#হৃদমাঝারে পর্ব-৮
#দেবারতি_ধাড়া
সকালে আয়ান ঘুম থেকে উঠে যখন বাথরুমে ফ্রেস হতে গেলো, তখন বাসন্তীদেবী আয়ানের ঘরের বিছানা গোছাতে এসে ওই ছবিটা আয়ানের বালিশের নিচে থেকে পেলেন। ছবিটা বালিশের নিচে থেকে পাওয়ায় উনি মনে মনে বেশ খুশিই হলেন। উনি বুঝতে পারলেন আয়ান নিশ্চয়ই রাতে ওই ছবিটা দেখেছে, আর ওর পছন্দও হয়েছে। সেইজন্যই হয়তো ছবিটা নিজের বালিশের নিচে রেখেছে আয়ান। বিছানা গোছাতে গোছাতে হঠাৎই আয়ানের পায়ের শব্দ পেয়ে উনি ছবিটা আবার বালিশের নিচেই রেখে দিলেন। আর এমন ভান করলেন যেন উনি কিছুই দেখেননি। আয়ান ঘরে ঢোকার আগেই উনি ইচ্ছে করে টেবিলের কাছে গিয়ে কিছু খোঁজাখুঁজি করার ভান করতে লাগলেন। আয়ান ঘরে ঢুকে বাসন্তীদেবীকে টেবিলের সব জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাটি করতে দেখে বললো,
-ওখানে কী করছো মা? তুমি কী কিছু খুঁজছো নাকি?
-হ্যাঁরে বাবান, দেখনা তোর দেখার জন্য যে কাল ওই মেয়েটির ছবিটা এই টেবিলে রেখে গেলাম, সেটাই নিয়ে যেতে এসেছি। তুই যখন এই বিয়েতে রাজীই নস, তাহলে বরং আমি ঘটকমশাইকে ছবিটা ফেরতই দিয়ে দিই। আর এই সম্বন্ধটা ভেঙে দিতে বলি। উনি বললেন আজ আসবেন। কিন্তু দেখনা ছবিটা কিছুতে খুঁজেই পাচ্ছি না আমি! হ্যাঁ রে বাবান, তুই কী দেখেছিস নাকি ছবিটা?
বাসন্তীদেবীর মুখে ছবির কথাটা শুনে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো আয়ান। ওর মনে পড়ে গেলো কাল রাতে ছবিটা দেখার পর ও বালিশের নিচে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সঙ্গে সঙ্গে ও বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো বিছানাটা পরিপাটি করে গুছিয়ে দিয়েছেন বাসন্তীদেবী। সেটা দেখার পর আরও বেশি লজ্জাজনক অবস্থায় পড়তে হলো আয়ানকে। ওকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে বাসন্তীদেবী বললেন,
-কীরে বাবান? তুই কী দেখেছিস নাকি ছবিটা?
-কই না তো! আমি কেন দেখতে যাবো?
-ও তুই দেখিসনি? তাহলে কোথায় গেলো বলতো ছবিটা?
-আমি কী করে জানবো? দেখো এদিক-ওদিক কোথাও আছে হয়তো!
-কী জানি! দেখতে তো পাচ্ছি না! দাঁড়া তোর বালিশের তলাটায় একটু খুঁজে দেখি। আমার মন বলছে হয়তো ওখানেই আছে!
বলেই বাসন্তীদেবী আয়ানের বালিশের নিচে থেকে ছবিটা বের করে নিয়ে এলেন। আর আয়ানের মুখের সামনে এসে বললেন,
-এইতো! ছবিটা তোর বালিশের নিচেই ছিলো। আমার মন তাহলে ঠিকই বলেছে বল বাবান? তুই বুঝি রাতে ছবিটা দেখছিলি?
বাসন্তীদেবীর সামনে ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলো আয়ান। তোতলাতে তোতলাতে কোনোরকমে ও বললো,
-কই নাতো! আমি কেন দেখতে যাবো? আমি তো তোমাকে আগেই বললাম ওইসব ছবিটবি এখানে রেখে যাবে না!
-তাহলে এই ছবিটা তোর বালিশের নিচে কীভাবে এলো রে?
-সে আমি কী করে জানবো? রিমলি রেখেছে হবে হয়তো!
-ওমা, রিমলি তোর ঘরে এসেছিলো নাকি? কখন এসেছিলো রে?
-ওই তো কাল রাতে যখন আমি শুতে এলাম, তখনই এসেছিলো হয়তো!
-তাই? রিমলি তোর ঘরে এসেছিলো বুঝি?
-হ্যাঁ, বললাম তো এসেছিলো!
-এই বাবান? তুই কী চোখে বেশি দেখছিস নাকি আজকাল? রিমলি তো কাল বিকেলে ওর বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলো, বন্ধুর জন্মদিন বলে। আর ও তো এখনও সেখান থেকে ফেরেইনি! কাল রাত থেকে ও ওখানেই আছে। আজ দুপুরে লাঞ্চ করে তবেই বাড়ি ফিরবে।
রিমলি কাল থেকে বাড়ি নেই শুনে লজ্জায় আর মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারলো না আয়ান। ও কী বলবে আর কিছু ভেবে পেলো না। ছেলের লাজুক মুখটা দেখে হা হা করে উচ্চস্বরে হেসে ফেললেন বাসন্তীদেবী। তারপর উনি এগিয়ে এসে আয়ানের গালে হাত দিয়ে একটু আদর করে দিয়ে বললেন,
-আচ্ছা আচ্ছা মায়ের কাছে আর লজ্জা পেতে হবে না! মায়ের কাছে এতো লজ্জা কীসের শুনি? আমি বুঝতে পেরেছি রে বাবান, যে তোর মেয়েটির ছবিটা দেখে মেয়েটিকে পছন্দ হয়ে গেছে… কীরে বল তাই না?
কোনো উত্তর দিতে পারলো না আয়ান। ও চুপ করে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়েই রইলো। আয়ানের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে উনি আবার বললেন,
-আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি! তোকে কিচ্ছু বলতে হবে না বাবান। তোকে আর এতো লজ্জাও পেতে হবে না! আমি এক্ষুণি ঘটকমশাইকে বলছি ওনাদের বাড়িতে খবর দিতে। উনি যেন জানিয়ে দেন যে, মেয়ের ছবি দেখে তোর পছন্দ হয়েছে। আর আমরা খুব তাড়াতাড়ি পাত্রীকে সামনাসামনি দেখতে চাই। সে ওনাদের বাড়িতে গিয়েই হোক কিংবা ওনারা আমাদের বাড়িতে এসেই হোক!
আয়ানকে গাল টিপে আরও একটু আদর করে ওর হাতে ছবিটা ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন বাসন্তীদেবী। আয়ান ছবিটা হাতে নিয়ে একটু মুচকে হেসে ফেলে বিছানায় গিয়ে বসলো।
জিয়া অফিস থেকে ফিরে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছিলো আর ল্যাপটপে ওর ফটোগ্রাফির পেজটা নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করছিলো। কাল এক্সিবিশনে যে যে ছবি গুলো তোলার জন্য ওকে সম্মানিত করা হয়েছিলো, সেগুলোও ভালো করে দেখছিলো। ঠিক তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। কলটা রিসিভ করে কানে দিয়ে জিয়া বললো,
-হ্যাঁ পিমণি বলো! কেমন আছো গো তুমি? কত্তদিন হয়ে গেলো তোমাকে দেখিনি আর তোমার সাথে কথা বলিনি! খুব মিস করছি গো তোমাদের সবাইকে!
-ভালো আছি রে জিয়া। কিন্তু তুই কবে আসবি সেটা আগে বল?
-কবে আসবো মানে? এখন তো ছুটি পাওয়ার কোনো চান্সই নেই! কবে ছুটি পাবো সেটা তো আমি নিজেও জানি না! তবে আমি কথা দিচ্ছি, ছুটি পেলেই তোমাদের বাড়ি যাবো!
-মানে টা কী? তোকে দাদা-বৌদি কিছু বলেনি?
-কই না তো! কেন গো কী বলবে? আজ সকালেই তো মা-বাবার সাথে কথা বললাম আমি। কই কিছুই তো বললো না আমাকে! হয়তো ভুলে গেছে বলতে!
-তুই তো জানিসই জিয়া, তোকে ছাড়া তোর দিদিয়া কখনও কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারে না! তার ওপর আবার বিয়ের মতো এতো বড়ো একটা ডিসিশন তো একদমই না!
-মানে? ও পিমণি, দিদিয়ার বিয়ে নাকি?!
-আসলে তোর পিসান তোর দিদিয়ার জন্য একটা সম্বন্ধ দেখেছে। মানে পিসানকে কেউ বলেছে একটা ভালো ছেলে আছে, তার সাথে তোর দিদিয়ার বিয়ে দেওয়ার কথা। আমি তো খুব আনন্দে আছি সেটা নিয়ে। ছেলে, ছেলের মা আর বোনের নাকি ছবি দেখে খুব পছন্দও হয়ে গেছে তোর দিদিয়াকে। তাই ওরা চাইছে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আগে আশীর্বাদটা সেরে ফেলতে। ছেলে এমনিতে কলকাতায় থাকে না। এখন কিছুদিনের জন্য কলকাতায় ফিরেছে। কিছু দিন পর ছেলে আবার ফিরে যাবে। তাই বিয়েটা এর মধ্যে হয়ে গেলেই ভালো হয়..
-বাব্বা! এতো কিছু হয়ে গেলো, কেউ আমাকে একবার জানালো না পর্যন্ত! দিদিয়ার বিয়ের কথা শুনে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, সেটা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না পিমণি! উফ! দিদিয়ার বিয়েতে আমি যা সাজবো না! খুব খুব মজা হবে গো!
-সেতো করবি জিয়া। কিন্তু তুই একটু তাড়াতাড়ি আয়। তুই এলে তবেই কিন্তু তোর দিদিয়া বিয়েতে রাজী হবে।
-আচ্ছা আচ্ছা পিমণি শোনোনা, তুমি এখন ফোনটা রাখো। আমি দেখছি কীভাবে ছুটি ম্যানেজ করা যায়! আর তুমি একদম চিন্তা করবে না পিমণি। আমি যেভাবেই হোক ছুটি নিয়ে কলকাতায় ফিরে দিদিয়ার সাথে কথা বলে ওকে বিয়েতে রাজী করাবো!
-আমি তো জানি, আর সেইজন্যই তো তোকে ফোন করে সবটা জানালাম জিয়া।
আজ সন্ধ্যায় বাসন্তীদেবীকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলো আয়ান। ফেরার পথে মাকে বাড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে পাড়ার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দোকানদারকে এক কাপ চা দিতে বলে, ও নিজের ফোনে ডায়াল করলো জিয়ার নাম্বারটা। জিয়া তখন সবে সবে ওর পিমণির সাথে কথা বলেই ফোনটা পাশে রেখেছিলো। তখনই আবার ওর ফোনটা বেজে ওঠায় আবারও পিমণিই ফোন করেছে ভেবে ল্যাপটপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে আর না তাকিয়ে কলটা রিসিভ করে ফোনটা আবার পাশে রেখে দিলো জিয়া। রিসিভ করেই ও বলতে শুরু করলো,
-আবার কী হলো পিমণি? আমি তো বলছি আমি দেখছি কীভাবে ছুটি ম্যানেজ করা যায়! আমি খুব তাড়াতাড়ি কলকাতা আসছি! তুমি একদম চিন্তা কোরো না গো! আমি গিয়ে দিদিয়ার বর পছন্দ করবো.. তবে হ্যাঁ, আর একটা কথা, আমার পছন্দ না হলে কিন্তু বর ক্যান্সেল! তুমি পিসানকে বলেই রেখো কেমন?
জিয়ার কলকাতায় ফেরার কথাটা শুনেই আয়ান মনে মনে বললো, “ও তার মানে তোমার বাড়ি থেকে তোমার দিদির বিয়ে বলে তোমাকে কলকাতায় ডেকে আনছেন তোমার পিমণি! ভালোই করেছেন। তুমি যা জেদি, বিয়ের কথা শুনলে তো তুমি এখানে আসবেই না! তুমি কোনো চিন্তা কোরো না জিয়া। আমি এই বিয়েতে রাজী হয়েছি ঠিকই, কিন্তু তুমি যদি এখানে এসে সবটা শোনার পর বিয়ে করতে না চাও, তাহলে আমি এই বিয়েটা কখনোই হতে দেবো না! আমি এই বিয়েতে রাজী হয়েছি, কারণ কাল যখন আমি তোমাকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম, তখন তুমি বলেছো যে তোমার ইচ্ছে গুলোকে যে ব্যক্তি সম্মান দিতে পারবে, আর যাকে বিয়ে করার পর সে তোমার নিজের স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ করবে না, তাকেই তুমি বিয়ে করতে রাজী হবে। আর আমি তোমার সব সিদ্ধান্তের সাথে একমত জিয়া। আমি তোমার সমস্ত ইচ্ছে গুলোকে মনে মনে খুব সম্মান করি। আর আমি তোমার কোনো স্বাধীনতাতেও কখনও হস্তক্ষেপ করবো না। তুমি আমাকে নিশ্চিন্তে তোমার মন আর জীবন দুটোতেই একটু জায়গা দিতে পারো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি জিয়া, তোমার বা তোমার কোনো ইচ্ছের অযত্ন বা অমর্যাদা করবো না আমি।”
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে জিয়া বললো,
-কী ব্যাপার পিমণি তুমি চুপ করে আছো যে?
কিন্তু তারপরেও অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে জিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে লক কী-টা প্রেশ করে দেখলো ওর পিমণি নয়, ওকে কলটা আয়ান করেছে। তাই কল ধরে থেকেও চুপ করে থাকার জন্য যথারীতি আয়ানকে মুখ ঝামটা দিতে শুরু করলো জিয়া,
-কী ব্যাপারটা কী হ্যাঁ প্রফেসর? কল করে কী ঘুমিয়ে পড়লে নাকি তুমি? কল করার পর চুপ করে আছো কেন? আমার কিন্তু শুধু শুধু কানে ফোন ধরে রাখার মতো এতো সময় নেই! যা বলার আছে তাড়াতাড়ি বলো প্লিজ!
জিয়ার মুখ ঝামটা শোনার পর ঘোর কাটলো আয়ানের। সঙ্গে সঙ্গে ও বললো,
-সরি সরি জিয়া! আসলে নেটওয়ার্ক প্রবলেম হচ্ছিলো হয়ত.. তাই বোধহয় তুমি শুনতে পাওনি!
-তাই? নেটওয়ার্ক প্রবলেম হচ্ছিলো বুঝি? আমার মুখ ঝামটা শোনার পর কী নেটওয়ার্ক ঠিক হয়ে গেলো নাকি?
-আরে না না.. সেটা নয়! আসলে..
-তাড়াতাড়ি বলে ফেলো দেখি কী ভাবছিলে?
-কিছু না! তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে…
-সারপ্রাইজ? কী সারপ্রাইজ? বলো বলো?!
-এখন না, পরে বলবো..
-ধুর! বলো না? সারপ্রাইজের কথা শুনলেই মনটা কেমন কী কী করে?
-বলে দিলে আর সারপ্রাইজ থাকবে কী করে? তুমি কলকাতায় কবে আসছো সেটা আগে বলো?
-কলকাতায়? হ্যাঁ, কলকাতায় তো আমাকে যেতেই হবে, আমার দিদির বিয়ে বলে কথা! দেখি কী করে ছুটি ম্যানেজ করা যায়! কিন্তু কেন বলোতো?
-দিদি? তোমার আবার দিদি আছে নাকি জিয়া?
-হ্যাঁ, আছে তো! এই শোনোনা প্রফেসর, আমার না একটা কল আসছে। একজন কলিগ কল করছে। কথা বলে নিয়ে আমি একটু পরে তোমাকে কলব্যাক করছি ওকে?
-ওকে ওকে!
আজ বিকেলে আয়ান আর বাসন্তীদেবীর পাত্রীর বাড়ি যাওয়ার কথা। বিকেল পাঁচটায় বেরোনোর কথা ওদের।
-কীরে বাবান তোর হলো? আর কতক্ষণ লাগবে বলতো তোর? সাড়ে চারটে তো বাজতে যায়।
-এই তো মা, আমার হয়েই গেছে! চলো এবার বেরোনো যাক..
-হ্যাঁ হ্যাঁ চল তাড়াতাড়ি! ঘটকমশাই তো সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য! আর ওদিকে মেয়ের বাড়ির লোকও তো অপেক্ষা করছেন!
বাসন্তীদেবীর কথা শুনে আয়ান মনে মনে বললো, “ওনাদের একটু অপেক্ষা করতে দাও মা! আমাকেও শিলিগুড়িতে অনেক অপেক্ষা করায় জিয়া। এমনিতেই তো মুখরা, ছটফটে, দূরন্ত, ঝগড়ুটে একটা মেয়েকে শান্ত, নম্র বলে তার ছবি দেখিয়েছেন ওনারা। কিন্তু ওনাদের মেয়ে যে কী জিনিস সে আমি খুব ভালো করেই জানি! আর তাছাড়া আমি তো শুধু ভাবছি জিয়া সবার সামনে আমাকে দেখে মুখ ঝামটা না দিতে পেরে কী করে চুপচাপ বসে থাকবে! আর ও বিয়ের জন্য পাত্রের সামনে বসতে রাজীই বা হলো কী করে? যাক গে! গিয়ে দেখাই যাক.. তবে আমি আজই তোমাকে আমার মনের কথাটা বলবো…” আয়ানকে নিজের মনে বিড়বিড় করতে দেখে বাসন্তীদেবী বললেন,
-কীরে বাবান? কী বিড়বিড় করছিস বলতো তুই?
-কিছু না মা, তুমি চলো..
কাল সন্ধ্যায় জিয়া কলকাতায় ফিরেছে। আজ ছেলের বাড়ি থেকে পাত্রী দেখতে আসার কথা আছে। জিয়া কাল পিসির বাড়িতে এসে ওর দিদিয়াকে অনেক করে বোঝাতে তবেই ওর দিদি পাত্র পক্ষের সামনে সেজেগুজে বসতে রাজী হয়েছে। এমনিতেই ট্রেন জার্নি করে এসে খুব ক্লান্ত ছিলো জিয়া। তার ওপর পিসির বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফেরার পর আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো ও। তাই রাতে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে রান্না করা ভালো ভালো খাবার খেয়ে অনেক তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিলো ও। সকালে উঠেই জিয়া আবার ওর পিসির বাড়ি চলে এসেছে। কলকাতায় আসার পর থেকে আয়ানের সাথে সেভাবে কথাই হয়নি জিয়ার। আজ সকাল থেকেই জিয়া পিসির বাড়িতে বেশ হাসি-মজা আর হৈ হুল্লোড় করতে করতে আয়ানকে কল করার সুযোগই পায়নি একদম। আয়ানও জিয়াকে সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা ভেবে ওকে আর কোনো কল করেনি।
জিয়া ওর দিদিকে নিজের হাতে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে, পাত্র পক্ষের সামনে বসার জন্য।
-আমাকে কেমন লাগছে মণি?
-তোকে খুব খুব সুন্দর লাগছে সোনা.. আমার মেয়েটা তো এমনিতেই খুব সুন্দর! তার ওপর আবার এতো সাজগোজ করেছিস। একদম রাজকন্যার মতো দেখতে লাগছে আমার মেয়েটাকে! দেখবি আজ পাত্র আর তার মা তোর দিক থেকে চোখই সরাতে পারবে না!
-কী যে বলোনা তুমি মণি! তুমি আমাকে যতোটা সুন্দর মনে করো, আমি কিন্তু ততোটাও সুন্দর নই। জিয়া আমাকে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো তাই হয়তো মনে হচ্ছে..
-হ্যাঁ সোনা, তুই ততোটাই সুন্দর! আর জিয়া আরও বেশি সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে তোকে। কিন্তু চুলটা এভাবে বাঁধলি কেন?! চুলটা তো খুলেই রাখতে পারতিস! খোলা চুলে তোকে আরও সুন্দর লাগতো..
-না পিমণি! দিদিয়ার চুলটা আমিই ওভাবে বেঁধে দিয়েছি। কী হবে চুলটা খুলে রেখে? পাত্রর মা কী টেনে দেখবে নাকি? শোনো পিমণি, ওইসব দিন কিন্তু এখন আর নেই। আর সেইজন্যই আমি ওর চুলটা ভালো করে বেঁধে দিলাম। যদি চুল-টুল খুলে দেখাতে বলে, তাহলে আমি ওই খোঁপার কাঁটা খুলেই ছেলের মায়ের চোখে গুঁজে দিতে বলেছি দিদিয়াকে!
-আঃ জিয়া! তুই চুপ কর এবার.. এসব কী কথা? এভাবে বলতে নেই মা.. পাশের ঘরেই যে ওনারা বসে আছেন, শুনতে পাবেন তো!
-পাক শুনতে! কী হবে শুনতে পেলে? যেটা ঠিক, আমি তো সেটাই বলেছি পিমণি। এই নাও তুমি দিদিয়াকে নিয়ে ওদের কাছে যাও! আমার একটা ফ্রেন্ড কল করছে। আমি কলটা অ্যাটেন্ড করেই আসছি।
বাসন্তীদেবী খেয়াল না করলেও অনেক্ষণ ধরেই বাইরে থেকে জিয়ার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিলো আয়ান। জিয়া ওর সামনে এসে বসলে আর ওকে দেখতে পেলে যে কী বলবে, কী করবে সেসব ভেবেই ভীষণ উত্তেজনায় আয়ানের হাত-পা প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসছিলো আয়ানের। এতো রাশভারী, গম্ভীর, কঠোর ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন অংকের প্রফেসর, যাকে দেখলে ওর স্টুডেন্টরা ভয়ে একদম সিঁটিয়ে থাকে, সেই রাশভারী প্রফেসর যে কীভাবে জিয়ার মতো একটা ছটফটে, দূরন্ত, উড়নচ্ডী মেয়েকে, ওর মুখ ঝামটাকে এতো ভয় পায় সেটা ও নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। আয়ানকে ওরকম ভীত এবং চুপচাপ দেখে বাসন্তীদেবী মনে মনে ভাবলেন আয়ান প্রথমবার কোনো পাত্রী দেখতে এসেছে বলে হয়তো ও একটু নার্ভাস হয়ে রয়েছে। তাই উনি আয়ানের হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন। এর মধ্যেই গায়েত্রীদেবী পাত্রীকে নিয়ে ঘরের ভিতরে এসে হাজির হলেন…
ক্রমশ…
নবম পর্বের লিংক-
https://www.facebook.com/101048758811830/posts/261817279401643/