#রজনী
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩
আস্তে আস্তে তোহার কাছে যেতেই ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। তোহার মুখটা কেমন জানি কালচে জালের মতো অবয়ব হয়ে গেল। তোহা তার চোখের দিকে তাকাতেই তার বুক যেন কেঁপে উঠল। কারণ তোহার চোখ গুলোর সাদা অংশ কালো বর্ণ ধারণ করেছে। সে তোহার দিকে তাকিয়ে নম্র সুরে বলল
– তুমি কে? তোহার মধ্যে তুমি কী অন্য কেউ?
সাথে সাথে তোহার রুপ স্বাভাবিক হয়ে গেল। তোহা কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল
– আয়েশা ভাবি কী বলছেন?
আয়েশা যেন হুঁশ ফিরে পেল। নিজেকে সামলে তোহার হাতের দিকে কৌশলে লক্ষ্য করল। তার হাত দুটো কেমন যেন হয়ে আছে। হাতের ভেতর মুঠো করা কিছু কালো বস্তু লক্ষ্য করল সে। তার দম ভারী হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই সহুরা বেগম আয়েশাকে ধরে বলল
– কী রে কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?
আয়েশা নিজেকে সামলে বলল
– কিছু না।
সহুরা বেগম আয়েশাকে ধরে ঘর থেকে বের হলেন। তবে আয়েশার মন থেকে তোহার বিষয়টা সরছে না। তাসকিনের মৃত্যু তাকে যতটা না কষ্ট দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে তাসকিনের মৃত্যু রহস্য কী সেটার প্রশ্ন মেলাতে গিয়ে। সে বাড়ির পথ ধরে হাঁটছে। বিয়ে বাড়িটা নির্জীব হয়ে গেছে৷ আলো জ্বলছে তবে সে আলোতে যেন সবকিছু আরও অন্ধকার হয়ে গেছে। আনমনে সহুরা বেগমের হাত ধরে সে হেঁটে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে। বুকের ভেতরটা দুমরে মুচরে যাচ্ছে। কান্নাগুলো বৃষ্টি হয়ে নামলে হয়তো ভারী পাথরটা বুক থেকে নামত। তবে কান্না যেন চোখ দিয়ে বের হচ্ছে না। উল্টো কষ্টে তার বুক ফেটে চৌচির। পৃথীবিতে সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক বিষয় হলো কষ্ট গুলো বুকে জমাট বেঁধে থাকা। আয়েশা হুট করে আঁচড়ে পড়ল। তার মনে হলো কেউ একজন তাকে পেছন দিক হতে ধাক্কা দিয়েছে। আঁচড়ে পড়তেই তার চোখ মাটিতে পড়ল। মাটিতে কালো কালো রক্তের ছোপ। রক্ত দিয়ে যেন একটা বাচ্চার অবয়ব অঙ্কিত। চোখের দৃষ্টি সামনে নিতেই একটা বাচ্চাকে দৌড়ে যেতে দেখল। বাচ্চাটার দাঁতগুলো কালো,ঠোঁটগুলো সেলাই করা,গায়ের বিভিন্ন জায়গায় কালো কালো কি যেন অংকন করা। মাথার পেছনের দিকটা গর্তের ন্যায়। সে এবার বেশ জোরেই চিৎকার দিয়ে উঠল। সহুরা বেগম মেয়ের এমন আচমকা পড়ে যাওয়া আর চিৎকার শুনে তাড়াহুড়ো করে তাকে ধরল। তাকে ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে হালকা জড়িয়ে ধরে বলল
– কী হয়েছে মা? এমন করে চিৎকার করে উঠলে কেন? শরীর খারাপ লাগছে কী?
আয়েশা চোখ বন্ধ করে সামনের দিকে হাত ইশারা করে বলল
– মা দেখো একটা অদ্ভুত বাচ্চা। আমার মনে হয় এ বাচ্চাটায় তাসকিনকে মেরে দিয়েছে। তাসকিনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু না। মা তাসকিনকে কোনো আত্মা মেরে দিয়েছে।
আয়েশার এমন ছন্নছাড়া কথা শুনে সহুরা বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন
– মারে সামনে কিছু নেই দেখ। তুই কী থেকে কী দেখেছিস। বেশি হতাশ হয়ে গেছিস। জোরে জোরে কাঁদ তাহলে ভালো লাগবে। সবার জীবন তো একই গতিতে যায় না। তোর কপালে এটা লেখা ছিল। মারে তুই এমন করিস না। আমার যে কলিজা ফেটে যায়।
মায়ের কথা শুনে আয়েশা সামনে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। নীচে তাকিয়ে দেখল কোনো রক্ত নেই। তাহলে একটু আগে সে কী দেখল। এটা কী তার মতিভ্রম নাকি কল্পনার বিস্তার,নাকি নিছক ভাবনার অভিব্যক্তি। সে নিজেকে সামলালো। মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল
– চলো…. বাসায় চলো।
সহুরা বেগম আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে এগুতে লাগল। আয়েশার বুকটা ভেদ করে যেন কোনো ছুরি ঢুকে আটকে গেছে মনে হচ্ছে। সেটার যন্ত্রণা অনেক প্রখর তবে বুঝতে পারছে না কী করে নিজেকে সামলাবে। এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। তাসকিনকে এভাবে হারাবে সেটা তার ভাবনার বাইরে ছিল। নিজের ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়েও যেন দাউদাউ করে জ্বলছে।
বাসায় আসার পর থেকে সারা বাড়ি চুপ হয়ে গেল। থমথমে পরিবেশ। আত্মীয় স্বজন আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগল। যেসব অতিথিদের দাওয়াত করা হয়েছিল সবাইকে আবার না করে দেওয়া হলো। আয়েশার ভেতরটা পুড়তেছে শুধু। কেউ কেউ আয়েশাকে পরোক্ষভাবে নিজের হবু বরের মৃত্যুর জন্য দায়ী করছে। কেউ কেউ অলক্ষী ট্যাগ দিয়ে দিচ্ছে। তাসকিন মরে গিয়েও যেন সবকিছুর জন্য তাকে দায়ী করে দিয়ে গেছে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। সারাদিন পানি ছাড়া কিছুই খায়নি আয়েশা। নিজের রুমের মেঝেতে বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে সে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । খারাপ লাগলেও কাঁদতে না পারার যন্ত্রণায় ভুগছে। এমন সময় তার খালাত বোন তূর্ণা এসে জানাল তাসকিনকে রাতে কবর দেওয়া হবে। তূর্ণার কথা শুনে তার বুকটা যেন আরও ভার হয়ে গেল। হালকা গলায় বলল
– রিপোর্ট কী বলে?
– আশ্চর্য হলেও সত্যি যে রিপোর্টে নাকি আসছে তাসকিন ভাইয়ার হত্যা হার্ট এটাকে হয়েছে। তবে তাসকিন ভাইকে তো ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। গলায়ও তেমন বিশেষ দঁড়িয় কোনো আঘাত বা চিন্হ পাওয়া যায়নি। বিষয়টা অবিশ্বাস্য হলেও ময়না তদন্তের রিপোর্ট এমন কিছুই বলছে।
তাসকিনের মৃত্যু স্বাভাবিক না সেটা আয়েশার এবার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস হতে লাগল। তূর্ণার হাত ধরে বলল
– আমি তাসকিনকে আরেক নজর দেখতে চাই। আমাকে একটু নিয়ে চল।
– খালা, খালু না করেছিল তোকে বলতে। আর বলেছে যেতে চাইলেও যেন নিয়ে যাওয়া না হয়। তোর মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে।
– তুই একটু লুকিয়ে আমাকে বের কর প্লিজ। আমি তাসকিনকে শেষ দেখা দেখতে চাই।
আয়েশার আবদারের কাছে তূর্ণা যেন গলে গেল। তাই মৃদু সুরে বলল
– এ দরজাটা লাগিয়ে দে। পেছনের দরজা দিয়ে বের হব আমরা। রাত নয়টায় জানাজা। এখন তো আটটা বাজে সবে। আমরা ৮ টা ৪৫ এ রওনা দিব। আমি এখন খালা খালুকে বলে আসি যে তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস আর আমি তোর সাথে ঘুমিয়ে যাব। তারপর দরজা লাগিয়ে দিব। তারা তো ভাববেই আমরা ঘুমিয়ে গেছি। তারপর আমরা মুখ ঢেকে পেছন দরজা দিয়ে বের হয়ে যাব। খালু তো মনে হয় জানাজায় যাবে। তাই বিকল্প রাস্তা ধরে যাব। যাতে কেউ দেখতে না পারে।
আয়েশা তূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল
– আমার জীবনটা কেন এমন হলো রে? আমার তাসকিনকে আমি পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেললাম। কলিজাটা যে ফেটে যাচ্ছে আমার।
– শান্ত হ তুই। এমন করিস না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য।
– এত ভালো তো আমি চাইনি।
– শান্ত হ আয়েশা। নিজেকে কনট্রোল কর।
আয়েশা নিজেকে সামলে নিল। তূর্ণা সহুরা বেগম আর আয়েশার বাবাকে ঘুমের কথা বলে দরজা লাগিয়ে দিল।
রাত তখন ৮ টা ৪৫। দুজনে কালো উড়না দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে বিকল্প রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল তাসকিনদের বাসায় যাওয়ার জন্য। এ রাস্তা মূলত ছোট গলি হওয়ায় চলাচল কম। এ সময়টায় এ গলিটা বেশ জণশূন্য। আশেপাশে কেউ নেই। গলিটা এমন সরু যে পাশাপাশি দুজন হেঁটে যাওয়াও মুশকিল। আয়েশা সামনে হাঁটছিল আর তূর্ণা পেছন পেছন হাঁটছিল। এমন সময় তূর্ণার পা ধরে কেউ একজন হেঁচকা টান দিল। তূর্ণা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল আর আয়েশার কামিজের এক অংশ টেনে ধরল। আয়েশা আচমকা জামায় টান পেয়ে পেছন ফিরল। পেছন ফিরতেই তার শরীর হিম হয়ে যেতে লাগল
কপি করা নিষেধ।