#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ২২

0
655

#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ২২
#ফারহানা ইয়াসমিন

শুভকে ভুলতেই কিনা কে জানে রুহি আজকাল রাযীনের সাথে ভীষণ আন্তরিক। রাযীনের টুকটাক কাজ ইদানিং নিজ থেকেই করে দেয়। রাযীন রাতে ল্যাপটপে কাজ করতে বসলে নিজ উদ্যোগে কফি বানিয়ে এনে দেয়, অফিস যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের কাছে গুছিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে টুকটাক গল্পও করে। রাযীনকে আগের মতো বদমেজাজি বদমায়েশ মনে হচ্ছে না। বরং মনেহচ্ছে যে লোক বউয়ের জন্য সাহস করে এতোটা করতে পারে সে অতোটা খারাপ লোক না। হয়তো লোকটার প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন কিন্তু মনটা কলুষিত নয়। হতে পারে পাঁচ বছর আগে করা নিজের কাজের জন্য সে অনুতপ্ত। অন্তত শুভর চাইতে হাজারগুন ভালো। শুভ জেনেবুঝে তার অনুভূতি নিয়ে খেলেছে। নিজেকে নিয়ে মিথ্যাচার করেছে। এই লোক তা করেনি। নিজেকে ভালো সাজানোর নাটক করে রুহিকে পটানোর চেষ্টা করেনি, স্বামী হিসেবে রুহিকে কাছে টানাও সুযোগ খোজেনি। এইটুকু ভাবলেও রুহির মনে প্রশান্তি আসে। রাযীনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে রুহি ছাদে পেতে রাখা চেয়ারে হেলান দিলো। বিকেলের সময়টা আজকাল ছাদে আসে রুহি। ডুবি ডুবি সূর্যের আলোয় চারপাশটা নরম আলোয় ভরে থাকে। পাখিরা সব কিচিরমিচির শব্দ তুলে ঘরে ফিরে যায়। এইসময় রুহি চুপচাপ বসে থেকে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতা ওল্টায়।
“আমাকে ছাড়াই আজকাল ভালো থাকছো দেখি?”
শুভ এসে দাঁড়িয়েছে রুহির সামনে। কথাটা শুনে চমকে শুভর পানে চাইলো রুহি। শুভর চুলগুলো এলোমেলো অবিন্যস্ত, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির আভা, চোখদুটো কোটরে ঢুকে গেছে। রুহির মনে হলো গত ক’দিন শুভকে দেখেনি সে। হঠাৎ শুভর বা হাতের দিকে নজর গেলো। বিশাল বড় একটা ক্ষত দেখা যাচ্ছে সেখানে।
“ভালো থাকাটা আপেক্ষিক বিষয় শুভ। চাইলে তুমিও ভালো থাকতে পারো। তোমার হাতে কি হয়েছে?”
শুভ রুহির সামনের চেয়ারে বসলো, হাত বাড়িয়ে দিলো রুহির দিকে-
“তোমার অবহেলা আর অবিশ্বাসের শাস্তি দিলাম নিজেকে।”
রুহি অবাক হয়ে শুভকে দেখলো-
“পাগল হয়ে গেছো?”
শুভ রুহির চোখে চোখ রাখে-
“তুমি আমার থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছ ততই নিজেকে পাগল লাগছে। কেন এমন করছো রুহি? প্লিজ চলো আমরা ঢাকায় ফিরে যাই। আমরা আমাদের পুরনো জীবনে ফিরে যাই।”
রুহি গভীর চোখে শুভকে দেখলো। শুভর চেহারায় বিষাদ খেলা করছে, কিছুটা পাগলামি ছেয়ে আছে মুখের রেখায়।
“এখন আর তা হয় না শুভ। তুমি যদি নিজের পরিচয় না লুকাতে তাহলে হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। আমি কে সেটা জানার পরও তুমি যে অন্যায় কাজটা করেছো সেটার পর তোমার সাথে আমার আর কোন কিছু হওয়া সম্ভব না। আমার চিন্তা তোমার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। তুমি বরং তোমার কাজে ফিরে যাও শুভ।”
শুভর মুখের রেখাগুলো দ্রুত বদল হচ্ছে। চেহারায় কাঠিন্যতা স্পষ্ট হচ্ছে। সে হিসহিসিয়ে উঠলো-
“তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার জন্য কি করেছি। এতোগুলো বছর তোমার পেছনে ঘুরেছি, তোমাকে সাহস দিয়েছি। আজ অন্য একজন এসে তোমায় আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে এটা আমি কিছুতেই হতে দেবোনা।”
শুভর এই পরিবর্তন দেখে রুহির বুক কাঁপছে। এ কোন শুভ? এসব কি বলছে? নিজের অন্যায়কে দেখেও দেখছে না? রুহি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে-
“এসব কি বলছো শুভ? অন্যায় তোমার, তুমি আমার সাথে ছলচাতুরী করেছো। এখন আরেকজনার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছ?”
“তোমাকে ভালোবেসেছি এটা অন্যায়? আমি ছলচাতুরী করেছি এখন তুমি করছো না? আমাকে ভুলে ভাইকে আপন করতে চাইলো এটা অন্যায় নয়? যে তোমাকে ফেলে রেখে চলে গেলো তাকেই এখন সবকিছু মনে হচ্ছে?”
শুভ উত্তেজিত হয়ে গেলো। রুহি ভীরু কন্ঠে প্রতিবাদ করে-
“সে যাই করুক তোমার মতো মিছে কথা তো কয়নি? তুমি তো আমার সাথে…”
“বাস আর শুনতে চাই না। তুমি যা করছো তার জন্য তোমাকে ভুগতে হবে রুহি। আমাকে বিশ্বাস করলে নাতো? দেখবে তুমি ঠকবে, ঠকে তোমায় আমার কাছেই ফিরতে হবে। তখন আমিও দেখবো…”
শুভ কথা শেষ করার আগেই রাযীনকে উঁকি দিতে দেখা গেলো-
“আরে তোমরা এখানে যে? দেবরের সাথে ভালোই আলাপ জমে গেছে দেখছি?”
রুহির ফ্যাকাসে চেহারা রাযীনের নজরে এলো না। শুভ তার আগেই উঠে দাঁড়ালো-
“তোমরা কথা বলো আমি যাই।”
“সে কিরে। আমি মাত্রই এলাম আর তুই চলে যাচ্ছিস? বয় গল্প করি।”
“না ভাইয়া, ওকে বড়মা ডাকছিলো তাই জানাতে এসেছিলাম। এসে দেখি বই পড়ছে। বই নিয়েই গল্প হচ্ছিল এতোক্ষণ।”
রাযীন রুহির দিকে তাকালো, রুহি ফ্যাকাসে হাসি দিলো-
“আমি দেখি মা কি বলে।”
রুহি নিজেকে আড়াল করতে উঠে চলে যেতে উদ্যত হলে রা্যীন থামায় ওকে-
“আরে দাঁড়াও। মায়ের সাথে দেখা করেই তো এলাম। আপাতত তোমার যেতে হবে না। এসো এখানে বসে এককাপ চা খাই। শুভ তুইও বয়।”
“নাহ আমার একটা কাজ আছে ভাইয়া৷ আমি গেলাম তোমার বসো।”
শুভ দাঁড়ালো না, এলোমেলো পা ফেলে দ্রুত নিচে নেমে গেলো। রুহিও উঠে দাঁড়ালো-
“চলুন ঘরে যাই। সন্ধ্যার সময় নাকি ছাদে থাকতে নেই?”
রাযীন হাসলো-
“কে বলেছে এসব কথা?”
“সবাই বলে। প্লিজ ঘরে চলুন, রাতে না হয় আসবো আবার?”
রুহি অসহায় দৃষ্টিতে তাকাতেই রাযীন আর কথা বাড়ায়নি। দু’জন একসাথে নেমে এলো।

★★★

দু’দিন ঝিলিককে খাবার টেবিলে না পেয়ে রুহি অবাক হলো। ঘরে থাকা সত্বেও ঝিলিক রুমে বসে খাচ্ছে এটা জেনে রুহির মনে খটকা লাগলো। দুপুর খাওয়ার আগে তাই আজ ঝিলিককে ডাকতে এলো। রুমের দরজায় অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর ঝিলিক দরজা খুলে-
“আরে রুহি যে? হঠাৎ আমার খোঁজে? কোন দরকার?”
“ভাবি, দু’দিন ধরে নিজের কামরায় বসে খাচ্ছ ভাবলাম দেখে যাই কি অবস্থা তোমার। শরীর কি বেশি খারাপ?”
রুহি উকি দিতেই ঝিলিক দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়-
“এসো ভেতরে এসো। এখন একটু ভালো আছি।”
রুহি রুমে ঢুকে ঝিলিকের বিছানায় বসলো। খেয়াল করে দেখলো বিছানায় বসতে যেয়ে ঝিলিক বারকয়েক মুখ কুঁচকালো। হয়তো ব্যাথা পেয়েছে কোন। রুহি চোখ ফিরিয়ে নিতে যেয়ে নজর এলো হাতের ক্ষতর দিকে। ঝিলিকের বাহুতে কালসিটে দাগ স্পষ্ট-
“ভাবি কি হয়েছে?”
ঝিলিকের হাতের দিকে ইশারা করে রুহি। ঝিলিক দ্রুত হাতে তা ওড়নায় ঢেকে নেয়-
“তেমন কিছু না রুহি একটু ব্যাথা পেয়েছি ঠিক হয়ে যাবে।”
“ওহহহ। নিচে খেতে যাবেনা?”
“নারে। আমার শরীর সত্যিই খারাপ। বেশিক্ষণ হাঁটলে মাথা ঘুরায়।”
“আর ইউ এক্সপেকটিং?”
ঝিলিক চমকে তাকালো রুহির দিকে-
“আরে না। একথা কেন বলছো হঠাৎ?”
রুহি মুচকি হাসলো-
“কেন যেন মনেহচ্ছে। কিছু মনে না করলে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
ঝিলিক অবাক হয়ে জানতে চাইলো-
“হ্যা অবশ্যই। কি বলবে বলো।”
“উনাকে তুমি ভালোবাসতে? কি হয়েছিলো তোমাদের মধ্যে? ওকে জিজ্ঞেস করলে আনসার দিতে চাইবে না জানি তাই তোমার কাছে জানতে চাওয়া। বললে আমি কিছু মনে করবো না।”
রুহি শান্ত স্বরে কথাগুলো বলে। ঝিলিক দোনোমোনো করে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নেয়-
“ছিলো। দু’জনই দু’জনকে পচ্ছন্দ করতাম। তারপর কি থেকে কি হলো দু’জনার পথ আলাদা হলো। সেও অনেক দিন আগের কথা। আপাতত আমাদের দু’জনার মধ্যে কিছু নেই। তোমার স্বামী তোমারই আছে ডিয়ার ভয় পেয়না।”
ঝিলিক কথাগুলো বলে হাসলো। রুহি মৃদুস্বরে গুনগুন করে যেন-
“ভয় পাচ্ছি না। ভাবছি যদি তাই হয়ে থাকে তবে তোমার গায়ের দাগগুলো কেন এলো?”
ঝিলিক চমকে তাকালো, কিছুক্ষণ নীরব থেকে ফিসফিস করলো-
“সবাই একরকম নয় রুহি। কারো বিশ্বাসের ভীত ভীষণ নড়বড়ে। তাদের ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। কাজেই তাদেরকে তাদের নিজেদের ভাবনা নিয়ে থাকতে দেওয়া উচিত।”
রুহির মুখে কথা আসে না। ঝিলিকই পূনরায় মুখ খুলে-
“রাজ ভালো ছেলে তবে সহজে অন্যের দারা প্ররেচিত হয়। তুমি ওকে আগলে রেখো যেন কেউ ওকে না ফুসলাতে পারে। তোমাদের মাঝে তৃতীয় কাউকে আসতে দিয় না। দেখবে দু’জনে সুখী হবে।”
রুহি মন দিয়ে ঝিলিককে দেখে। ওর মনে রাজকে নিয়ে সত্যিকার অর্থে কেন অনুভূতি আছে কিনা তা খোঁজার চেষ্টা করলো। ঝিলিকের চেহারা জুড়ে বিস্বাদ ছেয়ে আছে। রুহি কিছু একটা ভেবে আর কথা বাড়ায় না। উঠে আসার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝিলিককে ডাকে-
“ভাবি, সব সহ্য করো তবে আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয় না।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here