#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৩
প্রায় আধঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর প্রিয়া শাড়ি সামলাতে সামলাতে ওয়াশরুম থেকে বেরোয়। শাড়ি সে কোনোরকম পরা শিখেছিল। তাই পরতে পেরেছে। অনেকটা সময় লেগেছে বলে খারাপও লাগছে কিন্তু শাওয়ার নেওয়াটা জরুরী ছিল। সারাদিন কমতো ধকল গেলো না! তারউপর ভারী মেকআপ! চুলের হালকা পানিতে শাড়ি কিছুটা ভিজেছে। তোয়ালে দিয়ে মোছার পরেও পানি অনেকটাই থেকে গেছে। অবশ্য প্রিয়া চুল খুব হালকা করে মোছে। জারিফ ব্যালকনিতে ছিল এতক্ষণ। এখন ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজে রুমে এসেছে। রুমে এই পর্যায়ে সাদা বাতিই জ্বলছে ডিম লাইটগুলোর বদলে। প্রিয়া ইতস্তত করে আয়নার সামনে বসে। তারপর চুলগুলোর নিচে জমা পানি মুছে চিরুনি নিলো আঁচড়াতে। জারিফ ধীর পায়ে প্রিয়ার পেছোনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রিয়া যখনি চেইন পড়তে নিবে জারিফ বাঁধা দেয়। প্রিয়া আয়না দিয়ে তাকায় তার প্রিয় মানুষটির পানে। তার মুখে ঝুলছে মুগ্ধকরা হাসি যার বিনিময়ে প্রিয়ার মুখশ্রীতে ব্রীড়া মিশ্রিত আভা পরিলক্ষিত। জারিফ নিজ হাতে প্রিয়াকে অলংকারে সজ্জিত করে। পেন্ডেন্টের চেইন, এয়াররিং, আংটি ও হাতে লাল চুড়ি। সাঁজ শেষে জারিফ প্রিয়ার কাঁধে হাত রেখে আয়নায় প্রিয়ার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে,
“আজ আকাশের চাঁদটাও তোমাকে হিংসে করবে জানো! তারই জোৎসনায় তুমি চন্দ্রবিলাশ করবে আর আমি তোমাকে।”
প্রিয়া দৃষ্টি আর তুলতে পারলো না। চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। জারিফ আসার পর থেকে প্রিয়া একদম চুপ হয়ে আছে। একটা কথাও বলছে না। ব্যাপারটা জারিফ লক্ষ্য করল। জারিফ খানিকটা হেসে বলল,
“ফ*ড়ফ*ড়ানি পাখি আজ এতো নিরব? হঠাৎ কী হলো তার? যে সে নিজের স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ করছে। সে কী জানে? তার চঞ্চলতা আমার ভিষণ প্রিয়।”
প্রিয়া নত মস্তকেই হাসে অতঃপর আয়নায় জারিফের দিকে চেয়ে বলে,
“তার সংস্পর্শে নিজের নিরবতাতেও প্রশান্তি খুঁজে পাই।”
“তবে চলো তোমার মৌন ব্রতকে আরও দীর্ঘায়িত করতে!”
জারিফের হাসি মিশ্রিত হেয়ালিপূর্ণ কথায় প্রিয়া ভ্রুঁ কুঁচকালো। বলল,
“কোথায়?”
“ওই যে বললাম না? আজ তুমি চন্দ্রবিলাশ করবে আর আমি তোমাকে!”
প্রিয়া আবারও লাজরাঙা হয়। জারিফ প্রিয়াকে উঠতে ইশারা করে। তারপর ওরা দুইজন ব্যালকনিতে যায়। ব্যালকনিতে একটা ম্যাট বিছানো তারউপর কুশন। পাশে একটা গরম পানির ফ্লাস্ক, দুইটা কফি মগ, কফির, গুড়ো দুধ ও মধুর কৌটা রাখা। আর কতোগুলো চিপস, চকলেটের প্যাকেট রাখা। ব্যালকনির ফুলের গাছগুলোর উপর ছোটো ছোটো মরিচবাতির মতো হলুদ বাতি লাগানো তাছাড়া মরিচবাতি দিয়ে গোটা দালানের বহিরাভাগ তো সজ্জিতই। প্রিয়া জারিফের দিকে ঘুরে তাকিয়ে অবাক মিশ্রিত হালকা হাসে। জারিফ একজনকে মেসেজ করলো আর তার কিছুক্ষণ পর দালানে সাঁজানো সব মরিচবাতি বন্ধ হয়ে যায়। প্রিয়া বিস্ময় নিয়ে সুধায়,
“সব মরিচবাতি অফ হয়ে গেলো কেনো?”
জারিফ ম্যাটের উপর বসে প্রিয়াকে হাত ধরে বসতে বলে। তারপর মুচকি হেসে বলে,
“মরিচবাতির আলোয় জোৎসনা বিলাশ ঠিক জমবে না। এখন দেখো, চাঁদের আলোয় কী সুন্দর লাগছে।”
প্রিয়া চমৎকার হাসে। জারিফ কফি বানিয়ে প্রিয়াকে দেয়। প্রিয়া কফি এক চুমুক খেয়ে বলে,
“মধুর সাথে কফি তো আজকেই প্রথম ট্রাই করলাম। মিষ্টতা কম হলেও ভালো লাগছে। আপনাকে আমি একদিন চাফি বানিয়ে খাওয়াব। মালাই চায়ের সাথে কফি। অসাধারণ খেতে ওটা।”
জারিফ কিছুটা শব্দ করে হাসলো। প্রিয়া জারিফকে হাসতে দেখে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালো। জারিফ প্রিয়ার তাকানো দেখে হাসি চেপে বলে,
“ওহ সরি। চাফি নামটা ইন্টারেস্টিং। খেতেও নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টিং হবে।”
“হুহ্। আপনি যদি একবার খেয়ে আরেকবার খেতে না চান তবে আমার নাম….!”
প্রিয়ার অতি উৎসাহী মনোভাব দেখে জারিফ ওকে আটকায়।
“হেই স্টপ। ডোন্ট বি সো মাচ এক্সাইটেড। সবার পছন্দ এক না। তোমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগা জিনিসটা আমার ভালো নাই লাগতে পারে। উই শ্যুড রেসপেক্ট ইচ আদার চয়েস। চাফি নামটা আগে শোনা হয়নি বলেই আমি বলেছি। দ্যাটস ইট।”
প্রিয়া বলে,
“সরি। আপনি একবার টেস্ট করে দেখেন। তারপর বলবেন কেমন লেগেছে। আমার তো ভিষণ পছন্দ। ওটা খেলে আমি এনার্জি পাই।”
“অকে। নাউ এন্জয় দিস কফি।”
ব্যালকনিতে চন্দ্রবিলাশ ও কথা বলেই অনেকটা সময় পার করে ওরা ঘুম আসলে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরে।
________
রাহা অনেক মানুষ ও অপরিচিত জায়গায় ভালো করে ঘুমোতে পারে না। রাত দেড়টা বাজে। সচরাচর এই সময়টা নিস্তব্ধতায় ঘেরা থাকে। রাহা নিচু শব্দে দরজা খুলে রুমের বাহিরে যায়। রুমগুলো সব অন্ধকার। মরিচবাতিও বন্ধ তাই আলোক স্বল্পতা অধিকমাত্রায়। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে খুঁজে খুঁহে ডাইনিংয়ে যায় পানি খেতে। হাতে করে চকোলেটও নিয়ে এসেছে। ব্যাগে কফি পাউডারও আছে কিন্তু অন্যের বাড়িতে গভীর রাতে রান্নাঘরে যাওয়াটা শোভনীয় না। তাই চকোলেটই খাবে। পানি খেয়ে রুমে ফিরে যাচ্ছিল হঠাৎ এক পুরুষালি কন্ঠে থমকে দাঁড়ায়। ভয়ও পেয়েছে অনেকটা। দোয়া-দুরুদ, আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করেছে মনে মনে চোখ মুখ খিঁচে। একটা পায়ের শব্দ ক্রমশ রাহার দিকে আসছে আর ওর ভয় আরও বাড়ছে। হৃৎপিন্ড দ্রুতগতিতে কাজ করছে। এবার অনেকটা কাছ থেকেই কন্ঠস্বরটা শুনলো। কেউ মুখের উপর লাইট ছুড়েছে।
“ওহ তুমি।”
রাহা টিপটিপ করে এক চোখ খুলে দেখতে চাইলো, কে? কিন্তু লাইটা একদম চোখের উপরই পরেছে বলে চোখ মেলতে পারছে না। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। বিপরীত পাশের ব্যাক্তিটি হয়তো এই অস্বস্থি বুঝলো! সে লাইটটা উপরের দিকে ধরলো যার দরুন পুরো রুম হালকা আলোকিত হলো। রাহা আস্তে আস্তে চোখ খুলল। কন্ঠস্বরের মালিকটি আর কেউ নয় নাহান! নাহান জিজ্ঞেস করে,
“এতো রাতে এখানে কী করো? ঘুমোয়নি কেনো?”
রাহা থতমত খেয়ে যায়।
“না আসলে। আমার ঘুম আসছিল না। পানি খেতে এখানে এসেছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা। লাইট অন করে নিতে। অন্ধকারে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
“না তা লাগবে না। আমি এখনি রুমে চলে যাবো।”
নাহান বলে,
“অ্যাই ডোন্ট থিংক, তোমার এখন ঘুম আসবে। এক মগ কফি খেতে পারো। অনেকসময় কফি খেলে ভালো ঘুমও হয়। কনসানট্রেট থাকে যেটা করতে চাও আর ঘুমোতে চাইলে সেটাও হবে। সো?”
রাহা রাজী হয়ে যায়। তার কফি খেতে ইচ্ছেও করছিলো। নাহান ক্যাটলিতে পানি গরম বসিয়ে দিয়ে মিক্সড কফি পাউডার দিয়ে কফি বানিয়ে নেয়। চিনির বদলে সে মধু দেয় যাতে ঘুমটা ভালো হয়। দুজনে ড্রয়িংরুমে বসে কফি শেষ করে। দুজনে নিশ্চুপই ছিল। কফি শেষ করে রাহা বলে,
“থ্যাংকিউ ফর দ্যা কফি। অ্যাই রিয়ালি নিডেড ইট।”
নাহান হালকা হেসে বলে,
“মাই প্লেজার।”
রাহা মুচকি হেসে রুমে চলে যায় আর নাহানও নিজের রুমে চলে যায়। নাহান অবশ্য ঘুমাবে না। সে একটা মুভি দেখতে শুরু করেছিল একা একা ব্যালকনিতে বসে। মুভিটা শেষ হলে ঘুমোবে। অন্য সব কাজিনরা রাত একটা বাজার পরেই টায়ার্ড হয়ে প্রায় ঘুমিয়ে গেছে। দুয়েকজন অনলাইনে আছে তবে তারা ছাদে।
________
সকালে প্রিয়ার ঘুম ভাঙতে কিছুটা দেরি হয়। আটটা বেজে গেছে। উঠে ফ্রেশ হয়ে রাতে বদলে রাখা শাড়িটা পরে পরিপাটি হয়ে ডাইনিংয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখেছে জারিফ ঘরে নাই। প্রিয়া ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখে, তামান্না সেমাইয়ের বাটি রান্নাঘর থেকে ডাইনিং টেবিলে এনে রাখছে। প্রিয়াকে দেখে হেসে বলে,
“আরে তুমি এসে গেছো? তোমাকেই ডাকতে যেতাম সেমাইটা রেখে। নানী ও কয়েকজন দুঃসম্পর্কের দাদী শাশুড়িরা দেখবে, নাস্তার সময় তোমার হাতের বানানো কিছু খেতে চাইবে।”
প্রিয়া তামান্নার দিকে না বুঝে তাকালো। তামান্না বলে,
“চিন্তা করো না। তুমি পায়েসটা বানাতে পারবে? আমি দেখিয়ে দিবো সমস্যা হলে। মিষ্টি জাতীয় কিছু বানালে খুশি হবে। আমার বিয়ের পরেরদিনও আমি বানিয়েছিলাম। অবশ্য আমি বানিয়েছিলাম তাদের থেকে শোনার পর। খারাপ কিছু বলেনি কিন্তু তাও তারা বলার আগেই তুমি এবার বানিয়ে ফেলো।”
“আচ্ছা ভাবী। আমি পারব। আমি রান্নাবান্নার মধ্যে ডেজার্ট, স্নেক্সগুলো আর টুকটাক কিছু রান্না মোটামোটি পারি। ”
প্রিয়ার কথা শুনে তামান্না খুশি হয়ে বলে,
“তাহলে চলো। জলদি বানিয়ে ফেলো। আমিও নাস্তার জন্য একটা ডাল তরকারিটা বানিয়ে ফেলি। রুটি পাশের হোটেলে তেল ছাড়া বানানোর জন্য তোমার ভাইয়া বলে এসেছে। এতো মানুষের রুটি বাড়িতে বানানো সম্ভব না বাবা!”
প্রিয়া হেসে বলে,
“তা ঠিক বলেছো ভাবী। চলো তাহলে।”
দুই জা রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করতে শুরু করলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।