#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৩৬

0
670

#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৩৬
#ফারহানা ইয়াসমিন

সারাদিন পার হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে তবুও রাযীনের দেখা নেই। রোজীর প্রেশার উঠে অবস্থা এতোই খারাপ যে তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হচ্ছে। এসব দেখে আশরাফ নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। তারউপর ছেলে আর নাতিকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে আশরাফের মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। সে ভুলে গেলো সে অসুস্থতার নাটক করছিলো। সব ভুলে উত্তেজনায় নিচতলায় চলে এলো। বাড়ির মানুষগুলো বিস্ময় নিয়ে আশরাফকে দেখতে লাগলো। আশরাফ বিরক্তি নিয়ে জানতে চাইলো-
“কি? কি দেখছিস এমন করে?”
“ভাইজান! আপনি হাঁটতে পারছেন? সুস্থ হয়ে গেলেন নাকি?”
আফজাল বিস্মিত কন্ঠে জানতে চাইলো। আশরাফ মুখ কুঁচকে বললো-
“অসুস্থ হইনি কখনো। ছেলেকে কাছে আনার জন্য এতো নাটক করলাম আর সেই ছেলেই আজ আমার সবকিছু নিয়ে পালালো।”
আফজাল এখনো হজম করতে পারছে না আশরাফের মিথ্যাচার। তার আর কিছু বলার রুচি হয়না। সে চুপচাপ চোখ বুজে বসে থাকে।
“এসব কিছুর জন্য তোর বউ দায়ী। সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাটছে এখনো। বারবার বলছি আমার ভুল হয়েছিলো তখন তবুও আমার ছেলেটাকে রেহাই দিলো না। পাঁচ বছর ছেলেটা দেশেই এলোনা। এবার এতো কষ্ট করে দেশে আনলাম কিন্তু তোর বউয়ের হিংসা থেকে বাঁচাতে পারলাম না।”
আফজাল আড়চোখে শিখাকে দেখলো। ওর মধ্যে কোন হেলদোল নেই। শিখা ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে চুপচাপ বসে মজা দেখছে। ঝিনুককে কোথাও দেখা গেলোনা। রুহি চমকে একবার শশুরকে আরেকবার শিখাকে দেখলো। ছেলের কথা মনে এলেই তার চোখ থেকে আপনাতেই জল গড়াচ্ছে। আশরাফ এগিয়ে এলো রুহির দিকে, ওর মাথায় হাত রেখে বললো-
“মারে, আমাকে মাফ করে দিস। আমি তোর জীবনটা বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছি। অথচ আমি মন থেকে চাই তুই আর রাজ একটা সুখী জীবন কাটা। আমাকে মাফ করিস রে মা, মাফ করিস।”
রুহি কিছু বলতে পারলোনা কেবল গুমরে কেঁদে উঠলো।
আশরাফ পূনরায় শিখার কাছে এগিয়ে এলো-
“তুমি কি চাও বলোতো? অতীতে যা ঘটেছিলো তাতে কি তুমি একাই কষ্ট পেয়েছিলে আমরা পাইনি? কেন এমন করছো? তুমি একাই মা? কষ্ট শুধু তোমারই হয়? রোজীর কষ্টের কথা একবারও ভাবলে না? ও বেচারি কতোগুলো বছর ধরে তোমার এসব অত্যাচার সইছে বিনাবাক্যে কখনো ভেবেছো এসব?”
শিখা কোন জবাব দিলো না। আশরাফ আবার বলতে শুরু করলো-
“বাবার ইচ্ছে ছিলো আমরা যেন সবাই একসাথে থাকি। একই পরিবারে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে বাবার মত ছিলোনা কখনোই। আমি তার বড় সন্তান হয়ে চেষ্টা করেছিলাম তার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার। আলিফ আর নুূরীর ব্যাপারে এটাই আমার ভুল ছিলো। আমি আলিফকে মানা করি, বলি এরকম বিয়ে সম্ভব হবে না। আমার ছেলে যে সে কথা মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করবে সেটা তো আমি বুঝিনি। বুঝলে কি ওকে এ কাজ করতে দিতাম? আর নুরীও তো আমার মেয়ে। নুরী আলিফের শোকে পাগল হবে এটা কি জানতাম কখনো? কতো আদরে সোহাগে ছেলে বড় করেছিলাম সেই ছেলে অকালে চলে গেলো তোমার কি মনেহয় বাবা হিসেবে আমার কষ্ট লাগেনি? হ্যা আমার ভুল হয়েছিলো, ভেবেছি বাচ্চা মানুষ হয়তো আবেগে এমন করছে। বুঝিয়ে বললে বুঝবে ব্যাপারটা। ওরা যে এমন বুঝবে সেটা তো আমার ধারণায় ছিলোনা। যদি বুঝতাম তবে কখনোই এমন কিছু করতাম না। কিন্তু তুমি কি করেছো বলতো? এই ঘটনার পরে কতোবার নিজের ভুল স্বীকার করেছি তবুও তোমার মন গলেনি। ছোট বেলার থেকে ঝিলিক আর রাজ একসাথে, ওরা দু’জন দু’জনকে পচ্ছন্দ করে। সেই ঝিলিককে তুমি সৌরভের সাথে বিয়ে দিয়েছো আমি কিন্তু কিছু বলিনি। আমার ছেলে কষ্ট পাবে তবুও আমি চুপ থেকেছি যাতে তুমি শান্তি পাও। কিন্তু তুমি শান্তি পাওনি। তুমি রেনুর জীবনে অশান্তি করতে চেয়েছো তবুও আমি চুপ থেকেছি। ভাবলাম আফজালকে অফিস চালানোর দায়িত্ব দিলে হয়তো তোমার ক্ষোভ করবে। আমার দু’টো উদ্দেশ্য ছিলো। এক. ছেলেকে দেশে আনা দুই. ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া যাতে আফজাল সৌরভ সবকিছু দেখভাল করতে পারে। ওরা যেন মনে না করে আমি ওদের চাকর খাটাচ্ছি। রোজীকেও বললাম সংসারের চাবি তোমার হাতে দিতে। এসব কিছুই কিন্তু তোমাদের খুশি করতে। অথচ তোমরা এসব পেয়ে ভেবেছো আমরা মনেহয় দোষ লুকানোর জন্য এমন করছি। তোমরা আমাদের অপরাধী ভাবতে শুরু করো অথচ আমরা কোন অপরাধ করিনি। যাইহোক, এসবে আমার অভিযোগ নেই কোন। তুমি নিজের হিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই নিরপরাধ মেয়েটাকে সাজা দিচ্ছ আমার ছেলেটার মন দ্বিতীয়বারের মতো ভেঙে দিয়েছো। এটা কি ঠিক কাজ করেছো বলে মনেহয় তোমার? আর এতোকিছু করার পর তোমার কি মনেহয় এবার আমি চুপচাপ তোমার এসব কীর্তি মেনে নেবো?”
শিখা একটু নড়েচড়ে বসলো। আফজাল বউয়ের দিকে বিরক্তিভরে তাকালো। ভাইজান রেগে গেছে মানে এবার আসলেই খবর আছে শিখার। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভাবলো এই বয়সে এসে পৈতৃক নিবাস থেকে বিতাড়িত হওয়াটা মোটেও সুখকর হবে না। আশরাফ আবার মুখ খুললো-
“তুমি তোমার হিংসা তোমার সন্তানের মধ্যে সংক্রামিত করেছো। নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা ভেঙে নিজের মতো কিছু করার বুদ্ধি সৌরভকে তুমি দিয়েছো জানি। কিন্তু আমার কষ্ট লাগলো সৌরভের ব্যবহারে। ওকে আমি বিবেচক ভাবতাম কিন্তু ও তোমার সাথে ভেসে গেলো।”
সৌরভ অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের মুখ লুকালো।
কথাগুলো বলে আশরাফ খানিকক্ষণ থামলো। আলগোছে চোখে আসা জল মুছলো। তারপর ঠান্ডা গলায় বললো-
“আফজাল, শিখাকে নিয়ে তোরা নাসিরাবাদের বাড়িতে শিফট হয়ে যা। একসাথে থাকার জন্য যখন এতোকিছু তখন আর একসাথে না থাকাই ভালো। বাবার ইচ্ছে পূরণে আমি ব্যর্থ এটা মেনে নেবো আমি। আমি চেয়েছিলাম দু’ভাই একসাথে থাকবো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কিন্তু তা আর হলোনা। আমি মেনে…”
“বাবা!”
আশরাফ চমকে পিছু ফিরে খুশিতে চিৎকার করলো-
“রাজ! বাবা, তুই ফিরে এসেছিস?”
রুহি চিৎকার করে দৌড়ে এসে রাযীনের কাছ থেকে নিজের ছেলেকে কেড়ে নিলো। ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের গোটা শরীরে চুমু দিতে লাগলো। বুকে জড়িয়ে ধরে দৌড়ে দোতলায় নিজের কামরায় চলে গেলো। রাযীনের সাথে একটা কথাও বললো না এমনকি একবারও ফিরে তাকালো না। জানার আগ্রহও দেখালো না যে রাযীন কেন বাড়ি ছেড়ে গেলো। রাযীন চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটা দেখলেও একটা আওয়াজও করলোনা। রুহি চলে যেতেই আশরাফ ছেলের হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন-
“রাজ, তুই যদি আজ সত্যিই চলে যেতিস তবে আমার মৃত্যু ছাড়া গতি ছিলোনা। একটা মেয়েকে কয়বার কষ্ট দেওয়া যায় তুইই বল? আর যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে তাতে রুহির কোন দোষ নেই বাবা। তুই অনেক বড় পাপ থেকে বেঁচে গেলি আব্বু সেই সাথে আমাকেও বাঁচিয়ে দিলি।”
রাযীন শক্ত গলায় জবাব দিলো-
“অল থ্যাংস টু ঝিলিক। ও আমাকে বোঝালো এভাবে পালিয়ে গেলে আমি কি কি হারাবো। তা না হলে এতোক্ষণ আমি হয়তো আকাশে থাকতাম।”
আশরাফ ঝিলিকের দিকে তাকালো-
“মারে, তুই আমাকে ঋণী করে ফেললি। আমি আজন্ম তোর এই ঋনের বোঝা নিয়ে থাকতে চাই তোর কোন সমস্যা নেই তো?”
ঝিলিক আশরাফের পানে চেয়ে আস্বস্ত হাসি হাসলো। সৌরভের মেজাজ ততোক্ষণে খারাপ হয়ে গেলো। ঝিলিকের পরোপকারীতা দেখে সে যারপরনাই বিরক্ত। মেজাজ নাকের ডগায় এসে বসে রইলো। মনেমনে বললো, রুমে যেয়ে নেই খালি তারপর তোর খবর নিচ্ছি। পুরনো প্রেমিকের প্রতি টান এখনো কমেনি দেখছি? ঝিলিক যেন সৌরভের মনের খবর বেশ ভালো ভাবেই টের পেলো। সে সৌরভের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো একটু। সৌরভ সে হাসির মানে না বুঝে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো ঝিলিকের দিকে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

(রোজা রেখে আর বড় করতে পারলাম না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here