কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:২৬
কলমে : ইয়াসমিন
প্রিয়তমার মুখটা দুহাতের মধ্যে নিয়ে বসে আছে জামসেদ। কত বছরের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব রয়েছে বাকী কিন্তু প্রিয়তমার কষ্টের কাছে সেসব কিছুই না। এতগুলো বছর পরে নিজের ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে হৃদয়ের প্রতিটা কোণ আন্দোলিত হচ্ছে। ভালোলাগা ভালোবাসার অনুভূতিগুলো ডানা ঝাপটে মন আকাশে ডানা মেলেছে। তবুও পূণরায় হারিয়ে ফেলার ভয়ে ও কুঁকড়ে যাচ্ছে। কেনো এমন হচ্ছে ওর অজানা। নিজের কাছে নিজে আজ অপ/রাধী। এতবছরের করা পা/পের কালিমাখা হস্ত দ্বারা প্রিয়তমার পবিত্র ছোট্ট শরীরটাকে কিছুতেই নোংরা করতে মন সাড়া দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটু খানি ছুঁয়ে দিলেই মেয়েটা ঝরা ফুলের পাপড়ির ন্যায় ঝরে পড়বে। হাই খোদা,এ কেমন অনুভূতি?প্রতিটা সেকেন্ড শুধু নিজের করা অন্যায়গুলো চোখের সামনে শরৎ কালের মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। কিভাবে ওকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করবে সেই কষ্ট ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। ভাগ্যকে দোষারোপ করে কি হবে পাপ তো ও নিজ হাতেই করেছে। এতগুলো বছর শুধু নিজের জন্মদাতা পিতার উপরে রুষ্ট হয়ে দোষারোপ করেছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে উনি জন্মের পরে ওকে এতিমখানায় রেখে মোটেই ভুল কাজ করেননি। বরং ড্যাড যে ওকে সীমাহীন ভালোবাসা আর ঐশ্বর্যের মোহে আকৃষ্ট করে খারাপ কাজে লিপ্ত করেছে তার প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। জীবনটা এমন না হলেও পারতো। আফসোস হচ্ছে খুব। জামসেদ এক দৃষ্টিতে মীরার দিকে তাঁকিয়ে আছে। মেয়েটা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কিছুক্ষণ আগে ওদের বিয়ে হয়েছে যদিও সেটা খুব গোপনে। মেয়েটার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। সুস্থ হতে সময় লাগবে। নীরবতা ভেঙে মীরা মুখ খুলল।
> কহিনুরকে ডাকবেন প্লিজ? মেয়েটাকে খুব দেখতে মন চাইছে। ভেবেছিলাম কখনও আর আপনাকে দেখা হবে না। এখন মরেও শান্তি। সবটা তো ওর জন্য।
জামসেদ সব খারাপ লাগা পাশ কাটিয়ে মেয়েটাকে নিজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> এখুনি চলে যাওয়ার ভাবনা ভেবোনা। তোমার সব দুঃখ কষ্টের স্মৃতি মলিন করে সুখের সমুদ্রে নোঙর করার সুযোগ দাও প্লীজ। কথা দিচ্ছি যা কষ্ট পেয়েছো তার হাজার গুণ সুখ তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে তবে আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিব। আমি পা/পি অনেক পা/প করেছি দয়াকরে ভূল বুঝো না। যদি ছেড়ে যাও তবে আমার হৃদপিণ্ডকে ধা/রা/লো খ/ঞ্জ/র দ্বারা ক্ষতবীক্ষত করে যেও তবেই শান্তি পাবো।
জামসেদের কন্ঠ কাঁপছে।মীরা আবারও ফুপিয়ে উঠলো। জামসেদের কথার উত্তর দিতে পারলো না। যাকে ভালোবাসা হয় তার খারাপ দিক গুলো যে চোখে পড়ে না। হোক পা/পি,তা/পি খা/রাপ তবুও এই সীমাহীন ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার সাধ্য মীরার নেই। পৃথিবীতে এই লোকটা ছাড়া ওর কে আছে? কেউ নেই। মেয়েটাকে শান্ত করতে জামসেদ ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। চোখের পানি মুছে মুখের উপরে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বলল,
> কহিনুর এখানে নেই। ওর নিরাপত্তার দরকার। জুবায়ের ওকে নিয়ে চলে গেছে। চিন্তা করো না খুব তাড়াতাড়ি ওরা ফিরবে।
উত্তরে মীরা ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> মেয়েটা প্রচণ্ড সাহসী। জানেন কালো যাদু দ্বারা হ/ত্যা করা মেয়েদের আত্মা ওর জন্য মুক্তি পেয়েছে। সঙ্গে আমিও।
জামসেদ পূনরায় মীরাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো। মেয়েটা এতো এতো কষ্টে ছিল ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। দাদুকে কোনো রকমে শান্ত করতে পেরেছে কিন্তু ওর নিজের উপরে নিজের ভরসা হচ্ছে না। যেকোনো সময় কালো যাদুর প্রভাবে ও আবারও ভুলভাল কিছু করে বসতে পারে। নিজেকে কন্ট্রোল করা জরুরী। কথাটা ভেবে ও মীরার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
> এই বাড়িতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। কলি তোমার দেখাশোনা করবে। এখানে আমি সব সময় থাকতে পারবো না। রাতে আসবো।
মীরা উত্তর দিলো না। যতটা খারাপ অবস্থায় ছিল তার থেকে হাজার গুণ ভালো আছে।সেখানে যদি থাকতে পারে তাহলে এখানে কেনো পারবে না? তাছাড়া লোকটা ওর ভালো চেয়ে যা করবে ও মাথা পেতে নিবে। দিনে একবার হোক দেখা তো হবে?এটাই যথেষ্ট।
_______________
পূর্বের ছটফটানি আবারও ফিরে এসেছে আধারের শরীর মন বেয়ে। খান ভিলাতে দুদিন থাকার পরে যখন সুলতান ভিলাতে পা রাখে তখনই শুনতে পেয়েছে ওরা কোথাও একটা চলে গেছে। সেদিন খুব চিৎকার করতে ইচ্ছা করেও নিজেকে সামলে নিয়েছে। জামসেদ ফারুকীর উপরে নজরদারির ব্যবস্থা করেছে কিন্তু সন্দেহ হয় এমন কিছু চোখে পড়েনি। লোকটা চালাক তবে কহিনুরের বাবা মা অত্যধিক বুদ্ধিমান। ওরাই মেয়ের ভালোর জন্য পালিয়েছে। অপরাধ করেছে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে। আধার ঠিক ওদেরকে খুঁজে বের করবে তারপর কি হবে?আর কিসের বিয়ে? ওসব বিয়ে আধার মানেনা। চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। তেমনি কহিনুরের অনাকাঙ্খিত একটা বিয়ে হয়েছে তাঁতে কি যায় আসে? এমন বিয়ে হাজারটা হোক তবুও মেয়েটা ওর একান্ত নিজের। কাউকে দখলদারী করতে দিতে ও রাজি না। কহিনুর ওর নিজস্ব সম্পত্তি। কথাগুলো ভেবে ও সমুদ্রের তীরে হাত দুটো মেলে ধরলো। এখানেই ওর সঙ্গে মেয়েটার প্রথম দেখা হয়েছিল। সেই রাতের কথা ভাবলেই ওর গলা বুক শুকিয়ে যায়। কি অপরূপ লাবণ্যের অধিকারী মেয়েটা। ওর পাতলা চিকন ওষ্ঠদ্বয় আর মিটিমিটি জ্বলতে থাকা চোখের তারাতে সত্যি স্বর্গ আছে। তার স্বাদ আহরণ আধার নিশ্চয়ই করবে কারো ক্ষমতা নেই আটকানোর। পাখিটা যে শুধুমাত্র ওর আকাশেই ডানা ঝাপটে উড়বে। কথাগুলো ভেবে ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেছে আর না। আগামীকাল ভোরে ও জার্মান যাচ্ছে। প্রিয়তমা যে সেখানেই আছে।
***********
নিইস নদীর তীরের একটি ছোট্ট শহরে সুলতান জুবায়ের ফারুকী স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে বসবাস গড়ে তুলেছে। এ শহরের নাম গরলিটজ, জার্মানির সবচেয়ে পূর্বের শহর, যে শহরে প্রথম সূর্যোদয় হয়। এ শহরের প্রতিটি কোণে গল্পের উপাদান ছড়িয়ে আছে শহরের প্রকৃতি, ঐতিহাসিক স্থাপত্য, ভাস্কর্য, জাদুঘর, গ্রন্থাগার, মানুষ, সুস্বাদু খাবার এবং হাজার বছরের ইতিহাসে। তাই তো গরলিটজকে জার্মানির সবচেয়ে সুন্দর শহর বলে মনে করা হয়। জুবায়ের পূর্বে একবার এখানে এসেছিল একটু চেনাশোনা আছে বিধায় তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অধরা নিজের মতো করে ঘর সাজিয়ে নিয়েছে। যদিও বিশাল কোনো বিল্ডিং না কাঠের তৈরী তিন কক্ষবিশিষ্ঠ ছোট্ট একটা বাড়ি। একদম রুপকথার গল্পের মতো। অধরার খুব পছন্দ হয়েছে।কিন্তু সমস্যা অন্যখানে অনেকগুলো বছর বাংলাদেশে থাকার দরুন এখানকার ঋতুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছে। জার্মানি এমন একটা রাষ্ট্র যেখানে এক দিনে চার ঋতুর সঙ্গে দেখা পাওয়া সম্ভব।অন্যদিকে কহিনুরের জন্ম ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে। এখানে এসে হঠাৎ বৃষ্টি, হঠাৎ তুষারপাত আর গরমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অধরা ওকে কক্ষের বাইরে যেতে দেয়না বললেই চলে। জুবায়ের ওকে বুঝিয়েছে মেয়েকে এবার শক্তহাতে তৈরী করতে হবে। এভাবে ঘরকুনো হয়ে থাকলে চলবে না। এখানকার পরিচিত একজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জুবায়ের একটা ছোট্ট কফি হাউজ খুঁলেছে। কতগুলো দিন থাকতে হবে তারতো ঠিক নেই।একাউন্ট থেকে টাকা উঠালে ঝামেলা হতে পারে। জামসেদ যে অর্থ দিয়েছিল ওটা দিয়ে মোটামুটি নিজদের থাকার জন্য একটা বাড়ি ভাড়া আর কফি হাউজটা নিতে পেরেছে। এক ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গেছে মেয়ে শশুর বাড়ি উনার থেকে জুবায়ের খুব অল্প মূল্যতে পেয়ে গেছে এগুলো। যদিও অর্থের থেকে ভদ্রলোকের স্নেহ মায়া মমতার অভাব ঢের বেশি। পাশাপাশি বাড়িতে উনি থাকেন। এই বাড়িটা উনার স্ত্রীর নামে তৈরী করেছিলেন। এতদিন মায়া করে রেখেছিলেন হঠাৎ জুবায়ের আর অধরার অসহায় অবস্থার কথা ভেবে রাজি হয়েছেন। বিপদের দিনে আল্লাহ ঠিক কোনো না কোনো রাস্তা তৈরী করে দেন। মানুষের শুধু ধৈর্য্য ধারণের ক্ষমতা রাখতে হয়। পড়ন্ত বিকেলে হঠাৎ গরম পড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ আগেও ঝুম বৃষ্টি ছিল। জুবায়ের কফি হাউজে আছে অধরা রান্না বসিয়েছে। কহিনুর জানালায় চোখ রেখে বসে ছিল হঠাৎ বাইরে যাওয়ার প্রচণ্ড তৃষ্ণা ওকে জেকে বসলো তাই আর অপেক্ষা না করে চুপচাপ বেরিয়ে আসলো। বাড়ির সামনে সবুজ ঘাসের মাঝখান দিয়ে কালো পিচঢালা রাস্তা। খানিক এগিয়ে নদীর দুপাশ জুড়ে পাইন, বার্চসহ নানান গাছপালা। যদিও নদীর অস্তিত্ব সম্পর্কে কহিনুর অবগত না বিধায় ঘাসের উপরে চুপচাপ বসে পড়লো। এমনিতেও ওর একা থাকার অভ্যাস আছে তবুও নতুন পরিবেশে কেমন অস্বস্তি লাগছে। মাঝে মাঝে কথাবলতে ইচ্ছে করে কিন্তু বলতে পারে না। ভেতর থেকে কেউ একজন নিষেধ করে।মুখ খুললেই যেনো সর্বনাশ হয়ে যাবে। সবুজ ঘাসের মধ্যে টকটকে লাল রঙের গাউন পরিহিত মেয়েটাকে রূপকথার রাজকুমারীর মতোই লাগছে হঠাৎ একটা হাসির শব্দে ওর ধ্যান ভাঙলো। কহিনুর চমকে উঠে পেছনে ফিরে ভ্রু কচকে ফেলল। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার গায়ে ওর মতোই ড্রেস তবে মুখের আদল মোটেও ওর মতো না। মোটামুটি সুন্দরী বলা যায়। কহিনুর কৌতূহল নিয়ে তাঁকিয়ে আছে। মেয়েটা তখনই মুখ খুঁলল,
> আমি পিউ,সামনের বাড়িতে থাকি। তোমার ড্রেস যখন ক্রয় করা হয় তখন আমি মমের সঙ্গে ছিলাম। অবশিষ্ট দুটো ছিল। যেটার একটা তোমার আরেকটা আমার। দেখো কি সুন্দর মানিয়েছে!
কহিনুরের কপালে ভাজ পড়ে গেলো।মেয়েটা বাঙ্গালী তবে অতিরিক্ত কথা বলে। প্রথম আলাপে মানুষ নাম ঠিকানা জানতে চাই অথচ মেয়েটা কি অদ্ভুত ধরণের কথাবার্তা বলছে। কহিনুর মলিল হাসলো। তাতেই মেয়েটা হয়তো অনেক কথা বুঝে নিলো। মেয়েটা মন খারাপ করে বলল,
>মম বলেছে তুমি তো কথা বলতে পারোনা। সে যাইহোক তুমি ভীষণ সুন্দরী। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে? তোমাকে আমি এই শহর ঘুরিয়ে দেখাবো। খুব মজা হবে।
কহিনুর পূনরায় হেসে মাথা নাড়িয়ে রাজি হলো। মেয়েটা এক মূহুর্ত আর অপেক্ষা করলো না ওর হাতদুটো ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললো নদীর দিকে। নদীর পা ভিজিয়ে উল্লাস করতে কতই না মজা হবে। তাছাড়া এই সময় সেখানে সমবয়সি অনেকেই ঘুরতে যায়। কহিনুর বিব্রত হলো তবুও অদম্য এক ইচ্ছে ওকে টানতে থাকলো। মেয়েটা অনবরত কথা বলছে কহিনুর সেটা আগ্রহ করে আশপাশটা দেখছে। কতকিছু ওর অচেনা অদেখা রয়ে গেছে। পিপাসিত মন কেনো এতোকাল ঘরের কোনে পড়ে ছিল জানা নেই। যতই সামনে এগিয়ে গেলো ততই মনের মধ্যে ভালো লাগা ঘিরে ধরলো। এক সময় ওরা নদীর তীরে এসে থামলো। পাথরের উপরে মেয়েটা পা ছড়িয়ে বসতে বসতে বলল,
> এখানে আমি রোজ আসি তুমি আসবে আমার সঙ্গে?
কহিনুর কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। পিউ বুঝে নিলো কহিনুরের পছন্দ হয়েছে। ওর কাছের কোনো বন্ধু নেই। সব সময় একা থাকতে ভীষণ বিরক্ত লাগে। তবুও একজনকে পেয়েছে সেই আনন্দে ওর নাচতে মন চাইছে। অসংখ্য লোকজন নদীর তীরে ঘুরছে ছবি তুলছে। এটা পর্যটন এলাকা না হলেও মোটামুটি বেশ লোকজন থাকে। ছেলেমেয়েরা হাটাহাটি করে স্থানীয়দের তুলনায় শহরের বাইরের লোকজনের যাতায়াত এখানে বেশি। ওদের থেকে কিছুটা দূরে দুজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।। ছেলেটার চোখে কহিনুরের প্রতিচ্ছবি ভাসছে। এমন সুন্দর হয়তো ওর চোখে এই প্রথম। ছেলেটার কেমন হিংসা হলো এই ভেবে যে মেয়েটা এমন রূপের পসরা নিয়ে খোলা জায়গায় বসে আছে লোকের নজর লেগে যাবে ভেবে। এমন গায়ের রঙের সঙ্গে কি দরকার ছিল লাল রঙের পোশাকে নিজেকে আবৃত করার? ওর ইচ্ছা হলো অবাধ্য এই কিশোরীকে ধমক দিয়ে দুটো কথা শুনিয়ে আসতে কিন্তু ভেতর থেকে শক্তি পেলো না। কারণ অধিকারের প্রশ্ন। ও তো নিজেই নিজের নেই। অচেনা একজনের লিখিত আমানত। মেয়েটার দিকে এভাবে তাঁকানো ওর শোভা পাচ্ছে না। নিজেকে ছোট লাগছে তবুও এক অদৃশ্য ভালোলাগা ওকে ঝাপটে ধরেছে। ভয়ানক সব ইচ্ছারা মনের কোনে উঁকিঝুঁকি কাঁটছে। ঘরে বউ রেখে পরনারীর দিকে এভাবে মুগ্ধ হয়ে তাঁকানো যে ভয়ানক অপরাধ।তবুও মনকে বোঝাতে পারছে না।একসময় ঘোর লাগা চোখে ও সব ন্যায়নিষ্ঠতা পাশ কাটিয়ে পা বাড়ালো অচেনা মেয়েটার দিকে। অদম্য জিদ মাথায় পেয়ে বসেছে আশকারা দিচ্ছে। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ ও থমকে গেলো। কারণ মেয়েটা ততক্ষণে পিছে হাটতে শুরু করেছে। ছেলেটার পেছনে থেকে ডাক পড়লো,
> ভাইয়া মম দ্রুত ফিরতে বলেছে এখুনি যেতে হবে। তুমি অন্যদিন এসো। আজ আর না।
ছেলেটা থমকে গেলো। হলো না ওই মায়াপরীর সঙ্গে দুটো কথা বলার সুযোগ। সাময়িক মোহ ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল ক্ষণিকের জন্য তবে বাস্তবে ফিরেই নিজেকে ধিক্কার করলো। “ছিঁঃ তোর চরিত্র এতো খারাপ হয়ে গেছে!স্ত্রীর সঙ্গে বেইমানি করতে যাচ্ছিস?কোনো মোহ তোকে বশ করতে পারে না। তুই শুধুমাত্র একজনের জন্য। তোর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা হচ্ছে তোর স্ত্রী। সে যেমনি হোক তবুও সে তোর নিজের। একান্ত নিজের।
__________________
কক্ষে ফিরে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো জুবায়ের। সারাদিন বেশ পরিশ্রম হয়েছে খুব ক্লান্ত লাগছে। রেডিমেড কফি হাউজ পেয়েছিল এটাই অনেক। পড়ে থাকা কক্ষটা সাজাতে সময় লেগেছে। মাস খানেক টুকটাক অনেক কিছু কিনতে হয়েছে। এখন মোটামুটি ভালো চলছে দোকানটা। কোরিয়ান একটা ছেলের সঙ্গে ও নিজেই সবটা দেখাশোনা করে। অবস্থা বুঝে আরও দুজন লোক রাখার কথা ভাবছে। জুবায়ের ফারুকী ব্যবসায়ী মানুষ এসব বেশ ভালো আর দক্ষ হাতে সামলাতে পারে। তাছাড়া সুলতান পরিবারের ছেলেদের কোনো এক অদৃশ্য কারণে অর্থ অভাব ওদের ছুঁতে পারেনা। যেখানেই যা ইনভেষ্ট করে লাভ হয়ে যায়। হয়তো কহিনুরের কাছে চাওয়া সেই মহান ব্যক্তির জন্য। ভদ্রলোক চেয়েছিলেন সুলতান বংশের থেকে কখনও যেনো ঐশ্বর্য না হারিয়ে যায়। এটাই যুগের পর যুগ অভিশাপ হয়ে নাকি আশির্বাদ হয়ে কাজে লাগছে এটা ওর জানা নেই। কথাগুলো ভেবে জুবায়ের উঠে বসলো। খানিক পরে কফি হাতে ভেতরে প্রবেশ করলো অধরা। সেটা জুবায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
> এটা তোমার জন্য।
বিনিময়ে জুবায়ের সন্তুষ্ট চিত্রে হেসে কফি কাফটা পাশে রেখে অধরাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> সারাদিন এই কফির উপরেই আছি। এখনো তো আবার কফি হাউজরের মালিক। আর কত খেতে হবে বলো?এর চাইতে চুমু টুমু দাও ভালো লাগবে।
অধরা নাম মুখ কুচকে বলল,
> বউয়ের হাতের স্পেশাল কফিকে আপনার সস্তা মনে হচ্ছে? আপনার কফি হাউজের কি যোগ্যতা আছে যে আমার সঙ্গে পারবে? আমার থেকে শিখুন।
জুবায়ের মজা করে বলল,
> তুমি বরং শিখিয়ে দাও কিভাবে বউকে কাছে ডাকলে বউ ছুঁটতে ছুঁটতে চলে আসবে। এক সেকেন্ডের বিরহেও আমি জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি বোঝো না কেনো? শেখাও না প্লীজ প্লীজ।
অধরা বুঝতে পারলো জুবায়ের মজা নিচ্ছে। লোকটা এরকম কেনো কে জানে। হাজারো প্রশ্ন আর চিন্তা নিয়ে সেদিন ওরা বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছিল। ওখানকার খবরাখবর জানা হয়নি। এভাবে দূরে থাকলে রহস্য খোলাসা করবে কিভাবে একটুও চিন্তা করছে না। আছে বউয়ের সঙ্গে মজা নিতে। অধরা ওর থেকে মুক্ত হতে জোর খাটালো কিন্তু সুবিধা করতে পারলো না। জুবায়েরের শক্ত হাতের মুঠোয় বন্ধী ওর বাহুদ্বয়। অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,
> আপনাকে কবিরাজ দেখানো দরকার জানেন? চৌধুরী বাড়িতে থাকতে শুনেছিলাম জ্বীনে ধরলে মানুষ অদ্ভুত আচরণ করে। আপনারও তাই হয়েছে। ছাড়ুন আমি রেগে যাচ্ছি।
অধরার কথা শুনে জুবায়ের হাসলো। ওর কাধে নিজের থুতনি রেখে বলল,
> উন্মাদকে যতই কবিরাজ দেখাও বা ডাক্তার দেখাও কাজ হবে না। বউয়ের প্রেমে আপাতত আমি উন্মাদ তাই ঠিক হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। ওসব ছেড়ে তুমি বরং আমাকে কিছু খাবার দাও। বর বাড়িতে ফিরলে সেবাযত্ন করতে হয় জানো না মেয়ে? যাও যাও।
জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। সবটা ঘটলো চোখের পলকে। অধরা রাগে ফুলছে আর একটু হলে পড়ে যেতো। লোকটা মহা ফাজিল। মাথায় শুধু বদ বুদ্ধি ঘোরে। ওকে এতক্ষণ আটকে রেখে এখন দোষ দিচ্ছে। সময় হলে উচিৎ শিক্ষা দিবে তবে দোম।
_________________
ঘনঘন নিশ্বাসের শব্দে কহিনুরের ছোট্ট শরীরটা মৃদু উঠানামা করছে। বিকেলের গরম ভাবটা এখন আর নেই। শীত পড়ছে হয়তো তুষারপাত হতে পারে। ঘন অন্ধকার কক্ষে হঠাৎ একজোড়া চোখ কহিনুরের মুখের উপরে নেমে আসলো। গভীর সেই দৃষ্টি। মেয়েটার নিশ্বাস থমকে গেলো। হয়তো ঘুমের মধ্যেই মেয়েটা বুঝে নিয়েছে কেউ ওকে গভীর দৃষ্টিতে দেখছে। কহিনুরের সহ্য হলো না। চোখ বন্ধ করেই থাবা বসিয়ে দিলো সেই চক্ষুদ্বয়ের দিকে। হাতের নক গিয়ে বিধলো সেই ঘোলাটে ভয়ানক চক্ষুতে। সঙ্গে সঙ্গে চাপা গর্জন। ছটফট করতে করতে সেই গর্জনটা দূর থেকে বহুদূরে সরে গেলো। কহিনুর ঘুমের কোনো ভাবান্তর হলো না চোখ বন্ধ করেই রেখেছে শুধু ঠোঁটের কোনে সুক্ষ হাসির রেখা দেখা গেলো তারপর আবারও সেই নির্জনতা ঘিরে ধরলো।
চলবে