#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_২৭
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
২৭.
দানীন নির্মিমিখ দৃষ্টিতে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান লাজুক হেসে মাথা নিচু করে জিগ্যেস করলো,
“আপনি ভালো আছেন ম্যাডাম?”
কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন কোনো বাক্য সমষ্টি কর্ণগোচর হলো না, তখন আদ্রিয়ান মাথা তুলে সামনে উপস্থিত ব্যক্তিটির দিকে তাকালো। নির্লিপ্ত মুখায়ব ও তীক্ষ্ণ আঁখির চাহনি লক্ষ্য হতেই আদ্রিয়ানের মুখের লাজুক হাসি পানির স্ফুটনাঙ্কের মতো বাষ্পে রূপান্তরিত হলো। আদ্রিয়ান বার কয়েক ঢোঁক গিললো। তখন ওয়েটারের আগমন তাকে যেনো রক্ষা করলো।
কিন্তু না। দানীন একই অঙ্গবিক্ষেপে স্থির থেকে অর্ডার স্থাপন করলো। আদ্রিয়ান যখন অর্ডার করতে যাবে দানীন হাত উঠিয়ে থাকে থামিয়ে দেয়। পরিবর্তে সে বলে,
“ওয়াটার। অনলি মিনারেল ওয়াটার। উনার আবার ওয়াটার অন্যান্য বস্তু হজম হয় না।”
ওয়েটার আদ্রিয়ানকে অদ্ভুত দৃষ্টি উপহার দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বিদায় নিলো। প্রস্থান নিতেই আদ্রিয়ান কোকিলা কণ্ঠে ডেকে ওঠলো,
“ভাবিইই।”
যা দানীনের কর্ণকুহরে কাওয়ার কা কা হিসেবে প্রবেশ করলো।
দানীন তার হাতের পার্সটি আদ্রিয়ানের মাথা তাক করে নিক্ষেপ করলো। আদ্রিয়ানের মাথায় আঘাত হানার পূর্বেই তা সে ধরে ফেললো। আদ্রিয়ান আহ্লাদিত গলায় বলে ওঠলো,
“ভাবি আপনি আমাকে মারছেন কেন? আমি কি করেছি?”
দানীন আদ্রিয়ানকে ভয়ঙ্কর চাহনি নিক্ষেপ করে কর্কশ গলায় বলে ওঠলো,
“আমি তোর ভাবি হই? আমি তোর ম্যাডাম হই। ম্যাডাম ডাক।”
দানীনের আকস্মিক তুই তুকারি শ্রবণ করে আদ্রিয়ান ভড়কে গেলো।
দানীন তাকে ধমকে ওঠলো,
“ডাক ম্যাডাম!”
আদ্রিয়ান হতভম্ব গলায় ডাকলো,
“ম্যাডাম..”
দানীন ঠোঁটের বামদিকের কার্নিশ উপরে তুলে আদ্রিয়ানের উদ্দেশ্যে একটা হাসি দিলো। যা নীরিক্ষণ হতে আদ্রিয়ানের পাকস্থলী পাক মেরে ওঠলো। দৃশ্যপটে দৃশ্যমান হলো বিশালাকার এক নারীমূর্তি। হাতে তার মোটা বাঁশ। তা দিয়ে তার নিতম্বে সপাৎ সপাৎ মারছে আর বলছে,
“আর ভাবি বলে সম্বোধন করবি? বল করবি? ম্যাডাম ডাকবি ম্যাডাম। হা হা হা…”
আদ্রিয়ান তার নিতম্বে করতল ঠেকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে আর আকাশচুম্বী নারীমূর্তিকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
“ডাকবো না, ডাকবো না! আমার নাই কোনো ভাই, নাই কোনো ভাবি। ডাকবো না, ডাকবো না..”
বলতে বলতে সাবধানে চোখ মেলে নজরে পড়লো পুরুষ মুখমণ্ডল।
ওয়েটার হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান নিজেকে লক্ষ্য করে দেখলো সে বাচ্চা হাতির মতো চার হাত-পা উঁচিয়ে বসে আছে। চমকে উঠে তৎক্ষণাৎ হাত-পা নিচে নামালো। পূর্ব অবস্থানে নিজেকে এনে স্বাভাবিক হওয়ার প্রচেষ্টায় খুক খুক করে কাশলো। ওয়েটারও তার পাবদা মাছের মতো ভেটকানো মুখমণ্ডল স্বাভাবিক করলো। খাবার পরিবেশন করে দ্রুত প্রস্থান নিলো। বেচারা সম্ভবত ভয় পেয়েছে।
আদ্রিয়ান কাঁধ ঝুঁকিয়ে মাথা নিচের দিকে রেখে শক্ত হয়ে বসে রইলো।
দানীন তার উদ্দেশ্যে বললো,
“আদ্রিয়ান স্যার শুনুন। মাথা উপরে তুলুন।”
আদ্রিয়ান মাথা আরও ঝুঁকালো। ভাব এমন যেনো ঘাড় ভেঙে টেবিলের তলায় ঢুকিয়ে দেবে।
দানীনের মুখ হতে দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো। গলায় কোমলতা আনার চেষ্টা করে বললো,
“দেখুন আদ্রিয়ান স্যার। আপনি আর আপনার ভাই যেই নাটকীয় উপাখ্যান আরম্ভ করেছেন তা এখানেই স্থগিত করুন। বিগত এক বছর ধরে আপনি যে চাল চেলে এসেছেন আমি কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি, কবে বরিশাল যাচ্ছি, কবে ঢাকায় ফিরছি– এসব সেই কবেই আপনি ধরা খেয়েছেন। শুধু শিউর ছিলাম না যে এই চামচামির চাকরি আপনি আপনার গুণধর ভাইয়ের জন্য করে চলছিলেন।”
আদ্রিয়ান মাথা তুলে হা করে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই বিস্তৃত হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“আপনি এতো অসাধারণ ম্যাডাম! এতো সূক্ষ্ম কর্মকান্ডও বুঝে ফেলেছেন!”
টেবিলে সজোরে থাবা দিয়ে গদমদ করে বললো,
“এইজন্যই তো আপনাকে ভাবি হিসেবে পছন্দ করেছি। ভাইয়া আপনাকে ভালোবেসে সত্যিই স্বার্থক।”
দানীন হতাশ হয়ে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলো। সে যে কতো বড় দুই পাগলের পাল্লায় পড়েছে তা ধীরে ধীরে ঘণীভূত হচ্ছে।
দানীন বাজখাই গলায় আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে ওঠলো,
“দেখুন আদ্রিয়ান স্যার, আপনি এবং আপনার ভাই এসব বন্ধ না করলে আমি আপনাদের নামে মানহানির মামলা করবো। সেই সঙ্গে চাকরি তো খাবোই।”
আদ্রিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বিগলিত হেসে জবাব দিলো,
“চাকরি গেলে চাকরি পাবো ম্যাম। দরকার হলে রিকশা চালাবো। কিন্তু আপনার মতো ভাবি গেলে আর ভাবি পাবো না।”
দানীন এক কথায় হতভম্ব। অর্থাৎ চিন্তার করার মতো চিন্তনে কিছু খোঁজেই পাচ্ছে না। এই বাড়ির বউ হলে তো তাকে দুই দিনের মধ্যেই পাবনায় শিফট হতে হবে। তখন পাবনা থাকবে তার শ্বশুরবাড়ি। দানীন আঁতকে ওঠে। আহারে, অবশেষে তার কিনা এরকম একটা শ্বশুরবাড়ি জুটলো। পরক্ষণেই নিজেকে চোখ রাঙালো, কিসের শ্বশুরবাড়ি!
দানীন চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালে আদ্রিয়ান হাসিমুখে বলে ওঠলো,
“সাবধানে যাবেন ম্যাম। আমি বরং কিছু খেয়ে নিই। আজ কতো কাজ.. অন্যথায়, আমিই আপনাকে পৌঁছে দিতাম।”
এরপর ওয়েটারের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লো।
দানীন তাকে ভষ্ম করা চাহনি নিক্ষেপ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে হলো।
“আপু।”
“আপু!”
থেমে থেমে পরপর দুইবার আপু ডাক কানে যেতে দানীন এবড়োখেবড়ো চলনের গতি থামিয়ে দাঁড়ায়। ছেলে কণ্ঠ কর্ণপাত করে প্রথমে ফারিহ’র কথা স্মরণে এলো। মনে পড়লো ফারিহ তাকে কখনো আপু বলে সম্বোধন করে না। অন্য কাউকে ডাকছে ভেবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।
“দানীন আপু!”
দানীন এবার পিছনে ঘুরে তাকালো। কণ্ঠের উৎস খোঁজার উদ্দেশ্যে চতুর্দিকে অক্ষিগোলক চক্রাকারে ঘুরালো। দেখলো, স্কুল ড্রেস পরিহিত একটি ছেলে দ্রুত পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ছেলেটি হাসিমুখে জিগ্যেস করলো,
“কেমন আছো দানীন আপু? আমাকে চিনতে পেরেছো?”
দানীন সমতল ভ্রুর ভাঁজ কুঞ্চিত করে উত্তর দিলো,
“ভালো আছি। কিন্তু তোমাকে তো চিনতে পারছি না।”
কিছুক্ষণের জন্য ছেলেটির মুখের হাসি বিলীন হলো।
“আমি মুগ্ধ।”
দ্বিধাদ্বন্দ্ব গলায় মাথা চুলকে বললো,
“মাহবুব ভাইয়ের ছোটো ভাই।”
দানীন কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। এরপর ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বললো,
“ভালো আছো মুগ্ধ? তোমাকে সেই ছোটোবেলায় দেখেছিলাম। মাশাল্লাহ কতো বড় হয়ে গেছো।”
মুগ্ধ হাসলো। তার বাম হাতের ঘড়িটি একবার দেখে নিয়ে বললো,
“আপু আমি কিন্তু তোমাকে এখানে আরও আগে দেখেছি। তুমি যে প্রফেসর তা-ও জানি।”
দানীন বিস্তৃত নয়নে বললো,
“সত্যি! ছোট্ট মুগ্ধ দেখছি ডিটেকটিভ হয়ে গিয়েছে।”
মুগ্ধও হাসলো এবং তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠলো,
“আপু আজকে না দেরি হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে আবার তোমাকে দেখা করতে হবে। বলো করবে? প্লিজ, প্লিজ!”
দানীন হেসে বললো,
“অবশ্যই করবো।”
“তাহলে তোমার নম্বরটি দাও। কখন ফ্রি থাকবে, কোথায় দেখা করতে পারবে জিগ্যেস করে নেবো।”
মুগ্ধ থেকে বিদায় নিয়ে দানীন আবার এলোমেলো পথ ধরে হাঁটতে থাকলো। মুগ্ধের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তার অনুভূতি, চিন্তাগুলো এক লহমায় অসাড় হয়ে গিয়েছে। কি যেনো একটা ভাবতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। ঘোলাটে হয়ে দৃশ্যপটে বিচরণ করছে।
(চলবে)