#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#১৩তম_পর্ব
ধারার প্রতিটা কথা চুপ করে শুনেছে অনল। ধারা কথাগুলো বলে এগিয়ে যেতে নিলে হ্যাচকা টানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে অনল। ঘটনার আকর্ষিকতায় ধারা টাল সামলাতে না পেরে ওর বুকে আছড়ে পড়ে। অনল ও সুন্দর ভাবে তাকে সামলে নেয়। মাথা তুলে অনলের দিকে তাকাতেই বজ্রের মতো কঠিন কন্ঠে তাকে শুনিয়ে দেয়,
– ঠিকভাবে দু কদম চলতে পারে না আসছে একা একা হাসপাতালে যাবে। বেশি পাকামো করিস না। আমি যখন বলেছি আমি দিয়ে যাবো, মানে আমি নিয়ে যাবো। আর একটা কথা শুনলে কান লাল করে দিবো।
অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ধারা। অনল এখনো তার বাধন হালকা করে নি। অনলের দৃষ্টি ধারার আখি বরাবর। কোনো অজানা আকর্ষণে চোখ সরাতে ইচ্ছে হচ্ছে না ধারার। এই লোকটার সমস্যাটা কি সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। একবার কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় আবার অধিকার দেখায়। এই অনুভূতির উত্থান পতনে ধারা বুঝে উঠতে পারছে না তার কি করা উচিত। কতোক্ষণ অনলের বাহুডোরে ছিলো সেই হিসাবটা সে লাগাতেও যায় নি। সেদিনের রুমের ব্যবহারটা মনে পড়তেই ঝট করে সরে আসলো অনলের কাছ থেকে। ধারার এই আচারণটাই স্বাভাবিক এতে অস্বাভাবিকের কিছুই নেই। চোয়াল শক্ত করে ধারা বললো,
– কি প্রমাণ করতে চাইছো? খুব মহৎ তুমি? যথেষ্ট মহত্বের পরিচয় তো দিয়েছো। এবার আমাকে আর ঋণী করো না। নিজের কাছে নিজে প্রতিনিয়ত ছোট হয়ে যাচ্ছি। আবার তুমি দয়া দেখিয়ে এসব করবে, তারপর আমি আবার পেয়ে বসবো। বলা তো যায় না। আমার মতো মেয়ে
কথা শেষ করার আগে ধারার বাহু চেপে ধরলো অনল। শক্ত হাত দিয়ে বেশ শক্তি প্রয়োগ করেই ধরেছে সে। বেশ অগ্নিদৃষ্টি ধারার দিকে প্রয়োগ করে পূর্বের ন্যায় কড়া কন্ঠেই বললো,
– আর একটা শব্দ যাতে তোর মুখ থেকে না বের হয়। আমি রাস্তায় কোনো সিন ক্রিয়েট চাই না। আমার সময়ের একটা দাম আছে।
– তাই তো বলছি একা চলে যেতে চাচ্ছি।
– বেশি লায়েক হয়ে গেছো তুমি, একটা থাবা দিবো সব লায়েকি ছুটিয়ে দিবো। বুজেছি তোমার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আর আমি তোমার জন্য কিছুই করছি না। আমার নিজের জন্য করছি। সুতরাং আমাকে আমার কাজ করতে দাও।
কড়া ভাষ্যে কথাগুলো বলেই ধারার কোমল হাতটা নিজের মুঠোতে নিয়ে হাটা শুরু করলো। ধারা চেষ্টা করেও পারলো না কিছু করতে। এবার অসম্ভব রাগ হতে লাগলো তার। অনলের খবরদারি স্বভাবে খুবই বিরক্ত সে। অনল নিজেই তাকে তার থেকে দূরে থাকতে বলেছে। অথচ এখন সে আবার নিজেই ধারার জন্য এসব করছে। ধারা নিজের মনকে এই এক মাসে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে নিয়েছে মোটেই সে অনলের প্রতি দূর্বল হবে না। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য পড়াশুনাও শুরু করে দিয়েছে সে। অথচ আবারো নিজের মস্তিস্কের প্রহরীগুলোকে পরাজিত করে হৃদপ্যের মাঝে কবজা করে নিবে অনল। আর অপমানিত হওয়ার মতো সাহস তার নেই। অনল গাড়িতে উঠার আগ অবধি তার হাত ছাড়ে নি। শুধু তাই নয়, সি.এন.জি তে উঠার পর ও ধারা হাত নিজের মুঠোছাড়া করে নি সে। যেনো ছেড়ে দিলেই কোথাও পালিয়ে যাবে ধারা। গাড়িতে একটা কথাও বলে নি ধারা। সে জানে অনলের সাথে কথা বলা মানে অরণ্যে রোধনছাড়া কিছুই হবে না। পাশাপাশি বসা দুজন মানব-মানবীর মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। তারা চাইলেও হয়তো এই দূরত্ব মিটাতে পারবে না, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা____
ডাক্তারের কেবিনে বসে রয়েছে ধারা এবং অনল। গাইনি চিকিৎসক ডা.ইশরাতের তাদের মুখোমুখি বসা। ডা.ইশরাত অনলের ম্যাডাম। হাসপাতালে সবথেকে ভালো ডাক্তারদের মধ্যে একজন। তিনি খুব যত্ন করে সব টেস্ট করে ধারার। ধারার ওয়েটটা বেশ কম। এই ব্যাপারটা ডাক্তারকে বেশ ভাবাচ্ছে। বাচ্চার গ্রোথ দেখতে আলট্রাসোনোগ্রাফি করাটাও প্রয়োজন। তাই ডা.ইশরাত অনলকে জানালেন,
– অনল, বেবির এখন সাত উইক চলে কিন্তু ধারার ওয়েটটা বেশ কম। আমি তাই আলট্রাসোনো করে দেখবো। তুমি ওকে নিচে নিয়ে যাও। আলট্রাসোনো করে রিপোর্টটা আমাকে দেখিয়ে নিও।
– ম্যাম, আপনি কি খারাপ কিছু এস্যুম করছেন?
– আই ইম নট শিওর। যদি বেবুর হার্ট রেট ঠিক থাকে দেন টেনশনের কিছু নেই। তবে ধারার খাবার দাবার একটু বাড়িয়ে দাও। যদি ওর সাইজ এমন থাকে তাহলে কিন্তু প্রবলেম হবে। আর মেয়ে একটু বেশি খাওয়া দাওয়া করবা। যা খেতে চাবে অনলকে বলবে ও কিনে দিবে। এই সময়টাই সুযোগ। হাসবেন্ডদের নিয়ে খাটিয়ে নেওয়ার। হাহা
ডা.ইশরাতের কথায় মনের মাঝে এক ঝাক শুন্যতা তৈরি হয়। শুধুমাত্র আবেগের বশে সে যে ভুল করেছে সেইটার কারণে আজ সে আশ্রিতা হয়ে রয়েছে অনলের কাছে। কোন অধিকারে কিছু চাইবে। এই বাসার খাবারও গলা থেকে নামে না তার। কিন্তু কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বাবা-মার কাছে যাবে না কারণ তারা তাকে মেনেই নিয়েছে অনলের উদারতার জন্য। এই ছাদটা ব্যতীত কোথাও যাওয়ার সুযোগটাও নেই ধারার। ধারার চিন্তায় ছেদ পড়ে অনলের একটা কথায়,
– ধারার কোনো অযত্ন হবে না ম্যাডাম। ওর খাবারের দায়িত্ব এখন থেকে আমার ম্যাম। চিন্তা করবেন না।
অনলের কথাটা শুনে বেশ অবাক ই হলো। কিছু প্রশ্নের হয়তো উত্তর পাওয়া যায় না। এখন ধারার ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। অনল যত্ন সহকারে তাকে দাঁড় করিয়ে নিচে নিয়ে গেলো। ধারা বাধা দিলেও সে শুনে নি, আলট্রাসোনোগ্রাফী রুমে সে প্রবেশ করেছে। ওখানের কর্মরত মহিলা যখন স্ক্রিনে বাচ্চার অবস্থান দেখছিলো, তখন একটি ক্ষুদ্র ডটের মতো লাগছিলো ভ্রুণটিকে। মাত্র তো সাত উইক,, তবুও বেশ জোড়ালো তার হার্ট বিট। গ্রোথ আশানুরুপ না হলেও বাচ্চাটি সুস্থ আছে। ধারা অশ্রুসিক্ত চোখে ছবিটিকে দেখেই যাচ্ছিলো। হ্যা, এটাই তার বাচ্চা। হোক না অবৈধ, কিন্তু মা-বাচ্চার সম্পর্ক তাও বৈধতা অবৈধতা মানে না। এটা একটা অন্যরকম টান। যা সকল সম্পর্কের উপরে। হঠাৎ খেয়াল করলো অনল এক দৃষ্টিতে ওই ছোট বলটির দিকে তাকিয়ে আছে। অনল নিজেও জানে না এই আকর্ষণটাকে কি বলে। এই ক্ষুদ্র মাংসপিন্ডের হার্টবিট যেনো সরাসরি তার হৃদস্পন্দন দিয়ে অনুভব করতে পারছে। তার সাথে তো বাচ্চাটার কোন যোগসূত্র নেই, তবুও কেনো যেনো মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটি তার অনেক কাছের। অনল চোখ যেনো খুশিতে ভরে যাচ্ছে। পাঁচ বছরে এতোটা সুখ তার কখোনোই অনুভব হয় নি। আজ ধারা যতটা বাচ্চাটিকে অনুভব করেছে, অনল ও ততোটাই অনুভব করেছে। হয়তো এইটা তাদের সম্পর্কের যোগ সূত্র____
বিকেল ৪.৪৫টা,
সূর্য পশ্চিমে ঢেলে পড়েছে। এখোনের রোদে সাধারণত কোনো উত্তাপ থাকে না। আজ ও তেমন কোনো কোন উত্তাপ নেই রোদের। নদীর ধারে উত্তাপ আরো কম, মিষ্টি রোদ সাথে ঠান্ডা বাতাসের উত্তাল। এর মাঝে বসে আছে অনল ধারা। দুপুরের পর থেকেই জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে অনল। ধারা বারণ করেছিলো কিন্তু কে শোনে কার কথা। আধঘন্টা ধরে এখানেই বসে রয়েছে তারা। এখানে আসার পর অবশ্য ধারার আর যেতে ইচ্ছে হয় নি। প্রকৃতির কাছে নিজেকে সপে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয় জানিস?
অনলের কথাটা কানে আসতেই পাশ ফিরে তাকায় ধারা। অনলের চোখজোড়ায় একরকম শূন্যতা ভর করেছে। চাপা কষ্ট গুলো চোখে ভিড়েছে। পুরুষের কাঁদতে মানা, তাই অশ্রুরুপেও বের হতে পারছে না। কেনো যেনো ধারার ইচ্ছে হলো অভিমান গুলো পিছে রেখে আজ অনলকে শান্তনা দিতে। নদীর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
– কেনো? জায়গাটা সুন্দর বলে?
– এই জায়গাটা অনন্যার খুব প্রিয় ছিলো।
অনন্যার কথাটা শুনেই অনলের দিকে অবাক নয়নে তাকায় ধারা। অনল তখন ও নদীর দিকেই তাকায়ে আছে। ধারার দিকে না তাকিয়ে বলতে লাগে…….
চলবে
[পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে দিবো। দয়া করে কার্টেসী ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি