#THE_BOOK
#পর্ব_১০
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
সকালের বাতাসটা লাবন্যর গা ছুঁয়ে দিচ্ছে।মন্দ লাগছে না লাবন্যর। কফির কাপ হাতে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘনঘন কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে সে। সকালেই প্রিতমের সাথে কথা হয়েছে। খুব শীঘ্রই ওদের বিয়েটা হবে এই মাসে প্রিতমের অফিসের চাপটা একটু বেশি তাই পরের মাসে বিয়ের কথাবার্তা বলতে লাবন্যর বাড়িতে যাবে। এটা ভেবে লাবন্যর খুশি লাগছে খুব। এসব ভাবতে ভাবতে সময় অনেকটা পেরিয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে উঠে লাবন্যর। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো।
আজকে রেডিও স্টেশনে যেতে দেরি হয়ে গেছে লাবন্যর। অভিনব আর রা’দ আগেই চলে এসেছে। পূর্ণাশা আসেনি কারণ ও এই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ছোটখাটো একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি নিয়েছে।সামির রায়হান পড়েছে বিপাকে। ওনার রেডিও স্টেশন যে ডুবতে বসেছে। রা’দ অভিনব আর লাবন্য ও তো ছেড়ে দেবে। তাহলে ওনার চলবে কিভাবে??তাই তিনি প্রতিদিন ওদের কিছু কিছু বুঝাচ্ছে যাতে ওরা চাকরি না ছাড়ে।
লাবন্য তড়িঘড়ি করে অফিসে ঢুকলো। নিজের ডেস্কে বসতে বসতে অভিনবের দিকে তাকালো। অভিনব অন্যমনস্ক হয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।লাবন্য অভিনবকে বলল,”হোয়াট হ্যাপেন্ড অভিনব??”
লাবন্যর দিকে তাকিয়ে অভিনব মাথা নাড়ায় কিন্তু মুখে কিছু বলে না। লাবন্য বলল,”তুই কি কোনো বিষয়ে আপসেট?? হসপিটাল থেকে ফিরে আসার পর থেকে তুই যেন কেমন হয়ে গিয়েছিস প্লিজ কিছু তো বল??”
অভিনব বড় একটা শ্বাস ফেলে। রা’দ এসে ওর পাশে বসে বলল,”তোর আপসেটের কারণ কি মারমেইড??”
লাবন্য অবাক হয়ে বলল,”জলপরী?? অভিনব তখন তুই অসুস্থ ছিলি আর ওই জলপরী তোর ব্রেণ ওয়াশ করে দিয়েছিলো যার কারণে তুই প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলি। জলপরী তোকে ভালোবাসতো না এটা ওর ফাঁদ ছিলো। কিন্তু এখন তো তুই সুস্থ তাহলে?? এখন তো সব বুঝতে পেরছিস তাহলে এসব ব্যাপার নিয়ে আপসেট হচ্ছিস কেন??”
অভিনব দৃষ্টি নিচু করে বলল,”কিন্তু আমার অনুভূতি তো শূন্য ছিলো না। আমার ভালোবাসা তো মিথ্যা ছিল না। আমার পাগলামো গুলো কি শুধুই ওই বইয়ের লেখাগুলো পূরণ করার জন্য ছিলো?? ভালোবাসা কি ছিলোই না??? তখন আমি বুঝতে পারিনি যে কোনটা করলে আমার ভালো হবে কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। তবুও আমার মন মানছে না। আমার সাথেই এটা কেন হতে হলো?? মিথ্যা ভালোবাসার জালে জড়িয়ে আমি তাকে সত্যি ভালোবেসে ফেললাম কেন?? এখন কিছুতেই তার প্রতি আমার অনুভূতি শূন্য হচ্ছে না। আমি পারছি না তাকে ভুলতে। চোখ বন্ধ করলে ওর মুখটা কেনো ভেসে আসে?? আমি ওকে ভুলতে পারছি না। কোনদিন পারব ও না। এজন্য আমি তোদের দোষ দিচ্ছি না। তোরা আমার ভালোর জন্যই এসব করেছিস কিন্তু তবুও আমার ভালো লাগছে না।”
রা’দ আর লাবন্য অভিনবের দিকে তাকিয়ে আছে। অভিনব এখনও জলপরীকেই ভালোবাসে। কিন্তু অভিনব এটা জানে না যে এতদিনে মিথ্যা ভালোবাসার নাটক করতে করতে জলপরীর মনেও ওর জন্য কিছু অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। এসব বললে হয়তো অভিনব আরো কষ্ট পাবে তাই রা’দ অভিনবকে এসব বিষয়ে কিছু বলল না।অভিনবের কাঁধে হাত রেখে বলল,”এসব যত তাড়াতাড়ি ভুলবি ততই ভালো। সামনে আমাদের আরও অনেক বড় লড়াই আছে।সেই লড়াইতে তোর হাত লাগবে আমাদের। তুই থাকবি না??”
অভিনব রা’দের হাতে হাত রেখে বলল,” আমি সবসময়ই তোদের পাশে আছি। আমৃত্যু পর্যন্ত থাকবো।”
লাবন্য বলল,”তাহলে এবার তো একটু হাসি দে। তোর এই গোমড়া মুখ দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না।”
অভিনব জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। রা’দ আর লাবন্য তাতে উৎসাহ দিলো।
কিন্তু ওরা এখন পূর্ণাশাকে মিস করছে। চারবন্ধু এতদিন একসাথে ছিলো। হাসি খেলা আড্ডার মধ্যে দিয়েই ওদের জীবন কেটেছে কিন্তু এখন ওদের মধ্যে একজন নেই। এভাবেই কি কোন একদিন চারবন্ধু চার দিকে চলে যাবে?? হারিয়ে যাবে তাদের বন্ধুত্ব??নাকি কোন একদিন ফিরে আসবে সবাই?? আবার একসঙ্গে মজ করে দিন কাটবে সবার??
সন্ধ্যার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় পূর্ণাশা।ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে সে। আজকে বসের একগাদা ঝাড়ি খেয়েছে। তাই মনটা খারাপ হয়ে আছে। পূর্ণাশা তো এসব কাজ কখনোই করেনি। ভুত প্রেতের আড্ডায় মেতে থাকতো সবসময়। এসব চাকরি বাকরি কি ও করেছে কখনো??একরাশ বিরক্তি নিয়ে যাত্রি ছাউনীতে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণাশা। এই বাসটাও আসছে না। বিরক্তি আরো এসে পড়লো পূর্ণাশার। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস চলে আসলো। জানালার পাশের সিটটাতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। সিটের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসলো। বাড়িতে ফিরে তাড়াতাড়ি গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো। এতক্ষণে পূর্ণাশার মনটা শান্ত হলো।ক্লান্তিগুলো ও যেন উড়ে গেল। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে পূর্ণাশা যেন সবকিছু ভুলেই গিয়েছে। কলিং বেলের শব্দে পূর্ণাশার ধ্যান ভাঙলো। কিন্তু পূর্ণাশা তো এখনও ভিজতেছে। তড়িঘড়ি করে শাওয়ার বন্ধ করে চেঞ্জ করতে লাগলো। ওদিকে কলিং বেল অনবরত বেজেই যাচ্ছে। কোনরকমে চেঞ্জ করে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলে একদফা অবাক হয় পূর্ণাশা। ওর বন্ধুমহলের বাকি তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। বেশি অবাক হয়েছে অভিনবকে দেখে। কারণ অভিনব এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। ফোন করলে রিসিভ করে না। রিসিভ করলে ঠিকমতো কথা বলে না। আর সেই অভিনব ওর বাসায়!!পূর্ণাশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভিনব বলল,”কি রে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি নাকি??সর ভেতরে ঢুকতে দে??”
পূর্ণাশা সাইড দিতেই অভিনব ভেতরে ঢুকলো সাথে রা’দ আর লাবন্য। দুজনে গিয়ে আরাম করে বিছানায় বসলো। আর অভিনব কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ খুলে তাতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।পূর্ণাশা চুল থেকে তোয়ালে খুলতে খুলতে বলল,”যে হারে বেল বাজাচ্ছিলি আরেকটু হলে তো বেলটা নষ্ট হয়ে যেতো।”
রা’দ বলল,”এটা সম্পূর্ণ অভিনবের কাজ।”
তখনই রান্নাঘর থেকে অভিনব এসে বলল,”ফ্রিজে তো সবজি ছাড়া কিছুই নেই।এই ফকিন্নি কি খাওয়াবি আমাদের?? আমার তো খুব খিদে পেয়েছে।”
পূর্ণাশা হেসে ফেললো এই অভিনবকেই তো চেয়েছিল । পূর্ণাশা বলল,”কিছুই নেই ফ্রিজে আর খাওয়ার কিছুও নেই। পাস্তা আর নুডুলস আছে যা গিয়ে রান্না করে খা।”
অভিনব চোখ কুঁচকে সিংগেল সোফায় বসে বলল,”তোর বাড়িতে এসেছি তুই রান্না করে খাওয়াবি তাড়াতাড়ি যা।”
পূর্ণাশা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। কিচেনে গিয়ে পাস্তা আর নুডুলস সেদ্ধ হতে দিয়ে কাটাকুটি করতে লাগলো। অভিনব পাস্তা খায় না তাই পূর্ণাশা নুডুলস এনে রাখে। পূর্ণাশা পাস্তা খেতে পছন্দ করে নুডুলস বেশি একটা খায় না। রান্না শেষ করে সবাইকে সার্ভ করে নিজে খেতে বসলো। পূর্ণাশা খেতে খেতে বলল,”তো হঠাৎ এলি তোরা?? আমাকে তো ফোন করে জানালি না??”
লাবন্য খেতে খেতে বলল,”অনেক দিন পার হয়ে গিয়েছে। আমাদের তো দ্যা বুক ওপেন করতে হবে। দেখতে হবে না যে এরপর কার গল্প তৈরি হলো।”
সাথে সাথে পূর্ণাশার মুখটা থমথমে হয়ে যায় বলে,”ওহ,আজকেই পড়তে হবে।”
রা’দ বলে উঠলো,”হুম তবে এবার আমরা সবটা জানি বি কেয়ারফুল। আমাদের জিততে হবে।”
সবাই যার যার খাওয়ায় মন দিলো। খাওয়া শেষে সবাই তৈরি হয়ে নিলো। পুরো রুমে মোমবাতি সেট করে জ্বালিয়ে দিলো। প্রথম দিনের মতোই সবটা ঠিক করলো। বই সামনে নিয়ে বসে আছে সবাই। মনে মনে সবাই প্রার্থনা করতেছে যাতে ভয়ংকর কোন বিপদ না আসে ওদের সামনে। রা’দ আলতো করে বইটা খুললো। তারপর পড়তে শুরু করলো।অভিনবের গল্পটা শেষ,প্রথমে বইতে যা লেখা ছিল তার সাথে পরের কাহিনী যোগ হয়েছে। সেন্টমার্টিনে দেখা হওয়া জলপরীকে মারা ইত্যাদী সব। শেষে বড়বড় করে দ্যা ইন্ড লেখা।
রা’দ পরবর্তী গল্প পড়ার জন্য পরের পাতা উল্টায়।
“আয়না, মানুষের কাছে অতি পরিচিত। আয়না না থাকলে মানুষ তার নিজের চেহারা দেখতে পেত না। মানুষ তার রূপের সৌন্দর্য দেখে এই আয়নাতেই। কিন্তু এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা কুৎসিত দেখতে তারা এই আয়নাকে চায় না। নিজেদের এই কুৎসিত চেহারা তো তারা নিজেরাই পছন্দ করে না। তাদের অনেকেই সৃষ্টিকর্তার দিকে আঙুল তোলে। কেন তিনি ওদের এরকম বানিয়েছে কেন?? কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যে কোন এক বিশেষ উদ্দেশ্য তাদের বানিয়েছেন এটা কেউই ভাবতে চায় না। ‘কখনো নিজেকে অন্যের থেকে কুৎসিত বা অসুন্দর মনে করবেন না। কেননা সৃষ্টিকর্তা কোন এক উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাকে তৈরি করেছেন। আর তিনি কখনো ভুল করেন না’।
আয়নায় শুধু সুন্দর চেহারার অধিকারীদের দেখ যাবে তা কিন্তু নয়??যারা দেখতে কুৎসিত তাদেরকেও দেখা যাবে।
এমনই এক কুৎসিত চেহারার পুরুষের বসবাস এই আয়নার ভেতরে। যিনি এক আয়না থেকে অন্য আয়নায় চলাচল করতে পছন্দ করে। সেও চায় তার চেহারায় সৌন্দর্য আসুক। কিন্তু সে কিভাবে তার চেহারার সৌন্দর্য ফিরে পাবে?? কুৎসিত চেহারা তো বদলানো যায় না। এই চিন্তা ভাবনা সে কখনোই করতে চায় না। আর যখন এ চিন্তা তার মাথায় আসে তখন সে হয়ে ওঠে এক হিংস্র জানোয়ার। একজন সাধারণ মানুষের থেকে তার শক্তি সামান্যতম বেশি। তবে এই শক্তিতে সে মানুষের কাছে হার মানবে।
কোন এক কাল থেকে তার বদ্ধ ধারনা যে মানুষই পারে তার এই নিকৃষ্ট চেহারার পরিবর্তন ঘটাতে। সে সম্পূর্ণ অন্য জগতের কেউ। তাই সে মানুষের থেকে নিজের বংশবৃদ্ধি করতে চায়। তার দৃঢ় বিশ্বাস যে এর ফলে তার চেহারা সুন্দর হবে। কিন্তু কার উপর তার এই কুৎসিত ধারনার নজর পড়েছে??যার উপর তার এই ধারনাটা চেপেছে সেই বা কে??আর যদি সে এই সন্তান পৃথিবীতে আনতে পারে তাহলে কি হবে??? তার রূপ পরিবর্তনের এই বদ্ধ ধারণা তো সম্পূর্ণ মিথ্যা।যদি সে পরে এটা বুঝতে পারে তাহলে কি করবে??তার যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে কাকে মেরে ফেলবে??ছোট বাচ্চাটা কি বাঁচবে??নাকি সেই নিকৃষ্ট পুরুষের সাথে মিলে তার মা’কে ও মেরে ফেলবে??
শুরু হয়ে গেল মৃত্যু মৃত্যু খেলা। একজন মরলে দুজন মরবে। কিন্তু যার বাবা ভয়ানক তার বাচ্চা তো তার থেকে অধিকতর ভয়ানক। তাহলে কি হবে??মেয়েটা কি আদৌ বাঁচবে এই মৃত্যু খেলায়??”
লেখাগুলো শেষ বাকি পেইজ গুলো সাদা। রা’দ পড়া শেষ করে পূর্ণাশা আর লাবন্যর দিকে তাকালো। ওরা কেমন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। এটা বুঝতে ওদের বেগ পেতে হলো না যে এই গল্পটা পূর্ণাশা আর লাবন্যর মধ্যে কোন একজনের। কিন্তু কার??নাম বা জন্মতারিখ কোনটাই যে লেখা নেই এখানে।
রা’দ শব্দ করে বইটা বন্ধ করে দিলো।
সবাই এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না?? এই গল্পটা কেমন এলোমেলো লাগছে। কি সব আজব ধরনের কথা। এরকম কুৎসিত চেহারার কেউ আদৌ আছে যে অন্যজগতের?? এখানে আসার কারণটা এখনও অস্পষ্ট। সবাই চুপ থেকে কিছুটা বোঝার চেষ্টা করতেছে।
চলবে,,,,,,,,,