#দিন_বদলের_হাওয়ায় [১৩]
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
এতোক্ষণে ওর কথা বুঝলাম। ঠিকই তো। এ বাড়ি তো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে গত মাসেই। এখান থেকে তো এবার যেতে হবে। নতুন বাসা দেখে সেখানে উঠতে হবে। কিন্তু ওদের যা আদর আপ্যায়ন দেখছি ওরা কি যাবে? চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
আমাকে চিন্তিত দেখে রেদোয়ান বললো, কি এতো ভাবছো আয়ু?
ভাবছি ওরা আলাদা হবে? তুমি দেখছো না ওদের অবস্থা?
কেন হবে না? আমরা কি সাধে আলাদা হতে চেয়েছিলাম?
তা চাই নি।
তবে চিন্তা করছো কেন এতো? ওদের ছেড়ে তো যেতে চাই নি তবুও যেতে হবে। ওরা চায় না আমরা ওদের সাথে থাকি। ওদের উপর বোঝা হয়ে গেছি আমরা আয়ু! তুমি কি তা বোঝো না?
আমি কিছু বললাম না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এতো দিন ধরে একসাথে আছি কিন্তু হঠাৎ ঝড়ে সব তছনছ।
সময়ের স্রোতে দিন চলতে থাকলো। চারপাশ পরিবর্তন হতে থাকলো ক্রমাগত। কেটে গেলো একটি সপ্তাহ। সময়ের সাথে অনেক কিছু সম্পর্কে শিক্ষা নিতে পেরেছি। গতকাল রেদোয়ান আমাদের জন্য নতুন বাসা দেখেছে। বাসা পছন্দ হওয়ায় ও কালই এডভান্স দিয়ে এসেছে। আমি আর কিছু বলি নি। আজ সকাল থেকে শাশুড়ির সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। কিন্তু সময় হচ্ছে না। আমার শাশুড়ি মহাব্যস্ত। ঘরের কত রকমের কাজ করছেন তিনি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর শাশুড়ি ঘরে বসে পান চিবোচ্ছেন। শান্তি আর জুলি হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। দুজনের অবস্থাই নাজেহাল। বেচারারা কত্ত পরিশ্রম করে সারাটা দিন! এখন আমাদের নতুন বাসার ব্যাপারটা ওদের জানানো দরকার। মাস শেষ হতে আর চার দিন। পরশু ও বাসায় উঠবো। আমি আমার শাশুড়ির কাছে গিয়ে বললাম,
‘আম্মা আমাদের নতুন বাসা দেখা হয়ে গেছে। আমি আর রেদোয়ান পরশু আমাদের নতুন বাসায় উঠবো। আপনাকে গ্রামে মাসে কয় টাকা পাঠাবো?’
আমার কথায় আমার শাশুড়ি হকচকিয়ে গেলেন। কেমন যেন করে তাকিয়ে আছেন তিনি। আমার জায়েরাও কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। আমি স্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো বললাম। আমার শাশুড়ি আমতা আমতা করে বললেন, কি কও এগুলা বউ মা? কে কই যাইবো?
ও মা ভুলে গেলেন আম্মা? গত মাসে না এই বাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা তো আর গ্রামে যেতে পারবো না। ওর অফিস খুলে গেছে। আমরা সামনেই একটা ছোট বাসা নিয়েছি দুজনের জন্য।
কিন্তু…
শাশুড়ির মুখ একদম কালো হয়ে গেছে। জুলি পাশ থেকে বললো, এগুলো কি বলছো ভাবি? আমি তো পরশু দিনই বাড়িওয়ালাকে বলে এসেছি আমরা বাড়িটা ছাড়ছি না।
কেন ছাড়বে না? তুমিই তো বাড়ি ছাড়ার কথা তুলেছিলে? এখন ছাড়বে না কেন? বাড়ি ছাড়লে তো তোমার কিছু টাকা আয় হবে। তাই বাড়িটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
জুলি আমতা আমতা করে বললো, তখন তো…..
আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমরা আর এখানে থাকছি না জুলি। ও বাসায় এডভান্স দেওয়া হয়ে গেছে। আমাদের উঠতে হবে। তুমি বাড়িওয়ালাকে বলার আগে আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করো নি কেন?
আমি তো ভেবেছি ভাইয়ার চাকরি হয়েছে এখন আর কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু এমন হুট করে তোমরা চলে যাবে তা জানি না।
হুট করে বলছো কেন? আগেই তো সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। আর সেটা তুমিই দিয়েছিলে। তখন আমি কিছু বলি নি। এখন তোমারও কিছু বলার নেই জুলি।
আমার শাশুড়ি এতোক্ষণ চুপ ছিলেন। এবার তিনি বললেন, আচ্ছা আর কিছু কইয়ো না তোমরা। বড় বউমা আমি কইতাছিলাম তোমরা ওই বাসাটা না করে দাও। সবাই এখানেই মিল্লামিশ্শা থাকি। ওনে এডভাস (এডভান্স) আর কত হইবো ওইটা না কইরা দাও।
আমি ভীষণ বিরক্ত হলাম। তাদের সাথে আমার আর থাকা হবে না। আমি শান্ত ভাবেই শাশুড়িকে বললাম, না আম্মা। ওখানে আর না বলছি না। আমরা ওখানেই থাকবো। আমরা ওখানে থাকলে কি? আপনাদের আরো ভালো। আমাদের দুজনকে টানতে এতো দিন তো আপনাদের দম ফুরাতো। এখন সেটা হবে না আশাকরি।
আমার শাশুড়ি তৎক্ষণাৎ তেজী মেজাজ নিয়ে বললেন, নতুন বাসায় এডভান্স দিতে টাকা পাইলা কই? কেমনে উঠবা?
রেদোয়ানের টিউশনির টাকা। মাস তো শেষ প্রায়। দুটো টিউশনির টাকা নগদ পেয়েছে। ওটা দিয়েই এডভান্স দিয়েছে। আর কিছু জানতে চান আম্মা?
না আর কি কমু। তোমরাই তো সব নিজেরা নিজেরা কর। আমারে জিগাইছিলা বাসা নেওয়ার আগে?
আম্মা আপনারাই তো গত মাসে বলেছিলেন এ কথা। এখন কি মনে পড়ছে না? ভালো করে ভেবে দেখুন আম্মা। ঠিকই মনে পড়বে। আর আপনি যেহেতু মা তাই আপনার খরচপাতি যা লাগে সব হিসেব মতোই দিবো আমরা। আশা করি আর কিছু বলার নেই।
বলেই ওখান থেকে চলে আসলাম। আমার শাশুড়ির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ঘরে এসে জিনিসপত্র গোছগাছ শুরু করে দিলাম। আস্তে আস্তে সবকিছু গোছাতে হবে। আমি কাপড়গুলো প্রথমেই ব্যাগ ভর্তি করে নিলাম। এরপর ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা টুকিটাকি জিনিসপত্র গুলো একটা পাটের বস্তার ভিতরে রাখলাম। হঠাৎই আমার শাশুড়ি আমার কাছে এলেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই আমার শাশুড়ি বললেন, আমারে মাসে কয় টাকা কইরা দিবা?
আমি শান্ত ভাবেই বললাম, আপনার প্রয়োজন মাফিকই দিবো আম্মা। আপনি টেনশন করবেন না।
কয় টাকা কইরা দিবা কওন যায় না?
আমার শাশুড়ি না শুনে যাবেন না তার কথাতেই বোঝা যাচ্ছে। তাই কোন ভঙ্গিতা ছাড়াই বললাম, হাজার পাঁচেক করে দিবো আম্মা। এতে হবে না আপনার?
আমার শাশুড়ি এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু না বললেও মনে মনে বেজায় খুশি। শাশুড়ি কিছু বললেন না চলে গেলেন। থাকবেন তো ওই ছেলেদের কাছেই আমরা যেটা দিবো সেটা হবে তার আয়। আমি বুঝি না এই বয়সে আয় করে তার লাভটা কি? তিন তিনটে ছেলে আছে। তারা কি পারে না মাকে অন্ন দিতে? যাক যে যেভাবে খুশি থাকে থাকুক সেভাবে।
রেদোয়ান আজ বাড়িতে ফিরলো বেশ রাত করে। সারাটা সন্ধ্যা একা একা ঘরের ভিতর বসে কাটিয়েছি। বিকেলে নতুন বাসার খবর তাদের দেওয়ার পর আমার সাথে কেউ ততটা কথা বলছে না। সবার মুখেই বিষন্নতার ছায়া। আমিও আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাই নি কারো সাথে। সবার সব রূপ দেখে নিয়েছি আমি।
রেদোয়ান আজ এসেই বললো কাল সকালে রুশা আপার বাসায় যাবে। আমি আর কিছু বললাম না। যেতে যখন চাইছে তখন যাবেই আমি বাঁধা দিয়ে আর কি হবে?
সকালের নাস্তা সেরে আমরা দুজনেই রুশা আপার বাড়ির বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। তাদের বাড়িতে পৌঁছাতে এগারোটা বেজে গেলো। কেমন যেন লাগছে আমার। রুশা আপার কাছ থেকেও কম কষ্ট পাই নি আমি। রুশা আপা ওদের পাঁচ ভাইবোনের মাঝে সবার বড়। ও বাড়িতে বউ হয়ে যখন গেলাম সংসারের কাজকর্ম ততটা ভালো পারতাম না আমি। তিনিই আমায় সব কিছু হাতে কলমে শিখিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎই সবার সাথে সাথে বদলে গেলেন তিনি। আজ বহুদিন পর তার কাছে যাচ্ছি। জানি না তিনি কিভাবে গ্রহণ করবেন আমায়। একদমই সাচ্ছন্দ্য বোধ হচ্ছে না। তবুও দরজায় টোকা দিলাম। রুশা আপা নিজেই দরজা খুলে দিলেন। আপা আমার সাথে স্বাভাবিক আচরণই করলেন। দুপুরের খাবার দাবার সেখানেই শেষ হলো। আসার সময় আমার নুপূর জোড়া রুশা আপা আমায় ফিরিয়ে দিলেন। নিজের কাজের জন্য লজ্জিতও হলেন। আমি কিছু বললাম না। নূপুর জোরা নিশিকেই দিয়ে দিলাম। মেয়েটার পায়ে নূপুর জোরা বেশ মানিয়েছে। এটা আর নিতে ইচ্ছে হলো না। আমার মেয়ে হলে কি আমি দিতাম না? আমার থেকে চেয়ে নিলে আমি নিশ্চয়ই দিতাম। কিন্তু এভাবে না বলে নেওয়াটা আমার পছন্দ হয় নি।
বিকেলে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে গাড়ি খুঁজে চলেছি। রেদোয়ান বার বার এদিক ওদিক গাড়ি খুঁজে চলেছে। আমিও চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছি। কিন্তু হঠাৎই আমার চোখ গেলো রাস্তার ওপাশে। যা দেখলাম তা কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না!
চলবে………
(রিচেক হয় নি। অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমা করবেন।)