#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ২৭
#ফারহানা ইয়াসমিন
সারাদিন একসাথে টুকটাক কাজ করা, রান্না করে খেতে খেতে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা দিনগুলো দিব্যি উড়ে উড়ে পার হচ্ছে দু’জনার। দু’জনের এখন অনেকটা সহজ একে অপরের সাথে। বেশির ভাগ সময় রাযীন কথা বলে আর রুহি শোনে। আমেরিকায় পড়ালেখা, চাকরি, জীবনযাপন নিয়ে অনর্গল কথা বলে যায় রাযীন আর রুহি মন দিয়ে শোনে। মাঝে কয়েকদিন নিজের কাজে বেরিয়েছিলো রাযীন। কাজ শেষ হতেই বাড়ি ফিরেছিলো রাযীন। সবচেয়ে সত্যি কথা হলো এই ক’দিন ওরা বাইরে খায়নি এমনকি বাইরের খাবারও অর্ডার করেনি। রুহিও আজকাল টুকটাক রান্না করছে। সেগুলো খেতে ভালো না লাগলেও রাযীন চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। সত্যি বলতে রুহির ভালো লাগছে এখানে থাকতে। চিটাগং এর বাড়িতে শুভর ভাবনা মাথায় তাড়া করে ফিরে। এখানে অন্তত শুভকে দেখতে হচ্ছে না এটাই শান্তি। বিকেলে চায়ের মগে চুমুক দিতে যেয়ে রুহি আচমকা প্রশ্ন করে রাযীনকে-
“সেদিন মা বলছিলো, একজন তো অকালে চলে গেলো। কার কথা বলেছে বলুন তো? আপনাদের ছাদে একটা ঘর সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। ওটা কার? কে থাকতো ওখানে?”
রাযীন চমকে উঠতে উঠতে নিজেকে সামলে নিলো। এ প্রশ্ম তো আসতোই আজ অথবা কাল৷ উত্তরটা এখন দেবে কিনা ভাবছে। কে যেন বলেছিলো, কৌতূহল সঠিক সময়ে দমন না করলে বিপদ। রুহি নিষ্পলক চোখে রাযীনকে দেখছে। রাযীন মুখ খুললো-
“উত্তর জানা কি জরুরি?”
রুহি বিরক্ত হলো-
“আপনাদের সবার মধ্যে রহস্য ধরে রাখার প্রবনতা আছে। আমাকে যদি নিজেদের একাংশ মনে করেন তাহলে তো নিজ উদ্যোগে সব কথা জানানো উচিত। তাই না বলুন?”
“কিসের রহস্য করছি বলো তো?”
“সবকিছু নিয়ে। ঝিলিক ভাবির সাথে আপনার সম্পর্ক, কেন আলাদা হলেন কিছুই তো বলেননি। প্রথমদিন ছোট মা বলেছিলেন, তাদের আরেকটা মেয়ে আছে মানে আরেকটা বোন আছে আপনাদের অথচ তাকে কোনোদিন দেখলাম না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাকে জানানো উচিত না বলুন?”
রাযীন রুহির পানে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ-
“অতীত নিয়ে আলোচনা কে পচ্ছন্দ করে বলোতো? অতীতের ভুলগুলো কি কেউ মনে করতে চায়? ঝিলিক আমার প্রাক্তন ওকে নিয়ে কিছু বলতে আমার একদমই ভালো লাগে না। আসলে প্রয়োজন বোধ করি না। কারন ওকে পেছনে ফেলে আমি এগিয়েছি অনেক দূর। ও এখন আমার বড় ভাইয়ের বউ সম্মানের মানুষ। আর প্রয়োজন না হলে পারিবারিক ব্যাপার নিয়েই বা কি আলাপ করবো? তবে হ্যা তুমি যেহেতু আজ জানতে চাইলে তোমাকে জানাবো।”
রাযীন থামলো চায়ে চুমুক দিলো নিঃশব্দে। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিচ্ছে।
“আমরা দুই ভাই আর এক বোন। আর শুভরা দুইভাই দুইবোন। তো আলিফ ভাইয়া একটু মা ন্যাওটা আর নরম সরম মানুষ। বাবার ইচ্ছে ছিলো ভাইয়া লন্ডন স্কুল অফ বিজনেস এ পড়ুক কিন্তু ভাইয়ার এক কথা সে দেশ ছাড়বে না। ভাইয়া চিটাগং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছিলো। ভাইয়াকে পাঠাতে পারেনি বলে আমার উপর একটা চাপ ছিলো। যদিও সৌরভ ভাই বাবার সে ইচ্ছে পূরণ করেছে। তবুও আমার এ লেভেল শেষ হতেই বাবা আমাকেও আমেরিকা পাঠিয়ে দিলেন। একটু কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছিলাম। আসলে আমাদের কারোই বাড়ি ছাড়তে মন চাইতো না। সাত ভাই বোন যথেষ্ট আনন্দ নিয়ে বড় হয়েছি তাই বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইতাম না কেউই। বছর দুয়েক পর হঠাৎ একদিন জরুরিভাবে দেশে ফিরতে হয়েছিলো আমাকে। কি কারনে জানো? আলিফ আমার বড়ভাই, আমার মায়ের সর্বপ্রথম সন্তান ওই ছাদের ঘরে তার লাশ পাওয়া যায়। এন্ড গেস হোয়াট? ইটস এ কেস অফ
সুইসাইড।”
রুহি আঁতকে উঠলো-
“কি বলছেন? কি কারনে এমন করেছিলেন?”
রাযীন জবাব দিলো না চুপচাপ বসে আছে সে, চায়ের মগে চা ঠান্ডা হচ্ছে। তার চেহারায় বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। সে এক দৃষ্টিতে চায়ের মগের দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি অবাক হয়ে রাযীনকে দেখছে। মানুষটার এই রুপ একদমই অচেনা ওর কাছে। এরকম একটা দুঃখ আছে লোকটার এটাই তো জানতো না। রুহি তীব্র ভাবে মায়া অনুভব করলো। সে মায়াময় কোমল দৃষ্টিতে রাযীনের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাযীন যেন নিজেকে শুনাচ্ছে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলো-
“আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে নুরী আপু সবচেয়ে প্রানোচ্ছল হাসিখুশি মানুষ ছিলো। আমরা সবাই তার ইশারায় চলতাম। যে কোন অনুষ্ঠানে নুরী আপু মধ্যমনি। ভাইয়াও অনেক জলি মাইন্ডের। সবসময় মুখে হাসি ভাইয়ার সবচেয়ে বড় গুন। ভাইদের মধ্যে ভাইয়া বড় আর বোনদের মধ্যে নুরী আপু। এই দুইজন আমাদের আইডল। সবকিছুতে আমরা তাদের ফলো করার চেষ্টা করতাম। আর তাদেরই একজন এমন সেচ্ছামৃত্যু বেছে নেবে এটা কোনভাবেই মানতে পারছিলাম না। আমার সদা হাস্যোজ্জল ভাইটা এভাবে কেন হারিয়ে গেলো কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না।”
রাযীন দু’হাতে মুখ ঢাকলো। নিরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে বসে রইলো রুহি। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর রুহি কোমল গলায় জানতে চাইলো-
“কারনটা কি পরে জেনেছিলেন?”
রাযীন ভেজা লাল চোখ জোড়া তুলে রুহিকে দেখে মাথা ঝাকালো, আর্দ্র কন্ঠে বললো-
“ভাইয়া আর নুরি আপু একে অপরকে ভালো বাসতো। দে আর ইন লাভ ইচ আদার।”
রুহি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রাযীনের দিকে। এমন এ্যাঙ্গেল আসতে পারে সেটা কখনোই ভাবেনি রুহি। রাযীন শুকনো ঠোঁট জোড়া টেনে হাসলো-
“আমারও এমন অবাক লেগেছিল ব্যাপারটা। বিশ্বাস করো কখনো ওদের দেখে বুঝিনি এমন কিছু চলছে। সেই সময় বাসায় আমার ফুফাতো খালাতো কত ভাইবোন আসতো। সারাদিন হইহট্টগোল চলতেই থাকতো। এখন যেমন বাড়িটা নির্জিব দেখছো এমন মোটেও ছিলোনা। এরমধ্যে এই মানুষদুটো কখন কাছাকাছি এলো সেটাই রহস্য। ভাইয়া বেশিরভাগ সময় হোস্টেলেই থাকতো আর নুরী আপুও মেডিক্যাল ও। প্রতিবছর ডিসেম্বরে আমি আর সৌরভভাই বাড়ি আসতাম। মাসখানেক থেকে আবার ফিরে যেতাম। ওদের মধ্যে কিছু চলছে সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। তাই শুরুতে ভাইয়া আর নুরী আপুর বিষয়টা অবিশ্বাস্য লেগেছিল। কিন্তু বিশ্বাস না করেই বা উপায় কি? ভাইয়া মারা যাওয়ার পরই নুরী আপুও নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সফল না হলেও অসফলও হয়নি। আপু আপাতত আশ্রয় হয়েছে পাগলাগারদে। কোন চিকিৎসায় আপুকে সুস্থ করা গেলোনা। অথচ ওদের ব্যাপারে আমরা যদি জানতাম তাহলে সত্যি বলতে খুশিই হতাম। এতো চমৎকার দু’জন মানুষ একসাথে থাকবে এই ব্যাপারটাই ভীষন ভালো। কিন্তু ওরা কেন এতো গোপনীয়তা মেনেছিলো সেটা আমি আজো বুঝিনি।”
“কারো কাছে জানতে চাননি?”
রুহি আন্তরীক গলায় জানতে চাইলো-
“চেয়েছি। কিন্তু কে কি বলবে? সবাই আমার মতো অবাক।”
রুহি চেহারায় ফুটে ওঠা অসস্তি রাযীন টের পেলো। সে চুপ করে রইলো। এতোদিন পরে ব্যাপারগুলো কারো কাছে শেয়ার করে সত্যি ভীষণ হালকা লাগছে নিজেকে। কেন লাগছে সে জানে না। রুহি হালকা গলায় বললো-
“কিন্তু ভালোবাসা ব্যাপারটা এমন যে এটা গোপন রাখা যায় না। কেউ না কেউ জানবেই। ওদের বিষয়টা অবশ্যই কেউ না কেউ টের পেয়েছিলো। কিন্তু কথা হলো টের পেলেই বা কি? ভাইয়ার এমন করার পেছনে কারনটা কি নুরী আপু ছিলো নাকি অন্য কোন ব্যাপার? ওদের মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল কি?”
“জানি না আমি কিছুই জানি না। শুভ বেনু আপা, রেনু ওরা কেউ কিছু বলতে পারে না। কারো কাছেই কোন সদুত্তর পাইনি। আর নুরী আপুতো নির্বাক।”
“এমন কি হতে পারে মা বাবা চাচা চাচী জানে কিন্তু তারা আপনাদের বলছে না?”
রাযীন রুহির দিকে চিন্তিত মুখে তাকালো-
“হতে পারে। মায়ের কাছে কয়েকবার জানতে চেয়েছি কিছু বলেনি। আর বাবারও কঠিন নিষেধ ওদের নিয়ে যেন না কথা বলি। এমনিতেই সমাজে তার যথেষ্ট ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে আর যেন কিছু না করি। আমরা কেউ আর সাহস করিনি এসব নিয়ে কিছু বলবার।”
রুহি অন্ধকারে তাকিয়ে কিছু ভাবলো। হতে পারে পরিবারের কেউ এই দু’জনার ব্যাপারে কিছু একটা করেছে। সেটা ধামাচাপা দিতেই হয়তো ব্যাপারটা বেশিদূর এগোতে দেয়নি আশরাফ চাচা। কিন্তু কি এমন ব্যাপার ঘটেছিলো যে একটা মানুষ নিজেকে শেষ করে দেবে? রুহি ভাবলো এবার ফিরে গিয়ে ব্যাপারটা জানার চেষ্টা করবে। ওকে জানতে হবে এর পেছনে কি রহস্য লুকিয়ে আছে।
চলবে—
©Farhana_Yesmin
(প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ হয়ে গেলেও বই কেনা যেন না থামে। আমার দুটো বই রকমারিতে পাবেন। চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি অর্ডার লিংকঃ
তিয়াসঃ
https://www.rokomari.com/book/211757/tiyas
অনসূয়াঃ
https://www.rokomari.com/book/226534/anosoya)