাবে, এই আশায় সে বেঁচে থাকতে পারবে।

বৃষ্টির পর আকাশে রংধনুর দেখা পাওয়া যায়। রংধনু দেখতে খুব সুন্দর। ঠিক তেমনি মহুয়া, প্রহর আর নিবিড়ের জীবনেও এসেছিল এমন রংধনু। যেই রংধনু দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু যতোক্ষণ কাছে থাকে, খুব ভালো লাগে, জীবনটাও রঙিন মনে হয়। কিন্তু রংধনু হারিয়ে যাওয়ার পর আকাশের সৌন্দর্য মোটেও নষ্ট হয়ে যায় না! জীবনটাই হলো সেই আকাশ, জীবনটা আকাশের মতোই অনেক সুন্দর। আর এর ভিন্ন রূপ আমাদের অনেক মুগ্ধ করে। তাই শুধু রংধনুর আকাশের মাঝে ডুবে না গিয়ে পুরো আকাশটাকেই ভালোবেসে তার সব রূপে নিজেকে রাঙানো উচিত। কারণ অনুভূতি চিরস্থায়ী নয়। পুরোনো মানুষের চেয়ে নতুন মানুষের ভালোবাসা বেশি হলে, পুরোনো মানুষকে ভুলতে বেশি সময় লাগে না। এটাই মানুষের বৈশিষ্ট্য। নয়তো পৃথিবী দেবদাস আর রোমিও-জুলিয়েটে ভরে যেতো।

#সমাপ্তি

(❤️অনেক অপেক্ষা করিয়েছি সবাইকে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ভালো থাকবেন। প্রিয় মানুষকে গুরুত্ব দেবেন। আল্লাহ হাফেজ❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here