নীল চিরকুট লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ৫০.

0
1239

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৫০.

‘ সমস্যাটা কি?’

অন্তুর প্রশ্নে মাথা নিচু করল নীরা। বাঁধ ভাঙা কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠে বলল,

‘ মাকে মনে পড়ছে।’

নীরার উত্তরে হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল অন্তু। এতো বড় মেয়ে মায়ের জন্য কাঁদছে? আশ্চর্য! নীরাকে কখনোই মা নেউটা বলে মনে হয়নি অন্তুর। সব সময় হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করেছে সে। মাসের পর মাস বাড়িমুখো হতেও দেখা যায়নি তাকে। অন্তু শান্ত দৃষ্টিতে নীরার কান্না দেখল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎই প্রশ্ন করল,

‘ কেউ কিছু বলেছে?’

নীরা চোখ তুলে তাকাল। ভেজা চোখদুটোতে একঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে বলল,

‘ হু?’

অন্তু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। বইটা বন্ধ করে নীরার দিকে ফিরে বসল। নরম কন্ঠে বলল,

‘ আব্বা-আম্মা কিছু বলেছে? বকাঝকা করেছে?’

অন্তুর প্রশ্রয় মাখা কন্ঠে কান্নার বেগ যেন বেড়ে গেল নীরার। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকিয়ে মাথা নুইয়ে অসম্মতি জানাল। ছোট্ট করে বলল,

‘ না।’

‘ তাহলে হঠাৎ কান্নাকাটি কেন?’

নীরা জবাব দিল না। অন্তু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ এতো রাতে রূপগঞ্জ যাওয়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে সম্ভবপর কাজ হলো ঘুমিয়ে পড়া। আলো জ্বালিয়ে ঘুমের অসুবিধা করব না। আমি বাইরে যাচ্ছি।’

কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়াতেই ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল নীরা,

‘ বাইরে কোথায়?’

অন্তু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। অন্তুকে কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকতে দেখেই থতমত খেয়ে গেল নীরা। ডানহাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে মাথা নোয়াল। ভারি অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ আমার একা থাকতে ভয় লাগছে।’

অন্তু জবাব দিল না। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ চেয়ে থেকে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বিছানায় এসে বসল। শার্ট পাল্টে টি-শার্ট পরল। টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে গলা ভেজাল। তারপর বিছানা ছেড়ে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা খানিক ভেজিয়ে দিয়ে সিগারেট ধরাল। নীরা বেশ কিছুক্ষণ ভেজানো দরজার দিকে চেয়ে থেকে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ল খাটে। অন্তুর মতো একহাত কপালে রেখে অন্যহাতে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে চোখ বন্ধ করল। সাথে সাথেই চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। এই প্রেমপিপাসু, জন্ম দুঃখিনী রমণী জানতেই পারল না গভীর রাতে জানালার ওপাশ থেকে এক জোড়া মুগ্ধ চোখ ঘুরাফেরা করছিল তারই অঙ্গজুড়ে। শাড়ির ভাজে ভাজে থাকা প্রতিটি কার্ভের গভীরতা মাপতে মাপতেই ছাড়ছিল রাশি রাশি ধোঁয়ার বহর।

_

রাত একটা। শব্দহীন এয়ারকন্ডিশনে হিমশীতল ঘরের পরিবেশ। দেয়ালে টাঙানো বিশাল টেলিভেশনের স্ক্রিনে বন্ধুদের ছবি ভাসছে। একের পর এক অগোছালো ছবি। পাশের সাউন্ডবক্স থেকে বাজছে মাইক শিনোদার গাওয়া প্রিয় একটি গান। মেঝেতে মাথা রেখে বিছানার উপর পা তুলে দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে ছিল ছোঁয়া। মাথার পাশেই ধোঁয়া উঠা গরম কফির কাপ। চারপাশে ম্যাগাজিন আর বইয়ের ছড়াছড়ি। ঘরের আলো নেভানো। টেলিভেশনের মৃদু আলো এসে পড়ছে ছোঁয়ার মোমের মতো সাদা গায়ে। ছোঁয়া পা নাচাতে নাচাতে গানের সাথে ঠোঁট মেলানোর চেষ্টা চালাল,

‘ Looking for, trying to open doors.
Ringing bells, sending them to hell.
Or sitting by my side, expecting no surprise.
When it’s about love, nothing will work….’

ছোঁয়া হঠাৎ উঠে বসল। রিমোটের বোতাম টিপে গান বন্ধ করল। জীবনে প্রথমবারের মতো প্রিয় গানটাকে বিরক্তিকর, অর্থহীন বলে বোধ হলো তার। কি ভেবে, ইংরেজি গান পাল্টে বাংলা গান চালাল। নিস্তব্ধ রাতে এই প্রথমবারের মতো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ শুনে মুগ্ধ হল ছোঁয়া। গানের কথাগুলো আনমনেই গুনগুন করতে লাগল মনে,

‘ চঞ্চল মন আনমনা হয় যে তার ছোয়া লাগে
ভোরের আকাশে আলো দেখে পাখি যেন………. ‘

ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জানালার ভারী পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকাল। আচ্ছা? অস্ট্রেলিয়ার আকাশেও কি এমনই তারা হয়? তার দেশের মতোই এতোটা আপন আর নিজস্ব লাগে সব? উত্তরহীন মন নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে ছোঁয়া। পর্দাটা আবারও টেনে দিয়ে চোখ ফিরিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় তাকায়। মাম্মার কথামতো, আজ ছোঁয়ার মনটা দূর্দান্ত ভালো থাকার কথা। কিন্তু ছোঁয়ার মনটা ভালো থাকছে না। মন ভালো থাকার মতো আহামরি কিছু খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ান মিষ্টার পার্ফেক্টের সাথে ঘন্টাময় কথা বলেও আলাদা কোনো অনুভূতি তার হয়নি। লোকটির সুন্দর মুখশ্রী, ভদ্র ব্যবহার, পার্ফেক্ট সেন্স অব হিউমার তাকে মুগ্ধ করেনি। এই লোকটিকে সে বিয়ে করতে চলেছে বলে আলাদা উত্তেজনাও তার হয়নি। সবকিছু খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে। যতটা স্বাভাবিক নতুন কোনো ড্রেস পেলে হয় ঠিক ততটা স্বাভাবিক। বিশেষ কিছু নয়। ছোঁয়া টেলিভিশন বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে সাইম নামক ছেলেটিকে ভাবতে চেষ্টা করল। চেষ্টা সফল হলো না। সাইমের জায়গায় রিসেন্টলি পড়া বইটির ছবি ভেসে উঠল চোখে। ছোঁয়া আবারও চেষ্টা করল এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, সাইমের চেহারাটা তার মনে পড়ছে না। কি আশ্চর্য! যার সাথে আজ বাদে কাল বিয়ে তার চেহারাটাই ভুলে গেল ছোঁয়া? বিরক্তিতে চোখ মেলে তাকাল ছোঁয়া। মাম্মা বলেছিল, সাইমকে নিয়ে ভাবলেই সফ্ট কর্ণার তৈরি হবে। সাইম দারুণ একটি ছেলে। ছোঁয়ার উচিত এই দারুণ ছেলেটির প্রেমে পড়ে যাওয়া। বিয়ের আগেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং স্ট্রং করা। কিন্তু এমন কিছুই তো হচ্ছে না। ছোঁয়া চেষ্টা করেও প্রেমে পড়তে পারছে না। প্রেমে পড়ার মতো কঠিন কাজটা নমু আর নীরু কি করে করে ফেলল সেটাও বুঝতে পারছে না। ছোঁয়ার কি কিছু টিপস নেওয়া উচিত?

#চলবে….

[ অনেক বেশিই ছোট হয়েছে। দুঃখিত। কেন জানি লেখা এগুলোই না। তারওপর বাসায় কাজিনরা এসেছে। আড্ডা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। প্রতিদিন দেব কথা দিয়েছিলাম তাই না দিয়ে থাকতে পারলাম না। কাল বড় করে দেব। সত্যি!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here