#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____২৩
ভোরবেলা প্রহরের ঘুম ভাঙলো একটু দেরিতে। সূর্য ততক্ষণে উঠে পড়েছে। জানালার সরু ছিদ্র দিয়ে আলোর ঝলকানি ঢুকছে৷ ঘুমকাতুরে চোখ দুটো ডলে উঠে পড়লো সে। অনুভব বিছানায় নেই।
মিনিট দুই সময় নিয়ে সে সম্পূর্ণ বাড়ি খুঁজলো। ওয়াশরুম, রান্নাঘর কিছুই বাদ রাখলো না। অনুভব কোথাও নেই! অথচ শেষরাতে সে দেখেছে অনুভব তার পাশে বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাদের মতো মাঝে মধ্যে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিচ্ছে। এত নিশ্চিন্তের ঘুম সে ছেলেটিকে কোনোদিন ঘুমাতে দেখেনি। তাহলে সকাল সকাল বেলা কোথায় গেল?
ফ্রেশ হয়ে নাস্তা তৈরি করলো প্রহর। মনটা ফুরফুরে তার। অনুভবের আকস্মিক এত কাছে আসাতে যদিও ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রচন্ড খুশি সে। অবশেষে অনুভব তার হাতে ধরা দিল। অনুভূতির কাছে হার মেনে নিল। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? খুশির কি হতে পারে?
ঝটপট নাস্তা শেষ করে ভার্সিটির জন্য ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিল সে। প্রফুল্ল মনে বের হলো। গলিতে হাঁটতে হাঁটতে অনুভবের নাম্বারে ফোন দিল। ফোন বন্ধ! কাল রাতের বৃষ্টিতে ফোনটা কি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে? কি মুসিবত! প্রহর তবুও মেসেজ দিয়ে রাখলো।
‘রান্নাঘরে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখেছি। খেয়ে নিবেন বরসাহেব।’
সে জানে অনুভব কাল রাতের ঘটনার পর এমন অদৃশ্য হয়ে যাবে। খুব সহজে তার সামনে আসবে না। তার মুখোমুখি হবে না! অনুভবের নিত্যকার কোল্ড বিহেভ থেকে বের হয়ে হুট করে এত উষ্ণ ব্যবহারে প্রহর বেশ অবাক হয়েছিল। অবাক হবে না-ই বা কেন? অনুভব যেখানে ঠিকমতো তার দিকে তাকায় না! সেখানে? প্রহরের মনটা খুশিতে নেচে উঠলো।
পরিচিত জায়গাটাতে কুকুরটাকে খুঁজলো সে। আজ নেই! রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা তাকাতে অবশেষে চোখে পড়লো। গলির মাথায় জমিয়ে রাখা উচ্ছিষ্টে মুখ দিয়েছে। খাবার খুঁজে চলেছে অবিরাম। প্রহর এগিয়ে গিয়ে মুখ দিয়ে পরিচিত শব্দ করলো। কুকুরটা মুখ তুলে তাকালো। বাম হাতের খাবার টুকু পাশে নামিয়ে রাখলো প্রহর। অতঃপর হাত নেড়ে এগিয়ে চলল।
আজ রিকশা নিল না। হেঁটে রওনা দিল। ভেতর জুড়ে একরাশ ভালোলাগা। নতুন প্রেমে পড়ার মতো অনুভূতি। সব ভালো লাগছে তার৷ যা দেখছে তাই অনন্য মনে হচ্ছে। এলোমেলো গতিতে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে সে। হঠাৎ ধুলো উড়িয়ে একটা মাইক্রোবাস তার খুব কাছ ঘেঁষে গেল। অন্য সময় হলে প্রহর ভীষণ বিরক্ত হতো। কিন্তু আজ হলো না৷ ঠোঁটের হাসি আরো বিস্তৃত হলো।
আজকের আবহাওয়া সুন্দর। রোদ ঝলমলে দিনটা যেন এক টুকরো প্রশান্তি। প্রহরের অদ্ভুদ ইচ্ছে জাগলো। আশপাশে ছুটে চলা এই অপরিচিত মানুষদের নিজের ভালোলাগার কথা জানাতে মন চাইল। অন্তত আমেরিকানদের মতো বলতে ইচ্ছে হলো,
‘আজকের আবহাওয়া সুন্দর না? ভীষণ সুন্দর!’
______
একে একে দুদিন কেটে গেল। এ দুদিনে অনুভব বাড়ি ফিরলো না। প্রহরের এবার চিন্তা হতে লাগলো। ফোন বন্ধ। অনুভবের এত ছেলেমানুষী ব্যবহারে অবাক না হয়ে পারছে না সে। নিজে থেকে সব করে এখন নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেল। আশ্চর্য ছেলে।
ফোনটা অন্তত ঠিক করতে পারে৷ অন রাখতে পারে। দু একটা মেসেজ পাঠাতে পারে! ঠোঁট কামড়ে সে আবার ফোন দিল। লাফিয়ে উঠলো হঠাৎ। কল ঢুকেছে। রিং হচ্ছে। আজ দুপুর পর্যন্তও ফোন বন্ধ ছিল। প্রহরকে অবাক করে দিয়ে কল রিসিভড হলো। ওপাশে নিশ্চুপ দেখে প্রহর হড়বড় করে বললো,
‘অনুভব আপনি কোথায়? ঠিক আছেন? বাড়ি আসছেন না কেন? ফোন ঠিক করেছেন? কখন আসবেন?’
প্রহরের একগাদা প্রশ্নের ঝড়ের বদৌলতে অনুভব কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ রইলো৷ পরমুহূর্তে স্থির এক স্বর ভেসে এলো।
‘আমি ঠিক আছি। একটা কাজে আটকে গেছি। কিছুদিন বাড়ি আসবো না!’
নিঃশব্দে কল কেটে গেল। প্রহর তবুও উত্তেজিত হয়ে বললো,
‘হ্যালো, হ্যালো! অনুভব। ফোন কাটবেন না কিন্তু।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে পড়লো প্রহর। বুঝতে অসুবিধা হলো না অনুভব কেন বাড়ি আসছে না। তার মুখোমুখি হতে চায় না। সে যতদিন এখানে থাকবে অনুভব যথাসম্ভব চেষ্টা করবে বাড়ি না ফেরার। বেশ! তবে তাই হোক! প্রহর মাকে ফোন দিল। মাকে কিছু বুঝতে দিল না। উৎফুল্ল স্বরে বললো,
‘মা, গাড়ি পাঠিয়ে দাও তো। আমি আসছি। বাবা কোথায়? অফিস থেকে ফিরেছে?’
_______
‘অনুভব। রেস্টুরেন্টে লোক কেমন? কাস্টমার আসছে?’
‘গতকাল তুলনামূলক ভাবে একটু কম ছিল স্যার। তবে আজ অনেক বেশি। আমরা সবাই ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছি।’
‘বেশ, যেতে পারো তুমি।’
‘ঠিক আছে।’
সালাম দিয়ে বের হলো অনুভব। ফার্মগেটের এই রেস্টুরেন্টে কাজ করছে সে অনেকদিন হলো। আগে অর্ধেক বেলা করতো। কিন্তু গ্রাম থেকে ফেরার পর ফুল টাইম শুরু করেছে। তার কাজ হলো ক্যাশ কাউন্টারে বসা। অধিক পরিশ্রমের কোনো কাজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু মনের সাথে শরীর পেরে উঠলো না। শেষমেশ রেস্টুরেন্টকে বেছে নিয়েছে। মাথার ক্যাপটা খুলে চুলে হাত বুলিয়ে নিল সে। গোছগাছ করে আবার ক্যাপ পড়ে নিল। গায়ে মেরুন রঙের টিশার্ট অনুভবের। টিশার্টের উপরে রেস্টুরেন্টের লোগো। সে কাউন্টারে বসে পড়লো।
সন্ধ্যা হবে হবে। এখনো লোকজনের ভিড়। দক্ষিণ দিক ঘেঁষে একজোড়া কাপল বসে আছে। দীর্ঘক্ষণ হলো তারা গল্পে মশগুল। টেবিলের কফির কাপ অব্যবহৃত রয়ে গেছে এখনো। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুভবের প্রহরের কথা মনে পড়লো। পকেট থেকে ফোন বের করলো। কল করবে কি করবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এমন একটা কাজ করে ফেলেছে সে। নিজের ভেতর অস্বস্তি হচ্ছে। প্রহরের মুখোমুখি হতে পারছে না। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ওই মুহূর্তে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। দেহের উপর মস্তিষ্কের হস্তক্ষেপ ছিল না। মন মস্তিষ্কের কথা শুনছিল না। নিজের মাথায় নিজে চাটি মারলো সে। এতটা পাগল সে কি করে হলো? প্রথম বারের মতো সে বুঝতে পেরেছে, কিছু জিনিসের উপর কখনো কর্তৃত্ব ফলানো যায় না। মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। নিজের বশে রাখা যায় না। ভালোবাসা, অনুভূতি তেমনই একটা জিনিস।
তার চিন্তার মাঝে হাতের ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। প্রহর মেসেজ পাঠিয়েছে।
‘আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার জন্য আপনি বাড়ি ফিরছেন না। লজ্জা পাচ্ছেন, তাই তো? ঠিক আছে। আমি কিছুদিনের জন্য বাবার বাসায় যাচ্ছি। মাকে গাড়ি পাঠাতে বলেছি। একটুপর রওনা করবো। আজ রাতে বাড়ি আসবেন কিন্তু।’
কিছুক্ষণের জন্য অনুভবের মনটা চঞ্চল হয়ে উঠলো।
‘এক্সকিউজ মি! ভাইয়া বিল পে করবো।’
অনুভব বাস্তবে ফিরলো। দ্রুত মাথা নেড়ে ফোনটা পকেটে রাখলো। বিল পে শেষ হতে সে উঠে দাঁড়ালো। সাথের এক সহকর্মীকে ডেকে বললো,
‘আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো।’
_____
গলির সামনে আসতে উল্টো পথে কালো রঙের গাড়িটা যেতে দেখলো। পেছনের অংশ দেখে অনুভবের বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা প্রহরের বাবার গাড়ি। তার মানে প্রহর মাত্র রওনা দিল। ফোঁস করে শ্বাস ফেলল সে। নিশ্চিন্ত হলো কিছুটা। অস্থির মনটা একটু স্থবির হলো৷ সে এতদ্রুত প্রহরের সামনে যেতে চায় না। সময় দিচ্ছে প্রহরকে, নিজেকে। সেদিনের অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির রাতের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দু’জনেরই ভুলে যাওয়া সমীচীন।
হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে কিছুটা রিলাক্সে আনলো সে। আজ অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। ছোটাছুটি করতে হয়েছে অনেক৷ ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো অনুভব। দরজায় তালা ঝুলছে। বাম পকেট হাতড়ে চাবি খুঁজলো। পকেট খালি! কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভয় পেয়ে গেল। চাবিটা কি হারিয়ে গেল? দ্রুত শার্টের পকেট হাতড়ালো৷ প্যান্টের পকেট হাতড়ালো।
অবশেষে চাবি মিলল। মানিব্যাগের এক কোণে! চেহারায় প্রশান্তি মিলল৷ তালাটার দুটো চাবি৷ একটা তার কাছে থাকে৷ আরেকটা প্রহরের কাছে৷ এই অসময়ে চাবি হারিয়ে গেলে বড় বেকায়দায় পড়তে হতো। তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো সে।
ড্রয়িং রুমে বাল্ব জ্বলছে। প্রহর বাল্ব জ্বালিয়েই চলে গেছে। অনুভব বিড়বিড় করে বললো,
‘ভয়ংকর অসচেতন!’
তার রুমের দরজা ভেড়ানো ছিল। রুম অন্ধকার। দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে সুইচে চাপ দিল। তৎক্ষনাৎ রুম সাদা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো৷ ক্লান্ত দেহটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চোখ বড়োসড়ো হয়ে গেল অনুভবের। প্রহর বিছানায় হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। অনুভব দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। হ্যালুনসিনেশন? ড্রয়িং রুমের দিকে এক পলক চেয়ে ফের বিছানার দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে গেল তার। প্রহর এবার নড়ে উঠলো। মৃদু হেসে বলে উঠলো,
‘বরসাহেব! অবশেষে ফিরলেন তাহলে?’
(চলবে)