#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_১৯
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৯.
তারা তিনজন সিএনজি নিয়ে বাংলা বাজার রোড অবধি গেলো। তার কয়েক মিনিট হেঁটে গেলেই আমতলা পার্ক। এই আমতলা পার্কের অপর নাম স্বাধীনতা পার্ক। প্রবেশপথে পা ফেলতেই দানীনের হৃদয়-প্রাণ আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠলো। মাঝারি আকৃতির পুকুর পরিবেষ্টিত হয়ে ডানে-বামে সিমেন্টের মসৃণ পথ গিয়েছে। দুইপাশের পথের সর্বসম্মুখের সারি সুপারি গাছ এবং মধ্যবর্তী স্থানে ঝাউগাছ, টগর, গোলাপ ও মস্যুডা গাছ দ্বারা সজ্জিত। দুটো পথ পুকুরের অপরপাশে বিশালাকার আম-জাম গাছের ছোট্ট বাগানের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তবে বামদিকে চিকন পথের পর সুপারি গাছের পালি খানিক ঢালু হয়ে হরেকরকম ফুল গাছে আচ্ছাদিত সুশোভিত বাগান তৈরি হয়েছে। তিন-চার হাত দূরে দূরে সিমেন্টের ঢালাই দ্বারা বাঁধানো বসার ব্যবস্থা। গাছের ডালপালার ফাকে টুনাটুনির আলাপচারিতা।
প্রথমে দানীন, তার পাশে ইউসরা, তারপর ফারিহ– তিনজন সরলরৈখিকভাবে হাঁটছে।
দানীন ডান দিকের পথ ধরে পুকুরের কাছে এগিয়ে গেলো। সেখানে তিনটা পদ্মফুল ফুটেছে। তাকে ঘিরে লাল-নীল মাছ মৃদু ঢেউ তুলে ঝটপট ভঙ্গিমায় ঘুরছে। ফুলগুলোকে হাতের সংস্পর্শে এনে আদর করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পুকুরে নামার কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। ঝুঁকে ফুলের সংস্পর্শ যাওয়ার পূর্বেই সবুজাভ শ্যাওলাযুক্ত পানিতে নাকানি-চুবানি খেতে হবে।
খানিক দূরে বেঞ্চিতে একটা বাচ্চা মেয়ে ও উভয়পাশে দুজন পুরুষ-মহিলা বসে আছে। বাচ্চাটির হাতে হাওয়াই মিঠাই। হঠাৎ করে সে বলে উঠলো পুকুরের ওটা খাবে। আঙ্গুল দ্বারা ইঙ্গিত করায় বুঝা গেল সে হাওয়াই মিঠাই এর রঙের অনুরূপ পুকুরে ভাসমান পদ্মফুল খেতে চাইছে। দানীন মাথা ঘুরিয়ে আবার বাচ্চাটির দিকে তাকালো।
পাশে থাকা মহিলাটি বলছে,
“এটা তো ফুল মা।”
“খাবো।”
বাচ্চাটিকে শান্ত করার প্রযত্নে নমনীয় কণ্ঠে বললো,
“ফুল খাওয়ার জিনিস না, দেখার জিনিস। আমাদের যেভাবে চোখ দিয়ে দেখছো। সেটাকেও সেভাবে চোখ দিয়ে দেখবে মামণি।”
“না, ফুল খাবো।”
মহিলাটি খানিক রেগে বললো,
“মাইর খাবে মাইর!”
বাচ্চাটি তৎক্ষণাৎ মাথা উপর-নিচ নাড়িয়ে বললো,
“খাবো। মাইর খাবো।”
এরপর তুমুল কান্না জুড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“মাইর খাবো। মাইর খাবো। মাইর খাবো।”
বাচ্চাটির মা-বাবার চেহারা দেখার মতো যেনো এক্ষণই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।
দানীন মৃদু হেসে ফারিহ’র দিকে ফিরে বললো,
“ফারিহ তিনটা হাওয়াই মিঠাই কিনে নিয়ে আয় তো।”
ফারিহ হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আসতে গেলো। যতো বিকেল যাচ্ছে, পার্কে মানুষের আনাগোনা ততো বাড়ছে। তিনজন একটি বেঞ্চে গিয়ে বসলো।
কিছুক্ষণ বাদে ইউসরা বলে ওঠলো,
“পানি লাগবে। হাত কেমন চপচপ করছে। ধুতে হবে।”
ফারিহ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
“পুকুরে চলো, তোমাকে চুবিয়ে আনি। এক চুবানোতেই তেল-চর্বি পরিষ্কার।”
ইউসরা তার দৃষ্টি ফারিহ’র উপর কিছুক্ষণ স্থির রেখে বললো,
“আই আসকড ফর মিনারেল ওয়াটার। আমার সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তাই অন্তরও সাদা ফুলের মতো ফকফকা। তোমার মনে তো ময়লা।”
নাক ছিটকিয়ে বললো,
“উহ! গন্ধ।”
ফারিহ মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“ফুলের মতো সাদা না। ওটা টিকটিকির ল্যাতল্যাতে রক্ত।”
ইউসরাকে অনুকরণ করে বলে ওঠলো,
“উহ! গন্ধ।”
দানীন ওঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“তোমরা হার্ট এন্ড সোল দিয়ে ঝগড়া করো বাবুরা। আমি পানি নিয়ে আসছি।”
এই মুহূর্তে দানীনের কথা তাদের শ্রবণের ঊর্ধ্বে। গরুগুলো!
পার্ক থেকে দোকান খানিক দূরে। দানীন দোকানের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলো।
গালে মুখে রঙ-চঙ মাখা কয়েকটা সুন্দরী মেয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠছে। তাদের দৃষ্টি পাশের ঢালাই বাঁধা সিমেন্টের বেঞ্চির উপর বসে থাকা দুজন ছেলের উপর। বান্ধবীদের হাসি, চোখে চোখে ইশারা, প্রচ্ছন্নময় ভঙ্গি ও ফিসফিস করে তাদের ইঙ্গিত করে কথোপকথন আরসালান সবই বুঝতে পারছে। আরসালান বেঞ্চের উপর পা ভাঁজ করে বসে আছে। আদ্রিয়ান চারপাশ বিমোহিত দৃষ্টিতে দেখে চলছে এবং সঙ্গে মোবাইলে ক্লিক ক্লিক শব্দে ছবি তুলছে। আরসালান নিচু হয়ে মেরিলিন গাছের পাঁচ পাতাবিশিষ্ট কমলা রঙের ফুলটি ছিঁড়তেই আদ্রিয়ান চেঁচিয়ে ওঠলো।
“আহ, ভাইয়া! ফুল ছিঁড়ছো কেন?”
“তোকে খাওয়ানোর জন্য ছিঁড়ছি গাধা। নে হা কর।”
আদ্রিয়ান সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো করে ফেললো।
খানিক বাদে আরসালান বলে ওঠলো,
“যা তো, পানি কিনে আন। পিপাসা পেয়েছে।”
আদ্রিয়ান চুপচাপ উঠে পানি আনতে গেলো।
আরসালান উঠে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালো। চাট্রেউজ গ্রিন রঙের শার্ট গায়ে জড়িয়ে প্রতিবেশের সবুজের সঙ্গে মিশে যেতে চাওয়া সুদর্শন পুরুষটির চোখে-মুখে দিশেহারা ভাব। একটু পরপর উফ উফ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে; রেচনতন্ত্রের গোলযোগের কারণে পেটের ময়লা স্তুপ কমোডে ঠিকঠাক ফ্লাশ করতে না পারার মতো হতাশা প্রকাশ করছে। আরসালানের এখন বরিশালে কোনো কাজ নেই। তবুও সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। আসার পরই বারংবার মনে হচ্ছে কি যেনো নেই, কি যেনো নেই। কি যেনো চাই চাই অনুভূত হচ্ছে।
দানীন হাঁটতে হাঁটতে লতিয়ে পড়া কয়েকটা মেয়েকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে তো এককালে নিজের অজান্তে চারপাশের সব উপেক্ষা করে খিলখিল শব্দের ঝংকার তুলে হেসে ওঠতো। মেয়েদের নিজেকে যে কঠিন প্রাচীরের মাঝে সুরক্ষা রাখতে হয় সেটা জেনেও জানতো না। ভাবতো, সে তো কালো। কার কি যায় আসে। এই যায় আসা না ভেবেই সহজলভ্য করেছিল নিজেকে। সেই সহজলভ্য থেকে সস্তা। কোনো কী প্রয়োজন ছিলো নিজেকে মেলে দেওয়ার? এই মেয়েগুলোরই বা কেন প্রয়োজন পড়ছে? ভাবতে ভাবতে দানীন থমকে দাঁড়ালো। আর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চাট্রেউজ গ্রিন রঙের শার্ট পরিহিত পুরুষটির উপর। এ কি! এ তো তেনা-তুনা বিশেষজ্ঞ জ্বীন বাবাজি! ফর্সা গলায় এস লেটারের লকেট দোদুল্যমান, একদম গুন্ডাদের মতো যেমন– ব্লেড, ছুরি, কাচি, বটি ঝুলানো থাকে সেরকম।
গোলাপের স্নিগ্ধ প্রস্ফুটিত পাপড়ির উপর যেরকম মাদকতা প্রসারিত করে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা পতিত হয়, আরসালানের মসৃণ কপালের ঘর্মাক্ত অবস্থা তার অনুরূপ ঠেকছে। আর নাকে ব্যান্ডেজ। দানীন হতচকিত! তবে সে সত্যিই নাক ফাটিয়েছে।
অপরজনের দৃষ্টিও তার উপর বিধিবদ্ধ লক্ষ্য করে দানীন আঁতকে ওঠলো। তাকে কিডন্যাপ করতে কী ঢাকা থেকে বরিশাল চলে এলো? এই ছিলো তার কপালে, এই ভবিষ্যতের জন্য সে এতোদিন সাঁতরে মরেছে!
মেয়েদের মধ্যে একজনের কথা কানে এলো,
“ছেলেটার চেহারা কি কাটা কাটা দেখ। ঠিক হৃদয় ক্ষত করার মতো। আর সেই কি গম্ভীর চাহনি!”
কিন্তু দানীনের কেন এরকম লাগছে না। সে আরও গভীর দৃষ্টিতে আরসালানের দিকে তাকালো। কই ক্ষত করে দেওয়া চাহনি? এ তো ভোরের শিশিরের কোমল স্পর্শের মতো স্নিগ্ধ, সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর আঙুলের ছোঁয়ার মতো অনুরক্ত।
আরসালান দানীনকে চমকে দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,
“ভালো আছেন ম্যাডাম? চিনতে পেরেছেন তো? ঐ যে, গতকাল সকালেই তো দেখা হলো।”
দানীনের দুর্বল দুর্বল অনুভূত হচ্ছে। তাকে এতো সহজেই ভুলে যাবে কি করে। গতকালের পর এই জ্বীন বাবাজির সঙ্গে এই ভুবনে, এই জীবনে কখনো দর্শন না মেললেও সে কখনো ভুলতো নারে নাক ফাটা গরু। সৌম্যদর্শন পুরুষের নাক থেতলে দেওয়ার মধ্যে যে কি পৈশাচিক আনন্দ নিহিত তা তো এই নাগিন নাচনেওয়ালা কি বুঝবে।
কিন্তু মনে সাহস সঞ্জয় করে দানীন মুখে বললো,
“আমি কিন্তু চিৎকার-চেঁচামেচি করে লোক ডাকবো। আপনি যে ছেলে ধরা দলের সঙ্গে সংযুক্ত সবাইকে জানাবো। আমাকে যে কিডন্যাপ করার জন্য নানা ফন্দি এঁটেছেন, ঢাকা থেকে বরিশাল চলে এসেছেন সব জানাবো।”
আঁতকে উঠে ঢোঁক গিলার মতো শব্দ শুনে দানীন তার বামে তাকালো, আর আরসালান তার ডানে। মেয়েগুলোর মুখে আতঙ্কে শুষ্ক হয়ে গেছে।
একজন ফ্যাকাশে মুখে ফ্যাঁসফ্যাস গলায় বললো,
“ছেলে ধরা!”
দানীন ভ্রু নাচিয়ে ঠোঁটের কোণ বিস্তৃত করে বললো,
“দেখেছেন? এখন তো নাক ব্যতীত শরীরের বাকি পার্টস অক্ষত। তখন পাবলিক এমন অবস্থা করবে যে শরীরের ব্যথায় জামা গায়ে রাখতে পারবেন না। ন্যাংটো হয়ে বসে থাকবেন!”
দানীনের ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরের জ্বর উত্তাপ বাণীমালায় আরসালানের বুক ফেঁটে, নাক ফেঁটে, ঠোঁট ফেঁটে হাসি আসছে। এতো কিউট করে কেউ মারার কথা বলতে পারে তা তার জানা ছিলো না। নিজেকে সংযত করে অপাপবিশুদ্ধ চেহারা করে বললো,
“ছিঃ, ছিঃ ম্যাম! আপনাকে কেন কিডন্যাপ করবো? আমার ছেলে ধরা সংস্থা শুধু ছেলে ধরে। তাই তো নাম ছেলে ধরা। মেয়েও ধরলে নাম হতো ছেলে-মেয়ে ধরাধরি।”
তার কথা শুনে দানীন মুখে কাঠিন্য আনার চেষ্টা করছে। প্রচন্ড রেগে গিয়ে ছেলেটিকে ধুপধাপ পিটাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। কারণ সে হতভম্ব!
আরসালান বলতে থাকলো,
“আমরা শুধু ঐসব ছেলেদের তুলে নিয়ে যাই যারা বিয়ের জন্য মেয়েদের গাছপালা বা গরু-ছাগলের প্রজাতি মনে করে এবং নানা প্রজাতি তথা কারিনা, লতিফা, মিয়া খলিফা সব গুণাগুণ একসঙ্গে চায়। তাই তাদের ধরে নিয়ে বিশেষ জায়গাটি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে মরিচ ল্যাপে দেওয়া হয়। যেই কারেন্টের জন্য ঝটপট করে একের ভিতর দশ খুঁজে, সেই কারেন্টের সংযোগ সারাজীবনের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ফলে তারা স্বয়ং যেই প্রজাতির নাম নিয়ে জন্মেছে সেই নামটাও প্রাকৃতিকভাবে পরিবর্তিত হয়। লাঠি ছাড়া পুরুষ মানুষ। নাইস না ম্যাম? এদের কিন্তু হাফ ল্যাডিস বা ম্যান অভিহিত করারও সুযোগ নেই।”
দানীন আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। বজ্রপাতের আওয়াজ হলো বলে মনে হলো। কিন্তু কোথাও? এই মৃদুমন্দ বায়ুপূর্ণ পরিবেশে চারশো চল্লিশ ভোল্টেজের ঝাকানাকা ঝটকা অনুভূত হলো। মেয়েগুলো দৌঁড়ে দিগ্বিদিক হারিয়ে কোথায় যেন গেলো।
আরসালানের কথায় দানীন অবাক হলো এবং ব্যাপারটা তার নিকট ভালোও লাগলো। এতোদিনের দুঃখে জর্জরিত মন তাকে বিদিত করলো যে, সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করার উচিত ছিলো। তার উচিত ছিলো হেসে খেলে এই তেনা বাবার মতো একজনকে আছোলা বাশডলা দেওয়া। কিন্তু সে তো কেঁদে কেঁদেই কুপোকাত!
এই তেনা-তুনা বাবাজি তো মানুষ হয়েও জ্বীনের থেকে বেশি চরম ডোজ।
“সো ম্যাডাম, আপনি কী এই বিশেষ সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে সম্মতি প্রদান করবেন?”
“হ্যাঁ। কি? না।”
বলেই দানীন দাঁত খিচে, চোখ বন্ধ করে যেই পথে এসেছিলো সেই পথে দৌড় দিলো। আরসালান তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে সশব্দে হেসে ওঠলো।
“হাসছো কেন ভাইয়া?”
আরসালান তাকিয়ে দেখলো আদ্রিয়ান পানি ছাড়া চিপস, বিস্কুট, চকলেট, বাদাম এক কথায় পুরো দোকান নিয়ে এসেছে। তার বগলদাবা থেকে চিপসের প্যাকেট সংগ্রহ করে আরসালান বেঞ্চিতে আয়েশ করে বসে খাওয়া শুরু করলো।
“বললে না হাসছিলে কেন?”
আরসালান অনাশ্রিত গলায় জবাব দিলো,
“তোর ম্যাডামের সাক্ষাৎ মিলে ছিলো। উনি আমাকে পাবলিকের হাতে মার খাওয়াতে আগ্রহী।”
আদ্রিয়ান উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করলো,
“কিহ! ম্যাডামের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো? কোথায়! কোথায়!”
তার এরূপ মুখায়ব দেখে আরসালান ঘেঙচানো মুখমণ্ডলে বলে ওঠলো,
“ইশশ, ঢঙ! চুপচাপ বসে থাক। দেখার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে। ভাইকে যে গণধোলাই খাওয়াতে চেয়েছিলো সেই কথা কানে ঢুকবে কি কানের আশেপাশে দিয়েও তো যায়নি।”
আদ্রিয়ান হুট করে আরসালানের গা ঘেঁষে বসে নাকে ব্যান্ডেজের উপর আলতো করে আঙ্গুল বুলালো।
আরসালান ধমকে ওঠে,
“হাপ! যা দূরে সর। দূরে সরে বস।”
আদ্রিয়ান আহ্লাদিত গলায় বললো,
“এমন করো কেন? আসো ব্যান্ডেজের উপর দিয়ে একটা চুমু খাই। ভাইয়ের ভালোবাসা, সেবা-যত্নে নাক পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।”
“সুস্থ হওয়ার কি দরকার। কাচি নিয়ে আয়। তোরটাও কিচিং করে কেটে দেই।”
আদ্রিয়ান আরসালানের কথা উপেক্ষা করে আরও গাঢ় আহ্লাদি হয়ে বললো,
“ভাইয়া শুনো না?”
“কি?”
“চলো না ম্যামের বাসা থেকে ঘুরে আসি।”
কথাটা আরসালানের কর্ণপাত হতেই তার অগ্নি দৃষ্টিতে আদ্রিয়ানকে ভষ্ম করে দিলো।
দানীন ধপাস করে বসে বললো,
“পানি দে, পানি!”
ফারিহ আশ্চর্য হয়ে বললো,
“পানি তো তোমাকে আনতে পাঠিয়েছিলাম। তুমি উল্টো খুঁজছো।”
দানীন জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে বললো,
“ওহ, হ্যাঁ। তাই তো।”
ইউসরা চিন্তিত কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,
“কি হয়েছে বলো তো। এরকম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলে?”
দানীন চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ভাবলো। পরক্ষণেই মুচকি হেসে ওঠলো।
অনুচ্চ স্বরে জবাব দিলো,
“কিছু না।”
দানীন উঠে গিয়ে পুকুরের ধার ঘেঁষে দাঁড়ালো। আর তার অধরের মৃদু হাসি অনবরত বহমান।
“ইউসরু।”
“ইয়েস।”
“কিউটু হাসছে কেন?”
ইউসরা চোখের আকৃতি কুঞ্চিত করে জিগ্যেস করলো,
“একটা জিনিস খেয়াল করেছো ভাইয়া?”
“কি?”
“আপু কিন্তু অন্য সবার সামনে হাস্যরসাত্মক কথাবার্তা বা হাসিখুশি না থাকলেও আমাদের সঙ্গে পূর্বের মতোই হাসি-ঠাট্টা করে। কিন্তু এই হাসির মাঝেই আকাশসম, সমুদ্রের গভীরতা ন্যায় বিষণ্ণতা বিদ্যমান। আর এখন যেরকম আড়ালে আবডালে মুচকি হাসছে, এই হাসিও কিন্তু আমাদের চেনা। মনে আছে?”
ফারিহ অবাক হলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভীত হলো,
“তার মানে কী কিউটু আবার কাঁদবে? আবার অযাচিত কষ্টে জর্জরিত হয়ে নিজের ওষ্ঠের হাসি বিসর্জন দেবে?”
ইউসরা তার কনুই দ্বারা ফারিহকে সজোরে গুঁতো মেরে হাঁকিয়ে ওঠলো,
“ধুর, আগেভাগেই নেতিবাচক চিন্তাভাবনা! প্রথমবার ছিলো আবেগ। জীবনের প্রথম পরিসরে প্রথমবারের জন্য সাক্ষাৎ মেলা কিছু অনুভূতির দর্শন; যার স্থায়িত্ব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারতো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা চাননি সেই অনুভূতি-আবেগে পরিবেষ্টিত প্রতিবেশে আপুর দীর্ঘ বসবাস হোক। সেই মানুষকে নিয়ে আবেগ-অনুভূতির ডালপালা বিশালাকার বৃক্ষে পরিণত হয়ে বটবৃক্ষের মতো বসতি স্থাপন করুক তা প্রকৃতি চায়নি। আর আপু এখন আবেগে নুইয়ে পড়া কিশোরী নয়। আর না তার ব্যক্তিত্ব পরগাছার মতো ঠুনকো। এরপরও এই মুচকি হাসি! বুঝতে পারছো? এমন কারও সান্নিধ্যে আপু যে প্রকৃত অর্থেই মানুষ। আগেরটার মতো মেইল প্রস্ট্রিটিউট না!”
এতোক্ষণ ইউসরার কথায় পূর্ণ মনোনিবেশ করলেও সর্বশেষ বাক্য শুনে ফারিহ হেসে ওঠলো। ইউসরাও তার সঙ্গে হাসিতে অংশগ্রহণ করলো। প্রাণোচ্ছল হাসির ধ্বনি দানীন অবধি পৌঁছাতেই সে ঘুরে তাদের দিকে তাকালো। ধমকে উঠার বদলে সে-ও হাসলো। এ তো শুধু হাসি না, ভুবন মোহিনী কৃষ্ণকায় রমণীর ঐশ্বর্যমণ্ডিত হাসি।
(চলবে)