#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব২৬
#ফারহানা ইয়াসমিন
বাসায় ফিরে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের কাছে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে গেলো সৌরভের। ঝিলিককে ডাকলো কয়েকবার কিন্তু কোন সারা পাওয়া গেলোনা। বাথরুম আর বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো সেখানেও নেই। বাধ্য হয়ে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ঝিলিকের গলা শোনা গেলো-
“আমি মায়ের কাছে এসেছি থাকবো কয়েকদিন।”
“আমাকে না জানিয়ে গেলে কোন সাহসে?”
সৌরভ দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলো। ঝিলিক অবশ্য সৌরভের রাগকে গা করলোনা। সে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো-
“মাকে বলে এসেছি কাজেই তোমার রাগ হওয়ার কোন কারণ দেখি না। তুমি তো মায়ের বাধ্য ছেলে। মা অনুমতি দিয়েছে মানেই তো তোমার কোন সমস্যা নেই।”
সৌরভের রাগ আরেকপ্রস্ত বাড়লো, সে চিৎকার করে উঠলো-
“আমি তোমার স্বামী আমার অনুমতি না নিয়ে তুমি বাড়ির বাইরে গেলে কেন?”
“স্বামী! স্বামী মানে কি শুধু শাসন করার মানুষ? নিজে বাইরে অন্য মেয়েদের সাথে সময় কাটিয়ে আসবে আর বউকে অযাচিতভাবে সন্দেহ করবে, মারবে যা খুশি করবে? স্বামী মানে বোঝো তুমি?”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো ঝিলিক। লম্বা দম নিলো। এপাশে সৌরভ ফুঁসে উঠলো-
“তোমার খুব পা গজিয়েছে ঝিলিক। বড় বাড় বেড়েছো তুমি।”
“শোন সৌরভ, তুমি যদি আমার উপর অমুলক সন্দেহ করা না বন্ধ করো তবে আমি আর ফিরছি না। অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার যথেষ্ট অন্যায় সয়েছি এতোদিন। এমন না যে আমি গরীব, যাওয়ার কোন জায়গা নেই। শুধু ভেবেছি বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়েছে সংসার করি। তোমাকেও যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছি নিজেকে শোধরানোর। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল ছিলো। তুমি তো শোধরাবার মতো মানুষই না। তাহলে আমি নিজেকে শুধরে নেই। শুধু শুধু তোমার সাথে থেকে জীবন নষ্ট করবো কেন? এখন আবার ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয় না প্লিজ। নিজের বউয়ের ভিডিও নিয়ে যদি তাকে অপদস্ত করতে চাও তাহলে করতে পারো। নিজেকে এতোটা নিচে নামাতে চাইলে নামাতে পারো। আমার কিছু বলার নেই।”
সৌরভকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝিলিক ফোন কেটে দিতেই সৌরভ ফোন আছড়ে ভাঙলো। এবার রাযীন ফিরে আসার পর থেকেই ঝিলিক বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে। ওর এই সাহসের উৎস কি? রাযীন তো ওর সাথে কথাও বলেনা। তবে? সৌরভ কাপড় না পাল্টেই মায়ের ঘরে উঁকি দিলো-
“মা।”
শিখা মন দিয়ে কিছু কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলো।সৌরভকে দেখে একগাল হাসলো-
“আয়। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরলি মনেহয়?”
সৌরভ মায়ের কাছে এসে বসলো-
“একটা পার্টি আছে রাতে তাই এলাম।”
“আচ্ছা! তোর কাজ কতোদূর এগুলো?”
শিখা চশমা খুলে রাখলো। সৌরভের মন খারাপ ভাব চোখ এড়ালোনা তার।
“অফিসে রেনুর বর নকিব খুব সতর্ক। প্রায়ই অফিসে এসে বসে থাকছে আর এদিক সেদিক গল্প ফেদে বসছে। একাউন্টসে গিয়েও খোঁজখবর করছে।”
শিখা বিরক্ত হলো-
“ভাইজানের এই মেয়ে জামাইদের অফিসে বসানোর ব্যাপারটা আমার একদম ভালো লাগে না। ওদেরকে আলাদা বিজনেস বুঝিয়ে দিলেই হতো।”
সৌরভ হাসলো-
“আমাদের বেনুর বরও কম না। গতদিন আমাকে বলছিলো ওর নাকি লাখ বিশেক টাকা দরকার। কি একটা বিজনেস নাকি করবে বেনু।”
“কই বেনুতো আমাকে কিছু বলেনি? আচ্ছা আমি শুনবো ওর কাছে থেকে। রাজ ফিরতে ফিরতে তোর কাজ এগিয়ে নে। এসব তোর বাবাকে বলে লাভ নেই কারণ তাকে দিয়ে এসব করানো যাবে না।”
সৌরভ মাথা নেড়ে সায় দিলো। ঝিলিকের ব্যাপারটা মাকে বলবে কিনা ভাবছে। শিখা ছেলের ভাব বুঝে নিজে থেকে জানতে চাইলো-
“কিছু বলবি নাকি?”
সৌরভ উসখুস করে-
“ঝিলিক তোমাকে বলে বাড়ি গেছে?”
শিখা মাথা ঝাকালো-
“হ্যা। তোদের মধ্যে কিছু হয়েছে? ওকে ক’দিন ধরে খুব আপসেট দেখাচ্ছিলো।”
সৌরভ বলতে যেয়েও পারে না। মায়ের কাছে বলতে বাঁধো বাঁধো ঠেকে।
“কিছু না হলেই ভালো। মেয়েটা বেশ ভালো। পুরনো সব ভুলে সামনে এগিয়েছে এটাই সবচেয়ে ভালো ব্যাপার। তুই কখনো ওকে এসব নিয়ে কিছু বলে দুঃখ দিস না।”
সৌরভ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারে না। সত্য জানলে মা কি বলবে তাকে?
★★★
বারিধারা খ ব্লকের এই এ্যাপার্টমেন্টটাও রাযীনের বাবার তৈরী। ঢাকায় মাঝে মাঝে এসে থাকতে হতো বলে দুটো ফ্ল্যাট ফাঁকা রেখে বাকীগুলো ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। আত্মীয় স্বজন যে যখন প্রয়োজন হয় ঢাকায় আসে এখানেই থাকে। রুহির ভালোই লাগছে এখানে। গতকাল ঢাকায় এসেই বাবা মায়ের সাথে দেখা করে এসেছে। রাযীনও গেছিলো সাথে। রাতের খাবার খেয়ে ফিরেছে তারা। আজ বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো রুহির। উঠে শাওয়ার নিয়ে রান্নাঘরে এলো চা করবে বলে। সকালে খাবেই বা কি? থরে থরে জিনিস সাজানো আছে। কি বানাবে ভেবে পেলোনা রুহি। আসলে কখনো রান্নাঘরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি তার। গেলেও চা বানানো কিংবা ভাত ফুটানো ছাড়া কখনো কিছু করা হয়নি। রুটি সে বানাতে পারে না। ভাত কি রাযীন খাবে সকালে? রুহি একটা একটা করে বক্স নামিয়ে দেখছিলো কি আছে তাতে। কিছুক্ষন পরেই রাযীনকে দেখা গেলো চোখ ডলতে ডলতে রান্না ঘরে এসে দাঁড়ালো-
“এতো সকালে কি করছো রান্না ঘরে?”
“সকাল! সকাল কোথায় দেখলেন? সাড়ে এগারোটা বাজে। খিদেয় পেট চো চো করছে আমার।”
রুহির কথা শেষ হওয়ার আগেই চুলায় কিছু পুড়ে যাওয়ার গন্ধ পাওয়া গেলো। নিমিষেই রান্নাঘর ধুঁয়ায় ভরে গেলো। রাযীন দৌড়ে এসে রুহিকে হ্যাচকা টানে দূরে সরিয়ে দিয়ে চুলা বন্ধ করলো-
“আজব মেয়ে তুমি? চায়ের পানি চড়িয়ে ভুলে গেলে কেন? এখনই একটা দূর্ঘটনা ঘটলে কি হতো?”
রুহি অপরাধী চোখে নীরবে চেয়ে রইলো। আসলেও সে ভুলে গেছিলো। রাযীন নিজেকে শান্ত করে রুহির দিকে তাকালো-
“তুমি যাও বসে টিভি দেখো আমি হাতমুখ ধুয়ে এসে কিছু বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
রুহি চোখ বড় বড় করে তাকালো-
“আপনি রান্না করবেন?”
“হ্যা। এতে অবাক হওয়ায় কি আছে? গত সাত আট বছর ধরে আমেরিকায় ছিলাম একা। নিজের কাজ নিজেকেই করতে হতো ওখানে। বাইরে খেয়ে তো আর বছর পার করা যাবে না।”
রুহি অবাক চোখে রাযীনকে দেখছে। এই লোক তার অচেনা একেবারেই। চিটাগং এর বাড়িতে কোনোদিন কিছু করতে দেখেনি তাকে। রুহি ইন্টারেস্ট নিয়ে রাযীনের দিকে তাকালো-
“আমি প্লিজ থাকি এখানে? চুপচাপ দাঁড়িয়ে আপনার কাজ দেখবো শুধু। আমি না আসলে তেমন একটা রান্না টান্না পারিনা। মা কখনো রান্না ঘরে যেতে দেয়নি কিংবা প্রয়োজনও হয়নি। এখন দেখি আপনার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারি কিনা।”
রাযীন হো হো করে হাসলো-
“আমার কাছ থেকে রান্না শিখবে তবেই হয়েছে। আমি নিজে কি খুব ভালো রান্না পারি? তবে কাজ চালানোর মতো রান্না পারি অবশ্য। আচ্ছা একটু হেল্প করো। দেখো ফ্রিজে টমেটো ধনেপাতা আর ক্যাপসিকাম পাও কিনা। নিয়ে এসোতো। আমি ততক্ষণে হাতমুখ ধুয়ে আসি।”
রাযীন ঘরে ফিরে গেলো। ফ্রিজ খুলে অবাক হলো। থরে জিনিস সাজানো আছে। এতো জিনিস কে কিনে আনলো? ভাবতে ভাবতে ভেজিটেবল জোনের ডালা খুললো। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বেশি খুজতে হলোনা রুহির। হাতের কাছেই সব পেয়ে গেলো। সেগুলো নিয়ে ফিরে এসে দেখলো রাযীন এরমধ্যেই পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ কুচি করছে। চুলোয় ফুটে ওঠা চায়ের পানি থেকে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়েছে। রুহির হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে রাযীন একে একে সব কুঁচি করে তাতে লবন গোলমরিচ ডিম আর আটা মিশিয়ে গোলা বানিয়ে ননস্টিকি ফ্রাইপেনে রুটির মতো গোল গোল করে ভেজে নিচ্ছে। প্রথমটা প্লেটে তুলে রুহির দিকে বাড়িয়ে দিলো-
“নাও খেয়ে বলো কেমন হয়েছে। লবন ঝাল সব ঠিক আছে তো?”
রুহি হাসি মুখে রাযীনের বাড়িয়ে দেওয়া প্লেট থেকে ভেজে রাখা রুটির এককোনা ছিড়ে মুখে দিতেই চমকে উঠলো। নিঃশব্দে পর পর কয়েকবার মুখে দিয়ে খেতে লাগলো। স্বীকার করতেই হবে জিনিসটা খেতে খুবই সুস্বাদু হয়েছে। কয়েকরকম স্বাদের কারনে রুহি চোখ বুঁজে খাচ্ছে। চোখ খুলতেই দেখলো রাযীন তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে-
“তোমার আসলেই খিদে পেয়েছিল দেখছি।”
রুহি লাজুক হাসলো-
“না আসলে আপনার বানানো জিনিসটা খেতে খুবই মজা লাগলো। আমার মা বানাতো শুধু পেয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে। আমরা এটাকে ঝাল পিঠা বলি।
সেটা অন্যরকম মজা আর এটা একেবারেই আলাদা।”
“আচ্ছা? এতে যত জিনিস দেবে এর স্বাদ তত বাড়বে। আমি আস্তে আস্তে এটা শিখেছি। সহজে বানানো যায় বলে খেতেও ভালো লাগে।”
গল্প করতে করতে আরো কয়েকটা পিঠা বানিয়ে ফেললো রাযীন। দুটো ডিম পোচ করলো। তারপর দু’মগে চা ঢেলে রুহিকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো। রুহি অলরেডি তিনটে খেয়েছিলো, রাযীনের সাথে বসে আরো একটা খেলো। পেট একেবারে ফুল হয়ে গেছে। পানি খেয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো-
“আহ, অনেকদিন পরে শান্তি করে খেলাম।”
“চা টা খাও আরো ভালো লাগবে। এটা শ্রীলংকান চা, ফ্লেভারটা একদমই আলাদা।”
রুহি সোজা হয়ে বসলো-
“এখানে তো কেউ থাকে না তবে এতো বাজার কে করলো?”
“দারোয়ান আছে। ওর কাছে একট্রা চাবি দেওয়া আছে। কেউ আসার কথা থাকলে বউকে দিয়ে বাড়ি পরিস্কার করে, বাজার করে গুছিয়ে রাখে। চাইলে এখন এসে কাজও করে দেবে। ডাকবো?”
“তাহলে তো ভালোই হয়। দুপুরের রান্না করে দিয়ে যাক।”
রাযীন চুপ করে কি যেন ভাবলো তারপর গভীর গলায় বললো-
“আসলে আমি ভাবছিলাম কি যে ক’দিন এখানে আছি নিজেরাই নিজেদের মতো রেদেটেধে খেলাম না হয়। এই যে আজকের মতো। দু’জন গল্প করতে করতে রান্না হয়ে যাবে।”
রুহি ভাবলো ব্যাপারটা মন্দ না। এতে দু’জন দু’জনার সাথে আরো সহজভাবে মিশতে পারবে। নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাড়বে। রুহি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিলো। মাঝে মাঝে আড়চোখে রাযীনকে দেখছে। আজ রাযীনকে অনেকটা সহজ লাগছে। রাযীন হঠাৎ তাকাতেই চোখাচোখি হলো, রুহি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। রাযীন হেসে দিলো-
“এবার আমার পুরস্কার দাও।”
“কিসের পুরস্কার?”
রুহির কন্ঠে বিস্ময়।
“ওমা! এই যে এতো মজার নাস্তা খাওয়ালাম, কিছু দেবে না আমাকে?”
“ওহহহ, কি চাই আপনার বলুন।”
“আমি বলবো কেন? গিফট দেবে তুমি, তুমি কি দিতে চাও দেবে।”
রুহি ঠোঁট উল্টে বলে-
“আপনার কি চাই তা আমি কি করে বলবো?”
“উহু, আমি বলবো না। তুমি বুঝে নাও আমার কি চাই। আমি অপেক্ষা করবো তোমার উপহারের।”
নাস্তার প্লেট তুলে নিয়ে রাযীন চলে গেলো। রুহি দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবছে রাযীন কি চায় তার কাছে? রাযীনকে তার কি দেওয়ার ক্ষমতা আছে?
চলবে—
©Farhana_Yesmin
(প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ হয়ে গেলেও বই কেনা যেন না থামে। আমার দুটো বই রকমারিতে পাবেন। চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি অর্ডার লিংকঃ
তিয়াসঃ
https://www.rokomari.com/book/211757/tiyas
অনসূয়াঃ
https://www.rokomari.com/book/226534/anosoya)