শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_২৬

0
280

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_২৬
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২৬.
আদ্রিয়ানের বাসায় চিঠি পাঠানোর পর কয়দিন ধরে দানীনের জীবনযাপন বেশ যাচ্ছে। আদ্রিয়ান ভুল করে তার ছায়াও মারাচ্ছে না। সে যেচে এক-দুইবার কথা বলার চেষ্টা করাতেও আদ্রিয়ান ভূতের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে গায়েব হয়ে গেছে। অর্থাৎ জীবন জিঙ্গা লালা বলা যায়। বলা যেতো। কারণ দানীন ভালো নেই। শাহনাজকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি, ইউসরার সামনে ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখানোর পরেই মনে আসে, সে কেন এলো না? চিঠি দিয়েই ক্ষান্ত হলো তবে। মন ছুঁয়ে দেখলো না যে। মনকে বন্দী করার হয়তো সুবিস্তৃত পরিকল্পনা আঁটছে। কিন্তু তার মন তো আর মানছে না। নানা এলোমেলো, অবান্তর চিন্তা তার মনটাকে গ্রাস করতে চাইছে। কখনো তা হতে দিচ্ছে, কখনোবা প্রেমিক স্বামী হতে চাওয়া পুরুষটির চিঠিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকছে। এক দুপুর, এক বিকেল, কিংবা চাঁদের আলোতে বারান্দায় পা মেলে বসে সারারাত।

ভার্সিটি থেকে ফিরে এপার্টমেন্টের সামনে যেতেই দানীন আশ্চর্যান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার মা-বাবা, ভাই-ভাবি এমনকি তার ভাইঝি দিয়াও মায়ের সঙ্গে পা ছড়িয়ে বসে আছে। সবার মুখ হাসি হাসি দিয়া ব্যতীত। বাবা ভাইয়ের সঙ্গে আর মা ভাবির সঙ্গে কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন।
দানীন সতর্ক পদক্ষেপে তাদের অভিমুখে পা দুটোকে পরিচালনা করলো। দানীনকে দেখে তার মা দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
“আরে আইয়া পড়ছো। আয় আয়।”
আবার ঝুঁকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে অনুচ্চ স্বরে বাবার সঙ্গে বাক্যালাপ করতে লাগলেন। বাদবাকি কেউ দানীনের উপস্থিতি পাত্তাই দিলো না। উল্টো এমন ভাব যেনো সে তাদের বাড়ি অনধিকার চর্চার উদ্দেশ্যে চলে এসেছে। শুধু দিয়া ঠোঁট উল্টে ফুফুর নিকট দৌঁড়ে এলো,
“ফুপুউ।”
দানীন তাকে কোলে নিলো। আহারে দানীনের মতো ছোট্ট বাচ্চাটাকেও কেউ পাত্তা দিচ্ছে না।
দানীন গেইট খুলে দিলে সবাই তার আগেই ভিতরে প্রবেশ করলো। কিছুক্ষণ সবাইকে পর্যবেক্ষণ করার পর দানীন তার মাকে ডাকলো।
“মা।”
দিলরুবা খাতুন ভ্রু সঙ্কুচিত করে তাকালেন।
দিয়াকে সে কোল থেকে নামিয়ে জিগ্যেস করলো,
“তোমাদের হঠাৎ আগমনের কারণ জানতে পারি?”
ভাবি দিয়াকে তার কোলে বসালেন। হাত দিয়ে দিয়ার চুল ব্রাশ করতে করতে বললেন,
“পাত্র দেখতে আসছি। পছন্দ হলে আজই ফাইনাল কথা।”
দিলরুবা খাতুন বললেন,
“হ, আমহারার সবগো পোলা পছন্দ হইছে। দেখাদেখি তো খালি ফরম.. কি জানি এডা নাকিদ?”
“ফর্মালিটি মা।”
নাকিদ দিয়ার পাশে বসে বললো,
“আমার মেয়েটা মাশাল্লাহ কতো বড় হয়ে গিয়েছে।”
দানীনের মাথায় যেনো বজ্রপাত ঘটলো। তারা দিয়ার জন্য পাত্র খুঁজছে! ছায়াছবি বানাতে চাইছে নাকি? আশ্চর্য! ভাবতেই দানীনের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠলো। তাদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ দানীন পায়ে ঠেলে দরজার নিকট নিতে থাকলো। সবাই এরূপ কর্মকান্ড দেখে কথাবার্তা থামিয়ে দানীনের দিকে তাকালো।
দিলরুবা খাতুন চেঁচিয়ে ওঠলেন,
“এই ছেরি কি হরছ!”
দানীন দরজার বাহিরে ব্যাগ রেখে বাজখাই গলায় বললো,
“এখনই আমার বাসা থেকে বের হও। গেট আউট।”
তার বাবা নাইমোল্লাহ সাহেব এগিয়ে এসে আদরণীয় গলায় মেয়েকে জিগ্যেস করলেন,
“কি হইছে আম্মা? তুমি এমন কতা কেরে কইতাছো?”
আদরণীয় কণ্ঠস্বর শ্রবণ করে যেনো দানীন আরও রাগান্বিত হলো। সবাইকে এক এক করে চোখ রাঙিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠলো,
“তোমরা কি করে বলছো? দিয়ার মাত্র পাঁচ বছর। আর তার জন্য পাত্র দেখছো? ছিঃ!”
সবার মুখ ঠাহর করে মনে হলো তাদেরকে উড়ন্ত প্ল্যান থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আতঙ্কে সমস্বরে এখনই চিৎকার করে ওঠবে। কিন্তু কেউ চিৎকার করে ওঠলো না। বরং হো হো করে সশব্দে হেসে ওঠলো। মাকে হাসতে দেখে দিয়াও খিলখিল করে হেসে ওঠলো।
এরূপ হাসির ভঙ্গিমা দেখে দানীন যেনো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।
দিলরুবা খাতুন কোনোরকম হাসির শব্দ হ্রাস করলেন। তবুও তার মুখে বিস্তৃত হাসি ঝুলছে। দানীনের থুতনি আঙ্গুল দ্বারা স্পর্শ করে বললেন,
“পাত্র তোর লেইগা। তোর মতোই শিক্ষক।”
দানীন কপালে হাত রাখলো। এক ঝামেলা শেষ না হতেই আরেক ঝামেলা।
কলিং বেলের আওয়াজে দানীন মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। দরজার দিকে যেতে নিলে তার মা বলে ওঠলেন,
“যা দরজা খোল গা। তোর খালা নাকি ইউসরা তারা আইছে দেখ?”
দানীন অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তার মায়ের দিকে তাকালো। ইউসরা আসতে পারে তা ঠিক আছে, কিন্তু খালা! তার খালার এখানে কি কাজ?
দানীন এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো।
“কিউটুউ!”
ফারিহ বানরের মতো লাফ মেরে তার গলায় ঝুলে পড়লো।
“ওই ডিঙ্কা চিকা, ডিঙ্কা চিকা। বিয়ে খাবো, বিয়ে খাবো।”
তার খালাতো বোন অনুশুয়া আর ফারিহ তাকে ঘিরে নাচানাচি করতে লাগলো। তার খালা-খালু, ফুফা-ফুফি হাসিমুখে তার মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন।
“মা!”
দানীনের দ্বিতীয় দফা চিৎকারে সবাই তার দিকে তাকালো।
“আমি এসব বিয়ে টিয়ে করবো না। ফারদার মোর, আমার বাসা থেকে বের হও। গেট আউট!”
দিলরুবা খাতুন তার স্বামীর দিকে ফিরে বললেন,
“তাইলে বেয়াইনরে কল দেই। তোমারে আগেই কইছিলাম। হহালে হেনে গিয়া ওঠি। অস্তে অস্তে কাম সাইরা এম্মে আমুয়ানে। তোমার মাইয়া কী আর আদ্রিয়ান বাবার লাহান? ছেরাডা মাশাল্লাহ কতো ভালা।”
পাত্রের নাম কর্ণগোচর হতে দানীন জমাট বাঁধা মিষ্টান্নের মতো জমে গেলো। আদ্রিয়ান স্যার!
দানীনের পায়ের তলা থেকে যেনো মাটি সরে গেলো। এরকমটা তো হওয়ার ছিল না। নাকি তারই বুঝতে ভুল হয়েছে। আদ্রিয়ান স্যার কিভাবে..

দিলরুবা খাতুন তার সম্পর্কে অভিযোগ ও আদ্রিয়ান সম্পর্কে প্রশংসা বাণী আকাশে বাতাসে নিক্ষেপ করতে করতে কোথাও কল লাগালেন। রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অপর পাশ থেকে সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“আসসালামুআলাইকুম আপা। এসে পৌঁছেছেন? আমি মাত্র কল দিতে যাচ্ছিলাম।”
“আপা আইছি। কিন্তু দানীন তো আইত্নাত ঢুকতে দেয় না।”
দানীনের বাবা স্ত্রীকে বাহিরে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন,
“দুই ঘণ্টা ধইরে বাইরে খাড়য় আছি।”
ফোনের ওপাশের মহিলাকে মোটেও বিচলিত মনে হলো না। উনি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“আহারে, এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। শুভ্র আমাকে আগেই এরকম ইঙ্গিত দিয়েছিল। তাই তো আপনাদের আগে এখানে আসতে বললাম। শাহকেও পাঠালাম। আপনি তো শুনলেন না বেয়াইন। সব কথা ফাইনাল করে তখন না হয় দেখতেন ঢুকতে দেয় কিনা। যাইহোক, এখন তাড়াতাড়ি চলে আসুন আপা। আমি এখন শুভ্রকে পাঠাই।”
দানীনের চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারও কোনো কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলছে না।
তার মা ফোনে বললেন,
“আট্টু দেহি আপা। এহন জোমাইছে যে হান্দাইতে দিবো।”
তার ভাবি ও ভাই ভিতরে ব্যাগগুলো এনে দরজা লাগালেন। বাকি সবাই গিয়ে সোফায় বসলো। তার খালা তার মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ওই বাসায় কি কি নিয়া যাইবি তার লিস্ট করছসনি? কেনাকাটার তো সময়েরও ব্যাপার আছে।”
নাকিদ পাশ থেকে বললো,
“মা বিয়ের গহনা ঢাকা থেকেই কিনে নিয়ে যাই।”
ভাবি টেনে টেনে জিগ্যেস করলেন,
“টাকা আনছো কিনবা যে?”
নাকিদ মাথায় হাত দিয়ে বললো,
“হায়, হায়! যে টাকা এনেছি সব বোধহয় হবে না। তবে ছেলের চেইন আর আংটি হবে।”
তাদের এরকম আলোচনা কর্ণপাত হতে দানীন তার ভাই ও ভাবির দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো।
“ভাইয়া আমার বিয়েতে তুমি কেন টাকা খরচ করবে? আশ্চর্য!”
তার ভাবি বিরক্ত গলায় হাই তুলতে তুলতে বললো,
“এটাই নিয়ম।”
“চুপ!”
দানীনের ঠাডিয়ে ধমক মারায় ভাবি হাত উঁচু করে সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। ভীত গলায় বললো,
“সত্যিই নিয়ম। আমাদের গ্রামের গোবর্ধন কবিরাজ বলছেন। ভাইয়ের টাকায় বিয়ে সম্পন্ন হলে বোনের সংসারে সুখ বৃষ্টির মতো টুপ টুপ করে পড়ে।”
দিলরুবা খাতুন তাকে আরেকটা ধমক দিলেন,
“মুহে আঙ্গুল দাও তো বউ। এই মাইয়া এই নিয়ম-কানুনের কি বুঝে? মোর আদ্রিয়ান বাবা মা-বাবার উপ্রে একটা কতাও মাতে না। কি ভদ্দর পোলাটা, মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। যাইহোক, আইয়ো লিস্ট করি কি কি নিমু। পান-সুপারি, ফল, পাঁচশো বিশ টাকা দামের রসগোল্লা..”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here