রোদেলা,পর্ব: ৫২

0
1013

#রোদেলা,পর্ব: ৫২
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

এ্যামী চলে যাবার পরই সারা শোভনের সব দায়িত্ব নেয়, ওর দেখাশোনা, খাওয়া দাওয়া, ঘুম, ঔষধ, বাইরে বেরানো, সব… শোভনের মা এতদিনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। এ্যামী থাকতে তাকেও শোভনকে দেখে রাখতে হতো, কারন এ্যামীর ছোট বাচ্চা আছে, ওকেও তো সময় দিতে হয়। কিন্তু সারা ম্যাজিকের মতো সব সামলে নিয়েছে। দিনে দিনে যেন এ পরিবারের একজন হয়ে উঠে ও। নাতাশার সাথেও খুব ভাব হয় ওর। বয়সের অনেক ব্যাবধান সত্ত্বেও ওরা ঠিক যেন বন্ধু।
এরি মধ্যে সারা হুট করে নাতাশার সাথে রোদেলাদের বাড়িতে গিয়েছিল একদিন। সেখানে রোদেলার পরিবারের সবার সাথে খুব আন্তরিক ভাবে মিশে ও। রোদেলার মাকে সব খুলে বলে ও শোভনের বর্তমান পরিস্থিতি আর সুস্থ হওয়ার বিষয় নিয়ে। কথা বলার একপর্যায়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো নাসিমা। মেয়েকে মনে করেই যে তার এই কান্না তা না বললেও বুঝে নেন সবাই।

অনেক ভালো সময় কাটে ওর সেখানে। ওদের পরিবারের এলবাম দেখে সারা। ওর ব্যাবহৃত কিছু জামাকাপড়, জুতা, ব্যাগ, বইপত্র, ডায়েরি নিয়ে যেতে চায় সাথে করে। রোদেলার মা তাতে আর অমত করেন না। কারন তাদের মেয়ে তো নেই, কিন্তু ছেলেটা অন্ততঃ সুস্থ হোক….তারা যথাসাধ্য সাহায্য করবে বলে জানায় সারাকে।

প্রিসিলার সাথেও সারা গল্প করেছিলো রোদেলাকে নিয়ে। ও কিভাবে জামাকাপড় পরতো, কিভাবে চুল বাঁধতো, কি পছন্দ করতো এসব খুটিনাটি নিয়ে। মোটামুটি একটা ধারনা হয় সারার রোদেলার ব্যাপারে।

রোদেলা আর সারার জীবনযাপন পদ্ধতি একেবারে ভিন্ন। সারা ধনী পিতার একমাত্র মেয়ে। আর রোদেলার জীবণ কেটেছে জীবণের সাথে যুদ্ধ করে। সারা চেষ্টা করে নিজেকে বদলাতে। নাতাশা ওকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে। আর শোভন তো ওকে প্রায় প্রতিদিনই বলে রোদেলা সম্পর্কে। রোদেলার কি ওকে ওর প্রতি দূর্বল করেছে, কেন ওকে এত ভালোবেসেছে ও, কেন ওর না থাকাটা কষ্ট দেয় ওকে।

ধীরে ধীরে সারাও ওর জীবনযাপন পদ্ধতি বদলাতে থাকে। দামী জামাকাপড় রেখে পরতে শুরু করে সাধারণ কাপড়চোপড়, জুতা, ব্যাগ। যেমনটা রোদেলা পরতো। লম্বা চুলগুলোকে কেটে ফেলে রোদেলার আদলে, ঠিক কাঁধ বরাবর । এ জিনিসটা করতে ওর নিজেরও খুব কষ্ট হয়। এত যত্নের, শখের চুল…. কিন্তু ও ভাবে এসব মূল্যহীন ওর ভালোবাসার তরে। এর চেয়ে ওর ভালোবাসার দাম ওর কাছে অনেক বেশী।

তবুও অনিশ্চয়তা ওকে ঘিরে রাখে, শেষ পর্যন্ত ও পারবে তো শোভনের মনে জায়গা করে নিতে…?
মূহুর্তেই ভাবে এই যে ওর এত কাছাকাছি থাকতে পারছে, ওর খেয়াল রাখছে, এই সময়টুকুই বা কম কি….

স্কুল লাইফ থেকেই শোভনকে ভালো লাগত সারার। সব বন্ধুদের চাইতে ও যেন স্পেশাল ছিলো ওর কাছে। এক সাথে কলেজ, কোচিং যাওয়া আসা, সবচেয়ে বেশী সময় কাটানোর সুযোগ, দুজনের বাড়িতেই অবাধ যাওয়া আসা তাই হয়তো সবচেয়ে বেশী ভালো লাগত শোভনকে। এতদিন তাই জানতো সারা….

কিন্তু এটা যে ভালোবাসা ও টের পায় যখন ও শোভনকে এ অবস্থায় দেখতে এসে। শোভনের রোদেলাহীন এই দৈন্যতা যেন ভিতর থেকে নাড়া দেয় সারাকে। একটা মেয়েকে এত ভালোবাসা যায়, যার চলে যাওয়া এমন কষ্ট দিচ্ছে ওকে। কত লাকি ছিলো সে….

তারপর অনেক ভাবে ও… কেমন যেন মনটা পুড়ে ওর, এটাই কি তাহলে ভালোবাসা….!? স্কুল লাইফের ভালোলাগাটা যে তখোনো অবশিষ্ট রয়েছে, ফুরিয়ে যায় নি সময়ের ব্যাবধানে তা যেন জানান দিচ্ছিলো ওর মন আর মস্তিষ্কে।

ডাক্তারী পড়াশোনার চাপে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে ভাববার ফুরসত পায় নি কখনো। ওর ধ্যান ধারনা ছিলো পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট। তার উপর বাবার কড়া শাসনে ও এসব প্রেম ভালোবাসা নিয়ে ভাবে নি কখনো। বাবা মা যেখানে বিয়ে দিবে সেখানেই সোনামুখ করে টুপ করে বিয়েটা করে নিবে এই ছিলো এতদিন ওর ধ্যান ধারনা।

সেই সারার সেদিন যে এত সাহস কোত্থেকে এলো ভেবেই এখনো ওর আত্না কেঁপে যায়। ওর বাবাও এত সহজে মনবার মানুষ নয়, তিন বছর আগে সারার একটা এক্সিডেন্ট হয়, জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলো আট-আটটা দিন। তখন শোভন সহ সব বন্ধুরা পাশে ছিলো। শোভন বাড়ির কাছে থাকায় একটু বেশীই সময় দিয়েছিলো ওকে। এক্সিডেন্টের
পর থেকে ওর বাবা যেন কিছুটা শিথিল হয়েছিলো তার শাসনে। মেয়ে জমের সাথে দেখা করে ফিরেছে। আমূল বদলে যান তিনি। তাই হয়তো মেয়ের এমন সিদ্ধান্তে অমত করেন নি তিনি। তাছাড়া শোভনরাও তাদের দিক থেকে ফেলে দেয়ার পাত্র নন। শিক্ষিত, সুদর্শন, ওদের পারিবারিক প্রভাব প্রতিপত্তি বেশী ছাড়া কম নয় ওদেরও চেয়ে।

সারার প্রতি সন্ধ্যায় চেম্বারে বসার কথা, তিনটা চেম্বারে সপ্তাহে দুদিন করে। বলতে গেলে ক্যারিয়ার গোছানোর এ সময়টা ও পুরোটা ঢেলে দিচ্ছে এ ভেঙে যাওয়া পরিবারটাকে গোছাতে। ভালোবাসা গভীর না হলে এমন ত্যাগ সম্ভব না। সারা নিজেও অবাক হয় মাঝে মাঝে ও কিভাবে পারছে এতসব… সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার ও ওর অস্তিত্বকে মুছে ফেলছে, ধীরে ধীরে রোদেলা হয়ে যাচ্ছে নিজে….

এ জিনিসটা যে কোন মেয়ের পক্ষে মানা কষ্টের। যাকে সে ভালোবাসে সে ভালোবাসে অন্য একজনকে…..
রাতের বেলা এসব যখন মনে হয়, মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে,
ধীরে ধরে মনকে শান্ত করে সারা। ওকে সুস্থ করতে ও না-হয় রোদেলাই হয়ে যাবে…..

তারপর ও যখন সুস্থ হবে তখন ঠিক জায়গা করে নিবে নিজের জন্য। এটাই স্বান্তনা আপাততঃ….

শোভনের মা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে শোভনের মন যাতে একটু নরম হয় সারার প্রতি। কারন সারার মনের ভাব পরিষ্কার হলেও, শোভন ভাবলেশহীন। সত্যি বলতে ও হয়তো ভাববার মতো পরিস্থিতিতে নেই এখনো….

মোটামুটি এই পরিবারের মানুষগুলোর জীবণ স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে এই সারার হাত ধরেই…

কিন্তু এরিমধ্যে একদিন সারার মা এসেছেন সারাকে নিয়ে যেতে। তিনি তার মেয়ের জীবণকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিতে চান না তাই তার এই সিদ্ধান্ত।

নিঃসন্দেহে শোভন অনেক ভালো একটা ছেলে। তাকে দিয়ে তার মেয়ের ক্ষতি হবে এমন কোন ভয় তার মনে নেই, তবুও
যত যাই হোক না কেন সমাজ এমন যুবক ছেলের পাশে এমন যুবতী মেয়ের অকপট মেলামেশা কোন রকম সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া সমাজ কেন মেনে নিবে এটা….

সারা শোভনকে নিয়ে শপিংয়ে গিয়েছে জেনেই তিনি এ বাড়িতে এসেছেন শোভনের মায়ের সাথে কথা বলতে। মেয়ের সামনে এসব বলা সম্ভব না তাই…

তিনি শোভনের মায়ের হাতটা ধরে বলেন-
ভাবী আমরা একটা সমাজে বাস করি, তাই কিছু নিয়মকানুন আমাদের মেনে চলতে হয়। সমাজ উপেক্ষা করে চলবো ততোটাও আধুনিক আমরা নই… মানুষ কি সব কানাঘুষা করে ভয় হয়, আমার ফুলের মতো মেয়ের জীবণটা সত্যিই এমন না হয়ে যায়….. মেয়ে তো আপনারও রয়েছে, আপনি একটু ভাবুন আমার দিকটা… আমি কি ভুল না সঠিক। শোভনের জন্য আমার মেয়ে যদি সত্যি কিছু করতে পারে আমাদের মতো খুশি দ্বিতীয় কেও হবে না…
ও ওর জীবণ, ক্যারিয়ার সব গুটিয়ে নিয়েছে শোভনের জন্য। শোভন যদি ওকে ফিরিয়ে দেয় তাহলে অবস্থা কি হবে একবার ভেবে দেখুন।
সমাজের কথা বাদ আমার মেয়েটার মনের অবস্থা কি হবে…
একটু ভেবে দেখুন….
ও বেঁচে থেকেও মরে যাবে…

আমি অনেকে ভাবনাচিন্তা করার পরই এসেছি আপনার কাছে…. আপনারা সামাজিক স্বীকৃতিতে হয় ওকে পুত্রবধূ করে ঘরে রেখে দিন, না হয় আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আত্নীয় স্বজনরা নানান কথা শুনাচ্ছে….
ওর ফুফুরা আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
এসব বলে কেঁদে দেন সারার মা…

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন হঠাৎ বিয়ের কথা কেন বলছি আমি, আমার মেয়ের জন্য কি ছেলে কম পরবে…! তবুও এসব বলছি কারন বিয়ে এমন এক বন্ধন যেটাতে খোদ আল্লাহর রহমত থাকে। আমরা এ বিষয়ে ওকে কোন জোর করতে পারছি না, ও উল্টো আমাদেরকে বোঝায়। তাই আমি আপনার কাছে এসেছি….

শোভনের মা তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেন-
: আমি বুঝি আপনার মনের অবস্থা, আমিও তো মা, কিন্তু দেখেন স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের ছেলের দিকটাই ভাবছি গত ক’দিন ধরে। এসব একটা বারও মনে আসে নি, সারার মতো মেয়েকে ছেলের বৌ হিসেবে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। আমরা যে এ বিষয়ে কিছু বলবো সেই সাহস আমাদের নেই, আপনারা নিজে এই বিপদে হাত বাড়িয়ে না দিলে হয়তো নিজেদের এ সময়কার কষ্টের কথাই বলতে পারতাম না। আপনারা সত্যি ভীষণ ভালো মনের মানুষ, আমাদের কোন আপত্তি নেই এ বিয়েতে…

: ভাবী শোভন, কল্লোল, এ্যামী, ন্যান্সি ওরা তো আমাদের সামনেই বড় হলো, ওরা সোনার টুকরো ছেলেমেয়ে তা সবাই জানে। আপনাদের মতো পরিবারে আমাদের মেয়ে আসবে সেটাও আমাদের জন্য আনন্দের। ভাবী দেখেন যা করার দ্রুত করেন। আমি সব সময় ভয়ের মধ্যে আছি….
অনিশ্চয়তার ভয়ে, বদনামের ভয়ে….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here