শিমুল_ফুল #০৮,০৯

0
666

#শিমুল_ফুল
#০৮,০৯
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
০৮

পুষ্প একটানে মাথার ওরনা খুলে টেবিলে ছুড়ে মারে।মাথার চুল এলোমেলো করে,মোবাইলটা বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলে।কন্ঠে ঘুমঘুম ভাব এনে দরজা খুলে।
রোকসানা রেগে ভেতরে ঢুকে বলে, “কই ছিলি?”

পুষ্প মনে মনে ভ,য় পায়। আমতা।আমতা করে বলে,
“কোথাও না।ঘুমাচ্ছিলাম।”

রোকসানা চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকে।পুষ্পর বুকে অজানা আতং,কে খাবলে উঠে।মিনমিন করে বললো,
“ডেকেছো কেন আম্মা?”

রোকসানা রুমের ভেতরে ঢুকে বললো,
“পাঁচমিনিট ধরে ডাকছি এভাবেই ঘুমাস?”

পুষ্প মিথ্যে মিথ্যে হাই তুলে বললো,
“খুব ঘুম পেয়েছিলো আম্মা।তাই!”

“মরার মতো ঘুমাস!ঘরে আ,গুন লাগলেও তো খবর পাবি না।”

পুষ্প কিছু বলে না।পকপক করার থেকে চুপ থাকাই ভালো।

রোকসানা পুষ্পকে পাশ কাটিয়ে বললেন,
“গাধার মতো ঘুমায়।মেয়েরা এমন করে ঘুমালে আর সংসার করতে হবে না।আলমারি থেকে বালিশ নিবো সরে দাঁড়া।”

পুষ্প মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে।যা ভেবেছিলো তা নয়।আস্তে করে বললো,
“বালিশ কার জন্য আম্মা।”

রোকসানা চোখ কটমট করে বললো,
“বড় বোন আসছে কই খেয়াল রাখবে তা না আগে আগে ঘুমাতে চলে আসছে।”

তারপর থেমে আবার বললেন,
“মুন্নীদের রুমে আরেকটা বালিশ লাগবে।জামাই নাকি দুই বালিশে ঘুমায়।”

পুষ্প মাথা নাড়িয়ে বিছানায় বসে।বুকটা প্রচন্ড পরিমানে কাঁপছে।আম্মা বুঝে ফেললে মেরেই ফেলবে।বালিশে মাথা রেখে বললো,
“আম্মা লাইট অফ করে যাবে।”

রোকসানা লাইট অফ করে চলে যায়।পুষ্প চোখ বন্ধ করে শিমুলকে দেখে।আজকাল চোখ বন্ধ করলেই শিমুলের উচ্ছল হাসি,নেশা নেশা তাকানো ভেসে উঠে।বুক ভরে শ্বাস নেয়,মনে হচ্ছে শিমুলের শরীরের ঘ্রান এখনো চারপাশে ছড়িয়ে আছে।পুষ্প সুখ সুখ অনুভূতি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।এতো শান্তি কেন চারিপাশে?আর দুই মিনিট দেরী করলেই তার আম্মার কাছে ধরা খেতো তারপর খবর ছিলো।

আজকে দুইদিন হয়েছে সাফিন পুষ্পদের বাড়িতে এসেছে।আজকে চলে যাবে সবাই রেডি হয়ে গাড়ির অপেক্ষা করছে।সাফিন বারবার পুষ্পর দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটা এমন কেন?সাফিনকে একদম পাত্তা দিচ্ছে না।সাফিন পুষ্পর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
“পুষ্প”

পুষ্প সাফিনের গলা শুনে তাকায়।সাফিন যে তাকে পছন্দ করে ফেলেছে এটা খুব স্পষ্টভাবে চোখে ফুটে উঠেছে।আচ্ছা ছেলেরা কি জানে তাদের মনেক কথা মুখে আসার আগে চোখে ভাসে।সব ছেলেদের এমন হয় কিনা জানা নেই,কিন্তু অধিকাংশ ছেলের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়।পুষ্প মাথার ওরনা টেনে ঠিক করে বললো,
“জ্বি ভাইয়া।”

সাফিন কাচুমাচু করে তাকিয়ে বললো,
“ঢাকায় যাবে কবে?”

পুষ্প ভেবেছিলো এবার ঢাকায় আপুর বাসায় বেড়াতে যাবে।এখন সাফিনের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না যাওয়াই ভালো।
“যাবো কলেজ বন্ধ দিলে।”

“পুষ্প তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।”

পুষ্প জানে সাফিন কি বলবে।তার শুনতে ইচ্ছে করে না।কিন্তু সরাসরি তো আর না করা যায় না।তখনি শুনতে পায় বাড়ির বাহিরে সি.এন. জি হর্ণ দিচ্ছে।পুষ্প বললো,
“ভাইয়া গাড়ি এসে গেছে।আপুকে ডাকি।”

এটা বলে ঘরের ভেতরে চলে যায়।সাফিন হাত দিয়ে চুল টেনে ধরে,যেকোনো মূল্যেই পুষ্পকে চাই।এমন স্নিগ্ধ মেয়ে সে কমই দেখেছে।মনের কথা বলতে না পারার যন্ত্রনায় মুখ ভুতা করে দাঁড়িয়ে থাকে।

মিজান শেখ আর রোকসানা এই কয়দিন সাফিনের খুব যত্ন করেছে।দেখতে শুনতে সব দিক দিয়ে ভালো।ব্যবহার মাশাল্লাহ, ভালো চাকরি,ঢাকায় নিজের বাড়ি,চেনাজানার মধ্যে এমন ছেলের কাছে যদি পুষ্পকে বিয়ে দেয়া যেতো তাহলে খুবই ভালো হতো।সব বাবা মা ই চায় মেয়েদের ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে,মেয়েরা যেন ভালো থাকে শান্তিতে থাকে ।মনের ইচ্ছাটা মনে চেপে রেখেই বিদায় দেয়।

মঙ্গলবার দুপুর থেকে প্রচন্ড পরিমানে বৃষ্টি শুরু হয়।পুষ্প আর শিলা কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তার সামনের দোকানে দাঁড়ায়।হঠাৎ পুষ্প দেখে সামনের টং দোকানে শিমুল তিয়াশ আর কালাম মেম্বার বসে চা খাচ্ছে।কালাম মেম্বার কি জানো বলছে তা শুনে শিমুল হাসছে।পুষ্প অপলক তাকিয়ে থাকে।শিমুলটা কতো সুন্দর!অবিশ্বাস হলেও সত্য এই এতো সুন্দর শিমুল তাকে ভালোবাসে।তার জন্য হাজারো পাগলামি করে।আচ্ছা পুষ্প তাকে আগলে রাখতে পারবে তো?পুষ্প আবার তাকায় শিমুল কথা বলার মাঝেই দাত দিয়ে ছোট ছোট করে ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার ছেড়ে দিচ্ছে।পুষ্প চোখ ফিরিয়ে নেয়।এই শিমুল সবটাই নেশার বক্স।এতো মায়া এতো আদর লাগে বলে বুঝানো সম্ভব না।শিলা অন্য মেয়েদের সাথে গল্প করছে।পুষ্প নিজেকে সামলাতে পারে না আবার তাকায় শিমুলের দিকে।সে হাতে সিগারেট নিয়ে কি আয়েশ করে দুই ঠোঁটের ফাকে নেয় তারপর ঠোঁট গোল করে ধোঁয়ার কুন্ডলী বের করে ছেড়ে দিচ্ছে।শিমুলের এই সিগারেট খাওয়ার মতো ব্যাপারটাও পুষ্পর ভালো লাগে।আচ্ছা প্রেমিক পুরুষ যা করে মেয়েদের কি সব কিছুই ভালো লাগে?হয়তো।আচ্ছা শিমুলের অর্ধেক খাওয়া সিগারেটটা খেলে কেমন হয়?পুষ্পর এমন ভাবনায় নিজেই লজ্জা পায় মাথা নিচু করে লাজুক হাসি হাসে।পুষ্পর আজকাল যখন তখন মুখে লাজুক হাসি ফুটে উঠে।আবার দোকানের দিকে চোখ গেলে দেখে শিমুল দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।পুষ্প চোখ ফিরালো না চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে।শিমুলের চোখে চোখ রেখে পুষ্প নিজেই যখন খু ন হতে চায় সেখানে শিমুলের কি দায়!শিমুল পুষ্পর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে।এই যে পুষ্প তার দিকে তাকিয়ে আছে শিমুলের ইচ্ছে করছে বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় মেয়েটার হাত ধরে হাটতে।শিমুল তিয়াশের কাছে বাইকের চাবি দিয়ে বললো, “শিলাকে নিয়ে চলে যেতে।আর পুষ্পকে সামনে আসতে।”

পুষ্প দেখলো শিমুল এই ঝুপ বৃষ্টিতেই রাস্তায় নেমে হাটা শুরু করেছে।তিয়াশ বাইক নিয়ে আসে শিলাকে উঠতে বলে।পুষ্পর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“হেটে যা।সামনে অপেক্ষা করছে।”

তিয়াশের মুচকি হাসি দেখে পুষ্পর খুব লজ্জা লাগে।ওরা চলে গেলে পুষ্প ধীরপায়ে হাটতে থাকে।কিছুদূর গিয়ে দেখে শিমুল দাঁড়িয়ে আছে।

শিমুল দাঁড়িয়ে পুষ্পর হেটে আসা দেখছে।ফর্সা গায়ে বৃষ্টির পানি লাগাতে যেন আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।বৃষ্টির পানি লেগে গোলাপি ঠোঁট ভেজা টকটকে লাগছে।লজ্জালজ্জা মুখটা দেখতে শিমুলের খুব ভালো লাগে।শিমুল মাথা চুলকে নিচু হয়ে শ্বাস নেয়।

পুষ্প কাছে গেলে দুজনেই নিঃশব্দে হাটে।শিমুলের সানিধ্যে এসে পুষ্পর গাল ভারি হয়।নাকের ডগায় শিরশিরানি লাগে।শিমুল পুষ্পর দিকে তাকায় পুষ্পর কোমল গাল বেয়ে পানি পড়ছে শিমুল সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“বৃষ্টি আমার খুব পছন্দ।”

পুষ্প শিমুলের দিকে তাকায়।শিমুল আবার বলে,
“কিন্তু শিমুলের তো ভিজতে মানা”

পুষ্প বললো,
“কেন?”

“শিমুল তুলা ভিজে যাবে বলে।”

পুষ্প মুচকি হাসে।শিমুল বলে,
“শিমুলের তুলা হওয়ার আগে তো শিমুল ফুল ফুটে।”

“জানি।”

“শিমুল ফুল ভিজলে খুব স্নিগ্ধ লাগে।”

“হুম।”

শিমুল মাথার চুলে হাত ঝেড়ে বললো,
“আমার একটা ফুল দরকার।যার হাতে হাত রেখে বৃষ্টিতে ভিজতে পারবো।”

পুষ্প শিমুলের কথা শুনে মাথা নিচু করে নেয়।শিমুল কি তাকে ফুল বলছে?তার হাত ধরতে চাইছে?পুষ্প বৃষ্টি ভেজা ঠোঁট আবার জিভ দিয়ে ভিজানোর চেষ্টা করে।
শিমুল পুষ্পর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।তারপর একহাত দিয়ে পুষ্পর নরম,কোমল একটা হাত ধরে।শিমুলের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে পুষ্পর শরীরে শিহরণ বয়ে যায়।সলজ্জ চোখে তাকিয়ে দেখে তার দিকে শিমুল চুপ করে তাকিয়ে আছে।পুষ্প মাথা নামিয়ে ফেলে। এমন করে তাকালে কথা বলা যায়?এমন করে তাকালে তো নিঃশ্বাস আটকে যায়।শিমুল মাথা ঝুকিয়ে হাসে,
“অনুমতি নিলাম না।রাগ করেছিস?”

পুষ্প মনে মনে হাসে,’হাত ধরে জিজ্ঞেস করছে রাগ করেছি কিনা!শেয়ানা পুরুষ।বেশ আদায় করে নিতে জানে।’

শিমুল শক্ত করে পুষ্পর হাত ধরে রাখে।শিমুল হঠাৎ থেমে যায়।পুষ্প জিজ্ঞাস্য চোখে তাকালে বলে,
“বৃষ্টিতে ভিজে তোকে খুব সুন্দর লাগছে পুষ্প।”

সরাসরি প্রশংসায় পুষ্প লজ্জা পায়।এই প্রথম শিমুল প্রশংসা করলো কিনা!মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।শিমুল একনজরে তাকিয়ে থাকে, একপর্যায়ে পুষ্পর হাতে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলী দ্বারা ঘষে দেয়।পুষ্প ছটফটিয়ে উঠে,তাকায়।শিমুল কাতর গলায় বলে,
“আর একটু প্লিজ।”

মাটিতে বৃষ্টির পানি পড়লে যেমন নরম কাদা হয়ে যায়,পুষ্পর মনে শিমুলের এই হালকা হালকা প্রেমের ছিটা পড়ে পুষ্পকে পাগল করে দেয়।শিমুলের এই চোখের চাহনি সে নিতে পারেনা,সারা শরীর শিরশির করে কেঁপে ওঠে।যেদিন থেকে শিমুলের চোখে তাকিয়েছে সেদিন থেকে পুষ্পর সব উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে।অজানা অনুভূতি মাথা উচিয়ে চিরবিরিয়ে দাঁড়াতে চায়।অসহ্য জ্বালা।পুষ্প বলে,
“বাড়ি যেতে হবে।আম্মা টেনশন করবে।”

শিমুল আরো একটু কাছে এগিয়ে আসে।
“আমার দেখা হয়নি এখনো।”

পুষ্প দেখে শিমুলের কথার মধ্যে কি অধিকারবোধ।মাথা নেড়ে বললো, “এখন যাই?”

শিমুল বললো”
“যাবি?আচ্ছা শুনে যা,কালাম মেম্বারকে চিনিস না?”

পুষ্প কিছুক্ষণ আগেও কালাম মেম্বারের সাথেই শিমুলকে দেখেছে।মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।

“উনার ছোট বোন নাকি আমার কাছে বিয়ে দিতে চায়।”

পুষ্প চোখ বড় করে শিমুলের দিকে তাকায়।শিমুল বলতেই থাকে”
“উনার বোন নাকি আমাকে খুব পছন্দ করে,এখন বিয়ে করারা কথা বলেছে।”

পুষ্প গলা কেঁপে উঠে।হালকা গলায় বলে
“আপনি বিয়ে করবেন?”

শিমুল পুষ্পর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে তো করতেই হবে।”

পুষ্পর বুকটা কেঁপে উঠে।শিমুল বিয়ে করবে?বৃষ্টির পানিতে ভিজা চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে এক ফোটা অস্রু।শিমুলের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চায়।মুখে বলে,
“তো যান বিয়ে করেন গিয়ে।”

পুষ্পের রাগ দেখে শিমুল হাসে।
“আচ্ছা।করবো।”

শিমুলের কথা শুনে পুষ্পর গা জ্বলে উঠে।হাত ধরে হাটবে তার আর বিয়ে করবে আরেকজনকে?সে একটু জোড়েই বলে,
“হাত ছাড়েন।”

শিমুল পুষ্পর রাগ দেখে বললো,
“আরে বললেই কি বিয়ে করবো?আমার তো লাগবে ফুল।শিমুল ফুল।যাকে নিয়ে যখন তখন ভিজতে পারবো।”

শিমুলের কথা শুনে পুষ্পর উতপ্ত মন ঠান্ডা হয়।মাথা নিচু করে বললো,”এখন বাড়ি যাবো।”

“আচ্ছা।”

শিমুল পুষ্পর দুহাত ধরে।চোখে চোখ রেখে খুব নরম গলায় বললো,
“কবে বড় হবি পুষ্প?”

পুষ্প মনে মনে বলে,
‘আমি বড় হয়ে গেছি শিমুল ভাই।আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?’

শিমুলের চেহারায় কাছে টানার তীব্র ইচ্ছা ফুটে উঠে,বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে।মাথাটা নিচু করে হাত ছেড়ে দেয়।
“আচ্ছা যা।”

পুষ্প যেতে যেতে ফিরে তাকায়।লজ্জাশরম ভুলে মিনমিন করে বললো,
“আবার কবে?”

শিমুল মনে মনে হাসে।বুঝতে পেরেও বললো,
“কি?”

পুষ্প চোখ নামিয়ে বললো,
“দেখা।”

শিমুল এগিয়ে আসে।মাথা ঝুকিয়ে বলে,
“মহারানী যখন দেখা করতে চাইবে।”

পুষ্প শিমুলের দিকে তাকায়।শিমুল চোখে হাসে।মনে মনে ভাবে তোর সুখের ম র ণ ঘনিয়ে আসছে পুষ্প।

পুষ্প সামনে এগিয়ে যায়।শিমুলের কথাটা মনে সুখ দিয়েছে,মহারানী শিমুলের মহারানী।তবে শিমুল বড্ড জ্বালাচ্ছে।এই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে যেন সে বড় শান্তি পাচ্ছে।ছেলেটা চা,লা ক একটু বেশিই চা,লা ক।পুষ্প কয়েকবার ফিরে ফিরে তাকায়।শিমুল দাঁড়িয়ে তাকিয়ে তাকেই দেখছে।

শিমুল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার তো অনেক কিছু ইচ্ছা করছিলো,কোন ইচ্ছাই পূরন হলো না।বুকটা অসহ্য দহনে পুড়ছে।মেয়েটা তাকে পাগল করেই ছাড়ছে।এই পিচ্ছির প্রেমে কিনা শিমুল পা,গল!পুষ্প অবশ্য গুটিগুটি পায়ে এগুচ্ছে।প্রেমের মরণ বিষ আস্তে আস্তে পান করছে।শিমুল হাসে প্রেমে পড়ার মূহুর্তগুলো এতো সুন্দর এতো স্নিগ্ধ।পাগল করার মতো অনুভূতি শুধু প্রেমে পড়লেই পাওয়া যায়।

চলবে…….

#শিমুল_ফুল
#০৯
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

বসন্তের বাতাসে চারদিকে প্রেমের আলোড়ন তুলে।কোকিলের কুহু কুহু ডাকে মন করে আনচান।এই আনচান মন নিয়ে পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে হিজল গাছের নিচে।রাত বারোটা।ওই বৃষ্টির দিন যে দেখা হয়েছিলো আর দেখা হয়নি।নির্বাচনে কাজে শিমুল ঢাকা গিয়েছিলো,চারদিকে কাজ আর কাজ এবার বিরোধী দল বেশ শক্তিশালী।প্রায় পনেরো দিন পরে আজকে দেখা হচ্ছে।শিলার কাছে খবর পাঠিয়ে বলেছে,রাতে এখানে আসতে।পুষ্প আজকে লাল টুকটুকে একটা জামা পড়ে এসেছে।হালকা সেজেও এসেছে।আজকাল শিমুলের সামনে নিজেকে পরিপাটি করে উপস্থাপন করতেই বেশি ভালো লাগে।চুপচাপ দাঁড়িয়ে যখন আকাশ পাতাল ভাবছিলো তখনি শিমুল এলো।বসন্তের রাজা হয়ে,তিরতিরানো পাগলা বাতাস গায়ে মেখে পুষ্পকে সেই বাতাসে দুলাতে এসে উপস্থিত হলো।লাল রঙ্গা জামায় পুষ্পকে খুব সুন্দর লাগছে।চাঁদের আলোয় চারিপাশ ফকফক করছে।নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতায় এমন লাল পরী দেখে শিমুল হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।আশেপাশে দল বেধে জোনাকি পোকা উড়ে যাচ্ছে,ক্ষনে ক্ষনে ঝি ঝি পোকা ডাকছে।শিমুল কিছুক্ষণ ফাকা রাস্তায় তাকিয়ে থাকে।আজকের রাতটা বড্ড বেশী স্পেশাল হতে যাচ্ছে।এই এতো বড় শিমুলও মনে মনে নার্ভাস হয়।

পুষ্প শিমুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।প্রত্যেকের শরীরে আলাদা একটা ঘ্রান থাকে,শিমুলের শরীরের ঘ্রানটা ভিন্ন,যেন এটা শুধুমাত্র পুষ্প ফুসফুস ভরে দিতেই তৈরি।শিমুলের হাতে কি জানো দেখা যাচ্ছে।পুষ্প সেদিকে তাকাতেই শিমুল এগিয়ে তার কাছে আসে।
শিমুলের হাতে পাঁচটা শিমুল ফুল।পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বললো,
“পুষ্প ”

পুষ্প শিমুল ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে।তরতাজা পাঁচটা ফুল।শিমুলের ডাক শুনে তাকায়।

“তুই কি শিমুলের ফুল হবি?”

শিমুলের হঠাৎ এমন কথায়
পুষ্প ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।শিমুল তাকে প্রেম নিবেদন করছে?শিমুল হাতের ফুলগুলো দেখিয়ে আবার বললো,
“দেখ শিমুল ফুল কেমন লাল টকটকে।এই শিমুলও তোকে ভালোবেসে এমন লাল টকটকে করেই রাখবে।নরম তুলোর খোঁজ নিতে হলেও একবার শিমুল ফুল হয়ে যা প্লিজ।”

পুষ্পের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে আনন্দঅস্রু।শিমুল সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি আর পারছিনা,আমার তোকে লাগবে খুব আপন করে।তুই বুঝতে পারছিস তো ফুল?”

পুষ্প শিমুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ❝ফুল শিমুল ফুল,শিমুলের ফুল❞।বুকটা কাঁপছে।
শিমুল ফুলগুলো পুষ্পর হাতে দিয়ে তাকায়।লাল জামায় লাল ফুল হাতে খুব স্নিগ্ধ লাগছে সে হাত ধরে আরেকটু কাছে আসে।অন্তরে দাগ লাগানোর মতো করে ফিসফিস করে বললো,
“শিমুল ফুল হবি না?”

পুষ্প ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে মাথা দুলায়।শিমুল মাথা নেড়ে বললো , “মুখে বল।”

পুষ্প খুব আস্তে করে বললো,
“হবো।”

“সত্যি?”

“হুম।”

শিমুল চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।হাত দিয়ে পুষ্পর চোখের পানি মুছে দু’গালে হাত রেখে বললো,
“দেখি!আল্লাহ কেঁদে কেঁটে কি অবস্থা করে ফেলেছে।আমার ভয়ে?”

“না।”

“তাহলে?”

“এমনি।”

শিমুল নিজেও নার্ভাস।এই প্রথমবারের মতো নিজের বলিষ্ঠ দুই হাত পুষ্পর কোমড়ে রেখে নিজের দিকে টেনে নিলো।জীবনের এই প্রথম কোন পুরুষের ছোঁয়া পেয়ে,পুষ্প কেঁপে ওঠে।মাথা তুলে শিমুলের দিকে তাকায়।শিমুল মাথাটা নিচু করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।পুষ্প তাকালে বললো,
“কি?”

পুষ্পের শরীর যে মৃদু তালে কাঁপছে এটা শিমুল বুঝতে পারে।নিজের সাথে আরেকটু চেপে বললো,
“এতো কাঁপা-কাঁপির কি আছে?”

শিমুল তার কাঁপা-কাঁপির ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গেছে এটা ভেবে পুষ্প লজ্জা পায়।শিমুল আরো কাছে টানাতে দুজনের নিঃশ্বাসের আলিঙ্গন হয়।পুষ্পর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে।তার দুহাত শিমুলের শক্ত বুকের উপরে।মুখে লাজুক হাসি ঝুলিয়ে বলে,
“কিছুনা।”

শিমুল এক নজরে তাকিয়ে থাকে পুষ্পর মুখের দিকে।আজকে বেশামাল ইচ্ছেরা পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটোছুটি করছে তাদের কি আজকে একটু ছেড়ে দেওয়া উচিৎ?পুষ্পর শরীরটা নরম তুলতুলে।শিমুলের মনে হচ্ছে আস্ত একটা তুলোর বস্তা।শিমুল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে চুপ করে থাকে।কি বলবে?পুষ্পই কথা বলে,
“ছাড়েন।”

শিমুল পুষ্পর লজ্জামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কেন?”

“কেমন জানি লাগে।”

শিমুল আস্তে করে বললো,
“কেমন লাগে?”

পুষ্প উশখুশ করে বললো,
“যন্ত্রনা।”

শিমুল হাসে।মাথাটা আরেকটু নিচু করে বললো,
“যন্ত্রনার ছোঁয়া না লাগাতেই যন্ত্রণা?”

পুষ্প কথাটা পুরোপুরি বুঝতে পারে না।শিমুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।পুষ্পর চেহারা দেখেই শিমুল বুঝে।মাথা নেড়ে হেসে বললো,
“বোকারানী সময় হলে বুঝে যাবি।”

দুজনে চোখ আজ দুজনে’তে মজে আছে।শিমুল পুষ্পর ডান হাতে ছোট করে একটা চুমু খায়।পুষ্প চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।শরীরে অজানা শিহরণ ছুটোছুটি করছে।শিমুল কি তাকে মেরে ফেলবে?এতো ভালোবাসতে হবে কেন?পুষ্প যে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে শিমুল কি দেখে না?

শিমুল মাথাটা নিচু করে জড়ানো গলায় বললো,
“পুষ্প রে….।”

এমন ডাকে যেন পুষ্পর নরম অন্তর খুচিয়ে খুচিয়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়।অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“হুম”

শিমুল তার খোচাখোচা দাড়িওয়ালা গাল পুষ্পর নরম মোলায়েম গালে ঘষে বললো,
“এতো ভালোবাসবো যে তুই কল্পনাও করতে পারবি না।”

এটা কি সুখের পরশ নাকি অন্যকিছু পুষ্প বুঝতে পারে না।নরম গালে শিমুলের গালের খোচাখোচা দাড়ির ছোঁয়া পেয়ে পুষ্প ছটফট করে উঠে।শিমুল ফিসফিস করে বললো,
“কি হয়েছে?”

পুষ্প বললো,
“ছাড়েন।”

শিমুল পুষ্পর লজ্জামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে ছেড়ে দাঁড়ায়।অন্যপাশে মুখ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,মেয়েটাকে ছোঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে,বেশামাল ভাবে পাগল করতে ইচ্ছে করছে,নিজেকে স্বাভাবিক রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।হঠাৎ করেই শিমুলের এমন চুপ থাকা পুষ্পর ভালো লাগে না।মন খারাপ করে বললো,
“আমি কি চলে যাবো?”

পুষ্পর চলে যাবার কথা শুনে শিমুল রাগী দৃষ্টিতে পুষ্পর দিকে তাকায়।পুষ্প এমন দৃষ্টি দেখে বললো,
“চুপ করে আছেন তাই বললাম।”

শিমুল মাথা নিচু করেই বললো,
“পুষ্প একটা কথা বলি?”

পুষ্প মাথা নাড়ায়।
শিমুল পুষ্পর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো”
“খুব ভালোবাসি আমার শিমুল ফুলটাকে।”

পুষ্প লজ্জা পেলেও মিনমিন করে বললো,
“আমিও খুব ভালোবাসি।”

শিমুল শুনতে পেয়েও আরেকবার শোনার জন্য বললো,
“কি?শুনতে পেলাম না।”

পুষ্প লজ্জা পায়।মাথাটা নিচু করে বললো,
“ভালোবাসি।”

শিমুল চোখে হেসে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তমার দিকে যার জন্য এতো অপেক্ষা।পুষ্পর মুখ থেকে ভালোবাসি শুনার জন্য এতো তৃষ্ণা।আজকে কি মনটা শান্তি লাগছে না?লাগছে খুব শান্তি লাগছে।শিমুল গাছের মোটা শিকড়ে বসে পুষ্পর হাত ধরে টেনে কাছে বসায়।চোখে চোখ রেখে বললো,
“পুষ্প”

ভালোবাসি শব্দটা শুনার পর থেকে পুষ্প অন্য জগতে চলে গেছে,যে জগতে সুখের আনাগোনা।শিমুলের কথা শুনে ডাগর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।শিমুলই বলে,
“আমাকে অনেক ভালোবাসতে হবে কিন্তু।”

পুষ্প লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে নেয়।
“হাসলে চলবে না।”

পুষ্প হেসে হেসে বললো,
“আচ্ছা।”

শিমুল পুষ্পর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
“আমি কিন্তু খুব ভালোবাসবো।সামলাতে হবে কিন্তু।”

পুষ্প লজ্জায় পারেনা হিজল গাছের আগায় উঠে যায়।এতো লজ্জা দিচ্ছে কেন শিমুল?না!না!এখানে আর বসে থাকা যাবে না,পুষ্প উঠে দাঁড়ালে শিমুল কিছু বলার আগেই সে বললো,
“আর একটা কথাও বলবেন না।আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

পুষ্প হনহন করে সামনে এগিয়ে যায়।শিমুল হেসে দৌড়ে কাছে গিয়ে বলে,
“তোর নাম পুষ্প না রেখে লাজুকলতা রাখা উচিত ছিলো।কথায় কথায় লজ্জা পায়,এতো লজ্জা পেলে আমি বাবা হবো কিভাবে ভাই?”

পুষ্প হাটার মধ্যেই দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বললো,
“ছিহ ছিহ।অসভ্য কথাবার্তা।”

শিমুল দাঁড়িয়ে বললো,
” এজন্যই মানুষ বলে বাচ্চাদের সাথে প্রেম করতে নেই।রোমান্টিক মূহুর্তে এসে বলে ছিহ!”

পুষ্প দৌড়ে চলে যায়।শিমুল দাঁড়িয়ে হাসে তৃপ্তির হাসি।এতোদিন না বলে মনে মনে প্রেম হলেও আজকে হিজল গাছ সাক্ষী রেখে তাদের প্রেমের নতুন অধ্যায় শুরু হলো।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here